আমানুল্লাহ্

খোশ্-আম্‌দেদ আফগান-শের! – অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে আজ–

সালাম জানায় মুসলিম-হিন্দ শরমে নোয়ায়ে শির বে-তাজ!

বান্দা যাহারা বন্দেগী ছাড়া কী দিবে তাহারা, শাহানশাহ্!

নাই সে ভারত মানুষের দেশ! এ শুধু পশুর কতল‌্গাহ্!

দস্তে তোমার দস্ত রাখিয়া নাই অধিকার মিলাতে হাত,

রূপার বদলে দু-পায়ে প্রভুর হাত বাঁধা রেখে খায় এ জাত!

পরের পায়ের পয়জার বয়ে হেঁট হল যার উচ্চ শির,

কী হবে তাদের দুটো টুটো বাণী দু-ফোঁটা অশ্রু নিয়ে, আমির!

ভুলিয়া য়ুরোপ-‘জোহরা’র রূপে আজিকে ‘হারুত-মারুত’ প্রায়

কাঁদিছে হিন্দু-মুসলিম হেথা বন্দী হইয়া চির-কারায়;

মোদের পুণ্যে ‘জোহরা’র মত সুরূপা য়ুরূপা দীপ্যমান

ঊর্ধ্ব গগনে। আমরা মর্ত্যে আপনার পাপে আপনি ম্লান!

পশু-পাখি আর তরুলতা যত প্রাণহীন সব হেথা সবাই,

মানুষে পশুতে কসাইখানাতে এক সাথে হেথা হয় জবাই।

দেখে খুশি হবে– এখানে ঋক্ষ শার্দূলও ভুলি হিংসা-দ্বেষ

বনে গিয়া সব হইয়াছে ঋষি! সিংহ-শাবক হয়েছে মেষ!

কাবুল-লক্ষ্মী দেহে মনে এই পরাধীনদেরে দেখিয়া কি

রহিল লজ্জা-বেদনায় হায়, বোরকায় তাঁর মুখ ঢাকি?

তুমি এলে আজ অভিনব বেশে সেই পথ দিয়া, পার্শ্বে যার

স্তূপ হয়ে আছে অখ্যাতি-সহ লাশ আমাদের লাখ হাজার।

মামুদ, নাদির শাহ, আবদালি, তৈমুর এই পথ বাহি

আসিয়াছে। কেহ চাহিয়াছে খুন, কেহ চাহিয়াছে বাদশাহি।

কেহ চাহিয়াছে তখ‍্‍ত-ই-তাউস, কোহিনুর কেহ—এসেছে কেউ

খেলিতে সেরেফ খুশরোজ হেথা, বন্যার সম এনেছে ঢেউ।

‘খঞ্জর’ এরা এনেছে সবাই, তুমি আনিয়াছ ‘হেলাল’ আজ,

তোমারে আড়াল করেনি তোমার তরবারি আর তখ‍্‍ত্ তাজ।

তুমি আসনি ক’ দেখাতে তোমায়, দেখিতে এসেছ সকলেরে!

চলেছ, পুণ্য সঞ্চয় লাগি বিপুল বিশ্ব কাবা হেরে।

হে মহাতীর্থ-যাত্রা-পথিক! চির-রহস্য-ধেয়ানি গো!

ওগো কবি! তুমি দেখছ সে কোন অজানা লোকের মায়া-মৃগ?

কখন কাহার সোনার নূপুর দেখিল স্বপনে, জাগিয়া তায়

ধরিতে চলেছ সপ্ত সাগর তেরো নদী আজ পারায়ে, হায়!

তখ‍্‍ত্ তোমার রহিল পড়িয়া, বাসি লাগে নও-বাদ্‌শাহি,

মুসাফির সেজে চলেছ শা’জাদা না-জানা অকূলে তরী বাহি।

সুলেমান-গিরি হিন্দুকুশের প্রাচীর লঙ্ঘি ভাঙি কারা,

আদি সন্ধানী যুবা আফগান, চলেছে ছুটিয়া দিশাহারা!

সুলেমান সম উড়ন-তখ‍্‍‍‍‍তে চলিলে করিতে দিগ্বিজয়,

কাবুলের রাজা, ছড়ায়ে পড়িলে সারা বিশ্বের হৃদয়-ময়!

শম্‌শের হতে কমজোর নয় শিরীন-জবান, জানো তুমি,

হাসি দিয়ে তাই করিতেছ জয় অসির অজেয় রণ-ভূমি!

শুধু বাদশাহি দম্ভ লইয়া আসিতে যদি, এ বন্দী দেশ

ফুলমালা দিয়া না করি বরণ করিত মামুলি আর্জি পেশ।

খোশামোদ শুধু করিতে হয়ত, বলিত না তারা ‘খোশ-আমদেদ’,

ভাবিত ভারত ‘কাবুলি’তে আর কাবুলি-রাজায় নাহিকো ভেদ।

‘আমানুল্লা’রে করি বন্দনা, কাবুল রাজার গাহি না গান,

মোরা জানি ঐ রাজার আসন মানব জাতির অসম্মান!

ঐ বাদশাহি তখ্‌তের নীচে দীন-ই-ইসলাম শরমে, হায়,

এজিদ হইতে শুরু করে আজও কাঁদে আর শুধু মুখ লুকায়!

বুকের খুশির বাদশাহ তুমি,–শ্রদ্ধা তোমার সিংহাসন,

রাজাসন ছাড়ি মাটিতে নামিতে দ্বিধা নাই–তাই করি বরণ।

তোমার রাজ্যে হিন্দুরা আজও বেরাদর-ই-হিন্দ, নয় কাফের,

প্রতিমা তাদের ভাঙোনি, ভাঙোনি একখানি ইঁট মন্দিরের।

‘কাবুলি’রে মোরা দেখিয়াছি শুধু, দেখিনি কাবুল পামির-চূড়,

দেখেছি কঠিন গিরি মরুভূমি–পিই নাই পানি সেই মরুভূর!

আজ দেখি সেথা শত গুলিস্তাঁ-বোস্তাঁ-চমক কান্দাহার—

গজনী-হিরাট-পঘ্‌মান কত জালালাবাদের ফুল-বাহার!

ঐ খায়বার-পাশ দিয়া শুধু আসেনি নাদির আবদালি,

আসে ঐ পথে নারঙ্গি সেব্ আপেল আনার ডালি ডালি।

আসে আঙ্গুর পেস্তা বাদাম খোর্মা খেজুর মিঠি মেওয়া,

অঢেল শিরনি দিয়াছে কাবুল, জানে না ক’ শুধু সুদ নেওয়া!

কাবুল নদীর তীরে তীরে ফেরে জাফরান-খেতে পিয়ে মধু

আমাদেরই মত মৌ-বিলাসী গো কত প্রজাপতি কত বঁধু।

সেথায় উছসে তরুণীর শ্বাসে মেশ‍্‍ক-সুবাস, অধরে মদ,

গাহে বুলবুলি নার্গিস লালা আনার-কলির পিয়ে শহদ।…

দেখিয়াছি শুধু কাবুলির দেনা, কাবুলি দাওয়াই, কাবুলি হিং,–

তুমি দিয়ে গেছ কাবুল-বাগের দিল-মহলের চাবির রিং!