সঞ্জয় উবাচ।
তন্তথা কৃপয়াবিষ্টমশ্রুপূর্ণাকুলেক্ষণম্।
বিষীদন্তমিদং বাক্যমুবাচ মধুসূদনঃ ।। ১ ।।
সঞ্জয় বলিলেন—
তখন সেই কৃপাবিষ্ট অশ্রুপূর্ণাকুললোচন বিষাদযুক্ত (অর্জ্জুন)কে মধুসূদন এই কথা বলিলেন। ১ ।
শ্রীভগবান্ উবাচ।
কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্।
অনার্য্যজুষ্টস্বর্গ্যকীর্ত্তিকরমর্জ্জুন ।। ২ ।।
শ্রীভগবান্ বলিলেন-
হে অর্জ্জুন! এই সঙ্কটে অনার্য্যসেবিত স্বর্গহানিকর এবং অকীর্ত্তিকর তোমার এই মোহ কোথা হইতে উপস্থিত হইল?২।
মা ক্লৈব্যং গচ্ছ কৌন্তেয়1 নৈতৎ ত্বয্যুপপদ্যতে।
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৈর্ব্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ ।। ৩ ।।
কৌন্তেয়! ক্লীবতা প্রাপ্ত হইও না, ইহা তোমার উপযুক্ত নহে। হে পরন্তপ! ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্ব্বল্য পরিত্যাগ করিয়া উত্থান কর।৩।
অর্জ্জুন উবাচ।
কথং ভীষ্মমহং সংখ্যে দ্রোণঞ্চ মধুসূদন।
ইষুভিঃ প্রতিযোৎস্যামি পূজার্হাবরিসূদন ।। ৪ ।।
অর্জ্জুন বলিলেন-
হে শত্রুনিসূদন মধুসূদন! পূজার্হ যে ভীষ্ম এবং দ্রোণ, যুদ্ধে তাঁহাদের সহিত বাণের দ্বারা কি প্রকারে আমি প্রতিযুদ্ধ করিব? ৪।
গুরূনহত্বা হি মহানুভাবান্
শ্রেয়ো ভোক্তুং ভৈক্ষ্যমপীহ লোকে।
হত্বার্থকামাংস্তু গুরূনিহৈব
ভূঞ্জীয় ভোগান্ রুধিরপ্রদিগ্ধান্ ।। ৫ ।।
মহানুভব গুরুদিগকে বধ না করিয়া ইহলোকে ভিক্ষা অবলম্বন করিতে হয়, সেও শ্রেয়। আর গুরুদিগকে বধ করিয়া যে অর্থ কাম ভোগ করা যায়, তাহা রুধিরলিপ্ত।৫।
ন চৈতদ্বিদ্মঃ কতরন্নো গরীয়ো
যদ্বা জয়েম যদি বা নো জয়েয়ুঃ।
যানেব হত্বা ন জিজীবিষাম-
স্তেহবস্থিতাঃ প্রমুখে ধার্ত্তরাষ্ট্রাঃ ।। ৬ ।।
আমরা জয়ী হই বা আমাদিগকে জয় করুক, উহার মধ্যে কোন্টি শ্রেয়, তাহা আমরা বুঝিতে পারিতেছি না-যাহাদিগকে বধ করিয়া আমরা বাঁচিতে ইচ্ছা করি না, সেই ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ সম্মুখে অবস্থিত।৬।
কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ
পৃচ্ছামি ত্বাং ধর্ম্মসংমূঢ়চেতাঃ।
যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্রুহি তন্মে
শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্ ।। ৭ ।।
কার্পণ্য-দোষে আমি অভিভূত হইয়াছি এবং ধর্ম্ম সম্বন্ধে আমার চিত্ত বিমূঢ় হইয়াছে, তাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি। যাহা ভাল হয়, আমাকে নিশ্চিত করিয়া বল। আমি তোমার শিষ্য এবং তোমার শরণাপন্ন হইতেছি-আমাকে শিক্ষা দাও।৭।
কার্পণ্য অর্থে দীনতা। তারানাথ ‘বাচস্পত্যে’ এই অর্থ নির্দ্দেশ করিয়া উদাহরণস্বরূপ গীতার এই বচনটি উদ্ধৃত করিয়াছেন। ভরসা করি, কোন পাঠকই এখানে দীনতা অর্থে দারিদ্র্য বুঝিবেন না। ‘দীন’ অর্থে মহাব্যসনপ্রাপ্ত। উদাহরণস্বরূপ-তারানাথ রামায়ণ হইতে আর একটি বচন উদ্ধৃত করিয়াছেন, যথাঃ-”মহদ্বা ব্যসনং প্রাপ্তো দীনঃ কৃপণ উচ্যতে।” আনন্দগিরি বলেন,”যোহল্পাং স্বল্পমপি স্বক্ষতিং ন ক্ষমতে ব স কৃপণঃ।” যে সামান্য ক্ষতি স্বীকার করিতে পারে না, সেই কৃপণ।2 শ্রীধর স্বামী বুঝাইয়াছেন যে, “এই সকল বন্ধুবর্গকে নষ্ট করিয়া কি প্রাণ ধারণ করিব? অর্জ্জুনের ইতি বুদ্ধিই কার্পণ্য। তিনি “কার্পণ্যদোষ” ইতি সমাসকে দ্বন্দ্ব সমাস বুঝিয়াছেন-কার্পণ্য এবং দোষ। দোষ শব্দে এখানে পূর্ব্বকথিত কুলক্ষয়কৃত পাপ বুঝিতে হইবে। অন্যান্য টীকাকারেরা সেরূপ অর্থ করেন নাই।
নহি প্রপশ্যামি মমাপনুদ্যাদ্-
যচ্ছেকমুচ্ছোষণমিন্দ্রিয়াণাম্।
অবাপ্য ভূমাবসপত্নমৃদ্ধং
রাজ্যং সুরাণামপি চাধিপত্যম্ ।। ৮ ।।
পৃথিবীতে অসপত্ন সমৃদ্ধ রাজ্য এবং সুরলোকের আধিপত্য পাইলেও যে শোক আমার ইন্দ্রিয়গণকে বিশোষণ করিবে, তাহা কিসে যাইবে, আমি দেখিতেছি না।৮
সঞ্জয় উবাচ।
এবমুক্ত্বা হৃষীকেশং গুড়াকেশঃ পরন্তপঃ।
ন যোৎস্য ইতি গোবিন্দমুক্ত্বা তূষ্ণীং বভূব হ ।। ৯ ।।
সঞ্জয় বলিতেছেন—
শত্রুজয়ী অর্জ্জুন3 হৃষীকেশকে এইরূপ বলিয়া, যুদ্ধ করিব না, ইহা গোবিন্দকে বলিয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন।৯।
তমুবাচ হৃষীকেশঃ প্রহসন্নিব ভারত।
সেনয়োরুভয়োর্ম্মধ্যে বিষীদন্তমিদং বচঃ ।। ১০ ।।
হে ভারত! হৃষীকেশ হাস্য করিয়া উভয় সেনার মধ্যে বিষাদপর অর্জ্জুনকে এই কথা বলিলেন।১০।
শ্রীভগবান্ উবাচ।
অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে।
গতাসূনগতাসূংশ্চ নানুশোচন্তি পণ্ডিতাঃ ।। ১১ ।।
শ্রীভগবান্ বলিতেছেন—
তুমি বিজ্ঞের ন্যায় কথা কহিতেছ বটে; কিন্তু যাহাদের জন্য শোক করা উচিত নহে, তাহাদের জন্য শোক করিতেছ। কি জীবিত, কি মৃত, কাহারও জন্য পণ্ডিতেরা শোক করেন না।১১।