এক্ষণে আখ্যায়িকার সূত্র পুনঃগ্রহণ করা যাইতেছে। পুষ্পোদ্যান হইতে মাধব বাটীতে প্রত্যাগমন করিলে একজন পত্র-বাহক তাঁহার হস্তে একখানি লিপি প্রদান করিল। লিপির শিরোনামার স্থলে “জরুরি” এই শব্দ দৃষ্টে মাধব ব্যস্ত হইয়া পত্রপাঠে নিযুক্ত হইলেন। সদর মোকামে যে ব্যক্তি তাঁহার মোক্তার নিযুক্ত ছিল, সেই ব্যক্তি এই পত্র প্রেরণ করিয়াছিল। পত্রের মর্ম্ম নিম্নে উদ্ধৃত হইলঃ-

“মহিমার্ণবেষু-

অধীন এ মোকামে থাকিয়া হুজুরের মোকদ্দমা জাতের তদ্বিরে নিযুক্ত আছে, এবং তাহাতে যেমত যেমত আবশ্যক তাহা সাধ্যমত আমলে আনিতেছে। ভরসা করি সর্ব্বত্র মঙ্গল ঘটনা হইবেক। সম্প্রতি অকস্মাৎ যে এক গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছে তাহা হুজুরের গোচরে নিবেদন করিতে অধীনের সাহসাভাব। হুজুরের শ্রীমতী খুড়ী ঠাকুরাণীর উকিল হুজুরের নামে অদ্য এ মোকামের প্রধান সদর আপিল আদালতে এই দাবিতে মোকদ্দমা রুজু করিয়াছেন যে, রামগোপাল ঘোষ মহাশয়ের উইলনামা সম্পূর্ণ মিথ্যা তঞ্চক-হুজুর কর্ত্তৃক জাল উইল প্রস্তুত হইয়া বিষয়াদি হইতে তেঁহ বেদস্ত হইয়াছেন। অতএব সমেৎ ওয়াশিলাত তাবৎ বিষয়ে দখল পাওয়ার ও উইল রদের দাবি ইত্যাদি।”

পত্রী মাধবের হস্তলিখিত হইয়া ভূপতিত হইল। মনে যে তাঁহার কিরূপ ক্রোধাবির্ভাব হইল তাহা বর্ণনা করা দুষ্কর। বহুক্ষণ চিন্তার পর পত্রী মৃত্তিকা হইতে উত্তোলন করিলেন, এবং ললাটের স্বেদস্রুতি করদ্বারা বিলুপ্ত করিয়া পুনঃপাঠে প্রবৃত্ত হইলেন। যথা-

“ইঁহার ছলাদার কে, তাহা অধীন এ পর্য্যন্ত জানিতে পারে নাই; কিন্তু অধীন অনেক অনুসন্ধান করিতেছে ও করিবেক। ফলে এমত বোধ হয় না যে, বিনা ছলা স্ত্রীলোক এরূপ নালিশ উত্থাপন করিবেন। অধীন অদ্য পরম্পরায় শ্রুত হইল যে, কোনও অতি প্রধান ব্যক্তির কুপরামর্শমতে এ ঘটনা উপস্থিত হইয়াছে।”

মাধব মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন যে, এমত ব্যক্তি কে, যে কুপরামর্শ দিয়াছে? মাধব অনেক ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। কখন একজন প্রতিযোগী প্রতিবাসীর প্রতি সন্দেহ, কখনও বা অপরের প্রতি সন্দেহ করিতে লাগিলেন; কিন্তু কোনও সন্দেহ সমূলক বলিয়া বোধ হইল না।

পত্রপাঠে পুনঃপ্রবৃত্ত হইলেনঃ-

“অধীনের বিবেচনায় হুজুরের কোনও শঙ্কা নাই, কেন না, ‘যতো ধর্ম্মঃ ততো জয়’, কিন্তু যেরূপ বিপক্ষের সহায় দেখা যাইতেছে, তাহাতে সতর্কতার আবশ্যক।-বাবুদিগের এক্ষণে ওকালতনামা দেওয়া আবশ্যক-পশ্চাৎ সময়ে সময়ে সদর হইতে উকীল কৌন্সিলী আনান কর্ত্তব্য হইবেক। তৎপক্ষে হুজুরের যেমন মর্জি। আজ্ঞাধিন প্রাণপণে হুজুরের কার্য্যে নিযুক্ত রহিল-সাধ্যানুসারে ত্রুটি করিবেক না। ইতি তারিখ-

আজ্ঞানুবর্ত্তী শ্রীহরিদাস রায়”।

“পুনশ্চ নিং-

আপাততঃ মোকদ্দমায় খরচ প্রায় হাজার টাকার আবশ্যক হইবেক। যেরূপ হুজুর বুঝিবেন সেইরূপ করিবেন।”

পত্রপাঠ সমাপন মাত্র মাধব, খুল্লতাত-পত্নীর অনুসন্ধানে পুরমধ্যে চলিলেন। ক্রোধে কলেবর কম্পিত হইতেছিল, অতি তরল পদবিক্ষেপে গমন করিতে লাগিলেন;-তাঁহাকে খুল্লতাত-পত্নী কোন্ মুখে জাল সাজ বলিয়া বিচারাগারে ব্যক্ত করিয়াছেন, এ কথা জিজ্ঞাসা করিবেন, এবং তৎক্ষণাৎ খুড়ীকে গৃহবহিষ্কৃত করিয়া দিবেন স্থির করিলেন।

পুরমধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন যে, সন্ধ্যাকাল পাইয়া অন্তঃপুরবাসিনীরা যে হট্টগোল উপস্থিত করিয়াছেন, তাহাতে কর্ণপাত করাই কষ্ট, কথার উত্তর পাওয়া দূরে থাকুক। কোথাও কোন রূপসী-একে স্থূলাকার তাহাতে মেঘের বর্ণ-নানা মত চিৎকার করিয়া এটা ওটা সেটা চাহিতেছে, এবং নানামত মুখভঙ্গী অঙ্গভঙ্গী করিতেছে,-যেন একটা ক্ষুদ্র হস্তিনী কেলি করিতেছে। কোথাও একটি পরিচারিকা তদ্রূপ বিশাল দেহপর্ব্বত লইয়া ব্যস্ত-প্রায় বিবসনা-গৃহ মার্জ্জন করিতেছে; এবং যেমন ত্রিশূলহস্তে অসুরবিজয়িনী প্রমথেশ্বরী প্রতিবার শূলাঘাতে অসুরদল দলিত করিয়াছিলেন, পরিচারিকাও করাল সম্মার্জ্জনী হস্তে রাশি রাশি জঞ্জাল, ওজলা, তরকারির খোসা প্রভৃতি দলিত করিতেছিল, এবং যে আঁটকুড়ীরা এত জঞ্জাল করিয়াছিল তাহাদিগের পতিপুত্রের মাথা মহাসুখে খাইতেছিল। কোথাও অপরা কিঙ্করী আঁস্তাকুড়ে বসিয়া ঘোররবে বাসন মাজিতেছিল,-পাচিকার অপরাধ, সে কেন কড়া বগুনায় পাক করিয়াছিল?-তাই কিঙ্করীর এ গুরুতর কর্ম্মভোগ; যেমন মার্জ্জনা-কার্য্যে তাহার বিপুল করযুগল ঘর্ ঘর্ শব্দে চলিতেছিল, রসনাখানিও তদ্রূপ দ্রুতবেগে পাচিকার চতুর্দ্দশ পুরুষকে বিষ্ঠাদি ভোজন করাইতেছিল। পাচিকা স্বয়ং তখন স্থানান্তরে, গৃহিণীর সহিত ঘৃত লইয়া মহা গোলযোগ করিতেছিলেন, আঁস্তাকুড়ে যে তাঁহার পূর্ব্ব-পুরুষের আহারাদির পক্ষে এমন অন্যায় ব্যবস্থা হইতেছিল, তাহা কিছুমাত্র জানিলেন না-ঘৃতের বিষয়ে একেবারে উন্মত্তা। গৃহিণী পাকার্থ যতটুকু ঘৃত প্রয়োজন ততটুকু দিয়াছেন, কিন্তু পাচিকা তাহাতে সন্তুষ্টা নহেন। তিনি মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন যে, যতটুকু পাকার্থ আবশ্যক তাহার দ্বিগুণ ঘৃত কোন সুযোগে লওয়াই যুক্তি; কারণ, অর্দ্ধেক পাক হইবে, অর্দ্ধেক আত্মসেবার জন্য থাকিবে।

কোথাও বা দারুণ বঁটীর আঘাতে মৎস্যকুল ছিন্নশীর্ষ হইয়া ভূমিতে লুটাইতেছিল, কোথাও বা বালক-বালিকার দল মহানন্দে ক্রীড়া করিতেছিল। পুরসুন্দরীরা কক্ষ হইতে কক্ষান্তরে প্রদীপ-হস্তে যাতায়াত করিতেছিলেন; মলের শব্দ কোথাও ঝণাৎ ঝণাৎ, কোথাও রুণ্ রুণ্, কোথাও বা ঠুণু, ঠুণু; আর যেমন বয়স তার মলও তেমনই বাজিতেছিল। কখন বা বামাসুরে রামী বামী শ্যামীর ডাক পড়িতেছিল। পাড়ার গোটা দুই অধঃপেতে ছেলে নিজ নিজ পৌরুষ প্রকাশের উপযুক্ত সময় পাইয়া মল্লযুদ্ধ উপলক্ষে উঠানে চুল ছেঁড়াছিঁড়ি করিতেছিল। কতকগুলিন বালিকা কলরব করিয়া আগডুম বাগডুম খেলিতেছিল।

মাধব এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া হতাশ হইলেন; এ ঘোর কলরবের মধ্যে যে কেহ তাহার কথা শুনিতে পাইবে, এমত ভরসা রহিল না। তিনি অষ্টমে উঠিয়া চীৎকার করিয়া বলিলেন, “বলি, মাগীরা একটু থাম্‌বি।” এই বলিয়া উঠানে গিয়া মল্লযোদ্ধা-বালকদ্বয়ের মধ্যে একজনকে কেশাকর্ষণ করিয়া দুই-চারি চপেটাঘাত করিলেন।

একেবারে আগুনে জল পড়িল;- ঘোরতর কোলাহল পলকমধ্যে আর নাই, যেন ভোজবাজিতে সকলই তিরোহিত হইল। যে স্থূলাঙ্গিনী আকাশকে সম্বোধন করিয়া বিবিধ চীৎকার ও মুখভঙ্গি করিতেছিলেন, তাঁহার কণ্ঠ হইতে অর্দ্ধনির্গত চীৎকার অমনি কণ্ঠেই রহিয়া গেল, হস্তিনীর ন্যায় আকারখানি কোথায় যে লুক্কায়িত হইল তাহা আর দেখিতে পাওয়া গেল না; সমার্জ্জনীহস্তে যিনি বিবসনে বিষম ব্যাপার করিতেছিলেন, তিনি অমনি করস্থ ভীম প্রহরণ দূরে নিক্ষেপ করতঃ রণক্ষেত্র হইতে পলায়ন আরম্ভ করিলেন, কিন্তু প্রায়-বসনহীন, মাংসরাশি কোথায় লুকাইবেন স্থান না পাওয়ায় এ কোণ ও কোণ করিতে লাগিলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে মেঝেতে কে জল ফেলিয়াছিল-পরিচারিকা দ্রুতপদে বিবসন শরীর লইয়া যেমন পলাইবেন, অমনি পা পিছলাইয়া চীৎপাত হইয়া ভূ-শায়িনী হইলেন; যিনি পাত্রাদি মার্জ্জনে হাত মুখ দুই ঘুরাইতে ঘুরাইতে পাচিকার পিতৃপুরুষের পিণ্ডাদির ব্যবস্থা করিতেছিলেন, তাঁহার একটা লম্বা গালির ছড়া আধখানা বই বলা হইল না-হাত ঘুরিতে ঘুরিতে যেমন উঁচু হইয়াছিল তেমনই উঁচু রহিয়া গেল; মৎস্যদল-দলনী বারেক নিস্তব্ধ হইলেন, পশ্চাৎ কার্য্যারম্ভ করিলেন বটে, কিন্তু আর তাদৃশ ঘটা রহিল না; রন্ধনশালার কর্ত্রী যে ঘৃতের কারণ বক্তৃতা আরম্ভ করিয়াছিলেন, অকস্মাৎ তাহা হইতে নিবৃত্ত হইয়া পলায়নতৎপরা হইলেন–অন্যমনস্কপ্রযুক্তই হউক, আর তাড়াতাড়িতে বিবেচনার অভাববশতঃই হউক, পাচিকা পলায়নকালে পূর্ণভাণ্ড ঘৃত হইয়া চলিয়া গেল-পাচিকা ইতিপূর্ব্বে কেবল অর্দ্ধভাণ্ড মাত্র ঘৃতের প্রার্থিতা ছিলেন; যে পুর-সুন্দরীরা প্রদীপহস্তে কক্ষে কক্ষে গমনাগমন করিতেছিলেন, তাঁহারা সকলে ত্রস্তে পলাইয়া লুক্কায়িত হইলেন, পলায়নকালে মলগুলি একেবারে ঝন্ ঝন্ করিয়া বাজিয়া উঠিল-হস্তের দীপসকল নিবিয়া গেল।

যে শিশু মল্লযোদ্ধাটি মাধবের চপেটাঘাত খাইয়াছিলেন, তিনি বীরত্বের এমত নূতনতর পুরস্কার প্রাপ্ত হইয়া তৎক্ষণাৎ রণস্থলী হইতে বেগে প্রস্থান করিয়াছিলেন-দ্বিতীয় যোদ্ধাও সময়ের গতিক তাদৃশ সুবিধাজনক নয় বুঝিয়া রণে ভঙ্গ দিলেন, কিন্তু যেমন ঘটৎকচ মৃত্যুকালেও পিতৃবৈরী নষ্ট করিয়াছিলেন, ইনিও তেমনই পলায়নকালে বিপক্ষের ঊরুদেশে একটি পদাঘাত করিয়া গেলেন, যে বালিকাগণ কলরব-সহকারে খেলিতেছিল, তাহারা খেলা ত্যাগ করিয়া পলায়নতৎপর বীরের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল-ভয় হইয়াছে, কিন্তু হাসিটা একেবারে থামিল না। যে অন্তঃপুর এতক্ষণ অতি ঘোর কোলাহলপরিপূর্ণ ছিল, তাহা এক্ষণে একেবারে নীরব। কেবল মাত্র গৃহিণী-অবিকৃত কান্তিমতী হইয়া-বাবুর সম্মুখে দণ্ডায়মান রহিলেন।

মাধব তাহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “কি মাসী, আমার বাড়ীতে বাজার!”

মাসী মৃদুহাস্য করিয়া কহিলেন, “বাছা, মেয়ে মানুষের স্বভাব বকা।”

মাধব কহিলেন, “খুড়ী কোথা, মাসী?”

উত্তর-“আমিও তাই ভাবিতেছিলাম, আজ সকাল বেলা হ’তে কেহই তাঁহাকে দেখে নাই।”

মাধব বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, “সকাল অবধি নাই! তবে সকলই সত্য!”

মাসী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি সত্য বাপু?”

মাধব। কিছু না-পশ্চাৎ বলিব। খুড়ী তবে কোথায়? কাহারও সঙ্গে কি তাঁহার আজও দেখা হয় নাই?

গৃহিণী ডাকিয়া কহিলেন, “অম্বিকা, শ্রীমতী! তোরা কেহ দেখেছিস?”

তাহারা সকলে সমস্বরে উত্তর করিল “না।”

মাধব কহিলেন, “বড়ই আশ্চর্য্যের কথা।”

পরে অন্তরাল হইতে একজন স্ত্রীলোক মৃদুস্বরে কহিল, “আমি নাবার বেলা বড় বাড়ীতে তাঁকে দেখেছিলাম।”

মাধব অধিকতর বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া কহিলেন, “বড় বাড়ীতে? মথুর দাদার ওখানে!”

তাঁহার মনোমধ্যে এক নূতন সিদ্ধান্ত উপস্থিত হইল। ভাবিলেন, “তবে কি মথুর দাদার কর্ম্ম? না না, তা হ’তে পারে না-আমি অন্যায় দোষ দিতেছি”। পরে প্রকাশ্যে কহিলেন, “করুণা তুই বড় বাড়ীতে যা,-খুড়ীকে ডেকে আন্; যদি না আসেন, তবে কেন আস্‌বেন না, জিজ্ঞাসা করিস্।”

Leave a Reply