মাতঙ্গিনী অন্তরালে থাকিয়া তাবৎ শুনিয়াছিলেন। এই বিষম কু-সঙ্কল্পকারিদিগের মুখনির্গত যতগুলি শব্দ তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইয়াছিল, ততগুলি বজ্রাঘাত তাঁহার বোধ হইয়াছে। যতক্ষণ না কথোপকথন সমাপ্ত হইয়াছিল, ততক্ষণ বসন্ত-বাতাহত অশ্বত্থ পত্রের ন্যায় তাঁহার ভীতি-কম্পিত তনু কোন মতে দণ্ডামান ছিল; কিন্তু কথা সমাপ্তি হইবামাত্র মাতঙ্গিনী আত্ম-বিবশা হইয়া ভূতলে বসিয়া পড়িলেন।

প্রথমতঃ কিয়ৎক্ষণ ত্রাস ও উৎকট মানসিক যন্ত্রণার আধিক্য প্রযুক্ত বিমূঢ়া হইয়া রহিলেন; ক্রমে মনঃস্থির হইলে দৈব-প্রকাশিত এই বিষম ব্যাপার মনোমধ্যে পরিচালনা করিতে লাগিলেন। এ পর্য্যন্ত তিনি নিজ ভর্ত্তাকে সম্পূর্ণরূপে চিনিতেন না; আজ তাঁহার চক্ষুরুন্মীলিত হইল। চক্ষুরুন্মীলনে যে করাল মূর্ত্তি দেখিলেন, তাহাতে মাতঙ্গিনীর শরীর রোমাঞ্চিত হইল। এ পর্য্যন্ত মনে ভাবিতেন যে, বিধাতা তাঁহাকে ক্রোধ-পরবশ দুর্নীত ব্যক্তির পাণিগৃহিতী করিয়াছেন; আজ জানিলেন যে, তিনি দস্যুপত্নী-দস্যু তাঁহার হৃদয়-বিহারী।

জানিয়াই বা কি? দস্যু-স্পর্শ হইতে পলাইবার উপায় আছে কি? স্ত্রী-জাতি-পতিসেবাপরায়ণা দাসী-পতিত্যাগের শক্তি কোথায়? চিরদিন দস্যুপদে দেহ-রত্ন অর্পিত হইবে-গরলোদ্গীর্ণমান বিষধর হৃদয়-পথে আসীন থাকিবে, পাছে সে আন্দোলনে আসনচ্যুত হয় বলিয়া কখন দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিতে পারিবে না। ইহা অপেক্ষা আর কি ভয়ঙ্কর ললাট-লিপি বিধাতার লেখনী হইতে নির্গত হইতে পারে?

মাতঙ্গিনী ক্ষণেককাল এইরূপ চিন্তা করিলেন; পরক্ষণেই যে দস্যুদল-সঙ্কলিত দারুণপ্রমাদ ঘটনা হইবে তাহাই মনোমধ্যে প্রখর তেজে প্রদীপ্ত হইতে লাগিল। আর কাহারই বা এই সর্ব্বনাশ ঘটনা হইবে? হেমাঙ্গিনীর সর্ব্বনাশ, মাধবের সর্ব্বনাশ! মাতঙ্গিনীর শরীর রোমাঞ্চ কণ্টকিত,-শোণিত শীতল হইতে লাগিল, মস্তক বিঘূর্ণিত হইতে লাগিল। যখন ভাবিলেন যে প্রিয় সহোদরা এক্ষণে এই নির্জ্জন নিশীথে হৃদয়বল্লভের কণ্ঠলগ্না হইয়া নিশ্চিন্ত মনে সুষুপ্তি সুখানুভব করিতেছে, সে মনেও জানে না যে, দারিদ্র্যরাক্ষসী তাহার পশ্চাতে মুখব্যাদান করিয়া রহিয়াছে, এখনই গ্রাস করিবে; হয়ত ধনহানির সঙ্গে মানহানি, প্রাণহানি পর্য্যন্ত হইবে তখনই মাতঙ্গিনীর নিজ সম্বন্ধীয় মর্ম্মব্যথক ভূত ভবিষ্যত চিন্তা অন্তর্হিত হইল। মনে মনে স্থির বুঝিলেন যে, আমি না বাঁচাইলে হেমাঙ্গিনী ও মাধবের রক্ষা নাই, যদি প্রাণ পর্য্যন্ত পণ করিয়া তাহাদের রক্ষা করিতে পারি, তবে তাহাও করিব।

মাতঙ্গিনী প্রথমোদ্যমে মনে করিলেন, গৃহস্থ সকলকে জাগরিত করিয়া সকল ঘটনা বিবৃত করেন, কিন্তু তৎক্ষণাৎ সে ভাব অন্তর্হিত হইল; ভাবিলেন, তাহাতে কোন উপকার হইবে না। কেন না, রাজমোহনের আত্মপরিবার এমত অশ্রুতপূর্ব্ব সংবাদ বিশ্বাস হইবেক না; বিশ্বাস করিলেও মাধবের উপকারার্থ রাজমোহনের বিরুদ্ধাচারী হইবেক না। বরং লাভের মধ্যে তাহারা রাজমোহনের নিকট মাতঙ্গিনীকে এতদ্বিষয়ে সংবাদ-দাত্রী বলিয়া পরিচিত করিলে মাতঙ্গিনীর মহাবিপদ্ সম্ভাবনা।

পশ্চাৎ বিবেচনা করিলেন যে, কেবল কনককে জাগ্রত করিয়া তাহাকে সকল সংবাদ অবগত করান; এবং যাহা উচিত হয় পরামর্শ করেন। তদভিপ্রায়ে মাতঙ্গিনী শয্যাত্যাগ করিয়া বাটীর বাহিরে আসিলেন। কনকের গৃহ সন্নিকট। মাতঙ্গিনী ধীরে ধীরে কনকের গৃহাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন।

চন্দ্রালোকে পৃথিবী প্রফুল্লিতা। মাতঙ্গিনী কনকের গৃহ দ্বারে উপনীত হইয়া ধীরে ধীরে করাঘাত করিলেন, কনকের নিদ্রাভঙ্গ হইতে না হইতে কনকের মাতা কহিল, “কে রে?”

সর্ব্বনাশ! কনকের মাতা অতিশয় মুখরা, মাতঙ্গিনীর এ কথা স্মরণই ছিল না। মাতঙ্গিনী ভয়ে নিঃশব্দ রহিলেন। কনকের মাতা পুনঃ পুনঃ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে রে?” “কে রে?”

মাতঙ্গিনী সাহস করিয়া কম্পিত কণ্ঠে বলিল, “আমি গো।”

কনকের মাতা কোপযুক্ত স্বরে কহিল, “কে?-রাজুর বৌ বুঝি, এত রাত্রে তুমি এখানে কেন গা?”

মাতঙ্গিনী মৃদুস্বরে বলিলেন, “কনককে একটা কথা বলিব।”

কনকের মাতা বলিল, “রাত্রে কথা কি আবার একটা? সারাদিন কথা কয়ে কি আশ মেটে না? ভালমানুষের মেয়েছেলে রাত্রে এ-বাড়ী ও-বাড়ী কি গা? বউ-মানুষ, এখনই এ সব ধরেছ?-চল দেখি তোমার পিশেসের কাছে।”

মাতার তর্জ্জনে গর্জ্জনে কনকের নিদ্রাভঙ্গ হইল; বৃত্তান্ত বুঝিয়া কনক কহিল, “মা, দুয়ারটা খুলে দাও, শুনিই না কি বলে।”

কনকের মাতা গর্জ্জন করিয়া বলিল, “দেখ্ কন্‌কি, এমন মুড়ো ঝাঁটা তোর কপালে আছে।”

কনক নিস্পন্দ ও নির্ব্বাক্ হইল। মাতঙ্গিনী দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন, এবং পুনরায় গভীর চিন্তায় অভিভূত হইলেন। ভাবিলেন, “কি করি? কেমন করে তাদের রক্ষা হয়? কে সংবাদ দিবে?-কে এ রাত্রে যাইবে? আমি আপনিই যাই, এ ছাড়া অন্য উপায় নাই।” পরক্ষণে ভাবিলেন-“কেমন করিয়া যাইব? লোকে কি বলিবে? মাধব কি মনে করিবে? শুধু তাহাই নহে, স্বামী জানিতে পারিলে প্রমাদ ঘটিবে। তাহা হউক-লোকে যাই বলুক-মাধব যাহা হয় মনে করুক-স্বামী যাহা করে করুক, তজ্জন্য মাতঙ্গিনী ভীতা নহে।”

কিন্তু মাতঙ্গিনী যাইতে সাহস করিলেন না। এ গভীর নিশীথকালে, এই নিস্তব্ধ বনান্ত পথ, তাহাতে আবার একাকিনী অবলা, নবীন বয়সী, বাল্যকালাবধি ভৌতিক উপন্যাস শ্রবণে হৃদয়মধ্যে ভৌতিক-ভীতি বিষম প্রবলা। পথ অতি দুর্গম। তাহাতে আবার দস্যুদল কোথায় জটলা করিয়া আছে; যদি তাহাদের করকবলিত হয়েন? এই কথা স্মৃতিমাত্র ভয়ে মাতঙ্গিনীর শরীর রোমাঞ্চিত হইল। যদি দস্যুদলমধ্যে মাতঙ্গিনী স্বামীর দৃষ্টিপথে পতিতা হয়েন? এই ভয়ে মাতঙ্গিনী পুনঃ পুনঃ রোমাঞ্চিত হইতে লাগিলেন।

স্বভাবতঃ মাতঙ্গিনীর হৃদয় সাহস-সম্পন্ন। যে অন্তঃকরণে স্নেহ আছে, প্রায় সে অন্তঃকরণে সাহস বিরাজ করে। প্রিয়তমা সহোদরা ও তৎপ্রতির মঙ্গলার্থ মাতঙ্গিনী প্রাণ পর্য্যন্ত দিতে উদ্যত হইলেন। যেমন উপস্থিত বিপত্তির বিকট মূর্ত্তি পুনঃ পুনঃ মনোমধ্যে প্রকটিত হইতে লাগিল, অমনি মাতঙ্গিনীও হৃদয়গ্রন্থি দৃঢ়বদ্ধ হইতে লাগিল-তখন অগাধ প্রনয়-সলিলে ভাসমান হইয়া বলিলেন, “এ ছার জীবন কার আর কি জন্য? যদি এ সঙ্কল্পে প্রাণ রক্ষা না হয়, তাতেই বা ক্ষতি কি? এ গুরুভার বহন করা আমার পক্ষে কষ্টকর হইয়াছে। কাজেই এ দেহ ত্যাগ করিতে ইচ্ছা করে। যাহারা প্রাণাধিক্ তাহাদের মঙ্গল সাধনে এ প্রাণ ত্যাগ না করি কেন? আমার ভয় কি? প্রাণনাশাধিক বিপদও ঘটিতে পারে; জগদীশ্বর রক্ষাকর্ত্তা।”

কিন্তু মাধবের বাটীতে এ নিশীথে একাকিনী কি প্রকারেই যান? মাতঙ্গিনীর চিন্তাকুলতা সহনানীত হইল।

কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া মাতঙ্গিনী দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া চিন্তাসম্বর্দ্ধিত গ্রীষ্মাতিশয্যের প্রতিকার হেতু জালরন্ধ্র সন্নিধানে গিয়া জালাবরণী উত্তোলন করিলেন। দেখিলেন যে, বিটপী শ্রেণীর ছায়া এক্ষণে দীর্ঘাকৃত হইয়াছে-অস্তাচলাভিমুখী নিশাললাটরত্ন প্রায়-দিগন্তব্যাপী বৃক্ষশিরোরাজির উপরে আসিয়া নির্ব্বাণোন্মুখ আলোক বর্ষণ করিতেছেন। আর দুই চারি দণ্ড পরে সে আলোক একেবারে নির্ব্বাপিত হইবে; তখন আর হেমাঙ্গিনীকে রক্ষা করিবার সময় থাকিবে না। বিপদ্ একেবারে সম্মুখে দেখিয়া মাতঙ্গিনী আর বিলম্ব করিলেন না।

মাতঙ্গিনী ঝটিতি এক খণ্ড শয্যোত্তরচ্ছদে আপাদমস্তক দেহ আবরিত করিলেন, এবং কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্তা হইয়া যে কৌশলপ্রভাবে ক্ষণপূর্ব্বে রাজমোহন বাহির হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়াছিলেন, মাতঙ্গিনীও তদ্রূপ করিলেন।

গৃহের বাহিরে দণ্ডায়মানা হইয়া যখন মাতঙ্গিনী ঊর্দ্ধে অসীম নীলাম্বর, চতুর্দ্দিকে বিজন বন-বৃক্ষের নিঃশব্দ নিস্পন্ত্র শিরঃশ্রেণীর নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন, তখন পুনর্ব্বার সাহস দ্রবীভূত হইয়া গেল-হৃদয় শঙ্কাকম্পিত হইল-চরন অচল হইল। মাতঙ্গিনী অঞ্জলিবদ্ধ করে ইষ্টদেবের স্তব করিলেন। হৃদয়ে আবার সাহস আসিল; তিনি দ্রুতপাদবিক্ষেপে পথ বহিয়া চলিলেন।

বনময় পথ দিয়া যাইতে প্রভাতবাতাহত পদ্মের ন্যায় মাতঙ্গিনীর শরীর কম্পিত হইতে লাগিল। সর্ব্বত্র নিঃশব্দ; মাতঙ্গিনীর পাদবিক্ষেপশব্দ প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল; স্থানে স্থানে নিবিড় ছায়ান্ধকারে অন্তঃকরণ শিহরিতে লাগিল। যত বৃক্ষের গুঁড়ি ছিল প্রত্যেককে করালবদন পৈশাচ মূর্ত্তি বলিয়া ভ্রম হইতে লাগিল, বৃক্ষে বৃক্ষে, শাখায় শাখায়, পত্রে পত্রে, নরঘ্ন প্রেত লুক্কায়িতভাবে মাতঙ্গিনীকে লক্ষ্য করিতেছে তাহা তাঁহার প্রতীতি হইতে লাগিল। যে যে স্থলে তমসা নিবিড়তর, সেই সেই স্থানে দুরন্ত ভূতযোনী বা দস্যুর প্রচ্ছন্ন শরীরের ছায়া মাতঙ্গিনীর চক্ষুর্জ্বালা উৎপাদন করিতে লাগিল। বাল্যকালে যত ভৌতিক উপন্যাস শ্রুত হইয়াছিল, নিশীথ পান্থের গহনমধ্যে বিকট পৈশাচ দংষ্ট্র ভঙ্গী সন্দর্শনে ভীতি-বিহ্বল হইয়া প্রাণত্যাগ করার যে সকল উপকথা শ্রবণ করিয়াছিলেন, সে সকলই একেবারে তাঁহার স্মরণপথে আসিতে লাগিল।

যদি কোথাও শাখাচ্যুত শুষ্কপত্র-পতন শব্দ হইল, যদি কোনও শাখারূঢ় নৈশ বিহঙ্গ পক্ষস্পন্দন করিল, যদি কোথাও শুষ্কপত্রমধ্যে কোন কীট দেহ সঞ্চালন করিল, অমনি মাতঙ্গিনী ভয়ে চমকিয়া উঠিতে লাগিলেন; তথাপি দৃঢ় সঙ্কল্প-বিবদ্ধা সাহসিকা তরুণী, কখন বা ইষ্টদেব নামজপ কখন বা প্রিয়জনগনের বিপত্তি চিন্তা করিতে করিতে চঞ্চলপদে উদ্দিষ্ট স্থানাভিমুখে চলিলেন।

ভয়সঙ্কুল নিবিড় তমসাচ্ছন্ন পথের এক পার্শ্বে বৃহৎ আম্র-কানন অপর পার্শ্বে এক দীর্ঘিকার পাহাড়। বন্য উচ্চভূমিখণ্ডমধ্যে পথ অতি সঙ্কীর্ণ; তদুপরি দীর্ঘিকার উপর প্রকাণ্ডাকার কতিপয় বটবৃক্ষের ছায়ায় চন্দ্রালোকের গতি নিরুদ্ধ হইয়াছিল, সুতরাং এই স্থানে পথান্ধকার নিবিড়তর। দীর্ঘিকার পাহাড়ের বটবৃক্ষতল বহুতর লতাগুল্ম কণ্টক বৃক্ষাদিতে সমাচ্ছন্ন।

মাতঙ্গিনী ভীতি-চকিতনেত্রে ইতস্ততঃ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। আম্র-কাননের মধ্যে একটা প্রচণ্ড আলোক প্রদীপ্ত হইতেছিল, এবং অস্ফুটস্বরে বহু ব্যক্তির কথোপকথনের শব্দও মাতঙ্গিনীর কর্ণগোচর হইল।

মাতঙ্গিনী বুঝিলেন, যাহা ভর করিয়াছিলেন, তাহাই ঘটিল। এই আম্র-কাননের মধ্যে দস্যুদল জটলা করিতেছে। দুঃসময়ে বিপদ্ এক প্রকারে কেবল উপস্থিত হয় না;-পথিমধ্যে একটা কুকুর শয়ন করিয়াছিল, নিশাকালে পথিক দেখিয়া উচ্চরব করিতে লাগিল। আম্র-কাননের কথোপকথন তৎক্ষণাৎ বন্ধ হইল। মাতঙ্গিনী বুঝিতে পারিলেন যে, কুকুর-শব্দে দুরাত্মারা লোকসমাগত অনুভূত করিয়াছে; অতএব শীঘ্রই তাহারা কাছে আসিবে। আসন্নকালে মাতঙ্গিনী নিঃশব্দ গমনে দীর্ঘিকার জলের নিকট আসিয়া দাঁড়াইলেন। আম্র-কানন বা পথ হইতে তাঁহাকে কেহ দেখিতে পাইবার সম্ভাবনা রহিল না। কিন্তু যদি দস্যুরা দীর্ঘিকার তটারোহণ করিয়া পথিকের অণ্বেষণ করে, তাহা হইলে মাতঙ্গিনী তৎক্ষণাৎ দৃষ্টিপথে পতিত হইবেন। নিকটে এমত কোন ক্ষুদ্র বৃক্ষলতাদি ছিল না যে, তদন্তরালে লুক্কায়িত হইতে পারেন। কিন্তু আসন্ন বিপদে মাতঙ্গিনীর ধৈর্য্য ও কর্ত্তব্যতৎপরতা বিশেষ স্ফূর্ত্তি প্রাপ্ত হইয়া উঠিল।

ক্ষণমধ্যে মাতঙ্গিনী জলতীরস্থ এক খণ্ড গুরুভার আর্দ্র মৃৎখণ্ড উত্তোলন করিয়া অঙ্গস্থ শয্যোত্তরচ্ছদের মধ্যে রাখিয়া গ্রন্থিবন্ধন করিলেন। অনায়াস-গোপনযোগ্য পরিধেয় শাটীমাত্র অঙ্গে রাখিয়া কৃতপ্রতিজ্ঞ হইয়া দণ্ডায়মান রহিলেন। এক্ষণে পুষ্করিণীর পাহাড়ের অপর দিকে মনুষ্যকণ্ঠস্বর স্পষ্ট শ্রুতিগোচর হইল, এবং মনুষ্যসঞ্চালনশব্দও নিঃসন্দেহে শ্রুত হইল। মাতঙ্গিনী ঈদৃশ সাবধানতার সহিত শয্যোত্তরচ্ছদ জলমগ্ন করিলেন যে, জলশব্দ না হয়। বস্ত্রখণ্ড মৃৎখণ্ডের গুরুভারে তলস্পর্শ করিয়া অদৃশ্য হইল। মাতঙ্গিনী এক্ষণে ধীরে ধীরে জলমধ্যে অবতরণ করিয়া অন্ধকারবর্ণ স্বচ্ছ সরোবর-বক্ষে যথায় কথিত বটবিটপীর ছায়ায় প্রগাঢ়তর অন্ধকার হইয়াছিল, তথায় অধর পর্য্যন্ত জলমগ্ন হইয়া রহিলেন। তাঁহার মুখমণ্ডল ব্যতীত আর কিছু জলের উপর জাগিতেছিল না। তথাপি কি জানি, যদি সেই মুখমণ্ডলের উজ্জ্বলবর্ণ সে নিবিড় অন্ধকার মধ্যে কেহ লক্ষ্য করে, এই আশঙ্কায় মাতঙ্গিনী নিজ কবরীবন্ধনী উন্মোচন করিয়া কোমলকুঞ্চিত কুন্তলজাল মুখের উপর লম্বিত করিয়া দিলেন। অতঃপর সেই ঘনান্ধকারবর্ণ সরসীজলের উপরে, ঘনতর বৃক্ষ-ছায়াভ্যন্তরে যে নিবিড় কেশদাম ভাসিতেছিল তাহা মনুষ্য কর্ত্তৃক আবিষ্কৃত হওয়া অসম্ভব। পরক্ষণেই কথোপকথনকারীরা দীর্ঘিকা-তট অবতরণ করিয়া অর্দ্ধপথ আসিল। মাতঙ্গিনী তাহাদের কেবলমাত্র কণ্ঠস্বর ও পদশব্দ শুনিতে পাইলেন। তাহাদের পানে যে চাহিয়া দেখিবেন, এমত সাহস হইল না।

আগন্তুকদের মধ্যে একজন অর্দ্ধস্ফুট বাক্যে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে কহিল, “এ ত বড় তাজ্জব! আমি সঠিক বলিতেছি, আমি বেশ দেখিয়াছিলাম, এই পথের উপর একটা মানুষ চাদর মুড়ি দিয়া যাইতেছিল; বাগানের বেড়ার ফাঁক দিয়া আমি দেখিয়াছিলাম।”

দ্বিতীয় ব্যক্তি কহিল, “গাছপালা দেখে তোর ধাঁধা লেগে থাক্‌বে; অপদেবতা টেবতাই বা দেখে থাক্‌বি। এত গর্‌মিতে মানুষে কাপড় মুড়ি দিয়া বেড়াবে কেন?”
“হবে” বলিয়া পুনশ্চ উভয়ে ইতস্ততঃ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল ; আশঙ্কার মূল কারণ যে ভীতিবিহ্বলা অবলা তাঁহাকে তাহারা দেখিতে পাইল না।

দস্যুরা কিছু দেখিতে না পাইয়া চলিয়া গেল। যতক্ষণ তাহাদের প্রত্যাবর্ত্তন-শব্দ কর্ণগোচর হইতে লাগিল ততক্ষণ মাতঙ্গিনী জলমধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত করিয়া স্থিরভাবে দণ্ডায়মান রহিলেন। যখন বিবেচনা হইল যে, আর তাহাদের দেখিতে পাইবার সম্ভাবনা নাই, তখন জল হইতে উঠিয়া গমনোদ্যোগিনী হইলেন।

মাতঙ্গিনী যে পথে গমনকালীন এরূপ বিপদ্‌গ্রস্ত হইয়াছিলেন, শঙ্কাক্রমে এবার সে পথ ত্যাগ করিলেন। পুষ্করিণীর তীর পরিবেষ্টন করিয়া অপর দিকে এক পথে উঠিলেন। মধুমতী যাইতে মাতঙ্গিনীর নিষেধ ছিল বটে, কিন্তু পুষ্করিণী নিষিদ্ধ ছিল না, এবং মধ্যে মধ্যে আহ্নিক স্নানাদি ক্রিয়ার্থ এই জলে আসিতেন। সুতরাং এ স্থানের সকল পথ উত্তমরূপে চিনিতেন। পুষ্করিণীর অন্য এক পাহাড়ে উঠিয়া অন্য এক পথ অবলম্বন করিলে যে পূর্ব্বাবলম্বিত পথে পড়িতে হয়, অথচ আম্র-কাননের ধারে যাইতে হয় না, ইহা এই সময়ে মাতঙ্গিনীর স্মরণ হইল। বৃক্ষলতাকণ্টকাদির প্রাচুর্য্য বশতঃ এই পথ অতি দুর্গম, কিন্তু মাতঙ্গিনীর পক্ষে কণ্টকাদির বিঘ্ন, তুচ্ছ বিঘ্ন অলক্তক পরিবর্ত্তে কণ্টক-বেধবাহিত রক্তধারা চরণদ্বয় রঞ্জিত করিতে লাগিল। এক দিকে গুরুতর সঙ্কল্প সিদ্ধির জন্য উৎকণ্ঠা, অপর দিকে দস্যু-হস্ত হইতে পরিত্রাণের জন্য ব্যগ্রতা; এই উভয় কারণে মাতঙ্গিনী তিলার্দ্ধ বিলম্ব না করিয়া কণ্টকলতাদি পদদলিত করিয়া চলিলেন। কিন্তু এক নূতন ব্যাঘাত উপস্থিত হইবার উপক্রম হইল;-মাতঙ্গিনী রাধাগঞ্জে আসিয়া অবধি দুই তিনবার মাত্র সহোদরাবল্লভ মাধবের আলয়ে আগমন করিয়াছিলেন, কিন্তু পদব্রজে একবারও গমন করেন নাই। সুতরাং এদিকের পথ তাঁহার তেমন জানা ছিল না। এক্ষণে মাতঙ্গিনী চতুর্দ্দিকবাহী পথ-সন্নিধানে উপনীতা হইয়া কোন্ পথে যাইবেন, তাহা অবধারণে অক্ষম হইলেন। মাতঙ্গিনী পাগলিনীর ন্যায় ইতস্ততঃ চাহিতে লাগিলেন। ভাগ্যক্রমে মাধবের অট্টালিকার সম্মুখ-রোপিত দেবদারু-শ্রেণীর শিরোমালা নয়নগোচর হইল। দৃষ্টিমাত্র হর্ষিতচিত্তে তদভিমুখে চলিলেন; এবং সত্বর অট্টালিকার সমীপবর্ত্তিনী হইয়া খিড়কির দ্বারে উপস্থিত হইলেন। তথাপি মাতঙ্গিনীর ক্লেশের চূড়ান্ত হইল না। এ নিশীথে বাটীর সকলেই নিদ্রিত, কে দ্বার খুলিয়া দিবে? অনেকবার করাঘাত করিয়া মাতঙ্গিনী পুরকিঙ্করী করুণাকে নিদ্রোত্থিতা করিলেন। নিদ্রাভঙ্গে করুণা অপ্রসন্ন হইয়া ভীষণ গর্জ্জন করিয়া কহিল, “এত রেতে কে রে দোর ঠেঙ্গায়?”

মাতঙ্গিনী উৎকণ্ঠা-তীব্র স্বরে কহিলেন, “শীঘ্র-শীঘ্র করুণা, দ্বার খোল।” নিদ্রাভঙ্গকরণ-অপরাধ অতি গুরুতর ; এমন সহজে ক্ষমা সম্ভাবনা কি? করুণার ক্রোধোপণম হইল না, পূর্ব্ববৎ পুরুষ বচনে কহিল, “তুই কে যে তোকে আমি তিন পর রেতে দোর খুলে দেব?”

মাতঙ্গিনী স্পষ্টে আপন নাম ডাকিয়া কহিতে পারেন না, অথচ শীঘ্র গৃহ-প্রবেশ জন্য ব্যস্ত হইয়াছেন; অতএব পুনরায় সবিনয়ে কহিলেন, “তুমি এস শীঘ্র এসো গো, এলেই দেখ্‌তে পাবে।”

করুণা সম্বর্দ্ধত রোষে কহিল, “তুই কে বল্ না, আ মরণ‌!”

মাতঙ্গিনী কহিলেন, “ওগো বাছা, আমি চোর ছ্যাঁচড় নই, মেয়ে মানুষ।”

তখন করুণার স্থূল বুদ্ধিতেও একটু একটু আভাস হইল যে, চোর ছ্যাঁচড়ের কণ্ঠস্বর এত সুমধুর প্রায় দেখা যায় না। অতএব আর গণ্ডগোল না করিয়া দ্বার খুলিয়া দিল। এবং মাতঙ্গিনীকে দেখিবামাত্র সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, “এ কি! তুমি! তুমি ঠাকুরাণী!”

মাতঙ্গিনী কহিলেন, “আমি একবার হেমের সঙ্গে দেখা করিব-বড় দরকার; শীঘ্র আমাকে হেমের কাছে লইয়া চল।”

Leave a Reply