যুগবাণী[১]

‘যুগবাণী’ ১৯২২ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মুতাবিক ১৩২৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৯২০ খৃষ্টাব্দে কাজী নজরুল ইসলাম সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’-এ যে সকল সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লেখেন, তারই কতকগুলো এই সঙ্কলনে গ্রন্থবদ্ধ হয়। তৎকালীন বঙ্গীয় সরকার গ্রন্থখানি বাজেয়াপ্ত করেন। ‘যুগবাণী’ দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয় ১৩৫৬ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসে এবং তৃতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয় ১৩৬৪ বঙ্গাব্দে।

‘যুগবাণী’ প্রকাশ করেন লেখক স্বয়ং, ৭ প্রতাপ চাটুজ্যে লেন, কলিকাতা থেকে। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৯২, মূল্য এক টাকা। প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই (২৩ নবেম্বর, ১৯২২) বইটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয় ১৯৭৭ সালে। ১৩৫৬ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। প্রকাশক মঈনউদ্‌দীন হোসয়ন, বি. এ., নূর লাইব্রেরি, ১২/১ সারেঙ্গ লেন, কলিকাতা। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮ + ১২২; মূল্য আড়াই টাকা। বাংলা একাডেমি ‘নজরুল রচনাবলী’তে যুগবাণীর দ্বিতীয় সংস্করণের পাঠ অনুসৃত হয়েছে।

‘যুগবাণী’র শেষ প্রবন্ধ ‘জাগরণী’ ১৩২৭ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যা ‘বকুল’-এ ‘উদ্বোধন’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল।

এক[২]

১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে কাজী নজরুল ইসলামের ভুবন কাঁপানো ও অভূতপূর্ব কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হয়। ঠিক একই বছরের একই মাসে কয়েক দিনের ব্যবধানে ‘যুগবাণী’ নামে তাঁর আরো একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল।

রচনা ও প্রকাশের সময়কাল বিবেচনায় এটিই নজরুল ইসলামের প্রথম গ্রন্থ। সে হিসেবে নজরুলের কবিজীবন স্থায়ীভাবে শুরু হওয়ার আগে সাংবাদিক ও কলাম লেখক হিসেবে তার আবির্ভাব ঘটেছিল। গ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে নজরুল রাজরোষে পতিত হন। প্রকাশের মাত্র কয়েক দিনের মাথায় বেঙ্গল গভর্নমেন্ট গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করে। এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকে নজরুল নির্বাক হয়ে যাওয়ার অনেক বছর পর- ব্রিটিশ শাসনের শেষপাদ পর্যন্ত। এ গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ভারত বিভাগের পর। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখবার জন্য কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী আখ্যা পেয়েছেন এটি যেমন সত্য, তেমনি এ গ্রন্থ প্রকাশের আগেই গ্রন্থের বিষয় তাকে রাজদ্রোহী করে তোলে। নজরুল জীবনে কবিতা নয় গদ্যগ্রন্থই প্রথম বাজেয়াপ্তের তালিকায় জায়গা করে নেয়। আর সেই থেকে দখলদার শাসকের পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী আজীবন তাঁর পিছ ছাড়েনি। এ গ্রন্থে এমন কী ছিল যার জন্য ঔপনিবেশিক সরকার বাজেয়াপ্ত করতে বাধ্য হয়েছিল?

নজরুল ১৯২০ সালের মে মাসে প্রকাশিত ফজলুল হকের সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’-এ সম্পাদনার কাজে যোগ দেন এবং মাত্র সাত মাস কাজ করার পর ছেড়ে দেন। এই সাত মাসের মধ্যে লিখিত সম্পাদকীয় রচনার বাছাইকৃত নিবন্ধ নিয়ে ‘যুগবাণী’ সঙ্কলনটি প্রকাশিত হয়। তবে ‘যুগবাণী’র শেষ প্রবন্ধ ‘জাগরণী’ নবযুগে প্রকাশিত হয়নি। এটি হয়েছিল ‘বকুল’-এ উদ্বোধন শিরোনামে। নজরুল নবযুগে যোগ দেন ১৯২০ সালের ১২ জুলাই। মুজফফর আহমদের সঙ্গে তিনি এ কাগজের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতেন। পত্রিকাটি ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির মুখপত্র হলেও নজরুল তাঁর রচনার ক্ষেত্রে স্বাধীন ও নিজস্ব বক্তব্যের প্রতিই অনুরক্ত ছিলেন। নজরুলের রচনার জন্য কাগজটি শিগ্গির সরকারের কোপানলে পড়ে। বারংবার সতর্ক করে দেয়া ছাড়াও নজরুলের লেখার জন্য পত্রিকাটির জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। মুজফফর আহমদের ভাষায়— ‘‘নবযুগের গরম লেখার জন্য পর পর দু’বার কি তিনবার সরকার আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিল। শেষ সতর্ক করেছিল ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধের জন্য। প্রবন্ধটি নজরুল ইসলামের লেখা।’’ খিলাফত কমিটির একটি ইশতেহার ছাপাকে কেন্দ্র করে যদিও পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় তবু মুজফফর আহমদ মনে করেন, ‘নজরুলের মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে লেখাটিই ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের পক্ষে অসহ্য বোধ হয়েছিল।’

‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে’ শীর্ষক রচনার কিছুটা নমুনা দেওয়া যাক :

‘আর আমরা দাঁড়াইয়া মার খাইব না, আঘাত খাইয়া খাইয়া, অপমানে বেদনায় রক্ত এইবার গরম হইয়া উঠিয়াছে। কেন, তোমাদের আত্মসম্মান জ্ঞান আছে আমাদের নাই? আমরা কি মানুষ নই? তোমাদের একজনকে মারিলে আমাদের এক হাজার লোককে খুন করো, আর আমাদের হাজার লোককে পাঁঠা-কাটা করিয়া কাটিলেও আমরা কিছু বলিতে পাইব না? মনুষ্যত্বের বিবেকের আত্মসম্মানের স্বাধীনতার ওপর এত জুলুম কেহ কখনো সহ্য করিতে পারে না।’

নজরুলের ‘যুগবাণী’ গ্রন্থটির একটি বিশেষ ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। বিশেষ করে ব্রিটিশবিরোধী নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলেনের একটি ধারাবাহিকতার সূত্রপাত এ গ্রন্থে লক্ষ্য করা যায়। আমরা জানি, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দাবি করার আগে নজরুল তাঁর বিভিন্ন সম্পাদকীয় নিবন্ধে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দাবি করেন। আর নজরুলের এ ধরনের দাবি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কারণ নজরুল শুরু থেকেই প্রবল রাজনীতি সচেতন কবি এবং রাজনৈতিক সংগঠক ও তৎকালীন শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তিনি একই মঞ্চে কাজ করেছেন।

১৯২১ সালে আহমেদাবাদে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সম্মেলনে ভারতের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করা হয়। আর এই দাবিও উত্থাপন করেন এক উর্দু কবি, নাম হসরৎ মোহানী। কিন্তু গান্ধীজীর বিরোধিতায় দাবিটি পরিত্যক্ত হয়। পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা চাওয়ার জন্য কবি হসরৎ মোহানীকেও ব্রিটিশ কারাগারে অন্তরীণ থাকতে হয়। দেখা যাচ্ছে, ভারত স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা কবিরা। তারাই এই দাবিটি প্রথম মুক্তিকামী মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। নজরুল ১৯২২ সালে ধূমকেতুর ১৩শ’ সংখ্যায় লেখেন— ‘স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেননা, ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশ বিদেশীদের অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার সম্পূর্ণ থাকবে ভারতের হাতে। তাতে কোনো বিদেশী মোড়লীর অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে এ দেশকে শ্মশান ভূমিতে পরিণত করেছেন, তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোচকা পুঁটলি বেঁধে সাগর পাড়ে পাড়ি দিতে হবে।’

‘যুগবাণী’র প্রতিটি রচনাই ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। এ গ্রন্থে প্রবন্ধের সংখ্যা ছিল ২১ টি। সূচিপত্রের দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক : নবযুগ, গেছে দেশ দুঃখ নাই আবার তোরা মানুষ হ, ডায়ারের স্মৃতিস্তম্ভ, ধর্মঘট, লোকমান্য তিলকের মৃত্যুতে বেদনাতুর কলিকাতার দৃশ্য, মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে?, ছুঁৎমার্গ, উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন, মুখবন্ধ, রোজ-কেয়ামত বা প্রলয়-দিন, বাঙালির ব্যবসাদারী, আমাদের শক্তি স্থায়ী হয় না কেন, কালা আদমীকে গুলি মারা, শ্যাম রাখি না কুল রাখি, লাট-প্রেমিক আলী ইমাম, ভাব ও কাজ, জাতীয় শিক্ষা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, জাগরণী।

নজরুলের এই রচনাগুলো তথ্য ও শিল্পগত মূল্য বিচারের ক্ষেত্রে একটি বিষয় বিবেচনায় রাখা যায়। তাহলো, স্বাধীনতা ও সত্যের পক্ষে তার অকুতোভয় অবস্থান। নজরুল ১৯২২ সালে যখন এই রচনাগুলো সম্পাদন করছেন তখন পর্যন্ত ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দর ব্রিটিশ শাসন সম্বন্ধে দ্বিধা কাটেনি। অনেকেই ইংরেজ শাসনকে আশীর্বাদ হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। যদিও নজরুলের আগেই কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে দেশ-প্রেমমূলক কিছু রচনার নমুনা দেখা যাচ্ছিল; কিন্তু তা ছিল খণ্ডিত, যত না ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তারচেয়ে বেশি অতীতের মুসলিম বিজয়ের বিরুদ্ধে। হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় স্বাধীনতাহীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও দ্বিধা কাটাতে পারেননি। এমনকি ইংরেজ শাসনের অপকারিতা সম্বন্ধেও লেখকদের সুষ্ঠু ধারণা ছিল না। অনেকেই মনে করতেন ব্রিটিশ শাসন তাদের জন্য একটি আশীর্বাদ বয়ে এনেছে। আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার সংস্পর্শে এসে এমনকি বঙ্কিমের মধ্যেও স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়েছিল; কিন্তু তিনি দেশের কল্পিত শত্রু হিসেবে হীনবল এবং অবাস্তব মুসলিম শাসনকে চিহ্নিত করে উপন্যাস রচনায় মনোনিবেশ করলেন।

নজরুল ইসলামই প্রথম এসব দ্বিধা অতিক্রম করে স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। আর তার সর্বপ্লাবী লেখনীর কারণে লেখকদের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও তাদের দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে শিগ্গির পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার জন্য সর্বব্যাপী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। তৎকালীন স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—এই আন্দোলন দীর্ঘ সময় ধরে একটি শ্রেণী স্বার্থের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে। ব্রিটিশ থাকা এবং ব্রিটিশ যাওয়ার মধ্যে লাভক্ষতির হিসেবটা একটু বেশি মাত্রায় কাজ করেছে। এসব দ্বিধা কাটিয়ে ওঠার পরিবেশ সৃষ্টিতে নজরুল প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছিলেন।

নজরুল ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের মতো ‘যুগবাণী’-তে তার বৈশিষ্ট্যের সমান স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন।

এ গ্রন্থে লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলকের মৃত্যুতেও শোকাবিহ্বল নজরুলের অসীম শ্রদ্ধার নিদর্শন দেখা যায়। তিলক ছিলেন প্রাচীনপন্থি হিন্দুনেতা। যিনি হিন্দু মেলা ও শিবাজী উৎসবের মতো হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রবর্তন করেন; কিন্তু তিলকের বড়গুণ তিনি ইংরেজ শাসনের অবসান চান, সেই সঙ্গে হিন্দুশক্তির উদ্বোধন। নজরুল ভারতমাতার স্বাধীনতাকামীদের বিভক্ত করে আত্মশক্তি ক্ষয় করতে চাননি।

জাতীয় শিক্ষা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এসব নিয়েও নজরুলের ভাবনা প্রায় শতবর্ষ পরেও অপ্রাসঙ্গিক নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকিউলাম, স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে নজরুল প্রশ্ন তুলেছেন। যে শিক্ষা ছাত্রদের দেহমন পুষ্ট করে না সে ধরনের শিক্ষা কীভাবে দেশের প্রয়োজনে কাজে আসতে পারে নজরুল প্রশ্ন তুলেছেন। নিয়োগের ব্যাপারে অনিয়ম ও পক্ষপাত নিয়ে নজরুল বলেছেন, ‘যে সব অধ্যাপক গোলামখানা ছাড়িয়া আমাদের বাহবা লইয়াছেন, তাহাদিগকেই যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক করিতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। কেননা তাহারা কখনো এই ত্যাগের বদলে আর একটা বড়রকম লাভের আশায় এ ত্যাগ দেখান নাই।’

নজরুলের কবিসত্তাকে আমরা যত বড় করে জানি, সাংবাদিক সত্তাকে ঠিক ততখানি মনে রাখি না। কিন্তু তার কবিতা যেমন এখনো আমাদের আনন্দদান ও উদ্বোধনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেনি তেমন তার সাংবাদিক কর্মও আমাদের কাছে অনুপ্রেরণার অনুষঙ্গ হতে পারে। বিশেষ করে সাংবাদিকদের কাছে দেশ ও তার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত নজরুলের এই গ্রন্থটি দিতে পারে।

দুই[৩]

“হিন্দু হিন্দু থাক, মুসলমান মুসলমান থাক, শুধু একবার এই মহাগগনতলের সীমা-হারা মুক্তির মাঝে দাঁড়াইয়া-মানব! তোমার কণ্ঠে সেই সৃষ্টির আদিম বাণী ফুটাও দেখি! বলো দেখি ‘আমরা মানুষ ধর্ম।’ দেখিবে, দশ দিকে সার্বভৌমিক সাড়ার আকুল স্পন্দন কাঁপিয়া উঠিতেছে।… মানবতার এই মহাযুগে একবার গণ্ডী কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বলো যে, তুমি ব্রাহ্মণ নও, শূদ্র নও, হিন্দু নও, মুসলমান নও, তুমি মানুষ—তুমি সত্য”

কিংবা

“…আমরা চাই, আমাদের শিক্ষা-পদ্ধতি এমন হউক, যাহা আমাদের জীবনশক্তিকে ক্রমেই সজাগ, জীবন্ত করিয়া তুলিবে। যে-শিক্ষা ছেলেদের দেহ-মন দুইকেই পুষ্ট করে, তাহাই হইবে আমাদের শিক্ষা। ‘মেদা-মারা’ ছেলের চেয়ে সে হিসাবে ‘ডানপিটে’ ছেলে বরং অনেক ভালো”

উপর্যুক্ত উদ্ধৃতি দুটি কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘ছুৎমার্গ’ ও ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ শিরোনামীয় নিবন্ধের অংশবিশেষ, যা কবির প্রকাশিত প্রথম গদ্যরচনার সংকলন ‘যুগবাণী’র অন্তর্ভুক্ত। জাতির আত্মসমালোচনা এবং শিক্ষা পদ্ধতির অন্ধকার দিক নিয়ে খোলাখুলি ও সহজ ভাষায় ব্যক্ত মতামত কি আজও অপ্রাসঙ্গিক? না। এখনকার মতো তখনো তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার একজন যুদ্ধফেরত বাইশ বছরের যুবকের বাস্তবিক ও প্রাসঙ্গিক সমালোচনা সহ্য করতে পারেনি। ১৯২২ সালে ‘যুগবাণী’ প্রকাশিত হওয়ার এক মাসের মধ্যেই (সাতাশ দিনের মাথায়) বাজেয়াপ্ত করা হয়।

শুধু তা-ই নয়, সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করার আগেই প্রেস, প্রকাশকের দপ্তর, বিক্রয়কেন্দ্র এবং বইয়ের দোকানগুলো থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ‘যুগবাণী’র সব কপি।

১৯২০ সালের ১২ জুলাই থেকে কবির সম্পাদিত সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় সম্পাদকীয় হিসেবে ছাপা হওয়া রচনাগুলো প্রকাশিত হওয়ার পরপরই দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে দৈনিক নবযুগের প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট নজরুলের সম্পাদনায় বের হতে থাকে অর্ধ সাপ্তাহিক ধূমকেতু।

আর্য পাবলিশিং হাউসের পরিচালক শরত্চন্দ্র গুহর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর প্রথম তিনিই কবিকে নবযুগ সান্ধ্য দৈনিকে প্রকাশিত সম্পাদকীয় ও অন্যান্য রচনাকে গ্রন্থাকারে প্রকাশের প্রস্তাব ও পরামর্শ দিয়েছিলেন। নজরুলও প্রস্তাবটি লুফে নিয়েছিলেন। নিবন্ধগুলো বাছাই করে, ঘষামাজা করে ২০টি রচনা শরত্চন্দ্র গুহকে ‘যুগবাণী’ নাম দিয়ে প্রকাশের জন্য দেন।

ছাপা হলো ‘যুগবাণী’। ১৯২২ সালের ২৭ অক্টোবর গ্রন্থাকারে মুখ দেখল।

নিষিদ্ধ হলো ২৩ নভেম্বর ১৯২২। প্রকাশের মাত্র সাতাশ দিনের মাথায়। শুধু তা-ই নয়, সরকারি ঘোষণা প্রকাশিত হওয়ার আগেই আর্য পাবলিশিংয়ে হানা দিয়ে পুলিশ ৩৫০টি ‘যুগবাণী’র কপি বাজেয়াপ্ত করে ফেলল। উল্লেখ্য, আর্য পাবলিশিং হাউস ‘যুগবাণী’র প্রকাশক ছিল না। পরিবেশক ছিল। ‘যুগবাণী’র প্রকাশক ছিলেন কবি নিজেই। এর আগে ১৭ অক্টোবর ১৯২২ ধূমকেতু পত্রিকায়ই প্রথম ‘যুগবাণী’ বইটি প্রকাশের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল। বিজ্ঞাপন প্রকাশের ১০ দিন পরই বের হয়ে যায় ‘যুগবাণী’।

ব্রিটিশ শাসন কণ্টকমুক্ত করতে ব্রিটিশ সরকার অনেক কিছুই করেছিল। উপমহাদেশের বিদ্যমান বেশি কালাকানুনের প্রণয়ন ও প্রয়োগ ব্রিটিশদের হাতেই। ভারতীয় ফৌজদারি বিধির ৯৯এ ধারা অনুযায়ী ‘যুগবাণী’ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হওয়ার পর নানা আইনগত কারণে ব্রিটিশ সরকার সক্রিয় হতে পারেনি। ‘বিদ্রোহী’র জনপ্রিয়তা ও প্রচারের ব্যাপ্তি দেখে তা বাজেয়াপ্ত করতে সাহস করেনি তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার, হিতে বিপরীত হবে ভেবে। কিন্তু তারা কঠোর নজর রাখছিল কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে। লেখাগুলো নবযুগে প্রকাশিত হলেও যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় তখন ব্রিটিশ সরকার এর ভেতরের স্ফুলিঙ্গ টের পায়। তারা ধরে নিয়েছিল, বিচ্ছিন্নভাবে কাগজে ছাপা হলেও যখন বই আকারে পাঠকের কাছে পৌঁছায় তখন এর স্থায়িত্ব আর প্রভাব প্রবল হতে বাধ্য। ব্রিটিশ সরকার এই ঝুঁকি নিতে চায়নি।

যেদিন ‘যুগবাণী’ বাজেয়াপ্তের আদেশ হয়, অর্থাৎ ২৩ নভেম্বর কবি ছিলেন কুমিল্লায়। কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশের নির্দেশে কুমিল্লায় কবিকে গ্রেপ্তার করা হয়। মজার বিষয় হলো, সেদিন কবিকে ‘যুগবাণী’র জন্য গ্রেপ্তার করা হয়নি। তাঁর নিজের লেখা আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’র জন্য গ্রেপ্তার করা হয়। কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল তাঁরই সম্পাদিত অর্ধ সাপ্তাহিক ধূমকেতু পত্রিকায় ২৬ সেপ্টেম্বর। ধূমকেতু প্রকাশিত হতো প্রতি মঙ্গলবার ও শুক্রবার। ৮ নভেম্বর কবিকে গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যে কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশ ধূমকেতু অফিসে হানা দেয়। সম্পাদককে না পেয়ে মুদ্রক ও প্রকাশক আফজল উল্্ হককে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। সঙ্গে নিয়ে যায় পত্রিকার পুরনো সংখ্যা ও কাগজপত্র।

প্রথম প্রকাশের আঠারো বছর পর ‘যুগবাণী’ থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি উঠেছিল বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায়। খবর পেয়ে ‘যুগবাণী’র পুনঃপ্রকাশ ঠেকাতে আবারও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা উঠেপড়ে লেগেছিল। সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী ‘যুগবাণী’র ওপর থেকে বাজেয়াপ্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয় ১৯৪৫ সালে। কবি তখন এসবের ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন। জীবনটাই শুধু আছে। আর কিছু নেই। কথা নেই, লেখা নেই, প্রতিবাদ নেই, স্মৃতি নেই।

ব্রিটিশ সরকার চেয়েছিল যেকোনোভাবে কাজী নজরুল ইসলামকে সংযত করতে। শেষ পর্যন্ত করা যায়নি। কেউ তাঁকে সংযত করতে পারেনি। কারণ তিনি বিদ্রোহী যে!

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. বাঙলা একাডেমি প্রকাশিত ‘নজরুল রচনাবলী’, প্রথম খণ্ডে উল্লিখিত গ্রন্থপরিচয়ের আলোকে লিখিত।
  2. নজরুলের প্রথম বাজেয়াপ্ত বই ‘যুগবাণী’, লেখক মজিদ মাহমুদ; সাম্প্রতিক দেশকাল অনলাইন, ২৯ মে ২০২২।
  3. নজরুলের ‘যুগবাণী’ নিষিদ্ধের এক শ বছর, লেখক এমরান কবির; কালের কণ্ঠ অনলাইন, ২৪ নভেম্বর, ২০২২।