খালেদ

খালেদ! খালেদ! শুনিতেছে নাকি সাহারার আহা-জারি?

কত ‘ওয়েসিস’ রচিল তাহার মরু-নয়নের বারি।

মরীচিকা তার সন্ধানী-আলো দিকে দিকে ফেরে খুঁজি

কোন নিরালায় ক্লান্ত সেনানী ডেরা গাড়িয়াছ বুঝি!

বালু-বোররাকে সওয়ার হইয়া ডাক দিয়া ফেরে ‘লু’,

তব তরে হায়! পথে রেখে যায় মৃগীরা মেশক-বু!

খর্জুর-বীথি আজিও ওড়ায় তোমার জয়ধ্বজা,

তোমার আশায় বেদুইন-বালা আজিও রাখিছে রোজা।

‘মোতাকারিব’-এর ছন্দে উটের সারি দুলে দুলে চলে,

দু-চোখ তাদের দিশাহারা পথে আলেয়ার মতো জ্বলে।

‘খালেদ! খালেদ!’ পথ-মঞ্জিলে ক্লান্ত উটেরা কহে,

“বণিকের বোঝা বহা তো মোদের চিরকেলে পেশা নহে!”

‘সুতুর-বানের’ বাঁশি শুনে উট উল্লাস-ভরে নাচে,

ভাবে, নকিবের বাঁশরির পিছে রণ-দামামাও আছে।

ন্যুব্জ এ পিঠ খাড়া হত তার সওয়ারের নাড়া পেয়ে,

তলওয়ার তির গোর্জ নেজায় পিঠ যেত তার ছেয়ে।

খুন দেখিয়াছে, তূণ বহিয়াছে, নুন বহেনিকো কভু!

* * *

বালু ফেড়ে ওঠে রক্ত-সূর্য ফজরের শেষে দেখি,

দুশমান-খুনে লাল হয়ে ওঠে খালেদি আমামা এ কী!

খালেদ! খালেদ! ভাঙিবে নাকি ও হাজার বছরি ঘুম?

মাজার৬ ধরিয়া ফরিয়াদ করে বিশ্বের মজলুম!—

শহীদ হয়েছ? ওফাত হয়েছে? ঝুটবাত! আলবত!

খালেদের জান কব‍্‍জ করিবে ওই মালেকুল-মৌত?

বছর গিয়াছে গেছে শতাব্দী যুগযুগান্ত কত,

জালিম পারসি রোমক রাজার জুলুম সে শত শত

রাজ্য ও দেশ গেছে ছারেখারে! দুর্বল নরনারী

কোটি কোটি প্রাণ দিয়াছে নিত্য কত‍্‍ল-গাহেতে তারই!

উৎপীড়িতের লোনা আঁসু-জলে গলে গেল কত কাবা,

কত উজ তাতে ডুবে মলো হায়, কত নূহ্ হল তাবা!

সেদিন তোমার মালেকুল-মৌত কোথায় আছিল বসি?

কেন সে তখন জালিম রাজার প্রাসাদে প্রাসাদে পশি

বেছে বেছে ওই ‘সঙ্গ্-দিল’দের কব‍্‍জ করেনি জান?

মালেকুল-মৌত সেদিনও মেনেছে বাদশাহি ফরমান!—

মক্কার হাতে চাঁদ এল যবে তকদিরে আফতাব

কুল-মখলুক দেখিতে লাগিল শুধু ইসলামি খাব,

শুকনো খবুজ খোর্মা চিবায়ে উমর দারাজ-দিল

ভাবিছে কেমন খুলিবে আরব দিন-দুনিয়ার খিল,–

এমন সময় আসিল জোয়ান হাথেলিতে হাথিয়ার,

খর্জুর-শিষে ঠেকিয়াছে গিয়া উঁচা উষ্ণীয় তার!

কব‍্‍জা তাহার সব‍্‍জা হয়েছে তলওয়ার-মুঠ ডলে,

দু-চোখ ঝালিয়া আশায় দ‍জ‍্‍লা ফোরাত পড়িছে গলে!

বাজুতে তাহার বাঁধা কোর-আন, বুকের দুর্মদ বেগ,

আলবোরজের‍ চূড়া গুঁড়া-করা দস্তে দারুণ তেগ।

নেজার ফলক উল্কার সম উগ্রগতিতে ছোটে,

তির খেয়ে তার আশমান-মুখে তারা-রূপে ফেনা ওঠে।

দারাজ দস্ত যেদিকে বাড়ায় সেইদিক পড়ে ভেঙে,

ভাস্কর-সম যেদিকে তাকায় সেইদিক ওঠে রেঙে!

ওলিদের বেটা খালেদ সে বীর যাহার নামের ত্রাসে

পারস্য-রাজ নীল হয়ে উঠে ঢলে পড়ে সাকি-পাশে!

রোম-সম্রাট শারাবের জাম-হাতে থরথর কাঁপে,

ইস্তাম্বুলি বাদশার যত নজ্জুম আয়ু মাপে!

মজলুম যত মোনাজাত করে কেঁদে কয় “এয়্ খোদা,

খালেদের বাজু-শমশের রেখো সহি-সালামতে সদা।”

আজরাইলও সে পারেনি এগুতে যে আজাজিলের আগে,

ঝুঁটি ধরে তার এনেছে খালেদ, ভেড়ি ধরে যেন বাঘে!

মালেকুল-মৌত করিবে কব‍্‍জ রু্হ্ সেই খালেদের?–

হাজার হাজার চামড়া বিছায়ে মাজারে ঘুমায় শের!

খালেদ! খালেদ! ফজর হল যে, আজান দিতেছে কৌম,

ওই শোনো শোনো— “আস‍্‍সালাতু খায়র মিনান্নৌম!”

যত সে জালিম রাজা-বাদশারে মাটিতে করেছে গুম

তাহাদেরই সেই খাকেতে খালেদ করিয়া তয়ম্মুখ

বাহিরিয়া এসো, হে রণ-ইমাম, জামায়েত আজ ভারী!

আরব, ইরান, তুর্ক, কাবুল দাঁড়ায়েছে সারি সারি!

আব-জমজম উথলি উঠিছে তোমার ওজুর তরে,

সারা ইসলাম বিনা ইমামেতে আজিকে নামাজ পড়ে!

খালেদ! খালেদ! ফজরে এলে না, জোহর কাটানু কেঁদে,

আসরে ক্লান্ত ঢুলিয়াছি শুধু বৃথা তহ‍্‍রিমা বেঁধে!

এবে কাফনের খেলকা পরিয়া চলিয়াছি বেলা-শেষে,

মগ‍্‍রেবের আজ নামাজ পড়িব আসিয়া তোমার দেশে!

খালেদ! খালেদ! সত্য বলিব, ঢাকিব না আজ কিছু,

সফেদ দেও আজ বিশ্ববিজয়ী, আমরা হটেছি পিছু!

তোমার ঘোড়ার খুরের দাপটে মরেছে যে পিপীলিকা,

মোরা আজ দেখি জগৎ জুড়িয়া তাহাদেরই বিভীষিকা!

হঠিতে হঠিতে আসিয়া পড়েছি আখেরি গোরস্থানে,

মগ‍্‍রেব-বাদে এশার নামাজ পাব কিনা কে সে জানে!

খালেদ! খালেদ! বিবস্ত্র মোরা পরেছি কাফন শেষে,

হাথিয়ার-হারা, দাঁড়ায়েছি তাই তহ‍্‍রিমা বেঁধে এসে!

ইমামতি তুমি করিবে না জানি, তুমি গাজী মহাবীর,

দিন-দুনিয়ার শহিদ নোয়ায় তোমার কদমে শির!

চারিটি জিনিস চিনেছিলে মতুমি, জানিতে না হের-ফের,

আল্লা, রসুল, ইসলাম আর শের-মারা শমশের!

খিলাফত তুমি চাওনিকো কভু চাহিলে–আমরা জানি,–

তোমার হাতের বে-দেরেগ তেগ অবহেলে দিত আনি!

উমর যেদিন বিনা অজুহাতে পাঠাইল ফরমান,–

“সিপাহ্-সালার খালেদ পাবে না পূর্বের সম্মান,

আমার আদেশ–খালেদ ওলিদ সেনাপতি থাকিবে না,

সাদের অধীনে করিবে যুদ্ধ হয়ে সাধারণ সেনা!”

ঝরা জলপাই-পাতার মতন কাঁপিতে কাঁপিতে সাদ,

দিল ফরমান, নফসি নফসি জপে, গণে পরমাদ!

খালেদ! খালেদ! তাজিমের সাথে ফরমান পড়ে চুমি

সিপাহ-সালারের সকল জেওর খুলিয়া ফেলিলে তুমি।

শিশুর মতন সরল হাসিতে বদন উজালা করি

একে একে সব রেখে দিলে তুমি সাদের চরণ পরি!

বলিলে, “আমি তো সেনাপতি হতে আসিনি, ইবনে সাদ,

সত্যের তরে হইব শহীদ, এই জীবনের সাধ!

উমরের নয়, এ যে খলিফার ফরমান, ছি ছি আমি

লঙ্ঘিয়া তাহা রোজ-কিয়ামতে হব যশ-বদনামি?”

মার মুখো যত সেনাদলে ডেকে ইঙ্গিতে বুঝাইলে,

কুর্নিশ করি সাদেরে, মামুলি সেনাবাসে ডেরা নিলে!

সেনাদের চোখে আঁসু ধরে না কো, হেসে কেঁদে তারা বলে,–

“খালেদ আছিল মাথায় মোদের, এবার আসিল কোলে!”

মক্কায় যবে আসিলে ফিরিয়া, উমর কাঁদিয়া ছুটে,

এ কী রে, খলিফা কাহার বক্ষে কাঁদিয়া পড়িল লুটে!

“খালেদ! খালেদ!” ডাকে আর কাঁদে উমর পাগল-প্রায়

বলে, “সত্যই মহাবীর তুই, বুসা দিই তোকে, আয়!

তখ‍্‍তের পর তখ‍্‍ত যখন তোমার তেগের আগে

ভাঙিতে লাগিল, হাতুড়ি যেমন বাদামের খোসা ভাঙে,–

ভাবিলাম বুঝি তোমারে এবার মুগ্ধ আরব-বাসী

সিজদা করিবে, বীরপূজা বুঝি আসিল সর্বনাশী!

পরীক্ষা আমি করেছি খালেদ, ক্ষমা চাই ভাই ফের,

আজ হতে তুমি সিপাহ-সালার ইসলাম জগতের!”

খালেদ! খালেদ! কীর্তি তোমার ভুলি নাই মোরা কিছু,

তুমি নাই তাই ইসলাম আজ হটিতেছে শুধু পিছু।

পুরানো দামামা পিটিয়া পিটিয়া ছিঁড়িয়ে গিয়াছে আজ,

আমামা৩ অস্ত্র ছিল নাকো তবু দামামা ঢাকিত লাজ!

দামামা তো আজ ফাঁসিয়া গিয়াছে, লজ্জা কোথায় রাখি,

নামাজ রোজার আড়ালেতে তাই ভীরুতা মোদের ঢাকি!

খালেদ! খালেদ! লুকাব না কিছু, সত্য বলিব আজি,

ত্যাগী ও শহিদ হওয়া ছাড়া মোরা আর সব হতে রাজি!

রীশ-ই বুলন্দ্, শেরওয়ানি, চোগা, তসবি ও টুপি ছাড়া

পড়ে নাকো কিছু, মুসলিম-গাছ ধরে যত দাও নাড়া!

* * *

খালেদ! খালেদ! সবার অধম মোরা হিন্দুস্থানি,

হিন্দু না মোরা মুসলিম তাহা নিজেরাই নাহি জানি!

সকলে শেষে হামাগুড়ি দিই,–না, না, বসে বসে শুধু

মুনাজাত করি, চোখের সুমুখে নিরাশা-সাহারা ধুধু!

দাঁড়ায়ে নামাজ পড়িতে পারি না, কোমর গিয়াছে টুটি,

সিজদা করিতে ‘বাবা গো’ বলিয়া ধূলিতলে পড়ি লুটি!

পিছন ফিরিয়া দেখি লাল-মুখ আজরাইলের ভাই,

আল্লা ভুলিয়া বলি, “প্রভু মোর তুমি ছাড়া নাই।”

টক্কর খেতে খেতে শেষে এই আসিয়া পড়েছি হেথা,

খালেদ! খালেদ! রি রি করে বুকে পরাধীনতার ব্যথা!

বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনও বসে

বিবি-তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফেকা ও হাদিস চষে!

হানফী, ওহাবী, লা-মজহাবীর তখনও মেটেনি গোল,

এমন সময় আজাজিল এসে হাঁকিল, ‘তল্পি তোল!’

ভিতরের দিকে যত মরিয়াছি, বাহিরের দিকে তত

গুনতিতে মোড়া বাড়িয়া চলেছি গোরু ছাগলের মত!

খালেদ! খালেদ! এই পশুদের চামড়া দিয়ে কি তবে

তোমার পায়ের দুশমন-মারা দুটো পয়জারও হবে?

হায় হায় হায়, কাঁদে সাহারায় আজিও তেমনই ও কে?

দজলা-ফোরাত নতুন করিয়া মাতম করিছে শোকে!

খর্জুর পেকে খোর্মা হইয়া শুকায়ে পড়েছে ঝুরে

আঙুর বেদানা নতুন করিয়া বেদনার রসে পুরে।

এক রাশ শুখো আখরোট আর বাদাম ছাড়াতে লয়ে

আঙুল ছেঁচিয়া মুখ দিয়া চুষে মৌনা আরবি-বউয়ে!

জগতের সেরা আরবের তেজি যুদ্ধ-তাজির চালে

বেদুইন-কবি সংগীত রচি নাচিতেছে তালে তালে!

তেমনই করিয়া কাবার মিনারে চড়িয়া মুয়াজ্জিন

আজানের সুরে বলে, কোনোমতে আজও বেঁচে আছে দ্বীন!

খালেদ! খালেদ! দেখো দেখো ওই জমাতের পিছে কারা

দাঁড়ায়ে রয়েছে, নড়িতে পারে না, আহা রে সর্বহারা!

সকলের পিছে নহে বটে তবু জমাত-শামিল নয়,

উহাদের চোখে হিন্দের মতো নাই বটে নিদ‍্‍-ভয়!

পিরানের সব দামন ছিন্ন, কিন্তু সে সম্মুখে

পেরেশান ওরা তবু দেখিতেছি ভাঙিয়া পড়েনি দুখে!

তকদির বেয়ে খুন ঝরে ওই উহারা মেসেরি বুঝি।

টলে তবু চলে বারে বারে হারে বারে বারে ওরা যুঝি।

এক হাতে বাঁধা হেম-জিঞ্জির আর এক হাত খোলা

কী যেন হারামি নেশার আবেশে চক্ষু ওদের ঘোলা!

ও বুঝি ইরাকি? খালেদ! খালেদ! আরে মজা দেখো, ওঠো,

শ্বেত-শয়তান ধরিয়াছে আজ তোমার তেগের মুঠো!

দুহাতে দুপায়ে আড়-বেড়ি দেওয়া ও কারা চলিতে নারে,

চলিতে চাহিলে আপনার ভায়ে পিছন হইতে মারে।

মরদের মতো চেহারা ওদের স্বাধীনের মতো বুলি,

অলস দু-বাজু দু-চোখ সিয়াহ৬ অবিশ্বাসের ঠুলি!

শামবাসী ওরা সহিতে শেখেনি পরাধীনতার চাপ,

তলওয়ার নাই, বহিছে কটিতে কেবল শূন্যে খাপ!

খালেদ! খালেদ! মিসমার হল তোমার ইরাক শাম,

জর্ডন নদে ডুবিয়াছে পাক জেরুজালেমের নাম!

খালেদ! খালেদ! দুধারি তোমার কোথা সেই তলোয়ার?

তুমি ঘুমায়েছ, তলোয়ার তব সে তো নহে ঘুমাবার!

জং ধরেনিকো কখনও তাহাতে জঙ্গের খুনে নেয়ে,

হাথেলিতে তব নাচিয়া ফিরেছে যেন বেদুইন মেয়ে!

খাপে বিরামের অবসর তার মেলেনি জীবনে কভু,

জুলফিকার সে দুখান হয়েছে, ও তেগ টুটেনি তবু।

তুমি নাই তাই মরিয়া গিয়াছে তরবারিও কি তব?

হাত গেছে বলে হাত-যশও গেল? গল্প এ অভিনব!

খালেদ! খালেদ! জিন্দা হয়েছে আবার হিন্দা বুড়ি,

কত হামজারে মারে জাদুকরি, দেশে দেশে ফেরে উড়ি!

ও কারা সহসা পর্বত ভেঙে তুহিন স্রোতের মতো,

শত্রুর শিরে উন্মদবেগে পড়িতেছে অবিরত!

আগুনের দাহে গলিছে তুহিন আবার জমিয়া উঠে,

শির উহাদের ছুটে গেল হায়! তবু নাহি পড়ে টুটে!

ওরা মরক্কো মরদের জাত মৃত্যু মুঠার পরে,

শত্রুর হাতে শির দিয়া ওরা শুধু হাতে পায়ে লড়ে!

খালেদ! খালেদ! সর্দার আর শির পায় যদি মূর

খাসা জুতো তারা করিবে তৈরি খাল দিয়া শত্রুর!

খালেদ! খালেদ! জাজিরাতুল সে আরবের পাক মাটি

পলিদ হইল, খুলেছে এখানে যুরোপ পাপের ভাঁটি!

মওতের দারু পিইলে ভাঙে না হাজার বছরি ঘুম?

খালেদ! খালেদ! মাজার আঁকড়ি কাঁদিতেছে মজলুম।

খোদার হাবিব বলিয়া গেছেন আসিবেন ইসা ফের,

চাই না মেহেদি, তুমি এসো বীর হাতে নিয়ে শমশের।

কৃষ্ণনগর,

২১ অগ্রহায়ণ, ’৩৩