» » ‘বুলবুলে’র কবি

‘বুলবুলে’র কবি

ফরাসি জাদুকর আনাতোল ফ্রাঁস ঘটনাটি এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন,—জীবনের সায়াহ্নে বিসমার্ক শহর ছাড়িয়া গ্রামে (Villa-তে) আসিয়া বাস করিতেছিলেন, কর্মক্লান্ত জীবনের শেষ শান্তিকে এখানেই গ্রহণ করিবেন এই আশায়। একদিন ভোরবেলা বৃদ্ধ বিসমার্ক বারান্দায় ইজিচেয়ারে একাকী বসিয়া আছেন। সম্মুখে শ্যাম বনানী, বনের গাছে গাছে তখন কচি পল্লবে সবুজের বান ডাকিয়াছে—বনে বসন্ত আসিয়া পড়িয়াছিল। ভোরের আলো বনের মাথায় মাথায় ছড়াইয়া পড়িয়াছে—দুই চোখ মেলিয়া তিনি তাহাই দেখিতেছিলেন। ধীরে ধীরে চোখের দুই কোণে দুই ফোঁটা অশ্রু জমিয়া উঠিল। বৃদ্ধ বিসমার্ক বলিয়া উঠিলেন— ‘হায়, আমার জন্য—শুধু আমারই জন্য ইউরোপের তিন তিনটা যুদ্ধ হল।’ স্বর ভাঙিয়া পড়িল, আর্তস্বরে বৃদ্ধ কাঁদিয়া উঠিলেন—‘এত অফুরন্ত জীবন আমার গ্রামের, এই বনখানিতে সঞ্চিত রয়েছে, আর আমি হতভাগ্য, এমনি করে জীবন থেকে বঞ্চিত হলাম। Oh, I have lost my life!’

জীবনের শেষদিনে আমি আমার জীবন হারাইয়াছি,—হায়, আমি জীবন হারাইয়াছি—এই বলিয়া বিসমার্ক যে দুই ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন করিয়াছিলেন, তার মাঝে তাঁর সমস্ত অগণিত কীর্তি তুচ্ছ হইয়া ডুবিয়া গিয়াছে। দুই ফোঁটা অশ্রুর কাছে বিসমার্কের বাকি সমস্তটা জীবন হার মানিল। বিসমার্ক শেষ হইয়াছেন—তাঁর কর্মকীর্তি ধুলায় ধূসর হইয়াছে—কালের চাকার নিষ্পেষণ সহিবার ক্ষমতা তাদের ছিল না। কিন্তু এই দুই ফোঁটা চোখের জলের সাথে পরমাণু নিয়া মহাকালের লড়াই চলিল—চোখের জলের কাছে মহাকালই একদিন ক্লান্তিতে হাঁটু গাড়িয়া হার মানিবে। অনন্তকালের চোখে এই দুই ফোঁটা জল অশ্রু হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। বিসমার্ক চোখের দুই ফোঁটা জলে মহাকালকে ভুলাইয়াছেন—আজ চোখের জল অমর হইয়া রহিল। চিরন্তন ক্রন্দসীর ক্রন্দনের অশ্রুমালার এই দুই ফোঁটা জল ফুল হইয়া দুলিয়া রহিল। এমনই হয় —

কাজী নজরুল ইসলাম সম্বন্ধে লিখিতে গিয়া আনাতোলের এই কথা কেন মনে হইল—তাহাই বলি। নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবি বলিয়াই পরিচিত। ‘বিদ্রোহী’র কবি তিনি—কাজেই তাঁর সৃষ্টি তাঁর বিশেষণ হইয়া তাঁর নামের সঙ্গে আসিয়াছে। সৃষ্টি দিয়াই সৃষ্টিকর্তাকে চিনি। এবং সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টি উভয়কেই আমরা এক সঙ্গে এমনই করিয়া স্মরণ করি। নজরুলকে ‘বিদ্রোহী’র কবি না বলিয়া ‘বিদ্রোহী’ কবি বলাই উচিত কি না সে প্রশ্ন এখানে তুলিতে চাহি না; আমার বক্তব্য স্বতন্ত্র।

‘বিদ্রোহী’তে বিসমার্কের মতোই কবি আপন শক্তির নেশায় একদিন মশগুল হইয়া উঠিয়াছিলেন,—‘আমার সমুন্নত শির সৃষ্টির সীমা উল্লঙ্ঘন করিয়া সৃষ্টির বাহিরে বহু বহু ঊর্ধ্বে সীমা হারাইয়া ফেলিয়াছে—যেখানে অস্তিত্ব পর্যন্ত নাই—এত দূরে।’

সৃষ্টিকে ধ্বংস করিয়া যে বিধাতার মাথা ডিঙাইয়া গেল, সে বিদ্রোহী, কিন্তু তবু মানুষের কাছে বড় হইতে পারিল না। কারণ মানুষ জানে যে, এই বিপুল কীর্তির পরমায়ু মহাকালের পলকের ফুৎকারে নিভিয়া যাইবে, অনন্ত দিনের ঝড়-ঝঞ্ঝা সহিবার মত ক্ষমতা বিদ্রোহীর সমুন্নত কীর্তিস্তম্ভের নাই। বিধাতার সৃষ্টিকে ধ্বংস করিয়া বিধাতার সঙ্গে লড়াই করা চলে, কিন্তু মহাকালের দরবারে তাতে বিন্দুমাত্র বিক্ষোভ ওঠে না। তাই বিদ্রোহীকে বিস্ময়ের চোখেই দেখা যায়, ভয় ও শ্রদ্ধাও যে একটা না থাকে এমন নয়। কিন্তু ভালবাসার মাঝে যে শুচিস্নান না করিয়া আসে সে তো অমর হইতে পারে না।

বিসমার্কের অমর কীর্তি দুই ফোঁটা চোখের জল যেমন তাঁর জীবনের শেষ দিনের প্রতীক্ষায় ছিল, তেমনি কিছু একটা বিদ্রোহীর বিদ্রোহেও যেন চুপ করিয়া ছিল। ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি’ এই কথায় তাহার পূর্বাভাস আছে, কিন্তু সম্যক প্ৰকাশ নাই, কারণ আর এক হাতের রণতূর্যই তখন ভীষণ গুরুগর্জনে বাজিয়া উঠিতেছিল।

বাঁশি নীরব হইয়াই ছিল, কিন্তু বিদ্রোহীর অশান্ত তূর্যের ভৈরব গর্জন বাঁশির বুকের কবর-চাপা ঘুমন্ত সুরে মাঝে মাঝে প্রতিধ্বনি তুলিয়াছে—যেমন আকাশের গুরু গুরু মেঘগর্জন নিশীথনীপ-শাখায় ঘুমন্ত শিখীর কণ্ঠে আচমকা প্রতিধ্বনি তোলে— তেমনি তাই তো বিদ্রোহীর হাইদরি হাঁকের এক প্রান্তে একটি করুণ অশ্রুমুখী সুরধ্বনিকে দেখিতে পাই, শুনি—

আমি
গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি
ছল করে দেখা অনুখন,
আমি
চপল মেয়ের ভালবাসা তার
কাঁকন চুড়ির কনকন।

তখনই মন বলে, বিদ্রোহীর রণতূর্যে তোমার সত্যিকার পরিচয় নয়। দেশের, সমাজের জন্য তোমার এই বিদ্রোহের হয়ত অনেকখানিই প্রয়োজন আছে, যেমন আগ্রার দুর্গের একদিন প্রয়োজন ছিল, মুঘল সাম্রাজ্যের খবরদারি করিবার। কিন্তু মহাকালের কাছে তাহা অকিঞ্চিৎকর, তার প্রচণ্ড চরণপাতে আগ্রার বিশাল দুর্গের মতই বিদ্রোহী তুমি একদিন ধুলায় রেণু রেণু হইয়া ছড়াইয়া লুপ্ত হইয়া যাইবে। তোমার বাঁশি আছে তার প্রয়োজন নাই সত্য, যেমন তাজমহলের প্রয়োজন নাই, কিন্তু সেই বাঁশিতে যে সুর লুকাইয়া রাখিয়াছ তাহাকে মুক্ত করো, যে সুরের তালে তালে মহাকাল তার প্রেয়সীর জন্য কান্নার গানখানি গাহিবে। বাঁশিই তোমাকে বিসমার্কের চোখের জলের মত অমর করিবে, তোমাকে তখনই আমরা বড় বলিয়া স্বীকার করিব, যখন তুমি বিদ্রোহের সু-উচ্চ সুর নমিত করিয়া কাঁদিয়া বলিবে—‘ঐ এক ফোঁটা শিশু-পল্লবে অনন্ত জীবন সঞ্চিত রয়েছে, ওগো তৃষ্ণাতুর মানব, তুমি তাকে বন্দী করো, তাকে উপেক্ষা করো না; তবে জীবন হারাবে—বঞ্চিত হবে এ জীবনে।’ তখন আমরাও বলিব—‘ওগো কবি তোমার কণ্ঠে সে সুর বাজে, মহাকালের বীণায় তার অনন্ত প্রতিধ্বনি ওঠে।

বিশ্বের এই বিচিত্র গন্ধ-বর্ণের অবগুণ্ঠন টানিয়া যে চিরন্তন ক্রন্দসী আত্মগোপন করিয়া রহিয়াছে তাহাকে আবিষ্কার করাই কবির কাজ। নিখিলের এই প্রকাশের যবনিকা উত্তোলন করিলে দেখা যায় যে, এই রূপ-রস-গন্ধের অন্তরালে একটা চিরন্তন কান্নার ফল্গুধারা অনন্তকাল প্রচ্ছন্ন হইয়া বহিতেছে। শ্রেষ্ঠ যে কবি, সে এই অবগুণ্ঠন মুহুর্মুহু উন্মোচন করিতে প্রয়াস পায়—এই সৃষ্টির আড়ালে যে রহিয়াছে, তাহাকে সৃষ্টির সামনে প্রকাশিত করে। কবি হিসাবে কাজী নজরুল এ-দিক দিয়া কতখানি সার্থক হইয়াছেন, তাহাই বিচার করিব।

কথাটা অবান্তর হইলেও না বলিয়া পারিলাম না। একাধারে এমন লাঞ্ছিত ও সমাদৃত, নজরুলের মত আধুনিক কবিদের মধ্যে অল্পই আছে। কবির কণ্ঠে কুসুমের মালার পরিবর্তে নজরুলের ভাগ্যদোষে তাহা কণ্টকেই ভরিয়া আছে, এই কণ্টকমালার প্রতি কণ্টকমুখে যে জ্বালা বিচ্ছুরিত হয়, তাহার দাহে হয় মানুষ মরে, নয় গরলপায়ী নীলকণ্ঠের মতই অমর হয়। বিধাতা তার সুখ-দুঃখের চাকা মানুষের অদৃষ্টের পথে পর্যায়ক্রমে ঘুরাইয়া নিয়া ফিরিতেছে—যেমন আকাশপথে দিবস-রাত্রি একের পর অপরে পালা করিয়া ঘুরিয়া মরে। দুঃখের চাকা শেষ পাক খাইয়া যখন অদৃশ্য হইবে, সেদিন যে কবির কণ্ঠের কণ্টক-মালার প্রতিটি কাঁটা গোলাপ হইয়া পলকে ফুটিয়া উঠিবে—এ তো মিথ্যা দুরাশা নয়।

কবি নজরুলের লেখায় ফিলজফি নাই—একটা নালিশ তাঁর সম্বন্ধে শোনা যায়। এ অভিযোগ সত্যি হইলে দুঃখ নাই—মিথ্যা হইলে তো কথা থাকে না। তবু কথাটা না থাকাই উচিত। যাহা কবির লেখায় নাই তাহার জন্য তাহাকে অপরাধী করিয়া বড় জোর গালমন্দ দেওয়া যায়, নিন্দা করা যায়; কিন্তু কবিকে চেনা যায় না। যাহা তাঁহার আছে, তাহাই দিয়াই তাঁহাকে চিনিতে হইবে। মরুভূমির কাছে জল চাহিলে সে মরীচিকার ছলনাই করে—পিপাসা মিটায় না। নজরুল কবি, ফিলজফি চাহিলে চলিবে কেন? তাঁর কাছে যাহা চাহিতে হয় তাহা নিয়াই সমালোচনা তো করিতে হইবে।

নজরুলের প্রতি রক্তবিন্দুটি ভালবাসায় রক্তরঙিন। ভালবাসা নিয়া তিনি দর্শনশাস্ত্র রচনা করেন নাই, ব্যথায় গানই গাহিয়াছেন। রামগিরির বিরহী যক্ষ ইচ্ছা করিলে আষাঢ়ের প্রথম মেঘমালার কাছে বিরহের একটা বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক রূপ বর্ণনা করিতে পারিতেন, কিন্তু মেঘের হাতে তাঁর অন্তর-ব্যথা সমর্পণ করিতে পারিতেন না। আজও প্রতি বর্ষ মেঘদূতের হাতে সেই আদিম বিরহীর বিরহলিপি দেখিয়া এত দিন পরেও সভ্যজগতের সুখী মানবও বিমনা হয়। যাক—যাহা বলিতেছিলাম।

নজরুল প্রেমিক কবি। এই ধুলোমাটির তুচ্ছ মানুষের প্রেমই তাঁর সম্পদ। তাঁর সমস্ত কবিতা রক্ত-মাংসের মানুষের ব্যথায় ও কামনায় ভরপুর। সে ব্যথা যে পায় নাই—সেই অরূপ ব্যথার গান বিনাইয়া বিনাইয়া সে গাহে নাই। নিত্যকার মানুষ যে ব্যথা পায়—কাঁদিয়া আকুল হয়—তাহারই ব্যথায় সিন্ধু মথিত করিয়া কবির কাব্য জন্ম নিয়াছে।

সর্বশেষে তাহাই বলি প্রথমেই যে কথা বলা উচিত ছিল নজরুলের লেখার সমালোচনা-প্রসঙ্গে। নজরুল যৌবনের কবি। যৌবনের যে দিকটা খ্যাপা রুদ্রের মতই ধ্বংস-মাতাল, সেদিকের সাথে কবিকে আমরা যে ডমরু বাজাইতে শুনিয়াছি তাহা অতুলনীয়। দেশের অধীনতা ও সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযান আজ বাংলা সাহিত্যের গর্বের সামগ্রী।

যৌবনের অপর দিক—যেদিকে যৌবনের প্রতি পদক্ষেপে, সৃজনের নব নব শতদল রূপের সঙ্গে অসংখ্য জয়ধ্বনি তুলিয়া সারি বাঁধিয়া ফুটিয়া ওঠে, সে দিকের কথা বলিতে গিয়া প্রথমেই মনে পড়ে বিদ্রোহীর আত্মসমৰ্পণ—

হে মোর রাণী, তোমার কাছে

হার মানি আজ শেষে।

বিদ্রোহী শান্ত হইয়াছে, তার রাণীর কাছে নত হইয়া পরাজয় ভিক্ষা মাগিতেছে। পদতলে নত যৌবন অঙ্গুলি ইঙ্গিতে দেখাইতেছে ‘এই সমরজয়ী অমর তরবারি’ এই ক্লান্ত মুঠিতে শিথিল হইয়া আসিয়াছে, ঐ দেখ বিদ্রোহীর রক্তরথের চূড়ায় তোমার নীলাম্বরী পতাকা হইয়া দুলিতেছে। আমি হার মানি, ওগো রাণী, আমি হার মানি। বিদ্রোহী, যৌবনের এই পরাজয়, এই হার মানাই তোমার গলার হার হোক।

এই হার মানার সাথে রবীন্দ্রনাথের ‘আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর’ কবিতার পরম মিল আছে। সেখানেও যুদ্ধঅস্ত্র ধনুঃশর ফেলিয়া ভূতলে রাণীর রক্তপদতলে প্রেমিক ভিক্ষা মাগিতেছে—আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর, আমি তব স্বেচ্ছাবন্দী দাস।

এই ‘শ্যামলা বিপুল ধরণীর পানে’ চাহিয়া কবি মুগ্ধ মনে যে গান গাহিয়াছে, তাহার তুলনা নাই। এই গন্ধ—বরণের যবনিকার অন্তরালে থাকিয়া সে চিরন্তন প্রেয়সী ডাকে—এ হার মানি, তারই জওয়াব।

কবির গানখানি কহিবার আগে আইরিশ কবি ইয়েট্‌সের একটা গ্রাম্য কবিতা মনে পড়িল। মাঠের পথে গ্রাম্য বালা একা গাহিয়া চলিয়াছে—ওগো আমার প্রিয়, আমি তো দিকে দিকে আমার সন্ধান সমেত ছড়াইয়া রাখিয়াছি, তবু তুমি আমার কাছে আসিতে পারিলে না, সে কি আমার অপরাধ? বসন্তের বনভূমিকে জিজ্ঞাসা করো, সে আমার সন্ধান জানে; হেমন্তের গোধূলি-বেলায় আমার সোনার লিখন-পথের সঙ্কেত কহে; বর্ষাদিগন্তের শ্রাবণ-রেখায় দিগবধূ আমারই দেশের পথ দেখায়; ধরণীর তৃণে তৃণে আমার সোনার পুরীর অভিমুখে গোপন পথ পড়িয়াছে—তুমি যদি তাহা না জানো, সে কি আমার অপরাধ প্রিয়, সে কি আমার অপরাধ! এই হইল আইরিশ কবির সে কবিতার মূল সুর!

নজরুলের গানখানি এই—

আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায় কে গো দরদি?

খুলে দাও রঙমহলার তিমির দুয়ার ডাকিলে যদি।

যদি ডাকিলে, তবে নিখিলরাণী, তোমার এই বিচিত্র রূপরঙিন তিমির-দুয়ার খোলো, খোলো, রাণী, তোমার দুয়ার খোলো। শুনিয়াই রবীন্দ্রনাথের সে কথা মনে পড়ে—‘কে দিয়াছে হেন শাপ কেন ব্যবধান? / কেন কাঁদে ঊর্ধ্বে চেয়ে ব্যর্থমনোরথ?’ আরও মনে পড়ে রাধিকাকে ক্রোড়ে লইয়া বিরহভিতু কৃষ্ণের কান্না। সেখানেও প্ৰশ্ন—‘কে দিয়াছে হেন শাপ কেন ব্যবধান?’

কবি কাঁদিয়া চলিয়াছে, গুলবাগিচায় চৈতী হাওয়ায় তোমার লিপি পাঠাইয়াছ—সে খবর কহিতে গিয়া কোকিল ডাকিয়া ডাকিয়া চোখদুটি লাল করঞ্জা করিয়া ফেলিল। ওগো আমার দরদি!

পাঠালে ঘূর্ণি-দূতী ঝড়-কপোতী বৈশাখে সখি,

বরষায় সেই ভরসায় মোর পানে চায় জলভরা নদী।

‘বরষায় মোর পানে চায় জলভরা নদী—একটি সুরের টানে কবি অনন্ত দিনের বিরহিণীর যে ছলছল আঁখির ছবি আঁকিয়াছে, এর তুলনা নাই; এ অনবদ্য—অপূর্ব।

কবির গান চলে—

পউষের শূন্য মাঠে একলা বাটে চাও বিরহিণী,

দুহুঁ হায় চাই বিষাদে মধ্যে কাঁদে তৃষ্ণা জলধি।

তোমার আর আমার মাঝে বহিয়া চলিয়াছে হায়, কোন অজানা অভিশাপের মত এই তৃষ্ণার জলধি। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের কথা—

মিলনের পাত্রটি পূর্ণ যে বিচ্ছেদ বেদনায়;

এই চিরন্তন তৃষ্ণাজলধির ব্যবধান—এই দুস্তর বিরহ কেমন করিয়া পার হই—তখনই মানবাত্মা কাঁদিয়া আকুল হইয়া লুটাইয়া পড়ে—‘ওগো, দুহুঁ হায় চাই বিষাদে মধ্যে কাঁদে তৃষ্ণা জলধি।’ এই গানের ছোঁয়া লাগিয়া বুকের মাঝে যেন কেমন একটা ব্যথা তিরতির করিয়া কণ্ঠ পর্যন্ত ফেনাইয়া ওঠে; যাকে পাই নাই কোন দিন, যাকে হারাই নাই কখনও—তার জন্যই কেমন একটু অবুঝ ব্যথা এমনই সত্য হইয়া উঠে যে, ঊর্ধ্বের তিমির আকাশে দেখি অন্ধকার কাঁদিয়া কাঁদিয়া উঠিতেছে, দেখি—

তারায় তারায় খোঁজে তৃষ্ণায় আতুর অন্ধকার সঙ্গ সুধারস।

— রবীন্দ্রনাথ

কিন্তু কবি আশ্বাস শুনায়—ওরে মন, এই ভোরের মলয়ার সাথে বলয় বন্ধন হউক তোমার এই তিমির-দুয়ার চিরবন্ধ রহিবে আর কতকাল?

মানুষ, রক্তমাংসে সে সীমাবদ্ধ মানুষ—এই বোধ যখন তার হয়, তখন সে আবিষ্কার করে যে, বিশ্বের এই অস্তিত্বের পিছনে একটা মর্মান্তিক ব্যথার নদী চিরবহমান—সে ধারা নিয়তির মতই অমোঘ—দুর্বার নিষ্ঠুর। সে নদীর ছলছল গানের সাথেই সব কবি তাল রাখিয়া তাদের বীণার তার বাঁধে। কাজী নজরুল সে ব্যথা বারিধির অনন্ত কলধ্বনিকে বুক ভরিয়া আনিয়াছে।

সব কবিরই এই ব্যথাই মূলধন। রবীন্দ্রনাথ এই ব্যথার আঘাতে কাঁদিয়া ধাবমান বলাকার পলাতক পাখার স্পন্দনে আকুল হইয়া কহিলেন—

হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনখানে।

এই ব্যথার সাধনায় রবীন্দ্রনাথ ঋষির মতোই সত্যদ্রষ্ট হইয়াছেন। পৃথিবীকে এক ক্ষণভঙ্গুর মাটির ভাণ্ড হইতে ঊর্ধ্বে—বহু ঊর্ধ্বে অমৃতের সন্ধানে চোখ ফিরাইতে কহিয়াছেন। এ-দিক দিয়া রবীন্দ্রনাথ অপ্রতিদ্বন্দ্বী, বিশ্বকে বিশ্বাতীত আশ্রয়ে পথ দেখাইয়া দিয়াছেন তিনি।

কিন্তু ব্যথার আঘাতে নজরুল এই চোখের জলে সিক্ত সুন্দর ধরণীকে ছাড়িয়া যায় নাই। সে জানে বিরাট মৃত্যুর ভাঙনকূলে সৃষ্টির ঘর। খণ্ড পরমায়ুর আশ্রয়গুলি মুহুর্মুহু হইবে, মৃত্যুর কালো জলের ডাক ঐ শুনা যায়, ততই সে বেশি করিয়া ভালবাসিয়াছে। এই ধূলিমাটির বেদনার বন্ধনকে আরও সবলে জড়াইয়া ধরিয়াছে।

রবীন্দ্রনাথের ব্যথায় উদাসীন বৈরাগীর নির্লিপ্ত নির্বিকার শান্তির আভাস আছে; কিন্তু নজরুলের ব্যথায় মৃত্যুশীতল মানুষের হারাইবার বেদনা, পাইয়া না রাখিতে পারার জ্বালা আছে। ব্যথা সে পাইয়াছে—ইহাই তাহার কাছে সত্য, তাই ধরণীর গাত্রে আর কোন সান্ত্বনার মিথ্যা আবরণ সে পরায় নাই।

রবীন্দ্রনাথ—‘বেলা যে পড়ে এল জলকে চল’ কবিতায় একটা ব্যথাতুর মানবাত্মার মুক্তি-কান্নাকে বাঁধিয়া দিয়াছেন। কিন্তু এই কান্নার অন্তরালে একটা বিবাগী বাউল যে আপন মনে অতি সঙ্গোপনে একতারা বাজাইয়া চলিয়াছে—তাহা যেন আভাসের মত টের পাওয়া যায়। ‘কবে ফুরাবে সব খেলা জানিস্ যদি বল’ শেষের মধ্যে নিজের এই ব্যথার একটা সমাপ্তি রবীন্দ্রনাথ চাহিয়াছেন—নিজকে শেষের একটা রূপহীন কায়াহীন নির্বিকার শান্তির ছোরা দিয়া ব্যথাকে হত্যা করিয়াছেন।

নজরুল প্রকৃতিতে রবীন্দ্রনাথ হইতে স্বতন্ত্র—-একটা শেষের সন্ধান যে চাহে নাই। ব্যথা তার এত প্রবল যে শেষকে পর্যন্ত কামনা করিবার অবকাশ থাকে না। সে এই ব্যথামাখা প্রেমিকের চোখে পৃথিবীকে দেখিয়াছে—আর দেখিয়াই চলিয়াছে। নিম্নের সন্ধ্যার এই গানখানিতে ‘বেলা যে পড়ে এল জলকে চল’–সে সুরও আছে, নারীর যৌবন-জোয়ারের পানি না ফিরে গো আর, যৌবনের এই আসন্ন ভাঁটার ভীতি আছে, সঙ্গে সঙ্গে প্রেমিকের বেদনা আছে। অবশ্য কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ’ কবিতার সাথে একই স্তরে রাখিয়া বিচার করা চলে না—কারণ দুটি দুধরনের কবিতা।

এই কবিতার সুর একটি নিরবচ্ছিন্ন সুর নহে। কোন্ খেয়ালি অসাবধানে বিরহ মিলনের তার দুটির সাথে বৈরাগ্যের একটু রেশ জড়াইয়া রাখিয়া গিয়াছে যে, ছড় চালাইলেই একটা অপূর্ব কান্না হৃদয়ের রন্ধ্রে মোচড় খাইয়া ওঠে, কবি কহে—

বসিয়া বিজনে
কেন একা মনে
পানিয়া ভরনে
চল লো গোরী।

তারপরে যে সুরটুকু আসে, তাহা যে ঐ একাকিনীর ব্যথাটুকুই শুধু আনে, তা নয়, এই মূক বোবা প্রকৃতির সাথে ব্যথাতুর মানবাত্মার কথার যে কানাকানি চলে, সে খবরটুকুও আনে। তাই শুনি

চল জলে চল
কাঁদে বনতল
ডাকে ছলছল
জললহরী।

ব্যথা এত নিবিড় হয় যে, বনতলে কান্না শুনা যায়—তার জন্য যে গাগরি কাঁখে জলকে এই পথে যাইবে। গাঁয়ের নদীটি পর্যন্ত আঙ্গিনায় নীরব বধূটিকে বেলাশেষের সুরে ডাকে—ওগো, বেলা যে যায়, জলকে এস। ব্যথা কত একান্ত হইলে সন্ধ্যার বনতল ও নদীতরঙ্গে তাহা বিলানো চলে—তাহাই ভাবি।

তারপর কবি সন্ধ্যার যে ছবি দিয়াছে তাহা সত্যই রক্তমাংসের মানুষের ব্যথায় ও বেদনায় পুঞ্জিত। কবি ‘দিবা অবসান হল’ বলিয়া পূরবীর ম্লান বৈরাগ্য রাগিণী গাহে নাই। কিংবা —

ঐ যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কূলে

দিনের চিতা

বলিয়া একটা সীমাহীন মনের আবেগহীন নির্লিপ্ত মহান উদাসীনতাও প্রকাশ করে নাই।

কবি কহিল—

দিবা চলে যায়
বলাকা-পাখায়
বিহগের বুকে
বিগহী লুকায়,
কেঁদে চখাচখি
মাগিছে বিদায়
বারোয়ার সুরে
ঝুরে বাঁশরি।

সন্ধ্যার সমস্ত ছবি কবি বাদ দিল। নির্জন আঙিনায় একাকিনী যে বসিয়া আছে তাকে গিয়া কহিল,—‘দিবা চলিয়া যাইতেছে; সখি, বিহগের বুকে বিহগি লুকায়, চখাচখি কাঁদিয়া রাত্রির মত বিদায় লইতেছে।’ আর কোন কথা না কহিবার অর্থ কি? অন্য সমস্ত কথা বাদ দিয়া এই খবর দিবার মাঝেই কবির বিশেষত্ব। সন্ধ্যার ছবি ধীরে ধীরে চোখের উপর ভাসিয়া ওঠে। আর সবচেয়ে বড় কথা এই, যে ‘বিজনের একাকিনীকে’ কেন একা চুপ করিয়া বসিয়া আছে, ‘জলকে যাবে না’ বলিয়া প্রশ্ন করা হইয়াছিল, সন্ধ্যায় তার অন্তর-ব্যথা এই দুইটি ছবির মাঝে ধরা দিয়াছে—‘কেন’ প্রশ্নের উত্তরও দেওয়া হইয়াছে।

সন্ধ্যার এই ছবি চয়নে যে কৃতিত্ব কবি দেখাইয়াছে তাহা অনিন্দনীয়। সেই একই মনোভাব ও রুচি ছবি সংগ্রহ করিয়া চলিয়াছে—

সাঁঝ হেরে মুখ
চাঁদ-মুকুরে
ছায়াপথ-সিঁথি
রচি চিকুরে,

রসের দিক দিয়াই যে শুধু অপূর্ব তা নয়, বর্ণনার দিক দিয়াও এই কয় ছত্র সাহিত্যে অপূর্ব। তার পরে পাই—

নাচে ছায়া-নটী
কানন-পুরে,
দুলে লটপট
লতা-কবরী।

এখানেও চিত্র-নির্বাচনে প্রেমিক মনের সেই সূক্ষ্মতার আভাস পাই। ‘ছায়া-নটী’ ও ‘লতা-কবরী’ শব্দ দুইটির সাহায্যেই কবি বিচিত্র একটি প্রেমাতুর সন্ধ্যার ছবি চোখের সামনে ধরিয়া দিয়াছে; হয়ত দিনান্তে আঙিনার খুঁটি ধরিয়া আসন্ন অভিসারিকা রাধাও একদিন সন্ধ্যার বনতলের পানে চাহিয়া এই দৃশ্যই দেখিয়াছিলেন। সেই ছবি আরও প্রসারিত হয়—

‘বেলা গেল বধূ’
ডাকে ননদী
চল জল নিতে
যাবি লো যদি,
কালো হয়ে আসে
সুদূর নদী

‘বেলা গেল বধূ’ এবং ‘চল জল নিতে যাবি লো যদি’—ননদীর এই ডাকে মন কোন্ স্মরণাতীত অতীতের সন্ধ্যার সামনে গিয়া স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়ায়, যখন সে দেখে—

নাগরিকা সাজে
সাজে নগরী

শুধু ইহাই নয়। এই ‘ননদী’ শব্দ এবং ‘চল জল নিতে যাবি লো যদি’ শব্দে গাঁয়ের শান্ত নম্র সন্ধ্যাটি চোখের উপর অনাড়ম্বর মহিমায় ফুটিয়া ওঠে; পল্লীর মুদিত দিবসের সন্ধ্যার শান্তিখানি যেন মনকে আসিয়া স্পর্শ করে। সম্মুখে অবসন্ন রজনীর অন্তরালে ‘যেন ভিনগাঁর ভীরু মেয়ের’ অভিসার-পদধ্বনি শুনিতে পাই।

‘কালো হয়ে আসে সুদূর নদী’–এই ছত্রটির ব্যাখ্যা অসম্ভব। ইহা এমন একটি ভাবকে মনের মনে অনুভূতির মত শিহরণ তোলে যে, ভাষার আহরণে তাহাকে রূপ দিয়া বাহু বাড়াইয়া সম্মুখে আনা যায় না। অতি সুকুমার অনুভূতির ন্যায় মনের সর্বাঙ্গ পরিব্যাপ্ত হইয়া থাকে, যেমন শান্তনিশীথে নিস্তরঙ্গ সিন্ধুর বুকে একটা নিরবচ্ছিন্ন ‘ও—ও—ওম’ ধ্বনি কূল হইতে কূলে প্রসারিত হইতে থাকে। কালো হয়ে আসে সুদূর নদী— কম কবির কলমেই এমন অপূর্ব মায়া সৃষ্টি ধরা দেয়। সৌভাগ্যের মতই ইহা কদাচিৎ আসে।

এই সন্ধ্যার গানের শেষ হইল—

কারে ভেবে বেলা কাঁদিয়া কাটে

ভর আঁখিজলে ঘটগাগরী।

অনেক কিছু লিখিবার ছিল। আমি শুধু আর দুই স্থান হইতে তুলিয়া ক্ষান্ত হইব। ব্যথিতার গান—

কেন কাঁদে পরান কী বেদনায় কারে কহি,

সদা কাঁপে ভীরু হিয়া রহি রহি।

যাকে চাই, তার জন্য ব্যথা ও কামনাকে কেমন করিয়া বাহিরের বিশ্ব আমাদের বুক হইতে লুণ্ঠন করিয়া লয় তাহা দেখিবার বস্তু বটে। এ যেন ‘পঞ্চশরে দগ্ধ করে বিশ্বময়’ ছড়াইয়া দেওয়ার মত। তাই তো বিরহিণী ব্যথা এমন করিয়া নালিশ করে, নিজের অক্ষমতা জানায়—

সে থাকে নীল নভে আমি নয়ন—জল সায়রে,

সাতাশ তারার সতীন সাথে সে যে ঘুরে মরে,

কেমনে ধরি সে চাঁদে রাহু নহি।

কবি যাকে ভালবাসে, সে গোপন পায়ে বকুল ছায়ে যাতায়াত করে। সেই—

ঊষার রাগে সাঁঝের ফাগে

যুগল তাহার কপোল রাঙে

কমল দুলে সূরয্ শশী

নিশীথ চলে আঁধার রাশে।

সূর্যকে প্রেয়সীর খোঁপার ফুল করিয়া গুঁজিয়া দেওয়া কি-যে বিশ্বগ্রাসী তাই ভাবি। এই প্রেমিকই একদিন কহিয়াছিল—

সখি, মদনের বাণ হানা শব্দ শুনিস,

ও যে বিষমাখা মিশকালো দোয়েলার শিস।

সখি, তুমি বুঝি কান পাতিয়া মদনের বাণহানার শব্দ শুনিতেছ? ও তো বাণ নয়, ও যে কালো দোয়েলের শিস সই, ও মদনের বাণহানা শব্দ নয়; সখি, তোমার ভুল, বন মর্মরে শ্রীপতির পদধ্বনি বলিয়া ধ্রুবের যেমন ভুল হইয়াছিল তেমনই ভুল।

উপরিউক্ত দুই লাইনের তুলনা বাংলাতে কেন, যে-কোনো সাহিত্যেই হোক, অল্পই আছে—এ অতি দুঃসাহসিকের উক্তি হইতে পারে কিন্তু মিথ্যাবাদীর মিথ্যা ভাষণ নয় এ, তা জানি।

কবি বিশ্বরাণীকে কহিতেছে। যার কেশে রবি শশীর কমলকলি, অলক খোঁপায় গ্রহের মালা, সাঁঝের শাখায় কানন মাঝে যার বিহগ-কাঁকন বাজে তাঁকেই কবি মিনতি করিয়া কহিতেছে—

তোমার ‘লীলা—
কমল’ করে
নিখিল রাণী,
দুলাও মোরে।

এ ভক্তের নিবেদন নয়—এ প্রেমিকের আবেদন—

ঢুলাও আমার সুবাসখানি

তোমার মুখের মদির-শ্বাসে।

বাংলায় গজলের বহুল প্রচার সম্বন্ধে আমি অজ্ঞ নহি। তবু কবির বিদ্বেষীদের বলিতে চাই, বিদ্বেষ ও ঘৃণায় কান বন্ধ করিবেন না। তাদের কাননে যে বুল্‌বুলি উড়িয়া গেল, সে যে বড় ভীরু। দোস্তের মত আদরে বুকে লইতে না পারিলে বাগিচার মালিকের অপরাধে তার বুল্‌বুলির কণ্ঠ চাপিয়া নির্দয় হত্যা করিবেন না। একবার বুল্‌বুলের কণ্ঠ-শিসে গজল শুনুন। তারপর যদি ভাল না লাগে তবে সেই বুল্‌বুলই বন্ধু, তোমাকে এই বলিয়া আদাব জানাইবে—

স্বপনের স্মৃতি প্রিয়,

জাগরণে ভুলিও

ভুলে যেও দিবালোকে

রাতের এই আলেয়ারে!

অমলেন্দু দাশগুপ্ত