পথের দাবী

পথের দাবী বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগের অন্যতম বাঙ্গালী কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক বিরচিত একটি জনপ্রিয় উপন্যাস। ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে একদল বিপ্লবীর সংগ্রামের কাহিনী নিয়ে ব্রিটিশ শাসনামলে লিখিত একটি সাহসী উপন্যাস।

পথের দাবী প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার ১৩২৯ সালের ফাল্গুন ও চৈত্র; ১৩৩০ সালের বৈশাখ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুন; ১৩৩১ সালের জ্যৈষ্ঠ, আশ্বিন, কার্তিক, পৌষ ও মাঘ; ১৩৩২ সালের বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, ভাদ্র, কার্তিক, অগ্রহায়, পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুন এবং ১৩৩৩ সালের বৈশাখ সংখ্যায়। পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ৩১শে আগস্ট, ১৯১৬ খৃষ্টাব্দে। প্রকাশের পরপরই (ঐ মাসেই) ইংরেজ সরকার কর্তৃক রাজদ্রোহাত্মক অপরাধে বাজেয়াপ্ত হয়। রাজরোষ মুক্ত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়, বৈশাখ ১৩৪৬ সালে।

‘পথের দাবী’ বাজেয়াপ্ত করা হলে শরৎচন্দ্র অত্যন্ত আঘাত পান। তিনি রবীন্দ্রনাথকে ‘পথের দাবী’ দেন এবং তাঁর মতামত চান। শরৎচন্দ্র আশা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ যদি সরকারী নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান তাহলে হয়ত বইখানি পুনর্ব্বার প্রকাশ সম্ভব হবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রকে লেখেন—

তোমার ‘পথের দাবী’ পড়া শেষ করেছি। বইখানি উত্তেজক। ইংরেজের শাসনের বিরুদ্ধে পাঠকের মনকে অপ্রসন্ন করে তোলে। লেখকের কর্ত্তব্যের হিসাবে সেটা দোষের না হতে পারে—কেন না লেখক যদি ইংরেজরাজকে গ্রহণীয় মনে করেন তাহলে চুপ করে থাকতে পারেন না। কিন্তু চুপ করে না থাকার যে বিপদ আছে, সেটুকু স্বীকার করাই চাই। ইংরেজরাজ ক্ষমা করবেন এই জোরের উপরেই ইংরেজরাজকে আমরা নিন্দা করব সেটাতে পৌরুষ নেই। আমি নানা দেশ ঘুরে এলাম—আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে এই দেখলেম—একমাত্র ইংরেজ গভর্ণমেণ্ট ছাড়া স্বদেশী বা বিদেশী প্রজার বাক্যে বা ব্যবহারে বিরুদ্ধতা আর কোন গভর্ণমেণ্ট এতটা ধৈর্য্যের সঙ্গে সহ্য করে না। নিজের জোরে নয়, পরন্তু সেই পরের সহিষ্ণুতার জোরেই যদি আমরা বিদেশী রাজত্ব সম্বন্ধে যথেচ্ছ আচরণের সাহস দেখাতে চাই তবে সেটা পৌরুষের বিড়ম্বনামাত্র—তাতে ইংরেজরাজের প্রতিই শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়, নিজের প্রতি নয়। রাজশক্তির আছে গায়ের জোর, তার বিরুদ্ধে কর্তব্যের খাতিরে যদি দাঁড়াইতে হয়, তাহলে অপরপক্ষে থাকা উচিত চারিত্রিক জোর অর্থাৎ আঘাতের বিরুদ্ধে সহিষ্ণুতার জোর। কিন্তু আমরা সেই চারিত্রিক জোরটাই ইংরেজরাজের কাছে দাবী করি, নিজের কাছে নয়; তাতে প্রমাণ হয় যে, মুখে যাই বলি, নিজের অগোচরে ইংরেজকে আমরা পূজা করি —ইংরেজকে গাল দিয়ে কোন শাস্তি প্রত্যাশা না করার দ্বারাই সেই পূজার অনুষ্ঠান। শক্তিমানের দিক দিয়ে দেখলে তোমাকে কিছু না বলে তোমার বইকে চাপ দেওয়া প্রায় ক্ষমা। অন্য কোন প্রাচ্য বা প্রতীচ্য বিদেশী রাজার দ্বারা এটি হত না। আমরা রাজা হলে যে হতই না, সে আমাদের জমিদারের ও ভারতীয় রাজন্যের বহুবিধ ব্যবহারে প্রত্যহই দেখতে পাই। কিন্তু তাই বলে কি কলম বন্ধ করতে হবে? আমি তা বলিনে—শাস্তিকে স্বীকার করেই কলম চলবে। যে কোন দেশেই রাজশক্তিতে সত্যকার বিরোধ ঘটেচে সেখানে এমনিই ঘটবে—রাজবিরুদ্ধতা আরামে নিরাপদে থাকতে পারে না এই কথাটা নিঃসন্দেহ জেনেই ঘটেচে।

তুমি যদি কাগজে রাজবিরুদ্ধ কথা লিখতে তাহলে তার প্রভাব স্বল্প ও ক্ষণস্থায়ী হত—কিন্তু তোমার মত লেখক গল্পচ্ছলে যে কথা লিখবে তার প্রভাব নিয়ত চলতেই থাকবে। দেশে ও কালে তার ব্যাপ্তির বিরাম নেই—অপরিণত বয়সের বালক-বালিকা থেকে আরম্ভ করে বৃদ্ধরা পর্যন্ত তার প্রভাবের অধীনে আসবে। এমন অবস্থায় ইংরেজরাজ যদি তোমার বই প্রচার বন্ধ করে না দিত তা হলে এই বোঝা যেত যে সাহিত্যে তোমার শক্তি ও দেশে তোমার প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে তার নিরতিশয় অবজ্ঞা ও অজ্ঞতা। শক্তিকে আঘাত করলে তার প্রতিঘাত সইবার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। এই কারণেই সেই আঘাতের মূল্য—আঘাতের গুরুত্ব নিয়ে বিলাপ করলে সেই আঘাতের মূল্য একেবারেই মাটি করে দেওয়া হয়। ইতি— ২৭শে মাঘ, ১৩৩৩

তোমাদের

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এর উত্তর শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন। কিন্তু বন্ধুদের পরামর্শে তা পাঠান হয়নি। বর্তমান প্রসঙ্গে চিঠিখানির মূল্য অপরিসীম।

সামভাবেড়, পানিত্রাস পোস্ট

জেলা হাবড়া

শ্রীচরণেষু

আপনার পত্র পেলাম। বেশ, তাই হোক। বইখানা আমার নিজের বলে একটুখানি দুঃখ হবার কথা। কিন্তু সে কিছুই নয়! আপনি যা কর্ত্তব্য এবং উচিত বিবেচনা করেছেন তার বিরুদ্ধে আমার অভিমান নেই অভিযোগও নেই। কিন্তু আপনার চিঠির মধ্যে অন্যান্য কথা যা আছে সে সম্বন্ধে আমার দুই-একটা প্রশ্ন আছে, বক্তব্যও আছে। কৈফিয়তের মত যদি শোনায় সে শুধু আপনাকেই দিতে পারি।

আপনি লিখেছেন ইংরাজরাজের প্রতি পাঠকের মন অপ্রসন্ন হয়ে ওঠে। ওঠবারই কথা। কিন্তু এ যদি অসত্য প্রচারের মধ্য দিয়ে করবার চেষ্টা করতাম তাহলে লেখক হিসাবে তাতে আমার লজ্জা ও অপরাধ দুইই ছিল। কিন্তু জ্ঞানতঃ তা আমি করিনি। করলে Politician-দের Propaganda হ’ত, কিন্তু বই হ’ত না। নানা কারণে বাঙ্‌লা ভাষায় এ ধরনের বই কেউ লেখে না। আমি যখন লিখি এবং ছাপাই তার সমস্ত ফলাফল জেনেই করেছিলাম। সামান্য সামান্য অজুহাতে ভারতের সর্ব্বত্রই যখন বিনা বিচারে অবিচারে অথবা বিচারের ভান ক’রে কয়েদ নিৰ্ব্বাসন প্রভৃতি লেগেই আছে তখন আমিই যে অব্যাহতি পাবো, অর্থাৎ, রাজপুরুষেরা আমাকেই ক্ষমা করে চলবেন এ দুরাশা আমার ছিল না। আজও নেই। তাঁদের হাতে সময়ের টানাটানি নেই, সুতরাং, দু’দিন আগেপাছের অত কিছুই যায় আসে না। এ আমি জানি, এবং জানার হেতুও আছে। কিন্তু এ যাক্‌। এ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু বাঙ্‌লা দেশের গ্রন্থকার হিসাবে গ্রন্থের মধ্যে যদি মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে থাকি, এবং তৎসত্ত্বেও যদি রাজরোষে শাস্তি ভোগ করতে হয় ত করতেই হবে—তা’ মুখ বুজেই করি বা অশ্রুপাত করেই করি, কিন্তু প্রতিবাদ করা কি প্রয়োজন নয়? প্রতিবাদেরও দণ্ড আছে, এবং মনে করি তারও পুনরায় প্রতিবাদ হওয়া আবশ্যক। নইলে গায়ের জোরকেই প্রকারান্তরে ন্যায্য বলে স্বীকার করা হয়। এজন্যেই প্রতিবাদ চেয়েছিলাম। শান্তির কথাও ভাবিনি এবং প্রতিবাদের জোরেই যে এ-বই আবার ছাপা হবে এ সম্ভাবনার কল্পনাও করিনি।

চুরি-ডাকাতির অপরাধে যদি জেল হয় তার জন্যে হাইকোর্টে আপিল করা চলে, কিন্তু আবেদন যদি অগ্রাহ্যই হয় তখন দু’বছর না হয়ে তিন বছর হ’ল কেন এ নিয়ে বিলাপ করা সাজে না। রাজবন্দীরা জেলের মধ্যে দুধ ছানা মাখন পা না ব’লে কিম্বা মুসলমান কয়েদীরা মোহরমের তাজিয়ায় পয়সা পাচ্ছে, আমরা দুর্গোৎসবের খরচ পাই না কেন এই বলে চিঠি লিখে কাগজে কাগজে রোদন করায় আমি লজ্জা বোধ করি, কিন্তু মোটা ভাতের বদলে যদি Jail authorityরা ঘাসের ব্যবস্থা করে, তখন হয়ত তাদের লাঠির চোটে তা চিবোতে পারি, কিন্তু ঘাসের ড্যালা কণ্ঠরোধ না করা পর্য্যন্ত অন্যায় বলে প্রতিবাদ করাও জনি কৰ্ত্তব্য মনে করি।

কিন্তু বইখানা আমার একার লেখা, সুতরাং দায়িত্বও একার। যা’ বলা উচিত মনে করি, তা বলতে পেরেছি কিনা এইটেই আসল কথা। নইলে ইংরাজ সরকারের ক্ষমাশীলতার প্রতি আমার কোন নির্ভরতা ছিল না। আমার সমস্ত সাহিত্য সেবাটাই এই ধরণের। যা উচিত মনে করেছি তাই লিখে গেছি।

আপনি লিখেছেন আমাদের দেশের রাজারা এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের অন্যান্য রাজশক্তির কারও ইংরেজ গভর্ণমেণ্টের মত সহিষ্ণুতা নেই। একথা অস্বীকার করবার অভিজ্ঞতা আমার নেই। কিন্তু ও আমার প্রশ্নই নয়। আমার প্রশ্ন ইংরাজ রাজশক্তির এ বই বাজেয়াপ্ত করবার justification যদি থাকে, পরাধীন ভারতবাসীর পক্ষে protest করার justificationও তেমনি আছে।

আমার প্রতি আপনি এই অবিচার করেছেন যে, আমি যেন শাস্তি এড়াবার ভয়েই প্রতিবাদের ঝড় তুলতে চেয়েছি এবং সেই ফাঁকে গা-ঢাকা দেবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাস্তবিক তা নয়। দেশের লোক যদি প্রতিবাদ না করে, আমাকে করতেই হবে। কিন্তু সে হৈ-চৈ করে নয়, আর একখানা বই লিখে।

আপনি নিজে বহুদিন যাবৎ দেশের কাজে লিপ্ত আছেন, দেশের বাহিরের অভিজ্ঞতাও আপনার অত্যন্ত বেশী; আপনি যদি শুধু আমাকে এইটুকু আদেশ দিতেন যে এই বই প্রচারে দেশের সত্যকার কল্যাণ নেই, সেই আমার সান্ত্বনা হোত। মানুষের ভুল হয়, আমারও ভুল হয়েচে মনে করতাম।

আমি কোনরূপ বিরুদ্ধ ভাব নিয়ে এ-চিঠি আপনাকে লিখিনি, যা মনে এসেছে তাই অকপটে আপনাকে জানালাম। মনের মধ্যে যদি কোন ময়লা আমার থাকতো আমি চুপ করেই যেতাম। আমি সত্যকার রাস্তাই খুঁজে বেড়াচ্ছি, তাই সমস্ত ছেড়ে ছুঁড়ে নির্বাসনে বসে আছি। অর্থে সামর্থ্যে যে কত গেছে সে কাউকে জানাবার নয়। দিনও ফুরিয়ে এলো, এখন সত্যিকার কিছু একটা করবার তারি ইচ্ছে হয়।

উত্তেজনা অথবা অজ্ঞতাবশতঃ এ পত্রের ভাষা যদি কোথাও রূঢ় হয়ে থাকে আমাকে মার্জ্জনা করবেন। আপনার অনেক ভক্তের মাঝে আমিও একজন, সুতরাং কথায় বা আচরণে আপনাকে লেশমাত্র বাধা দেয়ার কথা আমি ভাবতেও পারিনে। ইতি—২রা ফাল্গুন, ১৩৩৩।

সেবক

শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

সামতাবেড় থেকে ১০ অক্টোবর ১৯২৯ খ্রীঃ শরৎচন্দ্র রাধারাণী দেবীকে লিখেছিলেন : “…একটা কথা তোমাকে জানাই, কারুকে বোলো না। ‘পথের দাবী’ যখন বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল তখন রবিবাবুকে গিয়ে বলি যে আপনি যদি একটা প্রতিবাদ করেন ত একটা কাজ হয় যে পৃথিবীর লোকে জানতে পারে যে গভর্ণমেণ্ট কি রকম সাহিত্যের প্রতি অবিচার করেছে। অবস্থা বই আমার সঞ্জীবিত হবে না। ইংরাজ সে পাত্রই নয়। তবু সংসারের লোকে খবরটা পাবে। তাঁকে বই দিয়ে আসি। তিনি জবাবে আমাকে লেখেন— “পৃথিবী ঘুরে ঘুরে দেখলাম, ইংরাজ রাজশক্তির মত সহিষ্ণু এবং ক্ষমাশীল রাজশক্তি আর নেই। তোমার বই পড়লে পাঠকের মন ইংরাজ গভর্ণমেণ্টের প্রতি অপ্রসন্ন হয়ে উঠে, তোমার বই চাপা দিয়ে তোমাকে কিছু না বলা, তোমাকে প্রায় ক্ষয় করা। এই ক্ষমার উপর নির্ভর করে গভর্ণমেণ্টকে যা তা’ নিন্দাবাদ করা সাহসের বিড়ম্বনা।”

ভাবতে পারো বিনা অপরাধে কেউ কাউকে এতবড় কটুক্তি করতে পারে? এ চিঠি তিনি ছাপবার জন্যেই দিয়েছিলেন, কিন্তু আমি ছাপাতে পারিনে এই জন্যে যে কবির এতবড় সার্টিফিকেট এখুনি স্টেটসম্যান প্রভৃতি ইংরাজি কাগজওয়ালারা পৃথিবীময় তার করে দেবে। এবং এই যে আমাদের দেশের ছেলেদের বিনা বিচারে জেলে বন্ধ করে রেখেছে এবং এই নিয়ে যত আন্দোলন হচ্ছে সমস্ত নিষ্ফল হয়ে যাবে। ঠিক বলতে পারিনে হয়ত এই কথা আমাদের মনের মধ্যে অলক্ষ্যে ছিল যখন সাহিত্যের রীতি-নীতি লিখি। তাতেই বোধ হয় কোথাও কোন জায়গায় একটু-আধটু তীব্রতার ঝাঁঝ এসে গেছে।”