» » সাত : আবার দুর্গাপূজা

সাত : আবার দুর্গাপূজা

আবার দুর্গাপূজা ফিরিয়া আসিয়াছে। অতি প্রত্যূষে জানলা খুলিয়া দিয়া হেম পূর্বদিকের অরুণ রক্তচ্ছটার দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। এ পাড়ার কোথায় রোশনচৌকির সানাইয়ের বিভাস শরতের সমস্ত করুণার সহিত মিলিয়া তাহার সর্বদেহে ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হইতেছিল। অজ্ঞাতসারে তাহার চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল। কতদিন হইয়া গিয়াছে, সে গুণীর কোন সংবাদ পায় নাই—সে মনে মনে ভাবিল, কে জানে গুণীদা আমার কোথায়, কেমন আছে। চলিয়া আসিবার সময় গুণী কাঁদিয়া বলিয়াছিল, হেম, আর দুটো দিন থাক—রাগ করে যেয়ো না। অভিমানীর চোখের জলের হেম সেদিন কোন মূল্য দেয় নাই। সেদিন পীড়িত রুগ্নদেহ সত্ত্বেও গুণী পথের ধার পর্যন্ত নামিয়া আসিয়া বলিয়াছিল, হেম, তোমার মন কখনই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই, যে কারণে হোক বিকৃত হয়ে উঠেছে—তাই অনুরোধ করচি, ফিরে এসে আরও একটা দিন থাক। হেম শোনে নাই, গাড়িতে উঠিয়া বসিয়াছিল। গুণী গাড়ির জানালার ধারে আসিয়া শেষ মিনতি জানাইয়া বলিয়াছিল, হেম, হয়ত এই কাজটা তোমার চিরকাল শেলের মত বিঁধে থাকবে—আমার জন্য বলছি নে ভাই, তোমার নিজের জন্যেই বলছি, আজকের মত গাড়ি থেকে নেমে এস। তাহার উত্তরে হেম কোচম্যানকে গাড়ি হাঁকাইয়া দিতে বলিয়াছিল। —হেম ফিরিয়া আসিয়া বিছানায় শুইয়া পড়িল এবং অনেকক্ষণ ধরিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া মাথার সমস্ত চুল ভিজাইয়া শেষে ঘুমাইয়া পড়িল। এত দুঃখের একটা কারণও ঘটিয়াছিল। তীর্থে যাইবার সঙ্কল্প করিয়া সে কাল দাসীকে দিয়া বাটীর সরকারের নিকট পঞ্চাশটি টাকা চাহিয়া পাঠাইয়াছিল। সরকার ফিরাইয়া দিয়া বলিয়া পাঠাইয়াছিল, ছোটবাবুর হুকুম ব্যতীত দিতে পারিবে না। হেম দেবরের সহিত কথা কহিত না, আড়ালে দাঁড়াইয়া বলিয়াছিল, আমি চেয়ে পাঠালে কি পঞ্চাশটা টাকা সরকার দিতে পারে না?

দেবর উত্তর করিয়াছিল, না; আপনি শুধু গ্রাসাচ্ছাদনের অধিকারিণী—টাকা পেতে পারেন না।

হেম বলিয়াছিল, কি পেতে পারি, না পারি, সে আমি জানি ঠাকুরপো! তোমার সঙ্গে টাকার জন্যে বিবাদ করতে, মামলা-মকদ্দমা করতে আমার প্রবৃত্তি হয় না। কিন্তু আমাকে অত নিরুপায় তুমি মনে ক’রো না। এনে দিতে ইচ্ছে হয় দাও, না হলে বলচি তোমাকে, টাকার যদি কোন জোর থাকে, শত্রুতা করে আমি তোমার বাড়ির এক-একটা ইট তুলে নিয়ে গিয়ে ঐ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসব।

তাহার কিছুক্ষণ পরেই টাকা আসিয়া পৌঁছিল, কিন্তু হেম গ্রহণ করিল না, রাগ করিয়া উঠানের মাঝখানে ছড়াইয়া ফেলিয়া দিয়া ঘরে দোর দিয়া শুইল; সমস্তদিন খাইল না, উঠিল না, মনে মনে কাহাকে স্মরণ করিয়া কাঁদিতে লাগিল। বেলা তখন সাতটা বাজিয়া গিয়াছে, তখন ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিয়া স্নান সারিয়া আসিয়া হেম আহ্নিক করিতে বসিতেছিল, দাসী আসিয়া সংবাদ দিল, বৌমা, তোমার ভাইয়ের বাড়ি থেকে চার-পাঁচ জন তত্ত্ব নিয়ে এসেচে। বলিতে বলিতেই মানদা আসিয়া প্রণাম করিল।

হেম একবারমাত্র তাহার মুখপানে চাহিয়া সব ভুলিয়া ছুটিয়া গিয়া তাহার গলা জড়াইয়া ছেলেমানুষের মত কাঁদিয়া উঠিল। কাল হইতেই তাহার চোখের জল শুকায় নাই, আজ অকস্মাৎ মানদাকে পাইয়া তাহার প্রায় এক বৎসরের রুদ্ধ-অশ্রু বন্যার মত সব ভাসাইয়া দিল। মানদাকে নিজের ঘরের মধ্যে টানিয়া লইয়া গিয়া বলিল, গুণীদা কি চিঠি লিখে দিয়েছে, আমাকে দে।

মানদা কহিল, তিনি ত চিঠি দেননি!

হেম যেন বিশ্বাস করিতে পারিল না, বলিল, দেননি?

মানদা বলিল, না দিদিমণি! তিনি কি উঠতে পারেন যে, চিঠি লিখবেন!

হেম পাংশু হইয়া গিয়া বলিল, উঠতে পারেন না, কি হয়েছে তাঁর?

তুমি কিচ্ছু জান না?

না, বল।

মানদা বলিল, আর কি বলব? বলিয়াই কাঁদিতে লাগিল।

হেম রূক্ষভাবে বলিল, কাঁদিস পরে—এখন বল্‌।

সে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, বলবার কিছুই নেই দিদি। তুমি চলে আসার পরের দিনই আবার জ্বরে পড়েন, ভাল হন, আবার জ্বরে পড়েন, আবার ভাল হন, আবার জ্বরে পড়েন—ফিরে গিয়ে যে দেখতে পাব, এমন ভরসাও করিনে।

হেম বলিল, তার পরে বল্‌।

মানদা বলিল, তার পরে কোথায় বর্ধমান না কোথা থেকে খবর পেয়ে, কোথাকার মাসী আসে, তার পরে মেসো, তার পরে মাসতুতো ভাই, বৌ, বোন, ভগিনীপতি, এখন আর কেউ বাকী নেই। বাড়িতে আর জায়গা নেই।

আমি সব বিদেয় করব—তার পর?

খাচ্ছে, দাচ্ছে, বসে আছে। বাবু ওপরে পড়ে আছেন, না ডাক্তার, না বদ্যি, না ওষুধ, না পথ্যি! শুনি, হাওয়া বদলালে ভাল হয়, তা নিয়ে যায় কে?

হেম বলিল, তোরা কি কচ্ছিস? নন্দা নিয়ে যায়নি কেন?

মানদা কপালে করাঘাত করিয়া বলিল, সে-ই বাবুর অনেকদিনের চাকর, তাকে মেসোবাবুর ছেলে অভয় মেরে তাড়িয়ে দিয়েচে—ছোঁড়া আবার মদ খায়—এক-একদিন বাড়িতে এসে এমন হাঙ্গামা করে যে, ভয়ে কেউ বেরুতে পারে না—তাকে আমাদের বাবু পর্যন্ত ভয় করেন।

হেম ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, মানু, একটা কথা সত্যি বল দিদি, আমার গুণীদা কি তাহলে বাঁচবে না?

মানদা বলিল, কেন বাঁচবেন না দিদি, দেখালে শোনালে, চেষ্টা করলে নিশ্চয় ভাল হবেন—কিন্তু অমন করে ফেলে রাখলে আর ক’দিন?

হেম মিনিট-খানেক চোখ বুজিয়া বসিয়া রহিল, তাহার পর উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, মানদা, তোদের ফিরে যাবার টাকা আছে?

আছে বৈ কি দিদি! জানোই ত, বাবু এক টাকার দরকার থাকলে সঙ্গে দশ টাকা দিয়ে পাঠান—আমাদের ভাড়া আমার কাছেই আছে। বলিয়া সে আঁচলে বাঁধা নোট দেখাইল।

হেম জিজ্ঞাসা করিল, কবে যাবি? কাল?

মানদা বলিল, হাঁ দিদি, কালই যেতে হবে—আমি যা একটা লোক আছি, না হলে সবাই নতুন—কেউ টিকতে পারে না। যেমন মাসী, তেমনি মেসো, তেমনি ছেলে, তেমনি ঝি-বৌ—বিধাতা-পুরুষ যেন ফরমাশ দিয়ে এঁদের এক ছাঁচে ঢেলেছিলেন। আমার নাকি বড় শক্ত প্রাণ, তাই এখনও টিঁকে আছি—অভয় ছোঁড়া আমাকেই একদিন তেড়ে মারতে এসেছিল—বাবুকে বলে, ও মলেই বাঁচা যায়!

হেমের চোখের মধ্যে আগুন জ্বলিতে লাগিল,—বলিল, আগে যাই। আজ স্টিমার কখন ফিরে যাবে জানিস?

মানদা বলিল, আর ঘণ্টা-খানেক পরেই ফিরবে, আমি ঘাট থেকে জেনে এসেছি।

তবে এতেই যাব। তুই গাড়ি ডেকে আন গে।

তুমি যাবে দিদি? আজ ত সুদিন নয়।

বেশ দিন। দেরি করিস নে—গাড়ি ডেকে আন।

সেইদিন অপরাহ্নবেলায় ছেলে অভয়কে খাবার দিয়া মা কাছে বসিয়া আর দুইখানা লুচি খাইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতেছিলেন। তাহার পাশ দিয়াই তেতলায় উঠিবার সিঁড়ি। অপরিচিতা হেমকে দেখিয়া বিস্মিত হইয়া মাসী প্রশ্ন করিলেন, তুমি কে গা বাছা?

আমি বিদেশী, বলিয়া হেম উপরে উঠিয়া গেল। অভয় তাহার আশ্চর্য রূপের দিকে নেকড়ে বাঘের মত চাহিয়া রহিল।

হেম গুণীর ঘরে গিয়া দেখিল, সে দেয়ালের দিকে মুখ করিয়া শুইয়া আছে। জাগিয়া আছে কি ঘুমাইতেছে, বোঝা গেল না। শিয়রের কাছে চাবির গোছাটা পড়িয়া ছিল, হেম সর্বাগ্রে সেটা নিজের আঁচলে বাঁধিয়া ফেলিল। একটা টেবিলের উপর গোটা-দুই খালি ঔষধের শিশি ছিল, তুলিয়া লইয়া দেখিল, লেবেলের গায়ে পনের দিন পূর্বের তারিখ দেওয়া আছে। সমস্ত ব্যাপারটা সে স্পষ্ট বুঝিল। তার পর লোহার সিন্দুক খুলিয়া চেক-বই বাহির করিয়া যখন ব্যবহৃত অংশগুলি পরীক্ষা করিয়া গুণীর দস্তখত মিলাইয়া দেখিতেছিল, এমন সময় মাসী ঘরে ঢুকিয়া একেবারে অবাক হইয়া গেলেন। চেঁচাইয়া বলিলেন, কে গা তুমি সিন্দুক খুলেচ?

হেম কহিল, চেঁচাও কেন, উনি উঠে পড়বেন যে!

মাসী আরও চেঁচাইয়া উঠিয়া বলিলেন, চেঁচাই কেন?

গুণী জাগিয়াছিল, পাশ ফিরিল। হেম বলিল, আমি খুলব না ত কে খুলবে? তুমি?

গুণী চাহিয়া দেখিতেছিল, দুইজনের কেহই তাহা লক্ষ্য করে নাই; মাসী ভয়ানক উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। গুণী আস্তে আস্তে কহিল, হেম, কখন এলে ভাই?

এই আসছি। ওঁকে বুঝিয়ে দাও—তোমার জিনিস খুললে বাইরের লোকের ঘরে ঢুকে চেঁচামেচি করতে নেই। এ সমস্তই আমার, এই কথাটা ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে ওঁকে যেতে বল।

গুণী সমস্ত বুঝিল। তার পর হাসিয়া বলিল, সেই সম্পর্কে এতদিন পরে বুঝি সিন্দুক খুলতে এসেচ?

হেম চেকের পাতা গুণিতে গুণিতে বলল, হুঁ।

মাসী বলিলেন, ও কে গুণী?

আমার বোন। উত্তর শুনিয়া হেম শিহরিয়া উঠিল। তাহার পর চোখ তুলিয়া একটিবার মাত্র তাহার মুখের দিকে চাহিয়া মাথা হেঁট করিয়া রহিল।

মাসী বলিলেন, কৈ, এতদিন ত এ-সব কথা শুনিনি? কিরকম বোন হয়?

গুণী সে-কথার উত্তর এড়াইয়া সংক্ষেপে কহিল, ঝগড়া করে চলে গিয়েছিল—ওরই সর্বস্ব মাসী।

মাসী বিশ্বাসও করিলেন না—বুঝিতে পারিলেন না, ধীরে ধীরে চলিয়া গেলেন। তিনি চলিয়া গেলে, গুণী হেমের দিকে ভাল করিয়া না চাহিয়াই বলিল, মরণকালে হঠাৎ এ খেয়াল কেন? কিন্তু বলিয়া ফেলিয়াই তাহার মুখ দেখিয়া ভীত হইয়া উঠিল। হেমের মুখ সাদা হইয়া গিয়াছে—সে যেন অকস্মাৎ কোন ক্রুদ্ধ তপস্বীর অভিসম্পাতে একনিমেষে পাষাণ হইয়া গিয়াছে। গুণী সভয়ে ডাকিল, হেম!

হেম সাড়া দিল না, নড়িলও না—নির্নিমেষ-নেত্রে মেঝের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল।

গুণী অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া ডাকিল, হেম, কথা শোন।

হেম তদুত্তরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া স্থির হইয়া রহিল। গুণী শয্যার উপর কোনমতে উঠিয়া বসিল, তাহার পর খাট হইতে নামিয়া ধীরে ধীরে অতি ক্লেশে হেমের সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইতেই সে একেবারে উপুড় হইয়া পড়িয়া তাহার দুই পায়ের মধ্যে মুখ লুকাইয়া কাঁদিয়া উঠিল, বিনা অপরাধে আমাকে সবাই শাস্তি দেয়—তুমিও দেবে, এ যে আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি!

গুণী নির্বাক হইয়া রহিল। শ্রাবণের আকাশভরা মেঘের মত বিপর্যস্ত কালো চুলে তাহার দুই পা ঢাকিয়া গিয়াছে—তাহার প্রতি চাহিয়া সে কিছুক্ষণ স্থির হইয়া রহিল। তার পর ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িয়া হেমের মাথার উপর ডান হাত রাখিয়া শান্তকণ্ঠে কহিল, তোমাকে শাস্তি দেব কি হেম, আমাকে ভালবেসেছিলে বলে আমি আমাকেও শাস্তি দিইনি। এ শাস্তি নয় বোন, চার বৎসরের বড় দুঃখের পর মরণের আগে যে শান্তি পেয়েছি, শেষদিনে আমি সে দুর্লভ বস্তুটিই তোমাকে দিয়ে যাব—চল, আমরা কাশী যাই।

হেম মুখ লুকাইয়া কাঁদিয়া বলিল, চল, কিন্তু এই কি তোমার শেষ আদেশ। এ কি আমি সহ্য করতে পারব?

গুণী বলিল, পারবে। যখন বুঝবে, সংসারে, ভালবাসাকে মহামহিমান্বিত করবার জন্য বিচ্ছেদ শুধু তোমার মত অতুল ঐশ্বর্যশালিনীর দ্বারে এসেই চিরদিন হাত পেতেছে, সে অল্পপ্রাণ ক্ষুদ্র প্রেমের কুটীরে অবজ্ঞায় যায়নি—তখনই সহ্য করতে পারবে। যখন জানবে, অতৃপ্ত বাসনাই মহৎ প্রেমের প্রাণ, এর দ্বারাই সে অমরত্ব লাভ করে যুগে যুগে কত কাব্য, কত মধু, কত অমূল্য অশ্রু সঞ্চিত করে রেখে যায়, যখন নিঃসংশয়ে উপলব্ধি হবে, কেন রাধার শতবর্ষব্যাপী বিরহ বৈষ্ণবের প্রাণ, কেন সে প্রেম মিলনের অভাবেই সুসম্পূর্ণ, ব্যথাতেই মধুর, তখন সইতে পারবে হেম। উঠে বস—চল, আজই আমরা কাশী যাই। যে ক’টা দিন আরো আছি, সে ক’টা দিনের শেষ সেবা তোমার, ভগবানের আশীর্বাদে অক্ষয় হয়ে তোমাকে সারা-জীবন সুপথে শান্তিতে রাখবে।