রাক্ষুসী

(বীরভূমের বাগদীদের ভাষায়)

[ ক ]

আজ এই পুরো দুটো বছর ধরে, ভাবছি, শুধু ভাবছি,—আর সবচেয়ে আশ্চয্যি হচ্ছি, লোকে আমাকে দেখলেই এমন করে ছুটে পালায় কেন! পুরুষেরা, যাঁরা সব পর্দার-আড়ালে গিয়ে মেয়ে-মহলে খুব জাঁদরেলি রকমের শোরগোল আর হল্লা করেন, আর যাঁদের সেই বিদঘুটে চেঁচানির চোটে ছেলেমেয়েরা ভয়ে ‘নফ্‌সি নফ্‌সি’ করে, সেই মদ্দরাই আবার আমায় দেখলে হুঁকো হাতে দাওয়া হতে আস্তে আস্তে সরে পড়েন, তখন নাকি তাঁদের অন্দর-মহলে যাওয়ার ভয়ানক ‘হাজত’। মেয়েরা আমাকে দেখলেই কাঁখ হতে দুম করে কলসি ফেলে সে কী লম্বা ছুট দেয়! ছেলেমেয়েরা তো নাকমুখ সিঁটকে ভয়ে একেবারে আঁতকে উঠে। হাজার গজ দূর থেকে বলে, ‘ওরে বাপরে, ঐ এল পাগলি রাক্ষুসী মাগি, পালা—পালা! খেলে, খেলে!’—কেনে! আমি কোন্ উনোনমুখো সুঁটকোর পাকা ধানে মই দিয়েছি? কোন্ খালভরা ড্যাকরার মুখে আগুন দিয়েছি? কোন্ চোখখাগী আবাগির বেটির বুকে বসে তপ্ত খোলা ভেঙেছি? কার গতর আমকাঠ না কুল-কাঠের আখায় চড়িয়েছি? কোন্ ছেলেমেয়ের কাঁচা মাথাটা চিবিয়ে খেয়েছি? বল তো বুন, তাদের কি ‘সরোকার’ আছে আমায় যা তা বলবার? কে তারা আমার?—মেরেছি?—বেশ করেছি, নিজের ‘সোয়ামিকে’ মেরেছি! … শুধু মেরেছি? দা দিয়ে কেটেছি! তাতে ওদের এত বুক চড় চড় করবে কেন? ওদের কারুর বুক থেকে তো সোয়ামিকে কেড়ে লি নাই, আর হত্যেও করি নাই, তাতে ওদের কথা বলবার আর সাওখুড়ি করবার কী আছে? ওরা কি আমার সাতপুরুষের কুটুম না গিয়াঁত? যদি এই রকমই করতে থাকে, তবে আমি সত্যিকারের রাক্ষুসীই হয়ে দাঁড়াব বলে রাখছি তখন। এক এক দায়ের কোপে ওদের সোয়ামির মাথাগুলো ধড় থেকে আলাদা করে দিব, মেয়েগুলোর বুক ফেঁড়ে কলজেগুলো ধরে পিষে পিষে দিব, তবে না সে আমার নাম সত্যসত্যিই রাক্ষুসী হয়ে দাঁড়াবে!

আমায় পাগল করলে কে? এই মানুষগুলোই তো—আমি তো ফের তেমনি করেই—যেন কিছু হয় নাই—ঘর পেতেছিলুম। রাত্তির দিন আমার কানের গোড়ায় আনাচে-কানাচে, পথে-ঘাটে, কাজেকর্মে, মজলিসে-জৌলুসে আমার নামে রাক্ষুসী রাক্ষুসী বলে কুৎসা, ঘেন্না, মুখ ব্যাঁকানি, চোখ রাঙানি,—এই সব মিলেই তো আমার মাথার মগজ বিগড়ে দিল? যে ব্যথাটাকে আমি আমার মনের মাঝেই চেপে রেখেচিলুম সেটাকে আবার জাগিয়ে তুলে চোখের সামনে সোজা করে ধরলে তো এরাই! আচ্ছা তুই-ই বল তো বুন, এ পাগল হওয়ার দোষটা কার? একটা ভাল মানুষকে খোঁচা মেরে মেরে ক্ষেপিয়ে তুললে সে দোষটা কি সেই ভালমানুষের, না যে ভালমানুষেরা তাকে খেপিয়ে তোলে, তাদের?—

আমার সোয়ামি ছিল সিদেসাধা মানুষ, সে তো সোজা ছাড়া বাঁকা কিছু জানত না। সে চাষ করত, কিরষাণি করত, আমি সারাটি দিন মাছ ধরে চাল কেঁড়ে, ধান ভেনে আনতুম। তা না হলে চলবে কী করে দিদি? তখন আমাদের তিনটি পুষ্যি,—বড়ো ছেলে সোমত্থ হয়ে উঠেছে, বে-থা না দিলে ‘উপর-নজর’ হবে, মেয়েটাও ঢ্যাং-ঢেঙিয়ে বেড়ে উঠেছিল, আর আমার ‘কোলাপুঁছা’ ছোটো মেয়েটিও তখন হাঁক্কো হাঁক্কো করে দু-একটি কথা ফুটছিল। ছা-পোষা মানুষ হলেও দিদি আমাদের সংসারে তো অভাব ছিল না কোনো কিছুর, তোমাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে। এই বিন্দিই তখন নাই নাই করে দিনের শেষে তিনটি সের চাল-তরকারির জন্যে মাছ রে, শামুক রে, গুগলি রে পিত্থিমির জিনিস জোগাড় করে আনত। তাছাড়া বড়ো ছেলেটাও তোমাদের শীচরণের আশীর্বাদে করে কর্মে দু-পয়সা ঘরে আনছিল। মেয়েটাও পাড়ার বউ-ঝিদের সঙ্গে যা দু-চারটে শাগ-মাছ আনত, তাতেও নেহাৎ কম পয়সা হত না। লুন-তেলের খরচটা ও দিয়েই বেশ দিব্যি চলে যেত। এ সবের উপর সোয়ামি বছরের শেষে চাষবাস আর কিরষাণি করে যা ধান-চাল আনত তাতে সারা বছর খুব ‘সচল বচল’ করে খেয়েও ফুরাত না। সংসারে তখন কি ছিরিই ছিল! লক্ষ্মী যেন মুখ তুলে চেয়েছিলেন। এত সব কার জন্যে—ঐ ছেলে-মেয়েগুলির জন্যেই তো? সারাদিন রেতে একটি সেরের বেশি চাল রাঁধতাম না। বলি আহা, শেষে আমার ছেলেরা কষ্ট পাবে! সোয়ামি আর ছেলেগুলোকে দিতুম ভাত, আর নিজে খেতুম মাড়—শুধু ভাতের ফেন! মেয়ে মানুষের আবার সুখ কী, ছেলেমেয়ে যদি ঠান্ডা রইল তাতেই আমাদের জান ঠান্ডা! নাইবা হলুম জমিদার। আমরা তো কারুর কাছে ভিক্ষে করতুম না, চুরি-দারিও করতুম না। নিজের মেহনতের পয়সা নেড়ে-চেড়ে খেতাম। নিজে খেতুম, আর পালে রে পার্বণে রে যেমন অবস্থা দু-দশটা অতিথ-ফকিরকেও খাওয়াতুম। আহা, ওতেই তো আমার বুক ভরে ছিল দিদি! লোকে বলত আমি নাকি বড্ডো ‘কিরপণ’; কারণ আমি একটি পয়সা বাজে খরচ করতুম না। তা বললে আর কী করব, তাতে আমার বয়ে যেত। তারা তো জানতো না, আমার মাথায় কী বোঝা চাপানো রয়েছে। দু দুটো মেয়ে আর একটি ছেলের বিয়ে দিতে হবে, বাড়িতে বউ আসবে, জামাই আসবে, আমার এই মাটির ঘরই আনন্দে ইন্দিরপুরি হয়ে উঠবে, দুটো সাদ-আরমান আছে—তাতে কত খরচ বল দিকিনি বুন? দায়ে ঠেকলে কেউ একটা পয়সা কর্জ দিয়ে চালাবে? বাপরে বাপ এই বিন্দির অজানা নেই গো, গলায় সাপ বেঁধে পড়লেও কোনো বেটি একটি ক্ষুদ্রকণা দিয়ে শুধোয় না। তার আবার গুমোর! আমার কাছে ও-সব শুধু কথায় চিঁড়ে ভিজে না বাপু! তবে বুঝতুম, অনেক কড়ুই রাঁড়ির বুক চচ্চড় করত হিংসেয় আমাদের এই এতটুকু সুখ দেখে।

এমনি করেই খুব সুখে দিন যাচ্ছিল আমাদের! আমি মনে করতুম, আর যটা দিন বাঁচি এমনি করে সোয়ামির সেবা করে, ছেলে-মেয়ে চরিয়ে, নাতিপুতি দেখে আমার হাতের নোওয়া অক্ষয় রেখে মরি ; কিন্তু তা আমার পোড়া বিধাতার সইল না। আমার সাধের ঘরকন্না শ্মশানপুরী হয়ে গেল! আর এত আশা-ভরসা সব-তাতে চুলোর ছাই-পাঁশ পড়ল! শুনে যা দিদি, শুনে যা সব, আর যদি দোষ দেখিস তো তোর ঐ মুড়ো খ্যাংরা দিয়ে আমার বিষ ঝেড়ে দিয়ে যাস, সাত উনুনের বাসি ছাই আমার পোড়া মুখে দিয়ে দিস! হায় বুন, আমার ‘দুখখুর’ কথা শুনলে পাথর গলে মোম হয়ে যায়, কিন্তু গাঁয়ের এই বে-দিল মানুষগুলো আমায় এতটুকু পেরবোধ তো দেয়ই না, তার উপর রাত্তির-দিন নানান কথা বলে জানটাকে খেপিয়ে তুলেছে! মনে করি আমার সব পেটের কথা কারুর কাছে তন্ন তন্ন করে বলি আর খুব আর খুব একচোট কেঁদে নিয়ে মনটাকে হালকা করি। তা যারই কাছ ঘেঁসতে চাই, সেই মনে করে এই আমায় খেলে রে। আমি যেন ডাইনি কুহকীরও অধম! এই ‘হেনস্থা’ আর ভয় করার দরুনে আমার সমস্ত মগজটা চমচম করে ধরে যায়। কাজেই আমার পাগলামি তখন আরও বেড়ে যায়। সাধে কি আমার মুখ দিয়ে এত গালিগালাজ শাপমন্যি বেরোয়, বুন! তুই সব কথা শুন আর নাথি মেরে আমার থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিয়ে যা!