মধুমতী নদীতীরে রাধাগঞ্জ নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রাম আছে। প্রভূত ধনসম্পন্ন ভূস্বামীদিগের বসতি-স্থান বলিয়া এই গ্রাম গণ্ডগ্রামস্বরূপ গণ্য হইয়া থাকে। একদা চৈত্রের অপরাহ্নে দিনমণির তীক্ষ্ণ কিরণমালা ম্লান হইয়া আসিলে দুঃসহ নৈদাঘ উত্তাপ ক্রমে শীতল হইতেছিল; মন্দ সমীরণ বাহিত হইতে লাগিল; তাহার মৃদু হিল্লোল ক্ষেত্রমধ্যে কৃষকের ঘর্ম্মাক্ত ললাটে স্বেদবিন্দু বিশুষ্ক করিতে লাগিল, এবং সদ্যশয্যোত্থিতা গ্রাম্য রমণীদিগের স্বেদবিজড়িত অলকপাশ বিধূত করিতে লাগিল।

ত্রিংশৎবর্ষবয়স্কা একটা রমণী একটি সামান্য পর্ণকুটীর অভ্যন্তরে মাধ্যাহ্নিক নিদ্রা সমাপনান্তে গাত্রোত্থান করিয়া বেশভূষায় ব্যাপৃতা হইলেন। স্ত্রীজাতির এই বৃহৎ ব্যাপারসম্পাদনে রমণীর কালবিলম্ব হইল না; একটু জল, একখানি টিনে-মোড়া চারি আঙ্গুল বিস্তার দর্পণ, সেইরূপ দীর্ঘকায় একখানি চিরুণির দ্বারা এ ব্যাপার সুসম্পন্ন হইল। এতদ্ব্যতিরেকে কিছু সিন্দূরের গুঁড়ায় ললাট বিশোভিত হইল। পরিশেষে একটি তাম্বুলের রাগে অধর রঞ্জিত হইল। এইরূপে জগদ্বিজয়িনী রমণী জাতির একজন মহারথী সশস্ত্র হইয়া কলসীকক্ষে যাত্রা করিলেন, এবং কোনও প্রতিবাসীর বংশ-রচিত দ্বার সবলে উদ্ঘাটিত করিয়া গৃহাভ্যন্তরে প্রবিষ্টা হইলেন।র্য্য

যে গৃহমধ্যে ইনি প্রবেশ করিলেন, তাহার মধ্যে চারিখানি চালা ঘর-মাটির পোতা-ঝাঁপের বেড়া। কুটীরমধ্যে কোথাও দারিদ্র্যলক্ষণ দৃষ্ট হইতেছিল না-সর্ব্বত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চতুষ্কোণ উঠানের চারিদিকে চারিখানি ঘর। তিনখানির দ্বার উঠানের দিকে-একখানির দ্বার বাহিরের দিকে। এই ঘরখানি বৈঠকখানা-অপর তিনখানি চতুষ্পার্শ্বে আবরণ বিশিষ্ট হইয়া অন্তঃপুরত্ব প্রাপ্ত হইয়াছিল। সদর বাটীর মণ্ডপ সম্মুখে সুকর্ষিত ভূমিখণ্ডে কিছু বার্ত্তাকু শাকাদি জন্মিয়াছিল। চারিপার্শ্বে নলের বেড়া; দ্বারে ঝাঁপের আগড়; সুতরাং অবলা অনায়াসে গৃহে প্রবেশ করিল।

বলা বাহুল্য যে, লব্ধপ্রবেশা প্রথমেই অন্তঃপুরাভিমুখে চলিলেন। পুরবাসী বা পুরবাসিনী বর্গ মাধ্যাহ্নিক নিদ্রা সমাপনান্তে স্ব স্ব কার্য্যে কে কোথায় গিয়াছিল, তাহা বলিতে পারি না। কেবলমাত্র তথায় দুই ব্যক্তি ছিল; একটি অষ্টাদশবর্ষীয়া তরুণী বস্ত্রোপরে কারুকার্য্যে ব্যাপৃতা ছিলেন, আর একটি চারি বৎসরের শিশু খেলায় মগ্নচিত্ত ছিল। তাহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পাঠশালায় যাইবার সময় জানিয়া শুনিয়া মস্যাধার ভুলিয়া গিয়াছিল। শিশু সেই মসীপাত্র দেখিতে পাইয়া অপর্য্যাপ্ত আনন্দ সহকারে সেই কালি মুখে মাখিতেছিল; পাছে দাদা আসিয়া দোয়াত কাড়িয়া লয়, বাছা যেন এই ভয়ে সকল কালিটুকু একেবারে মাখিয়া ফেলিতেছিল। অভাগ্যতা, কারুকার্য্যকারিণীর নিকট ধরাসনে উপবেশন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি করিতেছিস্ লো?”

সম্বোধিতা রমণী হাসিয়া উত্তর করিলেন, “আজ যে দিদি, বড় অনুগ্রহ; না জানি আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম।”

অভ্যাগতা হাসিয়া কহিল, “আর কার মুখ দেখে উঠ্‌বে? রোজ যার মুখ দেখে উঠ আজও তার মুখ দেখে উঠেছ।”

এই কথা শুনিয়া তরুণীর মুখমণ্ডল ক্ষণেকের জন্য মেঘাচ্ছন্ন হইল; অপরা নারীর অধরমূলে হাস্য অর্দ্ধপ্রকটিত রহিল। এই স্থলে উভয়ের বর্ণনা করি।

অভ্যাগতা যে ত্রিংশৎবর্ষবয়স্কা এ কথা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। সে শ্যামবর্ণা-কাল নয়-কিন্তু তত শ্যামও নয়। মুখকান্তি নিতান্ত সুন্দর নয়, অথচ কোন অংশ চক্ষুর অপ্রিয়কর নয়; তন্মধ্যে ঈষৎ চঞ্চল মাধুরী ছিল, এবং নয়নের ‘হাসি হাসি’-ভাবে সেই মাধুরী আরও মধুর হইয়াছিল। দেহময় যে অলঙ্কারসকল ছিল, তাহা সংখ্যায় বড় অধিক না হইবে, কিন্তু একটি মুটের বোঝা বটে। যে শঙ্খবণিক সেই বিশাল শঙ্খ নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন, তিনি বিশ্বকর্ম্মার অতিবৃদ্ধ প্রপৌত্র সন্দেহ নাই। আভরণময়ীর স্থূলাঙ্গে একখানি মোটা শাটী ছিল; শাটীখানি বুঝি রজকের উপর রাগ করিয়াছিল, তাই সে পথে অনেক কাল গতিবিধি করে নাই।

অষ্টাদশবর্ষীয়ার কোমল অঙ্গে এতাদৃশ অলঙ্কার বেশী ছিল না। বস্তুতঃ তাহার বাক্যালাপে পূর্ব্ব বঙ্গীয় কোনরূপ কণ্ঠবিকৃতি সংলক্ষিত হইত না; ইহাতে স্পষ্ট অনুভূত হইতে পারে যে, এই সর্ব্বঙ্গসুন্দর রমণীকুসুম মধুমতী-তীরজ নহে-ভাগীরথী-কূলে রাজধানী সন্নিহিত কোনও স্থানে জাতা ও প্রতিপালিতা হইয়া থাকিবেক। তরুণীর আরক্ত গৌরবর্ণছটা মনোদুঃখ বা প্রগাঢ় চিন্তাপ্রভাবে কিঞ্চিৎ মলিন হইয়াছিল; তথাচ যেমন মধ্যাহ্ন রবির কিরণে স্থলপদ্মিনী অর্দ্ধ প্রোজ্জ্বল, অর্দ্ধশুষ্ক হয়, রূপসীর বর্ণজ্যোতি সেইরূপ কমনীয় ছিল। অতিবর্দ্ধিতকেশজাল অযত্নশিথিল গ্রন্থিতে স্কন্ধদেশে বদ্ধ ছিল; তথাপি অলককুন্তল সকল বন্ধন দশায় থাকিতে অসম্মত হইয়া ললাট কপোলাদি ঘিরিয়া বসিয়াছিল। প্রশস্ত পূর্ণায়ত ললাটতলে নির্দ্দোষ বঙ্কিম ভ্রূযুগল ব্রীড়াবিকম্পিত; নয়নপল্লবাবরণে লোচনযুগল সচরাচর অর্দ্ধাং শমাত্র দেখা যাইত; কিন্তু যখন সে পল্লব ঊর্দ্ধোত্থিত হইয়া কটাক্ষ স্ফুরণ করিত, তখন বোধ হইত যেন নৈদাঘ মেঘমধ্যে সৌদামিনী-প্রভা প্রকটিত হইল। কিন্তু সে যৌবনমদমত্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিক্ষেপে চিন্তাকুলতা প্রতীত হইত; এবং তথায় ক্ষুদ্র ওষ্ঠাধর দেখিলেই বুঝা যাইত, সে হৃদয়তলে কত সুখ দুঃখ বিরাজ করিতেছে। তাহার অঙ্গসৌষ্ঠ ও নির্ম্মাণ-পারিপাট্য, শারীরিক বা মানসিক ক্লেশে অনেক নষ্ট হইয়াছিল; তথাচ পরিধেয় পরিষ্কার শাটীখণ্ডমধ্যে যাহা অর্দ্ধ দৃষ্ট হইতেছিল, তাহার অনুরূপ শিল্পকর কখনও গড়ে নাই। সেই সুঠাম অঙ্গ প্রায় নিরাভরণ, কেবলমাত্র প্রকোষ্ঠে ‘চুড়ি’ ও বাহুতে ‘মুড়কিমাদুলি’ ইহাও বড় সুগঠন।

তরুণী হস্তস্থিত সুচ্যাদি একপার্শ্বে রাখিয়া অভ্যাগতার সহিত বাক্যালাপে প্রবৃত্ত হইলেন। অভ্যাগতা কথোপকথনকালে নিজ গৃহযন্ত্রণা-বর্ণনে বিস্তর সদ্বক্তৃত্ব প্রকাশ করিলেন; দোষের মধ্যে এই, যে যন্ত্রণাগুলিন বর্ণনা করিলেন, তাহা প্রায় কাল্পনিক। বক্ত্রী নিজ কর্দ্দমময় বস্ত্রাঞ্চলের অগ্রভাগ লইয়া পুনঃ পুনঃ চক্ষে দিতে লাগিলেন; বিধাতা তাঁহাকে যে চক্ষুযুগল দিয়াছিলেন সে কিছু এমত অবস্থার যোগ্য নয়; কিন্তু কি হবে?-অবস্থাবিশেষে শালগ্রামেরও মৃত্যু ঘটে। চক্ষুর ঘটে নাই, যতবার কাপড়খানা এসে ঠেকে ততবার চক্ষু দুইটি কামধেনুর মত অজস্র অশ্রু বর্ষণ করে। বক্ত্রী-চূড়ামণি অনেকবার অশ্রুবৃষ্টি করিয়া একবার জাঁকাইয়া কাঁদিবার উদ্যোগে ছিলেন; কিন্তু ভাগ্যক্রমে কথিত চক্ষু দুইটি সেই সময় সেই শিশুটির কালিময় মুখের উপর পড়িল; শিশুটি মসীপাত্র শূন্য করিয়া অন্ধকারময় মূর্ত্তি লইয়া দণ্ডায়মান ছিল, বালকের এই অপরূপ অঙ্গরাগ দেখিয়া গৃহযন্ত্রণাবাদিনী কাঁদিতে গিয়া হাসিয়া ফেলিলেন; রসের সাগর উথলিয়া যন্ত্রণাদি ভাসাইয়া দিল।

রোদনাদির ব্যাপার সমাপ্ত হইলে, সূর্য্যদেবকে সত্য সত্যই অস্তাচলে যাইবার উদ্যোগী দেখিয়া বক্ত্রী তরুণীকে জল আনিতে যাইবার আমন্ত্রণ করিলেন। বস্তুতঃ এই আমন্ত্রণের জন্যই এত দূর আসা। নবীনা বারি-বাহনার্থ যাইতে অস্বীকৃতা হইলেন; কিন্তু তাঁহার সঙ্গিনী বিশেষ উত্তেজনা করিতে লাগিলেন। নবীনা কহিলেন, “মধুমতীতে বড় কুমীর, গেলে কুমীরে খাবে।”

ইহা শুনিয়া সঙ্গিনী যে ঘোর হাস্য করিল, নবীনা তাহাতেই বুঝিলেন,-তাঁহার আপত্তি গ্রাহ্য হইল না। তিনি পুনরায় কহিলেন, “যাবি কখন লা কনক, আর কি বেলা আছে?” “এখনও দুপুর বেলা” বলিয়া কনক অঙ্গুলী নির্দ্দেশে দেখাইলেন যে, এ পর্য্যন্ত সূর্য্যকর বৃক্ষোপরে দীপ্তিমান্ রহিয়াছে।

নবীনা তখন কিঞ্চিৎ গাম্ভীর্য্য সহকারে বলিলেন, “তুই জানিস্ ত কনক দিদি, আমি কখন জল আনিতে যাই না।”

কনক কহিল, “সেই জন্যই ত যাইতে কহি, তুই কেন সারাদিন পিঁজরেতে কয়েদ থাক্‌বি? আর বাড়ীর বউমানুষে জল আনে না?”

নবীনা গর্ব্বিত বচনে কহিলেন, “জল আনা দাসীর কর্ম্ম।”

“কেন, কে জল এনে দেয় লো? দাসী চাকর কোথা?”

“ঠাকুরঝি জল আনে।”

“ঠাকুরঝি যদি দাসীর কর্ম্ম করিতে পারে, তবে বৌ পারে না?”

তখন তরুণী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ স্বরে কহিল, “কথায় কাজ নাই কনক! তুমি জান আমার স্বামী আমাকে জল আনিতে বারণ করিয়াছেন। তুমি তাঁহাকে চেন ত?”

কনকময়ী কোনও উত্তর না করিয়া সচকিত কটাক্ষে চতুর্দ্দিকে নিরীক্ষণ করিলেন, যেন কেহ আসিতেছে কি না দেখিলেন। কোথাও কেহ নাই দেখিয়া সমভিব্যাহারিণীর মুখপ্রতি চাহিয়া রহিলেন, যেন কিছু বলিতে বাসনা আছে, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আশঙ্কাপ্রযুক্ত কথনেচ্ছা দমন করিয়া অধোদৃষ্টি করতঃ চিন্তা করিতে লাগিলেন। তরুণী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি ভাবিতেছিস্?”

কনক কহিল-“যদি-যদি তোর চোখ্ থাকত্___”

নবীনা আর না শুনিয়া ইঙ্গিতের দ্বারা নিষেধ করিয়া কহিল, “চুপ্ কর্, চুপ্ কর্-বুঝিয়াছি।”

কনক বলিল, “বুঝিয়া থাক ত কি করিবে এখন?”

তরুণী কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন, ঈষৎ অধরকম্পে এবং অল্প ললাট-রক্তিমায় প্রকাশ পাইতে লাগিল যে, যুবতীর মনোমধ্যে কোন্ চিন্তা প্রবল। তাদৃশ ঈষৎ দেহকম্পনে আরও দেখা গেল যে, সে চিন্তায় হৃদয় অতি চঞ্চল হইতেছে। ক্ষণেক পরে কহিলেন, “চল যাই, কিন্তু ইহাতে কি পাপ আছে?”

কনক হাসিতে হাসিতে কহিল, “পাপ আছে! আমি ভুঁড়ে ভট্টাচার্য্যনহি, শাস্ত্রের খবরও রাখি না; কিন্তু আমার আড়াই কুড়ি মিন্‌সে থাকিলেও যাইতাম।”

“বড় বুকের পাটা” বলিয়া হাসিতে হাসিতে যুবতী কলসী আনিতে উঠিল; “পঞ্চাশটা! হাঁলো, এতগুলো কি তোর সাধ?”

কনক দুঃখের হাসি হাসিয়া কহিল, “মুখে আনিতে পাপ; কিন্তু বিধাতা যে একটা দিয়াছেন, পঞ্চাশটাও যদি তেমনি হয়, তবে কোটীখানেকেই বা কি ক্ষতি? কাহারও সঙ্গে যদি দেখা সাক্ষাৎ না হইল তবে আমি কোটী পুরুষের স্ত্রী হইয়াও সতী সাধ্বী পতিব্রতা।”

“কুলীনে কপাল” বলিয়া তরুণী চঞ্চল পদে পাকশালা হইতে একটি ক্ষুদ্র কলসী আনয়ন করিলেন। যেমন বারিবাহিনী তেমনই কলসী। তখন উভয়ে প্রবাহিণী অভিমুখে যাত্রা করিলেন। কনক হাসিতে হাসিতে কহিল, “এখন এস দেখি মোর গৌরবিণী, হাঁ-করাগুলোকে একবার রূপের ছটাটা দেখাইয়া আনি।”

“মর্ পোড়ার বাঁদর” বলিয়া কনকের সমভিব্যাহারিণী অবগুণ্ঠনে সলজ্জ বদন আচ্ছন্ন করিলেন।

Leave a Reply