নব-বিধান

‘নব-বিধান’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৩০ বঙ্গাব্দের মাঘ ও ফাল্গুন এবং ১৩৩১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ, আষাঢ়,  শ্রাবণ, আশ্বিন ও কার্তিক সংখ্যা ‘ভারতবর্ষ’ মাসিক পত্রে। পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় আশ্বিন, ১৩৩১ বঙ্গাব্দ মুতাবিক অক্টোবর, ১৯২৪ খৃষ্টাব্দে। ২০১৩ খৃষ্টাব্দে ‘নববিধান’ উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ব প্রচার মাধ্যম ‘দূরদর্শন’ ‘তুমহারি পাখি’ নামে একটি ধারাবাহিক নির্মাণ ও প্রচার করেছিল।

কাহিনীর মুখ্যচরিত্র শৈলেশ্বর কলিকাতার একটা নামজাদা কলেজের দর্শনের অধ্যাপক। বয়স বত্রিশ। বিপত্নীক। একটি নয় বছরের ছেলে আর চাকরদের নিয়েই তার সংসার। স্ত্রী বিয়োগের বছর পাঁচেক পর তার পুনরায় বিবাহের সাধ হল। জানা গেল, ভবানীপুরের ভূপেন বাঁড়ুজ্যের মেজ মেয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছে। শৈলেশ্বরেরই বৈঠকখানায় চায়ের বৈঠকে এই আলোচনাই উঠে পড়ে। আলোচনায় বন্ধু-সমাজের না হলেও একজন অল্প-বেতনের স্কুল শিক্ষক ছিল, সে বলল—“একটা বৌকে তাড়ালেন, একটা বৌকে খেলেন, আবার বিয়ে! সংসার করতেই যদি হয় ত উমেশ ভট্‌চায্যির মেয়ে দোষটা করলে কি শুনি? ঘর করতে হয় ত তাকে নিয়ে ঘর করুন।”

সে উমেশ ভট্‌চায্যির মেয়ে উষা এই কাহিনীর মূখ্য নারী চরিত্র। শৈলেশ্বর বিলেত যাবার আগে তাকে বিয়ে করে, কিন্তু তার শ্বশুরের সাথে শৈলেশ্বরের পিতার বিবাদ হয়, সেই বিবাদ আর কিছুর নয়, যৌতুকের। পরে পাগল বলে উষাকে গৃহছাড়া করে শৈলেশ্বরের পিতা, সেও দেশে ফিরে উষাকে আর ঘরে তুলেনি। অতিশয় অভিমানী প্রকৃতির উমেশ তর্কালঙ্কারও নিজে যেচে নিজের ও কন্যার সম্মান বিসর্জন দিয়ে কন্যাকে শ্বশুরালয়ে পাঠাতে সম্মত হলেন না।

তৃতীয় বিয়েতে বন্ধুদের মত না পেয়ে অনেক ভেবে-চিন্তে শৈলেশ্বর উষাকে ঘরে আনাই স্থির করল। ভেবেছিল উষা হয়ত আসবে না, এলেও টিকবে না। তার ছেলে সোমেন্দ্রকে উষা ভাল বাসতে পারবে না, আবার সোমেন্দ্রও তাকে মা বলে মেনে নিতে পারবে না। কিন্তু ব্যাপারটা হল শৈলেশ্বরের ভাবনার বিপরীত।

কিন্তু শৈলেশ্বের বোন বিভা ভাইয়ের পরামর্শে সোমেনকে নিতে এল। উষা তাকে সম্মান-যত্ন করলেও সে তো আগেই মনকে তিক্ত করে এসেছিল, বলল, ‘বসবার সময় নেই আমার—ঢের কাজ। সোমেনকে আমি নিতে এসেচি।’ এই রুক্ষতার জবাব উষা হাসি মুখেই দিল। সোমনেও পিসির সাথে যেতে রাজি হল না, সে তার নতুন মায়ের কাছেই রয়ে গেল। কিন্তু বিভাও এত সহজে হেরে যাওয়ার রমনী নয়।

সোমেন যেমন নতুন মায়ের ভালবাসায় স্নিগ্ধ হয়, তেমনি শৈলেনও বুঝতে পারে ভালবাসা কি জিনিস। তবুও বোন বিভার ষড়যন্ত্র আর নিজের মানসিক দ্বন্ধের কারণে সে উষাকে পুনরায় হারাতে বসে।

 

নারীর ভালবাসার রূপ বোঝা বহুক্ষেত্রেই পুরুষের জ্ঞানসীমার বাইরে। নারী চোখ বুঝে সব সহ্য করে শুধু ভালবেসে যায়। তাদের ভালবাসার গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করাটা জীবনের চরম ভুল। তারা চাঁদের মত নিঃশব্দে আসে, সূর্যোদয় হওয়ার আগে ভালবাসার মহিমা অর্পণ করে চলে যায়। কখনো কাউকে বুঝতে দেয় না ভালবাসার গভীরতার পারদ কতটুকু।

উষা যেন জলের মত তরল। যার চোখে মুখে শুধু কল্যাণ। যে নারী দেবীর সমতুল্য। মানুষ বলে, যে তোমাকে দেবী করল, সে তোমাকে বির্সজন দিবে! কথাটা তারা বুঝে বলে কি না, যথেষ্ট সন্দেহ আছে বৈ কি। তোমরা কি বুঝ না কতটা ভক্তি নিয়ে দেবীর প্রতিমা বির্সজন দেয়, তার ভালবাসাটাকে বির্সজন দেয় না। সে তেমনি করে রোজ দেবীকে পূর্জা দেয়, ভালবাসে।

নব-বিধানে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেমন দেবীতুল্য উষাকে এঁকেছেন, তেমনটি দেখিয়েছেন নারীর আরেক রূপ, যা প্রদর্শিত হয়েছে বিভা চরিত্রে। বিভা চরিত্র দিয়ে আধুনিক ভারতে নারীর চাল-চলন, আচরণ তুলে ধরেছেন। আর উষা চরিত্র দিয়ে সে প্রাচীন নারী, যে পতিব্রতা, যে রোজ পূজা করে, নিজের মত করে সংসার পরিচালনা করে; যার আছে আত্ম-সম্মান আর নিজেকে চেনার অপূর্ব দক্ষতা।

লেখক এখানেও নারীর আত্মমর্যাদার বিষয়টি বিশেষ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। একজন নারীর প্রকৃত চরিত্র কেমন হওয়া উচিত–এই বইয়ে তাঁর মর্মটাই বুঝতে পারা যায়। যে স্বামীকে উষা ভালভাবে চেনে না, জানে না; তবুও সেই স্বামীর প্রতি তাঁর কর্তব্য ও শ্রদ্ধা এক অনন্য রূপ ধারণ করছে।