মুসলমান সাহিত্য[১]

লাটসাহেব বললেন, মুসলমানদের নিয়ে গল্প লিখবে। এ-কাজ যদি করতে পার তা হলে অত্যন্ত ভাল হয়। সাহিত্য নিয়ে আমি কোনদিন ছেলেখেলা করিনি। —অন্য ব্যাপারে হয়ত কথা রাখতে পারি। ১৯১৬ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসি; স্বর্গীয় পাঁচকড়ি বাঁড়ুয্যের সঙ্গে দেখা, বললেন, তুই নাকি লিখিস? আমায় দিস্‌ ত দু-একখানা বই। আমি বললাম, ও কিছুই নয়। তিনি বললেন, দ্যাখ্ তোকে যদি কেউ আক্রমণ করে তা হলে আমায় বলে দিবি। দ্যাখ্ কাগজ চালাতে গিয়ে যাদের গালাগালি দেওয়া উচিত নয়, তাদেরও গালাগালি দিতে হয়েছে। তুই ত আমার কাছে পড়েছিস্— যা নিজের জীবনে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে সত্যি হয়ে উঠবে—অবশ্যি কল্পনা থাকবে, তাই হবে সাহিত্যবস্তু। নিজের আয়কে অতিক্রম করে ব্যয় করতে যেয়ো না!

আমি বললাম, আশীর্ব্বাদ করুন।

তিনি বলিলেন, আশীর্ব্বাদ নয়, এই আমার আদেশ।

লোকে বলতে পারে পাঁচকড়ি বাঁড়ুয্যে লোক ভাল ছিলেন। কিন্তু তিনি এমন সমালোচনা করেছিলেন যা হয়ত তাঁর ইচ্ছে ছিল না।

ঐ দুটো কথা—কখনো আয়কে অতিক্রম করে চ’লো না, আর নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখবে। সাহিত্য সত্যও নয়, পুলিশ রিপোর্টও নয়। প্রথম যখন লোকে বলেছে, ঐ সব অস্বাভাবিক, হয় না, – ৩৫/৩৬ বছর বয়সে প্রথম ‘চরিত্রহীন’— সমালোচনা দেখে বুঝলাম প্রত্যেক পাঠক আমার চেয়ে বুদ্ধিমান। আর আমি ওটা কতবার দেখেছি, আর তোমরা একবার পড়েই সমালোচনা করলে।

আমায় যে লোকে ভালবাসল তার প্রধান কারণই হচ্ছে এই, লোকের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমার কথাগুলো মেলে। মানুষ সত্যি ছোট নয়। এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশবার দরুন অনেক কথা জানতে পেরেছিলাম, যেটা বাইরে থেকে জানা যায় না।

এক সময়ে মুসলমান-সমাজ পিছিয়ে পড়েছিল, গভর্ণমেণ্টই একরকম দাবিয়ে দিয়েছিল। Communal Award নিয়ে আলোচনা করবার জন্য ডাকা হয়েছিল। এক ভদ্রলোক বলেছিলেন, Why are you afraid of this Muhamadan people? Without Hindu’s help they can’t go on, they have to take it. এখন ওরা গভর্ণমেণ্টের সাহায্যে নিজেদের কথাটা বুঝেছে।

আমার বিশ্বাস, সাহিত্যের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার গর্কি প্রভৃতিকে ভাল লাগে— তাদের সঙ্গে আমাদের কোন মিল নাই, তবু তাঁদের appreciate করি। মুসলিম সাহিত্য-সমাজ আমি নিজে একটা গড়ব। এ-ছাড়া আমাদের সত্যি পথ নেই— আমি মুসলমানদের ঐ কথাটা অনেকবার বলেছি।

মুসলমান ছেলেরা আমার কাছে একখানা বই রাখলে, উপরে লেখা— “শ্যালক বঙ্কিমের গ্রন্থাবলী।”

বললাম, অপমান করবার জন্যেই কি এসেছ? একজন মৃত ব্যক্তিকে অপমান করা ঠিক নয়। বঙ্কিমবাবু অনেক জায়গায় অকারণ মুসলমানদের আক্রমণ করেছেন। তখন ওরা ছিল অত্যন্ত নিৰ্জ্জীব। কিন্তু সমস্ত action-এরই reaction আছে।

‘বঙ্কিম-দুহিতা’ বলে একখানা বই—অনেক নোংরা কথা তাতে আছে, এগুলো হতে বাধ্য। জাহানারা একদিন বললে, একটা লেখা দিতে হবে। আমার ‘বর্ষবাণী’ বেরুচ্ছে। তার আগে এখানের কাজী মোতাহার হোসেন বললেন, আপনার কি আমাদের একঘরে করে রেখে দেবেন? রবীন্দ্রনাথ বললেন, আমার উপরে এদের অনেকগুলি চিঠি এসেছে। আমায় চিঠি দিয়েছে ঔরঙ্গজেব সম্বন্ধে কি কতকগুলি তুলে দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ভয়ানক ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ও-সবের ভেতর আর আমি যেতে চাই না। ভোলানাথ যখন মারা গেল তার অপরাধটা কি? আক্রাম খাঁর ছেলেই কাগজ চালায়। তাদের spirit-এর একটা দৃষ্টান্ত দিই। নরেন দেবের কাছে লেখা চলে গেছে, বলে, “বাংলা থোড়া বহুৎ সমঝ্‌তে হেঁ, বোলনে নেই সাক্‌তে।”

আমাদের আশঙ্কা ওরা প্রথমে বাংলাটাকে নষ্ট করবে। ওরা যখন বাংলাকে মাতৃভাষা বলে স্বীকার করে না।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ১৯৩৬ সালের ৩১শে জুলাই ঢাকায় রূপলাল হাউসে ‘শান্তি’ পত্রিকার পক্ষ হতে অনুষ্ঠিত সম্মিলনে প্রদত্ত বক্তৃতা। প্রথম মুদ্রিত হয় ১৩৪৩ সালের ১৯শে ভাদ্র সংখ্যার ‘বাতায়ন’ পত্রিকায় এবং ‘শরৎচন্দ্রের পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনাবলী’র অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রথম গ্রন্থভূক্ত হয় শ্রাবণ, ১৩৫৮ সালে। পরবর্তীতে ‘শরৎ সাহিত্য-সংগ্রহ’, ষষ্ঠ সম্ভারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়।