তৃতীয় পরিচ্ছেদ—অনার্য্যের দুই বংশ, দ্রাবিড়ী ও কোল[১]

আমরা বুঝাইয়াছি যে, ভারতবর্ষে আগে অনার্য্যের বাস ছিল—তার পর আর্য্যেরা আসিয়া তাহাদিগকে জয় করিয়া তাড়াইয়া দিয়াছে। অনার্য্যেরা বন্য ও পার্ব্বত্য প্রদেশে গিয়া বাস করিতেছে। ভারতবর্ষে অন্যত্র যাহা ঘটিয়াছে—বাঙ্গালাতেও তাই, ইহা সহজে অনুমেয়। কিন্তু বাঙ্গালার সঙ্গে মধ্যদেশাদির একটা গুরুতর প্রভেদ আছে। মধ্যদেশাদির ন্যায় বাঙ্গালার অনার্য্যগণ সকলেই বিজয়ী আর্য্যদিগের ভয়ে পলায়ন করে নাই। কেহ কেহ পলাইয়াছে—কেহ কেহ ঘরেই আছে।

জয় দ্বিবিধ, কখন কখন কোন প্রবল জাতি জাত্যন্তরকে বিজিত করিয়া তাহাদিগের দেশ অধিকৃত করিয়া আদিমবাসীদিগকে দেশ হইতে দূরীকৃত করে। আদিমবাসীরা সকলে হয় জেতৃগণের হস্তে প্রাণ হারায়, নয় দেশ ছাড়িয়া দেশান্তরে পলাইয়া বাস করে। টিউটন্‌গণকর্ত্তৃক ব্রিটেন্ জয়ের ফল এইরূপ হইয়াছিল। সাক্সনেরা ব্রিটন্ জয় করিয়া পূর্ব্বাধিবাসীদিগকে নিঃশেষে ধ্বংস করিয়াছিলেন। কেবল যাহারা ওয়েল্‌স, কর্ণওয়াল্ বা ব্রিটানী প্রদেশে গিয়া পলাইয়া বাস করিয়া রহিল, তাহারাই রক্ষা পাইল। ইংলণ্ডে আর ব্রিটন্ রহিল না। ইংলণ্ড কেবল টিউটনের দেশ হইল। দ্বিতীয় প্রকারে দেশজয়ে পূর্ব্বাধিবাসীরা বিনষ্ট বা তাড়িত হয় না। বিজয়ীদিগের সঙ্গে মিশিয়া যায়। নর্ম্মান্‌গণকর্ত্তৃক ইংলণ্ড জয় ইহার উদাহরণ। আর্য্যগণ বাঙ্গালা জয় করিয়াছিলেন। তাঁহারা টিউটন্‌দিগের মত অনার্য্যদিগকে নিঃশেষ ধ্বংস বা বিদূরিত করিয়াছিলেন বা নর্ম্মান্‌বিজিত সাক্সনের মত অনার্য্যেরা বঙ্গজেতা আর্য্যদিগের সহিত মিলিয়া মিশিয়া গিয়াছিল, তাহা আমাদিগকে দেখিতে হইবে। যদি দেখি যে, বাঙ্গালার বর্ত্তমান অধিবাসীদিগের মধ্যে অনার্য্যবংশ এখনও আছে, তবে বুঝিতে হইবে যে, অনার্য্যেরা আর্য্যদিগের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছিল।

প্রথমে দেখা যাউক, বাঙ্গালার কোথায় কোন্ কোন্ অনার্য্য জাতি আছে। সে গণনার পূর্ব্বে প্রথমে বুঝিতে হইবে, বাঙ্গালা কাহাকে বলিতেছি। কেন না, বাঙ্গালা নাম অনেক অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। এক অর্থে পেশোর পর্য্যন্ত বাঙ্গালার অন্তর্গত—যথা, “বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি” “বেঙ্গল আর্ম্মি”। আর এক অর্থে বাঙ্গালা তত দূর বিস্তৃত না হউক, মগধ, মিথিলা, উড়িষ্যা, পালমৌ উহার অন্তর্গত—এই সকল প্রদেশ বাঙ্গালার লেফ্‌টেনেণ্ট্ গবর্ণরের অধীন। এই দুই অর্থের কোন অর্থেই “বাঙ্গালা” শব্দ এ প্রবন্ধে ব্যবহার করিতেছি না। যে দেশের লোকের মাতৃভাষা বাঙ্গালা, সেই বাঙ্গালী; আমরা সেই বাঙ্গালীর উৎপত্তির অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত। তাহার বাহিরে যাহারা আছে, তাহাদের ইতিহাস লিখিব না—সাঁওতাল বা নাগা এ প্রবন্ধের কেহ নহে তবে এখানে বাঙালার বাহিরে দৃষ্টিপাত না করিলে, আমরা কৃতকার্য্য হইতে পারিব না। যে সকল অনার্য্যজাতি বাঙালার আর্য্য কর্ত্তৃক দূরীভূত হইয়াছে, তাহারা অবশ্য বাঙ্গালার বাহিরে আছে। বাঙ্গালার ভিতরে ও বাঙ্গালার পার্শ্বে কোন্ কোন্ অনার্য্যজাতি বাস করিতেছে—দুইই দেখিতে হইবে।

উত্তরসীমায় ব্রহ্মদেশের সম্মুখে দেখিতে পাই, খামটি, সিংফো, মিশ্‌মি, চুলকাটা মিশ্‌মি। তার পর অপর জাতি, তাহাও অনেক প্রকার। যথা—পাদম্ মিরী দফ্‌লা ইত্যাদি। তার পর আসামপ্রদেশের নাগা, কুকি, মণিপুরী; কৌপয়ী, তাহার বাহিরে মিকির, জয়ন্তীয়া, খাসিয়া ও গারো জাতি। আসামের মধ্যে ব্রহ্মপুত্রতীরে দেখিতে পাই, কাছারি বা বোড়ো, মেচ্ ও ধিমালজাতি এবং বাঙ্গালার মধ্যে তাহাদিগের নিকটকুটুম্ব কোচজাতি। তৎপরে উত্তরে হিমালয়পর্ব্বতের ভিতরে বাস করে, ভোট, লেপ্‌ছা, লিম্বু, কিরান্তী বা কিরাতী (প্রাচীন কিরাত)। তার পর বাঙ্গালার পূর্ব্বদক্ষিণ সীমায় মগ, লুসাই, কুকি, কারেন্, তালাইন্ প্রভৃতি জাতি। ত্রিপুরার ভিতরেই রাজবংশী নওয়াতিয়া প্রভৃতি জাতি আছে; বাঙ্গালার পশ্চিম দিকে কোল, সাঁওতাল, খাড়িয়া, মুণ্ড, কোঁড়োয়া ওঁরাও বা ধাঙ্গড় প্রভৃতি অনার্য্যজাতি বাস করে। এই শেষোক্ত কয়েকটি জাতির সম্বন্ধেই আমাদের অনেকগুলি কথা বলিতে হইবে। উত্তর ও পূর্ব্বের অনার্য্যদিগের সঙ্গে আমাদিগের ততটা সম্বন্ধ নাই, তাহারা অনেকেই হালের আমদানী।

আমরা কেবল কয়েকটি প্রধান জাতির নাম করিলাম—জাতির ভিতর উপজাতি আছে এবং অন্যান্য জাতি আছে। প্রসঙ্গক্রমে তাহাদের কথাও বলিতে হইবে।

এখন প্রথম জিজ্ঞাস্য এই যে, ইহারা সকলে কি একবংশসম্ভূত? আর্য্যেরা সকলেই একবংশসম্ভূত—আর্য্য শব্দের অর্থই তাই। কিন্তু “অনার্য্য” বলিলে কেবল ইহাই বুঝায় যে, ইহারা আর্য্য নহে। যাহারা আর্য্য নহে, তাহারা সকলেই যে একজাতীয়, এমত বুঝায় না। যদি এমত প্রমাণ থাকে যে, ইহারা একবংশোদ্ভূত, তবে সহজে অনুমান করিতে পারা যায় যে, ইহারা সকলেই বাঙ্গালার প্রথম আধিবাসী—আর্য্যগণকর্ত্তৃক তাড়িত হইয়া নানাস্থানে ছড়াইয়া পড়িয়া নানাদেশে নানা নাম ধারণ করিয়াছে; কিন্তু যদি সে প্রমাণ না থাকে—বরং তদ্বিরুদ্ধে প্রমাণ থাকে যে, তাহারা নানাবংশীয়, তবে আবার বিচার করিতে হইবে, এইগুলির মধ্যে কাহারা কাহারা বাঙ্গালার প্রথম অধিবাসী।

প্রামাণ্য ইতিহাসের অভাবে ভাষাবিজ্ঞানের আবিষ্ক্রিয়া এ সকল বিষয়ে গুরুতর প্রমাণ। আমরা প্রথম পরিচ্ছেদে যে তিন শ্রেণীর ভাষার কথা বলিয়াছি, তাহার মধ্যে তৃতীয় শ্রেণীর ভাষার অন্তর্গত আর্য্যভাষা ও সেমীয়ভাষা (আরবী, হিব্রু প্রভৃতি)। প্রথম শ্রেণীর ভাষাগুলি—যাহা সংযোগনিরপেক্ষ অথবা বিভক্তিবিশিষ্ট নহে—সেই সকল ভাষাকে ইউরোপীয়েরা ভারত—চৈনিক বলিয়া থাকেন। নামটি আমাদিগের ব্যবহারের অযোগ্য—আমরা ঐ ভাষাগুলি চৈনিকীয়ভাষা বলিব। দ্বিতীয় ভাষার সাধারণ নাম তুরাণী। বাঙ্গালার মধ্য বা প্রান্তস্থিত অনার্য্যজাতিসকলের ভাষা এই দ্বিবিধ—কতকগুলি জাতির ভাষা চৈনিকীয়—ইহাদিগের বাস প্রায় আসামে বা বাঙ্গালার পূর্ব্বসীমায়। তাহারা অনেকেই আর্য্যদিগের পরে আসিয়াছে, এমত ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। তার পর অবশিষ্ট যে সকল অনার্য্যজাতি—তাহাদিগের সকলেরই ভাষা তুরাণীশ্রেণীস্থ।

কিন্তু সেই সকল অনার্য্যভাষার মধ্যেও জাতিগত পার্থক্য দেখা যায়। পূর্ব্বেই কথিত হইয়াছে, দ্রাবিড়ভাষা তুরাণীশ্রেণীস্থ। বাঙ্গালার অনার্য্যভাষার মধ্যে কতকগুলি জাতির ভাষার শব্দ সমাস ও ব্যাকরণ সমালোচনা করিয়া পণ্ডিতেরা দেখিয়াছেন যে, ঐ সকল ভাষা দ্রাবিড়ী ভাষার সঙ্গে সম্বন্ধবিশিষ্ট। আর কতকগুলি অনার্য্যভাষাতে দ্রাবিড়ী ভাষার সঙ্গে কোন প্রকার সাদৃশ্য নাই। ইহাতে সিদ্ধ হইয়াছে যে, বাঙ্গালার কতকগুলি অনার্য্যজাতি দ্রাবিড়ীদিগের জ্ঞাতি—কতকগুলি তাহাদিগের হইতে ভিন্ন জাতি।

যাহারা অদ্রাবিড়ী, তাহাদিগের মধ্যে ভাষাগত ঐক্য আছে। কোল বা হো, সাঁওতাল, মুণ্ড প্রভৃতি এখন ভিন্ন ভিন্ন স্থানবাসী ভিন্ন ভিন্ন জাতি বটে, কিন্তু যেমন সকল আর্য্যভাষাই পরস্পরের সহিত সাদৃশ্য ও সম্বন্ধবিশিষ্ট, কোল, মুণ্ড, সাঁওতাল প্রভৃতির ভাষাও সেইরূপ সাদৃশ্য ও সম্বন্ধবিশিষ্ট। অতএব ইহারা সকলেই একজাতীয় বলিয়া বোধ হয়।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. বঙ্গদর্শন, ১২৮৭, ফাল্গুন।

Leave a Reply