সংযুক্তা1

১। স্বপ্ন

নিশীথে শুইয়া,

রজত পালঙ্কে

পুষ্পগন্ধি শির,

রাখি রামা অঙ্কে,

দেখিয়া স্বপন,

শিহরে সশঙ্কে,

মহিষীর কোলে, শিহরে রায়।

চমকি সুন্দরী,

নৃপে জাগাইল,

বলে প্রাণনাথ,

এ বা কি হইল,

লক্ষ যোধ রণে,

যে না চমকিল

মহিষীর কোলে সে ভয় পায়!

উঠিয়া নৃপতি

কহে মৃদু বাণী

যে দেখিনু স্বপন,

শিহরে পরাণি,

স্বর্গীয়া জননী

চৌহনের রাণী

বন্য হস্তী তাঁরে মারিতে ধায়।

ভয়ে ভীত প্রায়

রাজেন্দ্রঘরণী

আমার নিকটে

আসিল অমনি

বলে পুত্র রাখ,

মরিল জননী

বন্যহস্তি-শূণ্ডে প্রাণ বা যায়।।

ধরি ভীম গদা

মারি হস্তিতুণ্ডে

না মানিল গদা,

বাড়াইয়া শূণ্ডে

জননীকে ধরি,

উঠাইলে মুণ্ডে;

পড়িয়া ভূমেতে বধিল প্রাণ।

কুস্বপন আজি

দেখিলাম রাণি,

কি আছে বিপদ

কপালে না জানি

মত্ত হস্তী আসি

বধে রাজেন্দ্রাণী

আমি পুত্র নারি করিতে ত্রাণ

শুনিয়াছি নাকি

তুরস্কের দল

আসিতেছে হেথা,

লঙ্ঘি হিমাচল

কি হইবে রণে,

ভাবি অমঙ্গল,

বুঝি এ সামান্য স্বপন নয়।

জননীরূপেতে

বুঝি বা স্বদেশ

বুঝি বা তুরস্ক

মত্ত হস্তী বেশ,

বার বার বুঝি

এইবার শেষ!

পৃথ্বীরাজ নাম বুঝি না রয়।।

শুনি পতিবাণী

যুড়ি দুই পাণি

জয় জয় জয়!

বলে রাজরাণী

জয় জয় জয়

পৃথ্বীরাজের জয়-

জয় জয় জয়! বলিল বামা।

কার সাধ্য তোমা

করে পরাভব

ইন্দ্র চন্দ্র যম

বরুণ বাসব।

কোথাকার ছার

তুরষ্ক পহ্লব

জয় পৃথ্বীরাজ প্রথিতনামা

আসে আসুক না

পাঠান পামর,

আসে আসুক না

আরবি বানর,

আসে আসুক না

নর না অমর।

কার সাধ্য তব শকতি সয়?

পৃথ্বীরাজ সেনা

অনন্ত মণ্ডল

পৃথ্বীরাজভূজে

অবিজিত বল

অক্ষয় ও শিরে

কিরীট কুণ্ডল

জয় জয় পৃথ্বীরাজের জয়।।

এত বলি বামা

দিল করতালি

দিল করতালি

গৌরবে উছলি,

ভূষণে শিঞ্জিনী,

নয়নে বিজলি

দেখিয়া হাসিল ভরতপতি।

সহসা কঙ্কণে

লাগিল কঙ্কণ,

আঘাতে ভাঙ্গিয়া

খসিল ভূষণ,

নাচিয়া উঠিল

দক্ষিণ নয়ন,

কবি বলে তালি না দিও সতি।।

২। রণসজ্জা।

রণসাজে সাজে

চৌহানের বল,

অশ্ব গজ রথ

পদাতির দল,

পতাকার রবে,

পবন চঞ্চল,

বাজিল বাজনা-ভীষণ নাদ।

ধূলিতে পূরিল

গগনমণ্ডল,

ধূলিতে পূরিল

যমুনার জল,

ধূলিতে পূরিল

অলক কুন্তল,

যথা কূলনারী গণে প্রমাদ।।

দেশ দেশ হতে

এলো রাজগণ

স্থানেশ্বর পদে

বধিতে যবন

সঙ্গে চতুরঙ্গ

সেনা অগণন-

হর হর বলে যতেক বীর।

মদবার হতে

আইল সমর

আবু হতে

এলো দুরন্ত প্রমর

আর্য্য বীরদল

ডাকে হর! হর!

উছলে কাঁপিয়া কালিন্দী-নীর।।

গ্রীবা বাঁকাইয়া

চলিল তুরঙ্গ

শূণ্ড আছাড়িয়া

চলিল মাতঙ্গ

ধনু আস্ফালিয়া-

শুনিতে আতঙ্গ-

দলে দলে দলে পদাতি চলে।

বসি বাতায়নে

কনৌজনন্দিনী

দেখিলা অদূরে

চলিছে বাহিনী

ভারত ভরসা,

ধরম রক্ষিণী-

ভাসিলা সুন্দরী নয়নজলে।।

৪<

সহসা পশ্চাতে

দেখিল স্বামীরে,

মুছিলা অঞ্চলে

নয়নের নীরে,

যুড়ি দুই কর

বলে “হেন বীরে

রণসাজে আমি সাজাব আজ।”

পরাইল ধনী

কবচকুণ্ডল

মুকতার দাম

বক্ষে ঝলমল

ঝলসিল রত্ন

কিরীট মণ্ডল

ধনু হস্তে হাসে রাজেন্দ্ররাজ।।

সাজাইয়া নাথে

যোড় করি পাণি

ভারতের রাণী

কহে মৃদু বাণী

“সুখী প্রাণেশ্বর

তোমায় বাখানি

এ বাহিনীপতি চলিলা রণে।

লক্ষ যোধ প্রভু

তব আজ্ঞাকারী,

এ রণসাগরে

তুমি হে কাণ্ডারী

মথিবে সে সিন্ধু

নিয়তি প্রহারি

সেনার তরঙ্গ তরঙ্গসনে।।

>আমি অভাগিনী

জনমি কামিনী

অবরোধে আজি

রহিনু বন্দিনী

না হতে পেলাম

তোমার সঙ্গিনী,

অর্দ্ধাঙ্গ হইয়া রহিনু পাছে।

যবে পশি তুমি

সমর-সাগরে

খেদাইবে দূরে

ঘোরির বানরে

না পাব দেখিতে,

দেখিবে ত পরে,

তব বীরপনা! না রব কাছে।।

সাধ প্রাণনাথ

সাধ নিজ কাজ

তুমি পৃথ্বীপতি

মহা মহারাজ

হানি শত্রুশিরে

বাসবের বাজ

ভারতের বীর আইস ফিরে।

নহে যদি শম্ভু

হয়েন নির্দ্দয়

যদি হয় রণে

পাঠানের জয়

না আসিও ফিরে,-

দেহ যেন বয়

রণক্ষেত্রে ভাসি শত্রুরুধিরে।।

কত সুখ প্রভু,

ভুঞ্জিলে জীবনে!

কি সাধ বা বাকি

এ তিন ভূবনে?

নয় গেল প্রাণ,

ধর্ম্মের কারণে?

চিরদিন রহে জীবন কার?

যুগে যুগে নাথ

ঘোষিবে সে যশ

গৌরবে পূরিত

হবে দিক্ দশ

এ কান্ত শরীর

এ নব বয়স

স্বর্গ গিয়ে প্রভু পাবে আবার।।

করিলাম পণ

শুন হে রাজন

নাশিয়া ঘোরীরে,

জিতি এই রণ

নাহি যতক্ষণ

কর আগমণ,

না খাব কিছু, না করিব পান।

জয় জয় বীর

জয় পৃথ্বীরাজ,

লভ পূর্ণ জয়

সমরেতে আজ

যুগে যুগে প্রভু

ঘোষিবে এ কাজ

হর হর শম্ভো কর কল্যাণ।।

১০

হর হর হর!

বম্ বম্ কালী!

বম্ বম্ বলি

রাজার দুলালি,

করতালি দিল-

দিল করতালি

রাজরাজপতি ফুল্ল হৃদয়।

ডাকো বামা জয়

জয় পৃথ্বীরাজ

জয় জয় জয়

জয় পৃথ্বীরাজ-

জয় জয় জয়

জয় পৃথ্বীরাজ

কর, দুর্গে, পৃথ্বীরাজের জয়।।

১১

প্রসারিয়া রাজ

মহা ভূজদ্বয়ে,

কমনীয় বপু,

ধরিল হৃদয়ে,

পড়ে অশ্রুধারা

চারি গণ্ড বয়ে,

চুম্বিল সুবাহু চন্দ্রবদনে।

স্মরি ইষ্টদেবে

বাহিরিল বীর,

মহাগজপৃষ্ঠে

শোভিল শরীর<

মহিষীর চক্ষে

বহে ঘন নীর।

যে জানে এতই জল নয়নে।

১২

লুটাইয়া পড়ি

ধরণীর তলে

তবু চন্দ্রাননী

জয় জয় বলে

জয় জয় বলে-

নয়নের জলে

জয় জয় কথা না পায় ঠাই।

কবি বলে মাতা

মিছে গাও জয়

কাঁদ যতক্ষণ

দেহ প্রাণ রয়,

ও কান্না রহিবে

এ ভারতময়

আজিও আমরা কাঁদি সবাই।।

৩। চিতারোহণ

কত দিন রাত পড়ে রহে রাণী
না খাইল অন্ন না খাইল পানি
কি হইল রণে কিছুই না জানি,
মুখে বলে পৃথ্বীরাজের জয়।
হেন কালে দূত আসিল দিল্লীতে
রোদন উঠিল পল্লীতে পল্লীতে-
কেহ নারে কারে ফুটিয়া বলিতে,
হায় হায় শব্দ ফাটে হৃদয়!

মহারবে যেন সাগর উছলে
উঠিল রোদন ভারতমণ্ডলে
ভারতের রবি গেল অস্তাচলে
প্রাণ ত গেলই, গেল যে মান।
আসিছে যবন সামাল সামাল
আর যোদ্ধা নাই সে ধরিবে ঢাল?
পৃথ্বীরাজ বীরে হরিয়াছে কাল,
এ ঘোর বিপদে কে করে ত্রাণ ||

ভূমিশয্যা ত্যজি উঠে চন্দ্রানী,
সখীজনে ডাকি বলিল তখনি,
সম্মুখ সমরে বীরশিরোমণি
গিয়াছে চলিয়া অনন্ত স্বর্গে।
আমি যাইব সেই স্বর্গপুরে,
বৈকুণ্ঠেতে গিয়া পূজিব প্রভুরে,
পূরাও রে সাধ; দুঃখ যাক দূরে,
সাজা মোর চিতা সজনীবর্গে ||

যে বীর পড়িল সম্মুখ সমরে
অনন্ত মহিমা তার চরাচরে
সে নহে বিজিত; অপ্সরে কিন্নরে,
গায়িতেছে তাহার অনন্ত জয়।
বল সখি সবে জয় জয় বল,
জয় জয় বলি চড়ি গিয়া চল
জ্বলন্ত চিতার প্রচণ্ড অনল,
বল জয় পৃথ্বীরাজের জয় ||

চন্দনের কাষ্ঠ এলো রাশি রাশি
কুসুমের হার যোগাইল দাসী
রতন ভূষণ কর পরে হাসি
বলে যাব আজি প্রভুর পাশে।
আয় আয় সখি, চড়ি চিতানলে
কি হবে রহিয়ে ভারতমণ্ডলে?
আয় আয় সখি যাইব সকলে
যথা প্রভু মোর বৈকুণ্ঠবাসে ||

আরোহিলা চিতা কামিনীর দল
চন্দনের কাষ্ঠে জ্বলিল অনল
সুগন্ধে পূরিল গগনমণ্ডল-
মধুর মধুর সংযুক্তা হাসে।
বলে সবে বল পৃথ্বীরাজ জয়
জয় জয় জয় পৃথ্বীরাজ জয়
করি জয়ধ্বনি সঙ্গে সখীচয়
চলি গেলা সতী বৈকুণ্ঠবাসে ||

কবি বলে মাতা কি কাজ করিলে
সন্তানে ফেলিয়া নিজে পলাইলে,
এ চিতা অনল কেন বা জ্বালিলে,
ভারতের চিতা, পাঠান ডরে।
সেই চিতানল, দেখিল সকলে
আর না নিবিল ভারতমণ্ডলে
দহিল ভারত তেমনি অনলে
শতাব্দী শতাব্দী শতাব্দী পরে ||

======================

1 পৃথ্বীরাজের মহিষী-কান্যকুব্জরাজার কন্যা। টডকৃত রাজস্থানের সংযুক্তার বৃত্তান্ত দেখ।

2 মেবার।

3 সমর সিংহ।

Leave a Reply