তের

নীচেকার ঘরের দরজা-জানালা ভারতী বন্ধ করিতে ব্যাপৃত রহিল, অপূর্ব সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া তাহার ঘরে প্রবেশ করিল, এবং ভাল দেখিয়া একটা আরামকেদারা বাছিয়া লইয়া হাত-পা ছড়াইয়া শুইয়া পড়িল। চোখ বুজিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আঃ! সে যে কতখানি শ্রান্ত হইয়াছিল তাহা উপলব্ধি করিল।

মিনিট-কয়েক পরে ভারতী উপরে আসিয়া হাতের আলোটা যখন তেপায়ার উপরে রাখিতেছে অপূর্ব তখন টের পাইল, কিন্তু সহসা তাহার এমন লজ্জা করিয়া উঠিল যে, এই ক্ষণকালের মধ্যে ঘুমাইয়া পড়ার ন্যায় একটা অত্যন্ত অসম্ভব ভান করার অপেক্ষা আর কোন সঙ্গত ছলনাই তাহার মনে আসিল না। অথচ, ইহা নূতন নহে। ইতিপূর্বেও তাহারা একঘরে রাত্রিযাপন করিয়াছে, কিন্তু শরমের বাষ্পও তাহার অন্তরে উদয় হয় নাই। মনে মনে ইহারই কারণ অনুসন্ধান করিতে গিয়া তাহার তেওয়ারীকে মনে পড়িল। সে তখন মরণাপন্ন, তাহার জ্ঞান ছিল না, সে যে না থাকার মধ্যেই, তথাপি সেই উপলক্ষ্যটুকুকেই হেতু নির্দেশ করিতে পাইয়া অপূর্ব স্বস্তিবোধ করিল। ভারতী ঘরে ঢুকিয়া তাহার প্রতি একবার মাত্র দৃষ্টিপাত করিয়া যে-সকল হাতের কাজ তখন পর্যন্ত অসম্পূর্ণ ছিল করিতে লাগিল, তাহার কপট নিদ্রা ভাঙ্গাইবার চেষ্টা করিল না, কিন্তু এই পুরাতন বাটীর সুপ্রাচীন দরজা-জানালা বন্ধ করার কাজে যে পরিমাণ শব্দ-সাড়া উত্থিত হইতে লাগিল, তাহা সত্যকার নিদ্রার পক্ষে যে একান্ত বিঘ্নকর তাহা নিজেই উপলব্ধি করিয়া অপূর্ব উঠিয়া বসিল। চোখ রগড়াইয়া হাই তুলিয়া কহিল, উঃ—এই রাত্রে আবার ফিরে আসতে হলো!

ভারতী টানাটানি করিয়া একটা জানালা রুদ্ধ করিতেছিল, বলিল, যাবার সময় এ কথা বলে গেলেন না কেন? সরকার-মশায়কে দিয়ে আপনার খাবারটা একেবারে আনিয়ে রেখে দিতাম!

কথা শুনিয়া অপূর্বর ঘুম-ভাঙ্গা গলার শব্দ একেবারে তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল, কহিল, তার মানে? ফিরে আসবার কথা আমি জানতাম নাকি?

ভারতী লোহার ছিটকিনিটা চাপিয়া বন্ধ করিয়া দিয়া সহজকণ্ঠে জবাব দিল, আমারই ভুল হয়েছে। খাবার কথাটা তখনি তাঁকে বলে পাঠানো উচিত ছিল। এত রাত্তিরে আর হাঙ্গামা পোয়াতে হতো না। এতক্ষণ কোথায় দুজনে বসে কাটালেন?

অপূর্ব কহিল, তাঁকেই জিজ্ঞেসা করবেন। ক্রোশ-তিনেক পথ হাঁটার নাম বসে কাটানো কি না, আমি ঠিক জানিনে।

ভারতীর জানালা বন্ধ করার কাজ তখনও সম্পূর্ণ হয় নাই, ছিটের পর্দাটা টানিয়া দিতেছিল, সেই কাজেই নিযুক্ত থাকিয়া বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল, ইস্‌, গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন বলুন! হাঁটাই সার হল । এই বলিয়া সে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া একটু হাসিয়া কহিল, সন্ধ্যা-আহ্নিক করার বালাই এখনো আছে, না গেছে? থাকে ত কাপড় দিচ্চি ওগুলো সব ছেড়ে ফেলুন। এই বলিয়া সে অঞ্চলসুদ্ধ চাবির গোছা হাতে লইয়া একটা আলমারি খুলিতে খুলিতে কহিল, তেওয়ারী বেচারা ভেবে সারা হয়ে যাবে। আজ ত দেখচি আফিস থেকে একবার বাসায় যাবারও সময় পাননি।

অপূর্ব রাগ চাপিয়া বলিল, অবশ্য আপনি এমন অনেক জিনিস দেখতে পান যা আমি পাইনে তা স্বীকার করচি, কিন্তু কাপড় বার করবার দরকার নেই। সন্ধ্যা-আহ্নিকের বালাই আমার যায়নি, এ জন্মে যাবেও তা মনে হয় না, কিন্তু আপনার দেওয়া কাপড়েও তার সুবিধে হবে না। থাক, কষ্ট করবেন না।

ভারতী কহিল, দেখুন আগে কি দিই—

অপূর্ব বলিল, আমি জানি তসর কিংবা গরদ। কিন্তু আমার প্রয়োজন নেই,—আপনি বার করবেন না।

সন্ধ্যা করবেন না?

না।

শোবেন কি পরে? আফিসের ওই কোট-পেন্টুলানসুদ্ধ নাকি?

হাঁ।

খাবেন না?

না।

সত্যি?

অপূর্বর কণ্ঠস্বরে বহুক্ষণ হইতেই তাহার সহজ সুর ছিল না, এবার সে স্পষ্টই রাগ করিয়া কহিল, আপনি কি তামাশা করচেন নাকি?

ভারতী মুখ তুলিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিল, বলিল, তামাশা ত আপনিই করচেন। আপনার সাধ্য আছে না খেয়ে উপোস করে থাকেন?

এই বলিয়া সে আলমারির মধ্য হইতে একখানি সুন্দর গরদের শাড়ী বাহির করিয়া কহিল, একেবারে নিভাঁজ পবিত্র। আমিও কোন দিন পরিনি। ওই ছোট ঘরটায় গিয়ে কাপড় ছেড়ে আসুন, নীচে কল আছে, আমি আলো দেখাচ্চি, হাত-মুখ ধুয়ে ওইখানেই মনে মনে সন্ধ্যা-আহ্নিক সেরে নিন। নিরুপায়ে এ ব্যবস্থা শাস্ত্রে আছে,—ভয়ঙ্কর অপরাধ কিছু হবে না।

হঠাৎ তাহার গলার শব্দ ও কথা বলার ভঙ্গী এমন বদলাইয়া গেল যে অপূর্ব থতমত খাইয়া গেল। তাহার দপ করিয়া মনে পড়িল সেদিন ভোরবেলাতেও ঠিক যেন এমনি করিয়াই কথা কহিয়া সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গিয়াছিল। অপূর্ব হাত বাড়াইয়া আস্তে আস্তে বলিল, দিন না কাপড়,—আমি নিজেই আলো নিয়ে নীচে যাচ্চি। আমি কিন্তু যার-তার হাতে ভাত খেতে পারব না তা বলে দিচ্চি।

ভারতী নরম হইয়া কহিল, সরকারমশায় যে ভাল বামুন। গরীব লোক, হোটেল করেছেন, কিন্তু অনাচারী নন। নিজে রাঁধেন, সবাই তাঁর হাতে খায়,—কেউ আপত্তি করে না—আমাদের ডাক্তারবাবুর খাবার পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকেই আসে।

তথাপি অপূর্বর কুণ্ঠা ঘুচিল না, বিরসমুখে কহিল, যা-তা খেতে আমার বড় ঘৃণা বোধ হয়।

ভারতী হাসিল, কহিল, যা-তা খেতে কি আমিই আপনাকে দিতে পারি? আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁকে দিয়ে সমস্ত গুছিয়ে আনবো,—তাহলে ত আর আপত্তি হবে না?—এই বলিয়া সে আবার একটু হাসিল।

অপূর্ব আর প্রতিবাদ করিল না, আলো এবং কাপড় লইয়া নীচে চলিয়া গেল, কিন্তু তাহার মুখ দেখিয়া ভারতীর বুঝিতে বাকী রহিল না যে সে হোটেলের অন্ন আহার করিতে অত্যন্ত সঙ্কোচ ও বিঘ্ন অনুভব করিতেছে।

কিছুক্ষণ পরে অপূর্ব যখন গরদের শাড়ী পরিয়া নীচের একটা কাঠের বেঞ্চে বসিয়া আহ্নিকে নিযুক্ত, ভারতী দ্বার খুলিয়া একাকী অন্ধকারে বাহির হইয়া গেল, বলিয়া গেল, সরকারমশায়কে লইয়া ফিরিয়া আসিতে তাহার বিলম্ব হইবে না, ততক্ষণ সে যেন নীচেই থাকে। বস্তুতঃ ফিরিতে তাহার দেরি হইল না। সেই মাত্র অপূর্বর আহ্নিক শেষ হইয়াছে, ভারতী আলো হাতে করিয়া অত্যন্ত সন্তর্পণে প্রবেশ করিল, সঙ্গে তাহার সরকারমশায়, হাতে তাঁহার খাবারের থালা একটা বড় পিতলের গামলা দিয়া ঢাকা, তাঁহার পিছনে আর একজন লোক জলের গ্লাস এবং আসন আনিয়াছে, সে ঘরের একটা কোণ ভারতীর নির্দেশমত জল ছিটাইয়া মুছিয়া লইয়া ঠাঁই করিয়া দিলে ব্রাহ্মণ অন্নপাত্র রক্ষা করিলেন। সকলে প্রস্থান করিলে ভারতী কবাট বন্ধ করিয়া দিয়া গলায় অঞ্চল দিয়া যুক্তকরে সবিনয়ে নিবেদন করিল, এ ম্লেচ্ছের অন্ন নয়, সমস্ত খরচ ডাক্তারবাবুর। আপনি অসঙ্কোচে আতিথ্য স্বীকার করুন।

কিন্তু তাহার এই সকৌতুক পরিহাসটুকু অপূর্ব প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করিতে পারিল না। সে জাতি মানে, যে-সে লোকের ছোঁয়া খায় না, হোটেলে প্রস্তুত অন্ন ভক্ষণে কিছুতেই তাহার রুচি হয় না, কিন্তু তাই বলিয়া দামের পয়সাটা আজ ম্লেচ্ছ দিল কি অধ্যাপক ব্রাহ্মণ দিলেন এত গোঁড়ামিও তাহার ছিল না।

বড়ভাইয়েরা তাহার শুদ্ধাচারিণী মাতাকে অনেক দুঃখ দিয়াছে, ভাল হউক মন্দ হউক সেই মায়ের আদেশ ও অন্তরের ইচ্ছাকে তাহার লঙ্ঘন করিতে অত্যন্ত ক্লেশ বোধ হয়। এ কথা ভারতী যে একেবারে জানে না তাহাও নয়, অথচ, যখন-তখন তাহার এই আচার-নিষ্ঠাকেই লক্ষ্য করিয়া ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ সৃষ্টি করার চেষ্টায় মন তাহার উত্যক্ত হইয়া উঠিল। কিন্তু কোন জবাব না দিয়া সে আসনে আসিয়া বসিল, এবং আচ্ছাদন খুলিয়া আহারে প্রবৃত্ত হইল। ভারতী সাবধানে সর্বপ্রকার স্পর্শ বাঁচাইয়া দূরে ভূমিতলে বসিয়া ইহাই তদারক করিতে গিয়া মনে মনে কুণ্ঠিত ও অতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। সে ক্রীশ্চান বলিয়া হোটেলের রন্ধনশালায় প্রবেশ করিতে পারে নাই, এই গভীর রাত্রে, সকলের আহারান্তে যাহা কিছু অবশিষ্ট ছিল তাহাই যে কোনমতে সংগ্রহ করিয়া সরকারমশায় হাজির করিয়াছিলেন ভারতী তাহা ভাবিয়া দেখে নাই। ঘরে যথেষ্ট আলোক ছিল না, তথাপি আবরণ উন্মোচন করায় অন্ন-ব্যঞ্জনের যে মূর্তি প্রকাশিত হইল তাহাতে মুখে আর তাহার কথা রহিল না। অনেকদিন সে তাহাদের উপরের ঘর হইতে মেঝের ছিদ্রপথে এই লোকটির খাওয়ার ব্যাপার লুকাইয়া লক্ষ্য করিয়াছে, তেওয়ারীর ছোটখাটো সামান্য ত্রুটিতে সেই খুঁতখুঁতে মানুষটির খাওয়া নষ্ট হইতে কতদিন ভারতী নিজের চোখে দেখিয়াছে, সে-ই যখন আজ নিঃশব্দ ম্লানমুখে এই কদন্ন ভোজনে প্রবৃত্ত হইল, তখন কিছুতেই সে আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না। ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিল, থাক থাক, ও আর খেয়ে কাজ নেই,—এ আপনি খেতে পারবেন না।

অপূর্ব বিস্মিত হইয়া মুখ তুলিয়া চাহিল, বলিল, খেতে পারব না? কেন?

ভারতী কেবলমাত্র মাথা নাড়িয়া জবাব দিল, না, পারবেন না।

অপূর্ব প্রতিবাদ করিয়া তেমনি মাথা নাড়িয়া কহিল, না, বেশ পারবো, এই বলিয়া সে ভাত ভাঙ্গিবার উদ্যোগ করিতেই ভারতী উঠিয়া একেবারে তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, কহিল, আপনি পারলেও আমি পারব না। জোর করে খেয়ে অসুখ হলে এ বিদেশে আমাকেই ভুগে মরতে হবে। উঠুন।

অপূর্ব উঠিয়া দাঁড়াইয়া আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, কি খাবো তাহলে? আজ আবার তলওয়ারকর পর্যন্ত আফিসে আসেন নি,—যা পারি এই দুটি না হয় খেয়ে নি? কি বলেন? এই বলিয়া সে এমন করিয়া ভারতীর মুখের প্রতি চাহিল যে তাহার অপরিসীম ক্ষুধার কথা অপরের বুঝিতে আর লেশমাত্র বাকী রহিল না।

ভারতী ম্লানমুখে হাসিল; কিন্তু মাথা নাড়িয়া বলিল, এ ছাই-পাঁশ আমি মরে গেলেও ত আপনাকে খেতে দিতে পারব না অপূর্ববাবু,—হাত ধুয়ে উপরে চলুন, আমি বরঞ্চ আর কোন ব্যবস্থা করচি।

অনুরোধ অথবা আদেশমত অপূর্ব শান্ত বালকের মত হাত ধুইয়া উপরে উঠিয়া আসিল। মিনিট-দশেকের মধ্যেই পুনরায় সেই সরকারমশায় এবং তাঁহার হোটেলের সহযোগীটি আসিয়া দেখা দিলেন। এবার ভাতের বদলে একজনের হাতে মুড়ির পাত্র এবং দুধের বাটি, অপরের হাতে সামান্য কিছু ফল ও জলের ঘটি; আয়োজন দেখিয়া অপূর্ব মনে মনে খুশী হইল। এইটুকু সময়ে এতখানি সুব্যবস্থা সে কল্পনাও করে নাই। তাহারা চলিয়া গেলে অপূর্ব হৃষ্টচিত্তে আহারে মন দিল। দ্বারের বাহিরে সিঁড়ির কাছে দাঁড়াইয়া ভারতী দেখিতেছিল, অপূর্ব কহিল, আপনি ঘরে এসে বসুন। কাঠের মেঝেতে দোষ ধরতে গেলে আর বর্মায় বাস করা চলে না।

ভারতী সেইখান হইতেই সহাস্যে কহিল, বলেন কি? আপনার মত যে একেবারে উদার হয়ে উঠল!

অপূর্ব কহিল, না, এতে সত্যই দোষ নেই।

ডাক্তারবাবু বললেন, চলুন, ফিরে যাই—আমিও ফিরে এলাম। এখানে যে মাতালের কাণ্ডে খুনোখুনি ব্যাপার হয়ে আছে সে কে জানতো?

জানলে কি করতেন?

জানলে? অর্থাৎ,—আমার জন্যে আপনাকে এত কষ্ট পেতে হবে জানলে আমি কখখনো ফিরে আসতে রাজী হতাম না।

ভারতী কহিল, খুব সম্ভব বটে। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম আপনি নিজেই ইচ্ছে করে ফিরে এসেছেন।

অপূর্বর মুখ রাঙ্গা হইয়া উঠিল। সে মুখের গ্রাস গিলিয়া লইয়া সজোরে প্রতিবাদ করিয়া বলিল, কখখনো না! নিশ্চয় না! কাল বরঞ্চ আপনি ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন!

ভারতী শান্তভাবে কহিল, এত জিজ্ঞাসা-পড়ারই বা দরকার কি? আপনার কথাই কি আর বিশ্বাস করা যায় না!

তাহার কণ্ঠস্বরের কোমলতা সত্ত্বেও অপূর্বর গা জ্বলিয়া গেল। সে ফিরিয়া আসিতেই ভারতী যে মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছিল তাহা স্মরণ করিয়া উত্তাপের সহিত বলিল, আমার মিথ্যে কথা বলা অভ্যাস নয়,—আপনি বিশ্বাস না করতে পারেন।

ভারতী কহিল, আমিই বা বিশ্বাস না করব কেন?

অপূর্ব বলিল, তা জানিনে। যার যেমন স্বভাব । এই বলিয়া সে মুখ নীচু করিয়া আহারে মন দিল।

ভারতী ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিল, আপনি মিথ্যে রাগ করচেন। ডাক্তারের কথায় না এসে নিজের ইচ্ছেয় ফিরে এলেই বা দোষ কি, তাই শুধু আপনাকে আমি বলছিলাম। এই যে তখন আপনি নিজে খুঁজে খুঁজে আমার এখানে এলেন তাতেই কি কোন দোষ হয়েছে?

অপূর্ব খাবার হইতে মুখ তুলিল না, বলিল, বিকেলবেলা সংবাদ নিতে আসা এবং দুপুররাত্রে বিনা কারণে ফিরে আসা ঠিক এক নয়।

ভারতী তৎক্ষণাৎ কহিল, নয়ই ত। তাইত আপনাকে জিজ্ঞেসা করছিলাম, একটু জানিয়ে গেলে ত এতখানি খাবার কষ্ট হতো না।সমস্তই ত ঠিক করে রাখা যেতে পারতো।

অপূর্ব নীরবে খাইতে লাগিল, উত্তর দিল না। খাওয়া যখন প্রায় শেষ হইয়া আসিল তখন হঠাৎ মুখ তুলিয়া দেখিল, ভারতী স্নিগ্ধ সকৌতুক দৃষ্টে তাহার প্রতি নিঃশব্দে চাহিয়া আছে। কহিল, দেখুন ত খাবার কত কষ্টই হল!

অপূর্ব গম্ভীর হইয়া বলিল, আজ আপনার যে কি হয়েছে জানিনে, খুব সোজা কথাও কিছুতে বুঝতে পারচেন না।

ভারতী বলিল, আর এমনও ত হতে পারে খুব সোজা নয় বলেই বুঝতে পারচি নে? বলিয়াই ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল।

এই হাসি দেখিয়া সে নিজেও হাসিল, তাহার সন্দেহ হইল, হয়ত ভারতী এতক্ষণ তাহাকে শুধু মিথ্যা জ্বালাতন করিতেছিল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাহার মনে পড়িল, এমনি ধারা সব ছোটখাটো ব্যাপার লইয়া এই খ্রীষ্টান মেয়েটি তাহাকে প্রথম হইতেই কেবল খোঁচা দিবার চেষ্টা করিয়া আসিতেছে, অথচ, ইহা বিদ্বেষ নয়, কারণ, যে-কোন বিপদের মধ্যে এতবড় নিঃসংশয় নির্ভরের স্থলও যে এই বিদেশে তাহার অন্য কোথাও নাই,—এ সত্যও ঠিক স্বতঃসিদ্ধের মতই হৃদয় তাহার চিরদিনের জন্য একেবারে স্বীকার করিয়া লইয়াছে।

জলের গ্লাসটায় জল ফুরাইয়াছিল, শূন্য পাত্রটা অপূর্ব হাতে করিয়া তুলিতেই ভারতী ব্যস্ত হইয়া উঠিল, ঐ যাঃ—

আর জল নেই নাকি?

আছে বৈ কি! এই বলিয়া ভারতী রাগ করিয়া কহিল, অত নেশা করলে কি আর মানুষের কিছু মনে থাকে? খাবার জলের ঘটিটা শিবু নীচের টুলটার ওপর ভুলে রেখে এসেচে,—আমারও পোড়া কপাল চেয়ে দেখিনি। এখন আর ত উপায় নেই, একেবারে আঁচিয়ে উঠেই খাবেন, কি বলেন? কিন্তু রাগ করতে পাবেন না বলে রাখচি।

অপূর্ব হাসিয়া কহিল, এতে আর রাগ করবার কি আছে?

ভারতী আন্তরিক অনুতাপের সহিত বলিল, হয় বৈ কি। খাবার সময় তেষ্টার জল না পেলে ভারী একটা অতৃপ্তি বোধ হয়। মনে হয় যেন পেট ভরলো না। তাই বলে কিন্তু ফেলে রেখেও কিছু উঠলে চলবে না। আচ্ছা, যাবো, চট করে শিবুকে ডেকে আনবো?

অপূর্ব তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া হাসিয়া কহিল, এর জন্যে এই অন্ধকারে যাবেন ডেকে আনতে? আমার কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই মনে করেন?

তাহার খাওয়া শেষ হইয়াছিল, তথাপি সে জোর করিয়া আরও দুই-চারি গ্রাস মুখে পুরিয়া অবশেষে যখন উঠিয়া দাঁড়াইল, তখন তাহার নিজেরই কেমন যেন ভারী লজ্জা করিতে লাগিল। কহিল, বাস্তবিক বলচি আপনাকে, আমার কিছুমাত্র অসুবিধে হয়নি। আমি আঁচিয়ে উঠেই জল খাবো,—আপনি মিথ্যে দুঃখ করবেন না।

ভারতী হাসিয়া জবাব দিল, দুঃখ করতে যাবো? কখখনো না। আমি জানি দুঃখ করবার আমার কিচ্ছু নেই। এই বলিয়া সে আলোটা তুলিয়া ধরিয়া আর একদিকে মুখ ফিরাইয়া কহিল, আমি আলো দেখাচ্চি, যান আপনি নীচে থেকে মুখ ধুয়ে আসুন। জলের ঘটিটা সুমুখেই আছে,—যেন ভুলে আসবেন না।

অপূর্ব নীচে চলিয়া গেল। খানিক পরে মুখ-হাত ধুইয়া উপরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, তাহার ভুক্তাবশেষ সরাইয়া উচ্ছিষ্ট স্থানটা ভারতী ইতিমধ্যেই পরিষ্কার করিয়াছে; দুই-একটা চৌকি প্রভৃতি স্থানান্তরিত করিয়া তাহার খাবার জায়গা করা হইয়াছিল, সেগুলো যথাস্থানে আনা হইয়াছে, এবং যে ইজিচেয়ারটায় সে ইতিপূর্বে বসিয়াছিল তাহারই একপাশে ছোট টিপায়ার উপরে রেকাবিতে করিয়া সুপারি এলাচ প্রভৃতি মশলা রাখা হইয়াছে। ভারতীর হাত হইতে তোয়ালে লইয়া মুখ-হাত মুছিয়া মশলা মুখে দিয়া সে আরামকেদারায় বসিয়া পড়িল, এবং হেলান দিয়া তৃপ্তির গভীর নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, আঃ—এতক্ষণে দেহে যেন প্রাণ এল। কি ভয়ঙ্কর ক্ষিদেই না পেয়েছিল!

তাহার চোখের সুমুখ হইতে আলোটা সরাইয়া ভারতী একপাশে রাখিতেছিল, সেই আলোতে তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া অপূর্ব হঠাৎ উঠিয়া বসিয়া বলিল, আপনার খুব সর্দি হয়েছে দেখছি যে!

ভারতী বাতিটা তাড়াতাড়ি রাখিয়া দিয়া বলিল, কৈ, না।

না কেন! গলা ভারী, চোখ ফুলো-ফুলো, দিব্যি ঠাণ্ডা লেগেচে! এতক্ষণ খেয়ালই করিনি।

ভারতী জবাব দিল না। অপূর্ব কহিল, ঠাণ্ডা লাগার অপরাধ কি! এই রাত্তিরে যা ছুটোছুটি করতে হল!

ভারতী ইহারও উত্তর দিল না। অপূর্ব ক্ষুণ্ণকণ্ঠে বলিল, ফিরে এসে নিরর্থক আপনাকে কষ্ট দিলাম। কিন্তু কে জানতো বলুন, ডাক্তারবাবু ডেকে এনে শেষে আপনাকে বোঝা টানতে দিয়ে নিজে সরে পড়বেন! ভুগতে হল আপনাকে।

ভারতী জানালার কাছে পিছন ফিরিয়া কি একটা করিতেছিল, কহিল, তা ত হলই। কিন্তু ভগবান বোঝা টানতে দিলে আর নালিশ করতে যাবো কার বিরুদ্ধে বলুন?

অপূর্ব আশ্চর্য হইয়া কহিল, তার মানে?

ভারতী তেমনি কাজ করিতে করিতেই বলিল, মানে কি ছাই আমিই জানি? কিন্তু দেখচি ত, বর্মায় আপনি পা দেওয়া পর্যন্ত বোঝা টেনে বেড়াচ্চি শুধু আমিই। বাবার সঙ্গে করলেন ঝগড়া, দণ্ড দিলাম আমি। ঘর পাহারা দিতে রেখে গেলেন তেওয়ারীকে, তার সেবা করে মলুম আমি। ডেকে আনলেন ডাক্তারবাবু, হাঙ্গামা পোহাতে হচ্চে আমাকে। ভয় হয়, সারা জীবনটা না শেষে আমাকেই আপনার বোঝা বয়ে কাটাতে হয়। কিন্তু রাত ত আর নেই, শোবেন কোথায় বলুন ত?

অপূর্ব বিস্মিত হইয়া বলিল, বাঃ, আমি তার জানি কি?

ভারতী কহিল, হোটেলে ডাক্তারবাবুর ঘরে আপনার বিছানা করতে বলে এসেচি, ব্যবস্থা বোধ হয় হয়েছে।

কে নিয়ে যাবে? আমি ত চিনিনে।

আমিই নিয়ে যাচ্চি, চলুন, ডাকাডাকি করে তাদের তুলি গে।

চলুন, বলিয়া অপূর্ব তৎক্ষণাৎ উঠিয়া দাঁড়াইল। একটু সঙ্কোচের সহিত কহিল, কিন্তু আপনার বালিশ এবং বিছানার চাদরটা আমি নিয়ে যাবো। অন্ততঃ, এ দুটো আমার চাই-ই, পরের বিছানায় আমি মরে গেলেও শুতে পারবো না। এই বলিয়া সে শয্যা হইতে তুলিতে যাইতেছিল, ভারতী বাধা দিল। এতক্ষণে তাহার মলিন গম্ভীর মুখ স্নিগ্ধ কোমল হাস্যে ভরিয়া উঠিল। কিন্তু সে তাহা গোপন করিতে মুখ ফিরাইয়া আস্তে আস্তে বলিল, এও ত পরের বিছানা অপূর্ববাবু, ঘৃণা বোধ না হওয়াই ত ভারী আশ্চর্য। কিন্তু তাই যদি হয়, আপনার হোটেলে শুতে যাবার প্রয়োজন কি, আপনি এই খাটেতেই শোন। এ কথাটা সে ইচ্ছা করিয়াই বলিল না যে, মাত্র ঘণ্টা-কয়েক পূর্বেই তাহার দেওয়া অশুচি বস্ত্রে ভগবানের উপাসনা করিতেও ঘৃণা বোধ হইয়াছিল।

অপূর্ব অধিকতর সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল, বলিল, কিন্তু আপনি কোথায় শোবেন? আপনার ত কষ্ট হবে!

ভারতী ঘাড় নাড়িয়া কহিল, একটুও না। আঙুল দিয়া দেখাইয়া কহিল, ওই ছোট ঘরটায় যাহোক একটা কিছু পেতে নিয়ে আমি স্বচ্ছন্দে শুতে পারবো। শুধু কাঠের মেঝের উপরে হাতে মাথা রেখে তেওয়ারীর পাশে কত রাত্রি কাটাতে হয়েছে সে ত আপনি দেখতে পাননি?

অপূর্ব একমাস পূর্বের কথা স্মরণ করিয়া বলিল, একটা রাত্রি আমিও দেখতে পেয়েছি, একেবারে পাইনি তা নয়।

ভারতী হাসিমুখে বলিল, সে কথা আপনার মনে আছে? বেশ, তেমনি ধারাই না হয় আর একটা রাত্রি দেখতে পাবেন।

অপূর্ব ক্ষণকাল অধোমুখে নীরবে থাকিয়া বলিল, তেওয়ারীর তখন ভয়ানক অসুখ,—কিন্তু এখন লোকে কি মনে করবে?

ভারতী জবাব দিল, কিছুই মনে করবে। কারণ পরের কথা নিয়ে নিরর্থক মনে করবার মত ছোট মন এখানে কারও নেই।

অপূর্ব কহিল, নীচের বেঞ্চে বিছানা করেও ত আমি অনায়াসে শুতে পারি?

ভারতী বলিল, আপনি পারলেও আমি তা দেব না। কারণ, তার দরকার নেই। আমি আপনার অস্পৃশ্য, আপনার দ্বারা আমার কোন ক্ষতি হতে পারে এ ভয় আমার নেই।

অপূর্ব আবেগের সহিত কহিল, আমার দ্বারা কখনো আপনার লেশমাত্র অনিষ্ট হতে পারে এ ভয় আমারও নেই। কিন্তু আপনাকে অস্পৃশ্য বললে আমার সবচেয়ে বেশী দুঃখ হয়। অস্পৃশ্য কথার মধ্যে ঘৃণার ভাব আছে, কিন্তু আপনাকে ত আমি ঘৃণা করিনে। আমাদের জাত আলাদা, আপনার ছোঁয়া আমি খেতে পারিনে, কিন্তু তার হেতু কি ঘৃণা? এত বড় মিছে কথা আর হতেই পারে না। বরঞ্চ, এর জন্যে আপনিই আমাকে মনে মনে ঘৃণা করেন। সেদিন ভোরবেলায় যখন আমাকে অকূল সমুদ্রে ফেলে রেখে চলে আসেন, তখনকার মুখের চেহারা আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে, সে আমি জীবনে ভুলব না।

ভারতী বলিল, আমার আর যাই কেন না ভুলুন, সে অপরাধ ভুলবেন না!

কখনও না।

সে মুখে আমার কি ছিল? ঘৃণা?

নিশ্চয়!

ভারতী তাহার মুখের পানে চাহিয়া হাসিল, তারপরে ধীরে ধীরে বলিল, অর্থাৎ মানুষের মন বোঝবার বুদ্ধি আপনার ভয়ানক সূক্ষ্ম,—আছে কি নেই! কিন্তু, আর কাজ নেই আপনি শোন। আমার রাত-জাগার অভ্যাস আছে, কিন্তু আপনি আর বেশী জেগে থাকলে আমারই হয়ত বিপদের অবধি থাকবে না।

এই বলিয়া সে প্রত্যুত্তরের আর অবকাশ না দিয়া র‍্যাকের উপর হইতে গোটা-দুই কম্বল পাড়িয়া লইয়া পাশের ছোট ঘরের ভিতরে গিয়া প্রবেশ করিল।

অনতিকাল পরে ফিরিয়া আসিয়া মশারি ফেলিয়া চারিদিক ভাল করিয়া গুঁজিয়া দিয়া ভারতী চলিয়া গেল, কিন্তু অপূর্বর নিমীলিত চোখের কোণে ঘুমের ছায়াপাতটুকুও হইল না। ঘরের এক কোণে আড়াল-করা আলোটা মিটমিট করিয়া জ্বলিতেছে, বাহিরে গভীর অন্ধকার, রাত্রি স্তব্ধ হইয়া আছে,—হয়ত, সে ছাড়া কোথাও কেহ জাগিয়া নাই, কখন যে ঘুম আসিবে তাহার কোন স্থিরতা নেই, তবুও এই জাগরণের মধ্যে নিদ্রাবিহীনতার বিন্দুমাত্র অস্বস্তিও সে অনুভব করিল না। তাহার সকল দেহমন যেন বর্ণে বর্ণে উপলব্ধি করিতে লাগিল, এই ঘরে, এই শয্যায়, এই নীরব নিশীথে ঠিক এমন চুপ করিয়া শুইয়া থাকার মত সুন্দর বস্তু আর ত্রিভুবনে নাই। এমন একান্ত ভাবনাহীন নিশ্চিন্ত বিশ্রামের আনন্দ সে যেন আর কখনও পায় নাই,—তাহার এমনি মনে হইতে লাগিল।

সকালবেলায় তাহার ঘুম ভাঙ্গিল ভারতীর ডাকে। চোখ মেলিয়াই দেখিল সম্মুখে তাহার পায়ের কাছে দাঁড়াইয়া এই মেয়েটি, পূবের জানালা দিয়া প্রভাত-সূর্যের রাঙ্গা আলো তাহার সদ্যোস্নাত ভিজা চুলের উপরে, তাহার পরনের সাদা গরদের রাঙ্গা পাড়টুকুর উপরে, তাহার সুন্দর মুখখানির স্নিগ্ধ শ্যাম রঙের উপরে পড়িয়া একেবারে যেন অপরূপ হইয়া অপূর্বর চোখে ঠেকিল।

ভারতী কহিল, উঠুন, আবার আফিসে যেতে হবে ত!

তা ত হবে, বলিয়া অপূর্ব শয্যাত্যাগ করিল। আপনার ত দেখচি স্নান পর্যন্ত সারা হয়ে গেছে।

ভারতী কহিল, আপনাকেও সমস্ত তাড়াতাড়ি সেরে নিতে হবে। কাল অতিথি-সৎকারে যথেষ্ট ত্রুটি হয়েছে, আজ আমাদের প্রেসিডেন্টের আদেশ, আপনাকে ভাল করে না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়া হবে না।

অপূর্ব জিজ্ঞাসা করিল, কালকের সে মেয়েটি বেঁচেছে?

তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে—বাঁচবে বলেই আশা।

মেয়েটিকে অপূর্ব চোখেও দেখে নাই, তথাপি তাহারই সুখবরে মন যেন তাহার পরম লাভ বলিয়া গণ্য করিল। আজ কাহারও কোন অকল্যাণ সে যেন সহিতেই পারিবে না তাহার এমনি জ্ঞান হইল।

সে স্নান-আহ্নিক সারিয়া কাপড় পরিয়া প্রস্তুত হইয়া যখন উপরে আসিল তখন বেলা প্রায় নয়টা। ইতিমধ্যে ঠাঁই করিয়া সরকারমশায় খাবার রাখিয়া গেছেন, অপূর্ব আসনে বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কৈ, আপনাদের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ত দেখা হল না! তাঁর অতিথি-সৎকারের বুঝি এই রীতি?

ভারতী বলিল, আপনার যাবার আগে দেখা হবে বৈ কি। তাঁর আপনার সঙ্গে বোধ করি একটু কাজও আছে।

অপূর্ব কহিল, আর ডাক্তারবাবু? যিনি আমাকে ডেকে এনেছেন? এখনো বোধ হয় তিনি বিছানাতেই পড়ে? এই বলিয়া হাসিল।

ভারতী এ হাসিতে যোগ দিল না, কহিল, বিছানায় পড়বার তাঁর সময়ই হয়নি। এই ত হাসপাতাল থেকে ফিরে এলেন। শোওয়া না-শোওয়া কোনটার কোন মূল্যই তাঁর কাছে নেই।

অপূর্ব আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল, এতে তাঁর অসুখ করে না?

ভারতী বলিল, কখনো দেখিনে ত। সুখ অসুখ দুই-ই বোধ হয় তাঁর কাছে হার মেনে পালিয়েছে। মানুষের সঙ্গেই তাঁর তুলনা হয় না।

অপূর্বর কাল রাত্রের অনেক কথাই স্মরণ হইল, মুগ্ধকণ্ঠে কহিল, আপনারা সকলেই বোধ হয় তাঁকে অতিশয় ভক্তি করেন?

ভক্তি করি? ভক্তি ত অনেকেই অনেককে করে।

বলিতে বলিতেই তাহার কণ্ঠস্বর অকস্মাৎ গাঢ় হইয়া উঠিল, কহিল, তিনি চলে গেলে মনে হয় পথের ধূলোয় পড়ে থাকি, তিনি বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে যান। মনে হয়, তবুও আশ মেটে না অপূর্ববাবু। বলিয়াই সে মুখ ফিরাইয়া চট করিয়া চোখের কোণ-দুটা মুছিয়া ফেলিল।

অপূর্ব আর কিছু জিজ্ঞাসা করিল না, নতমুখে নিঃশব্দে আহার করিতে লাগিল। তাহার এই কথাটাই বার বার মনে হইতে লাগিল, সুমিত্রা ও ভারতীর মত এতবড় শিক্ষিতা ও বুদ্ধিমতী নারী-হৃদয়ে যে মানুষ এতখানি উচ্চে সিংহাসন গড়িয়াছে, জানি না ভগবান তাহাকে কোন্‌ ধাতু দিয়া তৈরি করিয়া পৃথিবীতে পাঠাইয়াছেন! কোন্‌ অসাধারণ কার্য তাহাকে দিয়া তিনি সম্পন্ন করাইয়া লইবেন!

দূরে দরজার কাছে ভারতী চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, অপূর্ব নিজেও বিশেষ কোন কথা কহিল না, অতঃপর খাওয়াটা তাহার একপ্রকার নিঃশব্দেই সমাধা হইল। অপ্রীতিকর কোন কিছুই ঘটে নাই, তথাপি যে প্রভাতটা আজ তাহার বড় মিষ্ট হইয়া শুরু হইয়াছিল, অকারণে কোথা হইতে যেন তাহার উপরে একটা ছায়া আসিয়া পড়িল।

আফিসের কাপড় পরিয়া প্রস্তুত হইয়া সে কহিল, চলুন, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করে যাই।

চলুন, তিনি আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

সরকার-মহাশয়ের জরাজীর্ণ হোটেল-বাড়ির একটা অত্যন্ত ভিতরের দিকের ঘরে ডাক্তারবাবুর বাসা। আলো নাই, বাতাস নাই, আশেপাশে নোংরা জল জমিয়া একটা দুর্গন্ধ উঠিতেছে, অতিশয় পুরাতন তক্তার মেঝে, পা দিতে ভয় হয় পাছে সমস্ত ভাঙ্গিয়া পড়ে, এমনি একটা কদর্য বিশ্রী ঘরে ভারতী যখন তাহাকে পথ দেখাইয়া আনিল, তখন বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না। ঘরে ঢুকিয়া অপূর্ব ক্ষণকাল ত ভাল দেখিতেই পাইল না।

ডাক্তারবাবু অভ্যর্থনা করিয়া কহিলেন, আসুন অপূর্ববাবু।

উঃ—কি ভীষণ ঘরই আপনি আবিষ্কার করেছেন ডাক্তারবাবু!

কিন্তু কি রকম সস্তা বলুন ত! মাসে দশ আনা ভাড়া।

অপূর্ব কহিল, বেশি, বেশি, ঢের বেশি। দশ পয়সা হওয়া উচিত।

ডাক্তার কহিলেন, আমরা দুঃখী লোকেরা সব কিরকম থাকি আপনাদের চোখে দেখা উচিত। অনেকের কাছে এই আবার রাজপ্রাসাদ।

অপূর্ব কহিল, তা হলে প্রাসাদ থেকে ভগবান যেন আমাকে চিরদিন বঞ্চিত রাখেন! বাপ রে বাপ!

ডাক্তার বলিলেন, শুনলাম, কাল রাত্রে আপনার বড় কষ্ট হয়েছে অপূর্ববাবু, আমাকে ক্ষমা করতে হবে।

অপূর্ব কহিল, ক্ষমা করব শুধু আপনি এ ঘর ছাড়লে। তার আগে নয়।

প্রত্যুত্তরে ডাক্তার শুধু একটু হাসিলেন, বলিলেন, আচ্ছা, তাই হবে।

এতক্ষণ অপূর্ব নজর করে নাই, হঠাৎ ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া দেখিতে পাইল, দেওয়ালের কাছে একটা মোড়ার উপরে বসিয়া সুমিত্রা। আপনি এখানে? আমাকে মাপ করবেন, আমি একেবারে দেখতে পাইনি।

সুমিত্রা কহিলেন, সে অপরাধ আপনার নয় অপূর্ববাবু, অন্ধকারের।

অপূর্বর বিস্ময়ের সীমা রহিল না তাঁহার গলা শুনিয়া। সে কণ্ঠস্বর যেমন করুণ, তেমনি বিষণ্ণ। কি একটা ঘটিয়াছে বলিয়া যেন তাহার ভয় করিতে লাগিল। ভাল করিয়া ঠাহর করিয়া দেখিয়া আস্তে আস্তে কহিল, ডাক্তারবাবু, এ আপনার আজ কি রকম পোশাক? কোথাও কি বার হচ্ছেন?

ডাক্তারের মাথায় পাগড়ি, গায়ে লম্বা কোট, পরনে ঢিলা পায়জামা, পায়ে রাওলপিণ্ডির নাগ্‌রা, একটা চামড়ার ব্যাগে কি-কতকগুলা বান্ডিল বাঁধা। কহিলেন, আমি ত এখন চলতি অপূর্ববাবু, এঁরা সব রইলেন, আপনাকে দেখতে হবে। আপনাকে এর বেশী বলার আমি আবশ্যক মনে করিনে।

অপূর্ব অবাক হইয়া কহিল, হঠাৎ চলতি কি রকম? কোথায় চলতি?

এই ডাক্তার লোকটির কণ্ঠস্বরে ত কোন পরিবর্তন হয় না, তেমনি সহজ, শান্ত, স্বাভাবিক গলায় বলিলেন, আমাদের অভিধানে কি ‘হঠাৎ’ শব্দ থাকে অপূর্ববাবু? চলতি সম্প্রতি ভামোর পথে আরও কিছু উত্তরে। কিছু সাঁচ্চা জরির মাল আছে, সিপাইদের কাছে বেশ দামে বিক্রি হয়। এই বলিয়া মুখ টিপিয়া হাসিলেন।

সুমিত্রা এতক্ষণ কথা কহে নাই, সহসা বলিয়া উঠিল, তাদের পেশোয়ার থেকে একেবারে ভামোয় সরিয়ে এনেচে, তুমি জানো তাদের ওপর এখন কিরকম কড়া নজর। তোমাকেও অনেকে চেনে কখখনো ভেবো না সকলের চোখেই তুমি ধূলো দিতে পারবে। এখন কিছুদিন কি না গেলেই নয়? শেষের দিকে তাহার গলাটা যেন অদ্ভুত শুনাইল।

ডাক্তার মৃদু হাসিয়া কহিলেন, তুমি ত জানো, না গেলেই নয়।

সুমিত্রা আর কথা কহিলেন না, কিন্তু অপূর্ব ব্যাপারটা একেবারে চক্ষের পলকে বুঝিতে পারিল। তাহার চোখ ও দুই কান গরম হইয়া সর্বাঙ্গ দিয়া যেন আগুন ছুটিতে লাগিল। কোনমতে জিজ্ঞাসা করিয়া ফেলিল, ধরুন যদি তারা কেউ চিনতেই পারে? যদি ধরে ফেলে?

ডাক্তার কহিলেন, ধরে ফেললে বোধ হয় ফাঁসিই দেবে। কিন্তু দশটার ট্রেনের আর ত সময় নেই অপূর্ববাবু, আমি চললাম। এই বলিয়া তিনি স্ট্র্যাপে-বাঁধা মস্ত বোঝাটা অবলীলাক্রমে পিঠে ফেলিয়া চামড়ার ব্যাগটা হাতে তুলিয়া লইলেন।

ভারতী একটি কথাও কহে নাই, একটি কথাও কহিল না, শুধু পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিল। সুমিত্রাও প্রণাম করিল, কিন্তু সে পায়ের কাছে নয়, একেবারে পায়ের উপরে। হঠাৎ মনে হইল সে বুঝি আর উঠিবে না, এমনি করিয়া পড়িয়াই থাকিবে—বোধ হয় মিনিটখানেক হইবে,—যখন সে নীরবে উঠিয়া দাঁড়াইল, তখন স্বল্পালোকিত সেই ক্ষুদ্র ঘরের মধ্যে তাহার আনত মুখের চেহারা দেখিতে পাওয়া গেল না।

ডাক্তার ঘরের বাহিরে আসিয়া অপূর্বর হাতখানি গতরাত্রির মত মুঠার মধ্যে টানিয়া লইয়া কহিলেন, চললাম অপূর্ববাবু,—আমি সব্যসাচী।

অপূর্বর মুখের ভিতরটা শুকাইয়া মরুভূমি হইয়া গিয়াছিল, তাহার গলা দিয়া স্বর ফুটিল না, কিন্তু সে চক্ষের পলকে হাঁটু পাতিয়া তাঁহার পায়ের কাছে মেয়েদের মতই ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিল। ডাক্তার মাথায় তাহার হাত দিলেন, আর একটা হাত ভারতীর মাথায় দিয়া অস্ফুটে কি বলিলেন শোনা গেল না, তাহার পরে একটু দ্রুতপদেই বাহির হইয়া গেলেন।

অপূর্ব উঠিয়া দাঁড়াইয়া দেখিল, ভারতীর পাশে সে একাকী দাঁড়াইয়া আছে, পিছনে সেই ভাঙ্গা ঘরের রুদ্ধদ্বারের অন্তরালে কর্তব্যকঠিন, অশেষ বুদ্ধিশালিনী, পথের-দাবীর ভয়লেশহীনা তেজস্বিনী সভানেত্রী কি যে করিতে লাগিলেন, তাহার কিছুই জানা গেল না।