রবীন্দ্রনাথ[১]

কবির জীবনের সপ্ততি বৎসর বয়স পূর্ণ হোলো। বিধাতার এই আশীর্বাদ শুধু আমাদিগকে নয়, সমস্ত মানবজাতিকে ধন্য করেছে। সৌভাগ্যের এই স্মৃতিকে আনন্দোৎসবে মধুর ও উজ্জ্বল করে আমরা উত্তরকালের জন্য রেখে যেতে চাই এবং সেই সঙ্গে নিজেদেরও এই পরিচয়টুকু তাদের দিয়ে যাবো যে, কবির শুধু কাব্যই নয়, তাঁকে আমারা চোখে দেখেচি, তাঁর কথা কানে শুনেচি, তাঁর আসনের চারিধারে ঘিরে বসবার ভাগ্য আমাদের ঘটেচে। মনে হয়, সেদিন আমাদের উদ্দেশেও তারা নমস্কার জানাবে।

সেই অনুষ্ঠানের একটি অঙ্গ—আজকের এই সাহিত্য-সভা। সাহিত্যের সম্মিলন আরও অনেক বসবে, আয়োজন-প্রয়োজনে তাদের গৌরবও কম হ’বে না, কিন্তু আজকের দিনের অসামান্যতা তারা পাবে না। এ ত সচরাচরের নয়, এ বিশেষ এক দিনের, তাই এর শ্রেণী স্বতন্ত্র।

সাহিত্যের আসরে সভা-নায়কের কাজ আরও করবার ডাক ইতিপূর্বে আমার এসেছে, আহ্বান উপেক্ষা করতে পারিনি, নিজের অযোগ্যতা স্মরণ করেও সসঙ্কোচে কর্তব্য সমাপন করে এসেচি, কিন্তু এই সভায় শুধু সঙ্কোচ নয়, আজ লজ্জা বোধ করচি। আমি নিঃসংশয় যে, এ গৌরব আমার প্রাপ্য নয়, এ ভার বহনে আমি অক্ষম। এ আমার প্রচলিত বিনয়বাক্য নয়, এ আমার অকপট সত্য কথা।

তথাপি আমন্ত্রণ অস্বীকার করিনি। কেন যে করিনি আমি সেইটুকুই শুধু ব্যক্ত করব।

আমি জানি বিতর্কের স্থান এ নয়, সাহিত্যের ভালো-মন্দ বিচার, এর জাতিকুল নির্ণয়ের সমস্যা নিয়ে এ পরিষৎ আহূত হয়নি,—তার প্রয়োজন যথাস্থানে—আমরা সমবেত হয়েছি বৃদ্ধ কবিকে শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নিবেদন করে দিতে। তাঁকে সহজভাবে বলতে—কবি, তুমি অনেক দিয়েছো, এই দীর্ঘকালে তোমার কাছে আমরা অনেক পেয়েছি। সুন্দর, সবল, সর্বসিদ্ধি-দায়িনী ভাষা দিয়েছো তুমি, তুমি দিয়েছো বিচিত্র ছন্দোবদ্ধ কাব্য, দিয়েছো অনুরূপ সাহিত্য, দিয়েছো জগতের কাছে বাংলার ভাষা ও ভাবসম্পদের শ্রেষ্ঠ পরিচয়, আর দিয়েছো যা সকলের বড়—আমাদের মনকে তুমি দিয়েছো বড় করে। তোমার সৃষ্টির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার আমার সাধ্যাতীত—এ আমার ধর্মবিরুদ্ধ। প্রজ্ঞাবান যাঁরা যথাকালে তাঁরা এর আলোচনা করবেন, কিন্তু তোমার কাছে আমি নিজে কি পেয়েছি সেই কথাটাই ছোট করে জানাবো বলেই এ নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম।

ভাষার কারুকার্য আমার নাই। ওতে যে পরিমাণ বিদ্যা এবং শিক্ষার প্রয়োজন, সে আমি পাইনি, তাই মনের ভাব প্রচলিত সহজ কথায় বলাই আমার অভ্যাস—এবং এমনি করেই বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু দুর্গ্রহ এসে বিঘ্ন ঘটালে। একে আমি বিখ্যাত কুঁড়ে, তাতে বায়ু-পিত্ত-কফ আদি আয়ুর্বেদোক্ত চরের দল একযোগে কুপিত হয়ে আমাকে শয্যাশায়ী করে দিলে। এমন ভরসা ছিল না যে, নড়তে পারবো। কিন্তু একটা বিপদ এই যে, চিরকাল দেখে আসচি আমার অসুখের কথা কেউ বিশ্বাস করে না, যেন ও আমার হতে নেই। কল্পনায় স্পষ্ট দেখতে পেলাম সবাই ঘাড় নেড়ে স্মিতহাস্যে বলচেন, উনি আসবেন না ত? এ আমরা জানতাম। সেই বাক্যবাণের ভয়েই আমি কোনমতে এসে উপস্থিত হয়েছি। এখন দেখচি ভালই করেছি। এই না-আসতে পারার দুঃখ আমার আমরণ ঘুচত না। কিন্তু, যা লিখে আনবার ইচ্ছে ছিল, সে হয়ে ওঠেনি। একটা কারণ পূর্বেই উল্লেখ করেচি, তার চেয়েও বড় কৈফিয়ত আছে। মানুষের অল্পস্বল্প পাওয়ার কথাই মনে থাকে, তাই লিখতে গিয়ে দেখলাম কবির কাছে থেকে পাওয়ার হিসেব দিতে যাওয়া বৃথা। দফাওয়ারি ফর্দ মেলে না।

ছেলেবেলার কথা মনে আছে। পাড়াগাঁয়ে মাছ ধরে ডোঙা ঠেলে, নৌকো বেয়ে দিন কাটে। বৈচিত্র্যের লোভে মাঝে মাঝে যাত্রার দলে সাগরেদি করি, তার আনন্দ ও আরাম যখন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন গামছা-কাঁধে নিরুদ্দেশ যাত্রায় বার হই, ঠিক বিশ্বকবির কাব্যের নিরুদ্দেশযাত্রা নয়, একটু আলাদা। সেটা শেষ হলে আবার একদিন ক্ষতবিক্ষত পায়ে, নির্জীব দেহে ঘরে ফিরে আসি। আদর অভ্যর্থনার পালা শেষ হলে, আভিভাবকেরা পুনরায় বিদ্যালয়ে চালান করে দেন। সেখানে আর একদফা সম্বর্ধনা লাভের পর, আবার বোধোদয়-পদ্যপাঠে মনোনিবেশ করি, আবার একদিন প্রতিজ্ঞা ভুলি, আবার দুষ্টা-সরস্বতী কাঁধে চাপে, আবার সাগরেদি শুরু করি, আবার নিরুদ্দেশযাত্রা—আবার ফিরে আসা, আবার তেমনি আদর আপ্যায়ন সম্বর্ধনার ঘটা। এমনি বোধোদয়, পদ্যপাঠ ও বাঙ্গালা জীবনের এক অধ্যায় শেষ হল। এলাম শহরে। একমাত্র বোধোদয়ের নজিরে গুরুজনেরা ভর্তি করেছিলেন ছাত্রবৃত্তি ক্লাসে। তার পাঠ্য—সীতার বনবাস, চারুপাঠ, সদ্ভাবশতক ও মস্ত মোটা ব্যাকরণ। এ শুধু পড়ে যাওয়া নয়, মাসিক সাপ্তাহিকে সমালোচনা লেখা নয়, এ পণ্ডিতের কাছে মুখোমুখী দাঁড়িয়ে প্রতিদিন পরীক্ষা দেওয়া। সুতরাং সসঙ্কোচে বলা চলে যে সাহিত্যের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটলো চোখের জলে। তারপর বহু দুঃখে আর একদিন সে মিয়াদও কাটলো। তখন ধারণাও ছিল না যে, মানুষকে দুঃখ দেওয়া ছাড়া সাহিত্যের আর কোন উদ্দেশ্য আছে।

যে পরিবারে আমি মানুষ, সেখানে কাব্য উপন্যাস দুর্নীতির নামান্তর, সঙ্গীত অস্পৃশ্য। সেখানে সবাই চায় পাস করতে এবং উকীল হতে। এরি মাঝখানে আমার দিন কেটে চলে। কিন্তু হঠাৎ একদিন এর মাঝেও বিপর্যয় ঘটলো। আমার এক আত্মীয় তখন বিদেশে, তিনি এলেন বাড়ি। তাঁর ছিল সঙ্গীতে অনুরাগ, কাব্যে আসক্তি; বাড়ির মেয়েদের জড় করে তিনি একদিন পড়ে শোনালেন রবীন্দ্রনাথের ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’। কে কতটা বুঝলে জানিনে কিন্তু যিনি পড়ছিলেন তাঁর সঙ্গে আমার চোখেও জল এলো। কিন্তু পাছে দুর্বলতা প্রকাশ পায়, এই লজ্জায় তাড়াতাড়ি বাহিরে চলে এলাম। কিন্তু কাব্যের সঙ্গে দ্বিতীয়বার পরিচয় ঘটলো এবং বেশ মনে পড়ে এইবারে পেলাম তার প্রথম সত্য পরিচয়। এরপরে এ বাড়ির উকিল হবার কঠোর নিয়ম-সংযম আর ধাতে সইলো না, আবার ফিরতে হলো আমাদের সেই পুরোনো পল্লী-ভবনে। কিন্তু এবার বোধোদয় নয়, বাবার ভাঙ্গা দেরাজ থেকে খুঁজে বের করলাম ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’। আর বেরোলো ‘ভবানী পাঠক’। গুরুজনদের দোষ দিতে পারিনে, স্কুলের পাঠ্য ত নয়, ওগুলো বদ্-ছেলের অ-পাঠ্য পুস্তক। তাই পড়বার ঠাঁই কোরে নিতে হোলো আমার বাড়ির গোয়াল ঘরে। সেখানে আমি পড়ি, তারা শোনে। এখন আর পড়িনে, লিখি। সেগুলো কারা পড়ে জানিনে। এক ইস্কুলে বেশী দিন পড়লে বিদ্যে হয় না, মাস্টারমশাই স্নেহবশে এই ইঙ্গিতটুকু দিলেন। অতএব আবার ফিরতে হোলো শহরে। বলা ভাল, এর পরে আর ইস্কুল বদলাবার প্রয়োজন হয়নি। এইবার খবর পেলাম বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলীর। উপন্যাস-সাহিত্যে এর পরেও যে কিছু আছে, তখন ভাবতেও পারতাম না। পড়ে পড়ে বইগুলো যেন মুখস্থ হয়ে গেল। বোধ হয় এ আমার একটা দোষ। অন্ধ অনুকরণের চেষ্টা না করেছি যে নয়। লেখার দিক দিয়ে সেগুলো একেবারে ব্যর্থ হয়েছে কিন্তু চেষ্টার দিক দিয়ে তার সঞ্চয় মনের মধ্যে আজও অনুভব করি।

তারপরে এলো ‘বঙ্গদর্শনে’র নবপর্যায়ের যুগ। রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ তখন ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্চে। ভাষা ও প্রকাশভঙ্গীর একটা নূতন আলো এসে যেন চোখে পড়লো। সে দিনের সেই গভীর ও সুতীক্ষ্ণ আনন্দের স্মৃতি আমি কোন দিন ভুলবো না। কোন কিছু যে এমন করে বলা যায়, অপরের কল্পনার ছবিতে নিজের মনটাকে যে পাঠক এমন চোখ দিয়ে দেখতে চায়, এর পূর্বে কখন স্বপ্নেও ভাবিনি। এতদিনে শুধু কেবল সাহিত্যের নয়, নিজেরও যেন একটা পরিচয় পেলাম। অনেক পড়লেই যে তবে অনেক পাওয়া যায়, এ কথা সত্য নয়। ওই ত খানকয়েক পাতা, তার মধ্য দিয়ে যিনি এতবড় সম্পদ সেদিন আমাদের হাতে পৌঁছে দিলেন, তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা পাওয়া যাবে কোথায়?

এর পরেই সাহিত্যের সঙ্গে হলো আমার ছাড়াছাড়ি। ভুলেই গেলাম যে জীবনে একটা ছত্রও কোনও দিন লিখেছি; দীর্ঘকাল কাটলো প্রবাসে,—ইতিমধ্যে কবিকে কেন্দ্র করে কি করে যে নবীন বাঙ্গালা সাহিত্য দ্রুতবেগে সমৃদ্ধিতে ভরে উঠলো আমিই তার কোনও খবর জানিনে। কবির সঙ্গে কোনও দিন ঘনিষ্ঠ হবারও সৌভাগ্য ঘটেনি, তাঁর কাছে বসে সাহিত্যের শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পাইনি, আমি ছিলাম একেবারেই বিচ্ছিন্ন। এইটা হলো বাইরের সত্য, কিন্তু, অন্তরের সত্য সম্পূর্ণ বিপরীত। সেই বিদেশে আমার সঙ্গে ছিল কবির খান-কয়েক বই—কাব্য ও কথা-সাহিত্য এবং মনের মধ্যে ছিল পরম শ্রদ্ধা বিশ্বাস। তখন ঘুরে ঘুরে ঐ ক’খানা বই-ই বার বার করে পড়েছি,—কি তার ছন্দ, ক’টা তার অক্ষর, কাকে বলে art, কি তার সংজ্ঞা, ওজন মিলিয়ে কোথাও কোনও ত্রুটি ঘটেছে কিনা—এ-সব বড় কথা কখনো চিন্তাও করিনি—ও-সব ছিল আমার কাছে বাহুল্য। শুধু সুদৃঢ় প্রত্যয়ের আকারে মনের মধ্যে এইটুকু ছিল যে, এর চেয়ে পূর্ণতর সৃষ্টি আর কিছু হতেই পারে না। কি কাব্যে, কি কথা-সাহিত্যে আমার ছিল এই পুঁজি।

একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ যখন সাহিত্য-সেবার ডাক এলো, তখন যৌবনের দাবী শেষ করে প্রৌঢ়ত্বের এলাকায় পা দিয়েছি। দেহ শ্রান্ত, উদ্যম সীমাবদ্ধ—শেখবার বয়স পার হয়ে গেছে। থাকি প্রবাসে, সব থেকে বিচ্ছিন্ন, সকলের কাছে অপরিচিত, কিন্তু আহ্বানে সাড়া দিলাম—ভয়ের কথা মনেই হলো না। আর কোথাও না হোক, সাহিত্যে গুরুবাদ আমি মানি।

রবীন্দ্র-সাহিত্যের ব্যাখ্যা করতে আমি পারিনে, কিন্তু ঐকান্তিক শ্রদ্ধা ওর অন্তরের সন্ধান আমাকে দিয়েছে। পণ্ডিতের তত্ত্ববিচারে তাতে ভুল যদি থাকে ত থাক, কিন্তু আমার কাছে সেই সত্য হয়ে আছে।

জানি রবীন্দ্র-সাহিত্যের আলোচনায় এ-সকল অবান্তর, হয়তো বা অর্থহীন, কিন্তু গোড়াতেই আমি বলেছি যে, আলোচনার জন্য আমি আসিনি, এর সহস্র ধারায় প্রবাহিত সৌন্দর্য, মাধুর্যের বিবরণ দেওয়াও আমার সাধ্যাতীত, আমি এসেছিলাম শুধু আমার ব্যক্তিগত গোটা-কয়েক কথা এই জয়ন্তী-উৎসবসভায় নিবেদন করে দিতে।

কাব্য, সাহিত্য ও কবি রবীন্দ্রনাথকে আমি যেভাবে লাভ করেছি, তা জানালাম। মানুষ-রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে আমি সামান্যই এসেছি। কবির কাছে একদিন গিয়েছিলাম বাঙ্গালা সাহিত্যে সমালোচনার ধারা প্রবর্তিত করার প্রস্তাব নিয়ে। নানা কারণে কবি স্বীকার করতে পারেন নি, তার একটা হেতু দিয়েছিলেন যে, যার প্রশংসা করতে তিনি অপারক, তার নিন্দে করতেও তিনি তেমনি অক্ষম। আরও বলেছিলেন যে, তোমরা যদি এ কাজ কর, কখনো ভুলো না যে, অক্ষমতা ও অপরাধ একবস্তু নয়। ভাবি, সাহিত্য-বিচারে এই সত্যটা যদি সবাই মনে রাখতো!

কিন্তু, এই সভার অনেকখানি সময় নষ্ট করেছি, আর না। অযোগ্য ব্যক্তিকে সভাপতি নির্বাচন করার এটা দণ্ড। এ আপনাদের সইতেই হবে। সে যাই হোক, রবীন্দ্র-জয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে এ সমাদর ও সম্মান আমার আশার অতীত। তাই সকৃতজ্ঞচিত্তে আপনাদিগকে নমস্কার জানাই।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ১৩৩৮ সালে ‘রবীন্দ্র-জয়ন্তী’ উপলক্ষে পঠিত।