সাহিত্য ও নীতি[১]

শিশুকাল থেকেই কৃষ্ণনগর নামটি আমার কাছে পরিচিত, এবং সে পরিচয় ঘটেছিল আমার পিতামহীর মুখের নানা বিচিত্র গল্প ও ছড়ার মধ্য দিয়ে। সাহিত্য-রসের সেই মধুর আস্বাদ এই প্রাচীন বয়সেও আমি ভুলি নাই। এই জনপদই যে একদিন শিল্প-কলা ও সাহিত্যের কেন্দ্র ছিল, আমি নিশ্চয় জানি, এ কথা বললে অতিশয়োক্তির অপরাধ হয় না। বাঙ্গালার মস্ত বড় দু’জন কবি,—একজনের কর্মভূমি, ও অন্যজনের জন্মভূমি এই কৃষ্ণনগর! বঙ্গদেশের নানা সুখ-দুঃখের ইতিহাসে এই প্রাচীন নগর একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। ইহাকে চোখে দেখবার লোভ মনে মনে আমার চিরদিন ছিল। আজ সাহিত্য-পরিষদের পক্ষ থেকে আপনাদের সাদর আহ্বানে সে সাধ আমার পূর্ণ হলো। আপনারা আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।

সাহিত্য সেবাই আমার পেশা, কিন্তু ইহার যাচাই-বাছাই ঘষা-মাজার ব্যাপারে আমি নিতান্তই অনভিজ্ঞ, এ কথা আমার মুখে অদ্ভুত শুনালেও ইহা বাস্তবিক সত্য। কোন্‌ ধাতুর উত্তর কি প্রত্যয় করে সাহিত্য-পদ নিষ্পন্ন হয়েছে, কোথায় ইহার বিশেষত্ব, রস বস্তুটি কি, কাকে বলে সত্যকার আর্ট, কাকে বলে মিথ্যাকার আর্ট, কি ইহার সংজ্ঞা, আমি কিছুই এ সকলের জানি না। সুদূর প্রবাসে কেরানিগিরি করতাম, ঘটনাচক্রে বছর-দশেক হলো এই ব্যবসায়ে লিপ্ত হয়ে পড়েছি। খান-কয়েক বই লিখেছি, কারও ভাল লেগেছে, অনেকেরই লাগেনি,—পণ্ডিত যাঁরা, তাঁরা ভারী ভারী কেতাব থেকে শক্ত শক্ত অকাট্য নজির তুলে সপ্রমাণ করেছেন যে, বাঙ্গালা ভাষার আমি একেবারে সর্বনাশ করে দিয়েছি। এত সত্বর এত বড় দুষ্কার্য কি করে করলাম তা-ও আমি বিদিত নই, কি-ই বা এর কৈফিয়ত সেও আমার সম্পূর্ণ অপরিজ্ঞাত। সুতরাং তথ্যপূর্ণ গভীর গবেষণার লেশমাত্রও আমার কাছে আপনারা আশা করবেন না।

বাদ-প্রতিবাদে লিপ্ত হওয়া আমার স্বভাব নয়, আত্মপক্ষ সমর্থন করবার মত শক্তি বা উদ্যম কোনটাই আমার নেই, আমি শুধু আমার স্বল্পপরিসর সাহিত্যিক জীবনের পরিণতির গোটাকয়েক সাদামাটা কথাই আপনাদের কাছে বলতে পারি। হয়ত বলার একটু প্রয়োজনও আছে। জবাবদিহির স্বরূপে নয়, কারণ পূর্বেই বলেছি এ আমি করিনে, করার আবশ্যকতাও মনে করিনে,—এ কেবল একজন আধুনিক সাহিত্য-সেবকের নিতান্তই নিজের কথাটাই বলতে চাই। পরলোকের ব্যাপার আমি জানিনে, কিন্তু ইহলোকের মানবের জীবন-যাত্রা পথের যতদূরে দৃষ্টি চলে, দেখা যায়, বিশ্বমানব একটা বস্তু লক্ষ্য করে নিরন্তর চলেছে—তার তিনটে অংশ—art, morality এবং ধর্ম,—religion. সংসারের সমস্ত মারামারি কাটাকাটি, একের রাজ্য অপরের কেড়ে নেওয়া, একজনের দুঃখের উপার্জন অন্যজনের ঠকিয়ে নেওয়া,—সর্ববিধ কাম ক্রোধ লোভ মোহ—এরা পথের জঞ্জাল, চলার কাঁটা,— কিন্তু মানবের যে বৃহত্তর প্রাণ তার লক্ষ্য শুধু ওইখানে।

মারবাড়ী তার কাপড়ের দোকানে বসে এ কথা শুনলে হাসবে, বার্ড কোম্পানির বড়সাহেব তার অফিসের টেবিলে এ সত্য উপলব্ধি করতে পারবে না, stock-exchange-এর ভিড়ের মধ্যে এ কথা একেবারে মিথ্যে বলে মনে হবে, তবুও আমি জানি তাদেরও শেষগতি ওইখানে এবং এর চেয়ে বড় সত্যও আর নেই। কিসের জন্যে এত লোভ, এত মোহ? কিসের জন্যে এই বাদ-বিসংবাদ? কিসের জন্যে এমন ঐশ্বর্যের কামনা? সত্যকার যা ঐশ্বর্য সে চিরদিনই মানুষের নিত্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত। মানুষ একাকী তাকে অর্জন করে, সঞ্চয় করে, কিন্তু যে মুহূর্তে সে ঐশ্বর্য হয়ে দাঁড়ায় সেই মুহূর্তেই সে তার একমাত্র আপন ভোগের বাইরে গিয়ে পড়ে। ঐশ্বর্যকে একাকী ভোগ করবার চেষ্টা করলেই সে আপনাকে আপনি ব্যর্থ করে দেয়। যা সর্বমানবের একার লোভ সেখানে পরাভূত হবেই হবে।আর এই ঐশ্বর্যের চরম পরিণতি কোথায়? সুন্দর এবং মঙ্গলের সাধনায়,—art, morality এবং ধর্মে। এ একলার নয়, এ ঐশ্বর্য বিশ্ব-মানবের জেনে এবং না জেনে, মানুষের চেষ্টা মানুষের উদ্যম এই ঐশ্বর্য আহরণের দিকেই অবিশ্রাম চলেছে,—অতএব, যা অসুন্দর, যা immoral, যা অকল্যাণ, কিছুতেই তা art নয়, ধর্ম নয়। Art for art’s sake কথাটা যদি সত্য হয়, তা হলে কিছুতেই তা immoral এবং অকল্যাণকর হতে পারে না; এবং অকল্যাণকর এবংimmoral হলে art for art’s sake কথাটাও কিছুতে সত্য নয়; শতসহস্র লোকে তুমুল শব্দ করে বললেও সত্য নয়। মানব জাতির মধ্যে যে বড় প্রাণটা আছে সে একে কোন মতেই গ্রহণ করে না। সুতরাং, সত্যকার কবি বলে যথার্থ artist বলে যাকে এক হাতে গ্রহণ করব তার সৃষ্টিকে অন্যায় বলে, কুৎসিত বলে অন্য হাতে বর্জন করা হতেই পারে না। বরঞ্চ চালাবার চেষ্টা করলেই সবচেয়ে বড় ভুল এবং বড় অন্যায়ই করা হয়।

কিন্তু এ ত গেল theory–র দিক দিয়ে, আদর্শবাদের দিক দিয়ে। এর মধ্যে হয়ত তত বিবাদ নেই। কিন্তু কবির মধ্যে, artist-এর মধ্যে, অর্থাৎ তার নিজের মধ্যেই যেখানে একটা ছোটমানুষ থাকে, হাঙ্গামা বাধে তাকে নিয়ে। এখানে লোভ, মোহ, যশঃ, নিন্দে, prejudice, সংস্কার মাঝে মাঝে এমন কুহেলিকা গড়ে তোলে যে, তার অন্ধকার আশ্রয়েই অনেক fraud, অনেক উৎপাত ঢুকে গিয়ে দারুণ উপদ্রবের ভিত্তিস্থাপন করে। এইখানেই হল অসত্য এবং অকল্যাণের দ্বার। এই আঁধারে অধিকারী এবং অনধিকারী, কবি এবং অকবি, সুন্দর ও কুৎসিত, কাব্য এবং নোংরামিতে মিলে যে মন্থন শুরু করে দেয়, তার কাদাই ছিটকে উঠে নির্বিচারে সকলের মুখে পাঁক মাখিয়ে দেয়। এ কাদা ধুয়ে দিতে পারে শুধু কাল। এর হাতেই শুধু অনাগত ভবিষ্যতে শুদ্ধ ও স্নাত হয়ে সত্যবস্তু মানুষের চোখে পড়ে। এই জন্যই বোধ হয় কবির মধ্যে যে অংশটুকু তাঁর কবি, এই চরম বিচারের প্রতীক্ষা করতে তাঁর বাধে না, কিন্তু যে-টুকু তাঁর ছোট্ট মানুষ তারই কেবল সবুর সয় না। সে কলহ করে, বিবাদ করে, দল পাকায়, হাতনাগাদ নগদ মূল্য চুকিয়ে না নিলেই তার নয়। সাময়িক কাগজপত্রে এই স্থানটাই তার বার বার ঘুলিয়ে ওঠে।

পূজ্যপাদ রবীন্দ্রনাথ বলেন, তিনি স্কুল-মাস্টার নন,—তিনি কবি। বেত হাতে ছেলে মানুষ করা তাঁর পেশা নয়।এই নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যক্ত এবং অব্যক্ত কটুকথার বিরাম নেই। কটুকথার মালিক যাঁরা তাঁরা বোধ করি কবির উক্তির এইরূপ অর্থ করেন যে, যেহেতু তিনি বেত হাতে ছেলে মানুষ করতে সম্মত নন, গল্পচ্ছলে ভুলিয়ে বুড়ো ছেলেদের নীতিশিক্ষা দিতে চান না, তখন নিশ্চয়ই তাঁর ছেলে বইয়ে দেওয়াই অভিসন্ধি।

কিন্তু কাব্য—যা সত্যকার কাব্য, সে যে চির-সুন্দর, চির-কল্যাণকর, কবির অন্তরের এই কথাটা তাঁরা উপলব্ধি করেতেই চান না। এবং, ওই সব ফন্দি-ফিকিরের মধ্যেই যে কবি এবং কাব্য আপনাদের আপনি নিষ্ফল করে তোলে এই সত্যটাই তাঁরা বিস্মৃত হন।

এই কথাটাই আমি গোটা-দুই দৃষ্টান্ত দিয়ে পরিস্ফুট করতে চাই। আমার নিজের পেশা উপন্যাস-সাহিত্য, সুতরাং এই সাহিত্যের দু-একটা কথা বলা বোধ করি নিতান্তই অনধিকার চর্চা বলে গণ্য হবে না। যাঁরা আমার নমস্য আমার গুরুপদবাচ্য তাঁদের লেখা থেকে এক-আধটা উদাহরণ দিলে যদি বা একটু বিরুদ্ধ মত থাকে, আশা করি আপনাদের কেহই তাকে অসম্মান বা অশ্রদ্ধা বলে ভুল করবেন না। আমার সাহিত্যিক জীবনের পরিণতির প্রসঙ্গে এর প্রয়োজনও আছে। গোটা-দুই শব্দ আজকাল প্রায় শোনা যায়, Idealistic and Realistic. আমি নাকি এই শেষ সম্প্রদায়ের লেখক। এই দুর্নামই আমার সবচেয়ে বেশি। অথচ, কি করে যে এই দু’টোকে ভাগ করে লেখা যায়, আমার অজ্ঞাত। Art জিনিসটা মানুষের সৃষ্টি, সে nature নয়। সংসারে যা-কিছু ঘটে,—এবং অনেক নোংরা জিনিসই ঘটে,—তা কিছুতেই সাহিত্যের উপাদান নয়। প্রকৃতির বা স্বভাবের হুবহু নকল করা Photography হতে পারে, কিন্তু সে কি ছবি হবে? দৈনিক খবরের কাগজে অনেক-কিছু রোমহর্ষণ ভয়ানক ঘটনা ছাপা থাকে, সে কি সাহিত্য? চরিত্র-সৃষ্টি কি এতই সহজ? আমাকে অনেকেই দয়া করে বলেন, মশাই আমি এমন ঘটনা জানি যে, সে যদি আপনাকে বলি, ত আপনার চমৎকার একটা বই হতে পারে।

আমি বলি, তা হলে আপনি নিজেই সেটা লিখুন।

তাঁরা বলেন, তা হলে আর ভাবনা ছিল কি? ওইটে যে পারিনে!

আমি বলি, আজ না পারলেও দু’দিন পরে পারতে পারেন। অমন জিনিসটে খামকা হাতছাড়া করবেন না।

এঁরা জানেন না, সংসারে অদ্ভুত কিছু একটা জানাই সাহিত্যিকের বড় উপকরণ নয়। আমি ত জানি কি করে আমার চরিত্রগুলি গড়ে ওঠে। বাস্তব অভিজ্ঞতাকে আমি উপেক্ষা করচি নে, কিন্তু, বাস্তব ও অবাস্তবের সংমিশ্রণে কত ব্যথা, কত সহানুভূতি, কতখানি বুকের রক্ত দিয়ে এরা ধীরে ধীরে বড় হয়ে ফোটে, সে আর কেউ না জানে আমি ত জানি। সুনীতি দুর্নীতির স্থান এর মধ্যে আছে, কিন্তু বিবাদ করবার জায়গা এতে নেই,—এ বস্তু এদের অনেক উচ্চে। এদের গণ্ডগোল করতে দিলে যে গোলযোগ বাধে কাল তাকে ক্ষমা করে না। নীতি-পুস্তক হবে, কিন্তু সাহিত্য হবে না। পুণ্যের জয় এবং পাপের ক্ষয়, তাও হবে, কিন্তু কাব্যসৃষ্টি হবে না।

আমার মনে আছে, ছেলেবেলায় ‘কৃষ্ণকান্তের উইলের’ রোহিণীর চরিত্র আমাকে অত্যন্ত ধাক্কা দিয়েছিল। সে পাপের পথে নেমে গেল। তারপরে পিস্তলের গুলিতে মারা গেল। গরুর গাড়িতে বোঝাই হয়ে লাশ চালান গেল। অর্থাৎ হিন্দুত্বের দিক দিয়ে পাপের পরিণামের বাকী কিছু আর রইল না। ভালই হল। হিন্দু সমাজও পাপীর শাস্তিতে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলো। কিন্তু আর একটা দিক? যেটা এদের চেয়ে পুরাতন, এদের চেয়ে সনাতন,—নর-নারীর হৃদয়ের গভীরতম, গূঢ়তম প্রেম?— আমার আজও যেন মনে হয়, দুঃখে সমবেদনায় বঙ্কিমচন্দ্রের দুই চোখ অশ্রুপরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, মনে হয়, তাঁর কবিচিত্ত যেন তাঁরই সামাজিক ও নৈতিক বুদ্ধির পদতলে আত্মহত্যা করে মরেছে।

অনেকবারই আমার মনে হয়েছে, রোহিণীর চরিত্র আরম্ভ করবার সময়ে এ কল্পনা তাঁর ছিল না, থাকলে এমন করে তাকে গড়তে পারতেন না। কেবল প্রেমের জন্যই নিঃশব্দে সংগোপনে বারুণীর জলতলে আপনাকে আপনি বিসর্জন দিতে পাপিষ্ঠাকে কবি এমন করে নিয়োজিত করতেন না।

গোবিন্দলালকে রোহিণীর অকৃত্রিম এবং অকপটেই ভালবেসেছিল,—সমস্ত হৃদয়-প্রাণ দিয়েই ভালবেসেছিল, এবং এ প্রেমের প্রতিদান যে সে পায়নি তাও নয়। কিন্তু হিন্দুধর্মের সুনীতির আদর্শে এ প্রেমের সে অধিকারী নয়, এ ভালবাসা তার প্রাপ্য নয়। সে পাপিষ্ঠা, তাই পাপিষ্ঠাদের জন্য নির্দিষ্ট নীতির আইনে বিশ্বাসঘাতিনী তার হওয়া চাই এবং হলও সে। তার পরের ইতিহাস অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। মিনিট-পাঁচেকের দেখায় নিশাকরের প্রতি আসক্তি এবং পিস্তলের গুলিতে মৃত্যু। মৃত্যুর জন্য আক্ষেপ করিনে, কিন্তু করি তার অকারণ, অহেতুক জবরদস্তির অপমৃত্যুতে। হতভাগিনীর অস্বাভাবিক মরণে পাঠক-পাঠিকার সুশিক্ষা থেকে আরম্ভ করে সমাজের বিধি ও নীতির convention সমস্তই বেঁচে গেল, সন্দেহ নেই, কিন্তু ম’ল সে, আর তার সঙ্গে সত্য, সুন্দর art। উপন্যাসের চরিত্র শুধু উপন্যাসের আইনেই মরতে পারে, নীতির চোখরাঙানিতে তার মরা চলে না।

ঠিক এই অজুহাতেই শ্রীযুক্ত যতীন্দ্রমোহন সিংহ মহাশয় আমার ‘পল্লী-সমাজের’ বিধবা রমাকে তাঁর ‘সাহিত্যের স্বাস্থ্যরক্ষা’ পুস্তকে বিদ্রূপ করে বলেছেন, “তিনি ঠাকুরানী বুদ্ধিমতী না? বুদ্ধিবলে তোমার পিতার জমিদারি শাসন করিতে পারিলে, আর তুমিই কিনা তোমার বাল্যসখা পরপুরুষ রমেশকে ভালবাসিয়া ফেলিলে? এই তোমার বুদ্ধি? ছিঃ?।” এ ধিক্কার art-এর নয়, এ ধিক্কার সমাজের, এ ধিক্কার নীতির অনুশাসন। এদের মানদণ্ড এক নয়, বর্ণে বর্ণে ছত্রে ছত্রে এক করার প্রয়াসের মধ্যেই যত গলদ, যত বিরোধের উৎপত্তি।

শ্রীযুক্ত যতীন্দ্রবাবুর সামাজিক ধিক্কার art-এর রাজ্যে কতখানি মহামারী উপস্থিত করতে পারে তার আর একটা দৃষ্টান্ত দিই। আমার পরম শ্রদ্ধাস্পদ বন্ধু একজন প্রবীণ সাহিত্যিকের একটি ছোটগল্প আছে, তার plot–টা অত্যন্ত সংক্ষেপে এইরূপ,—নায়ক একজন বড়লোক জমিদার। Hero, অতএব, হৃদয় প্রশস্ত, প্রাণ উচ্চ, নৈতিক-বুদ্ধি অতিশয় সূক্ষ্ম। কলকাতায় তাঁর একটা মস্তবড় বাড়ি আছে; ভাড়া খাটে, দাম প্রায় লাখো টাকা। এক তারিখে বাড়িটা মাস-খানেকের জন্যে একজন ভাড়া নিলে। বাড়িওয়ালা জমিদার ত পাশের বাড়িতেই থাকেন, হঠাৎ একদিন রাত্রে তিনি ওই বাড়িটার ভেতর থেকে একজন স্ত্রীলোকের কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। দিন-দুই পরে অনুসন্ধানে জানা গেলে, বাড়িটার মধ্যে ভ্রূণহত্যা হয়েছে। কিন্তু ভাড়াটেরা বাড়িভাড়া না দিয়েই পালিয়েছে। তাদের ঠিকানা জানা নেই; পাপের দণ্ড দেওয়া অসম্ভব, তাই তিনি হুকুম দিলেন, বাড়িটা ভেঙ্গেচুরে মাঠ করে দাও। পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে অতবড় লাখো টাকার বাড়ি ভেঙ্গে মাঠ হয়ে গেল।

গল্প এইখানেই সমাপ্ত হল। প্রেসিডেন্সি কলেজের একজন English-এর প্রবীণ অধ্যাপক এই গল্প পাঠ করে সাশ্রুনেত্রে বারবার বলতে লাগলেন, জীবনে এমন শিক্ষাপ্রদ সুন্দর গল্প আর পড়েন নাই এবং এমন গল্প বাঙ্গালা সাহিত্যে যত বাড়ে ততই মঙ্গল।

এমন গল্প আমিও যে বেশি পড়িনি সে কথা অস্বীকার করিনে, এবং বাড়ি যখন আমারও নয়, অধ্যাপকেরও নয়, গ্রন্থকারেরও নয়, তখন যত ইচ্ছে ভেঙ্গেচুরে মাঠ করে দিলেও আপত্তি নেই, কিন্তু art ও সাহিত্যের যিনি অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, তাঁর মনে যে কি ভাবের উদয় হয়েছে সে শুধু তিনিই জানেন।

ভাল-মন্দ সংসারে চিরদিনই আছে,—ভালকে ভাল, মন্দকে মন্দ বলায় কোন art-ই কোন দিন আপত্তি করে না। কিন্তু দুনিয়ায় যা কিছু সত্যই ঘটে নির্বিচারে তাকেই সাহিত্যের উপকরণ করলে সত্য হতে পারে, কিন্তু সত্য-সাহিত্য হয় না।

অর্থাৎ, যা কিছু ঘটে তার নিখুঁত ছবিকেও আমি যেমন সাহিত্য-বস্তু বলিনে, তেমনি যা ঘটে না, অথচ, সমাজ বা প্রচলিত নীতির দিক দিয়ে ঘটলে ভাল হয়, কল্পনার মধ্য দিয়ে তার উচ্ছৃঙ্খল গতিতেও সাহিত্যের ঢের বেশি বিড়ম্বনা ঘটে।

আমার অবসর অল্প, বক্তব্য বস্তুকে আমি পরিস্ফুট করতে পারিনি, এ আমি জানি, কিন্তু আধুনিক-সাহিত্য-রচনায় সমাজের একশ্রেণীর শুভাকাঙ্ক্ষীদের মনের মধ্যে কোথায় অত্যন্ত ক্ষোভ ও ক্রোধের উদয় হয়েছে, বিরোধের আরম্ভ যে কোন্‌খানে, সেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করাটুকু বোধ করি আমার সম্পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু আলোচনা ঘোরতর করে তোলবার আমার প্রবৃত্তি নেই, সময় নেই, শক্তিও নেই, শুধু অশেষ শ্রদ্ধাভাজন আমাদের পূর্ববর্তী সাহিত্যাচার্যদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবার পথে কোথায় বাধা পেয়ে আমরা যে অন্য পথে চলতে বাধ্য হয়ে পড়েছি, সেই আভাসটুকু মাত্র আপনাদের কাছে সবিনয়ে নিবেদন করলাম।

পরিশেষে যে গৌরব আজ আমাকে আপনারা দিলেন, তার জন্যে আর একবার অন্তরের ধন্যবাদ জানিয়ে এই ক্ষুদ্র ও অক্ষম প্রবন্ধ আমি শেষ করলাম।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ১৩৩১ সালের ১০ই আশ্বিন বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ নদীয়া শাখার বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতির অভিভাষণ।