তিন[১]

বিষয়-সম্পত্তির কাজে কন্যার উৎসাহ ও মনোযোগ দেখিয়া রে-সাহেব অত্যন্ত প্রীত হইলেন। ঝাড়া-মোছা হইতে আরম্ভ করিয়া চুন দেওয়া, রং দেওয়া, আসবাবপত্রের পরিবর্তন, পরিবর্জন ইত্যাদিতে সমস্ত বাড়িটারও একদিকে যেমন সংস্কার শুরু হইল, অন্যদিকে শৃঙ্খলাহীন, ঢিলাঢালা জমিদারী সেরেস্তাতেও তেমনিই অত্যন্ত কড়া নিয়ম-কানুনসকল প্রত্যহই জারি হইয়া উঠিতে লাগিল। সাংসারিক সকল ব্যাপারেই অনভিজ্ঞ এই মেয়েটির মধ্যে যে এতখানি কর্মপটুতা ছিল, তাহা পেনশনপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ম্যানেজারবাবু পর্যন্ত স্বীকার না করিয়া পারিলেন না। তাঁহার ত সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবসর নাই। দাখিলা, চিঠা, কবজ, খতিয়ান, রোকড়, রোডসেস্‌, কাহাকে কি বলে এবং কোথায় কি হয়, জমিদারী কাজের এইসকল পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা লইয়া আলেখ্যের কাছে তিনি ত প্রায় গলদঘর্ম হইয়া উঠিলেন। কর্মচারীদের মধ্যে কাহার কি কাজ, কত বেতন, ফাঁকি না দিলে কতখানি কাজ করা যায়, এ-সকল বুঝিয়া লইতে আলেখ্যের বিলম্ব হইল না। কয়েকটি স্থবির-গোছের লোকের প্রতি প্রথম হইতেই তাহার দৃষ্টি পড়িয়াছিল, জেরার চোটে ম্যানেজার স্বীকার করিয়া ফেলিলেন যে, এইসকল লোকের দ্বারা বস্তুত: কোন উপকারই হয় না, এবং এ কথা তিনি ইতঃপূর্বে সাহেবকে জানাইয়াছিলেন, কিন্তু কোন ফল হয় নাই। ইনি এই বলিয়া জবাব দিয়াছিলেন যে, এই সংসারে চাকরি করিয়া আজ যাহারা বুড়া হইয়াছে, তাহাদের প্রতি জুলুম করিয়া কাজ আদায় করিবার আবশ্যকতা নাই, নূতন লোক বাহাল করিলেই জমিদারির কাজ চলিয়া যাইবে। এইজন্যই এত লোক বেশী হইয়া পড়িয়াছে।

আলেখ্য কহিল—এবং এইজন্যেই বাবার খরচে কুলোয় না!

ম্যানেজার ব্রজবাবু চুপ করিয়া রহিলেন।

আলেখ্য কহিল—আমি কাজ চাই, দানছত্র খুলতে চাইনে।

ব্রজবাবু সবিনয়ে কহিলেন, আপনি যেমন আদেশ করবেন, তেমনি হবে।

রে-সাহেব দিন দুই-তিন হইল কলিকাতায় তাঁহার পুরাতন বন্ধু-বান্ধবগণের সহিত দেখা-সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলেন, বাটীতে উপস্থিত ছিলেন না, এই অবকাশে আলেখ্য একদিন ম্যানেজারকে ডাকাইয়া তাঁহার হাতে একখানি ছোট কাগজ দিয়া কহিল—এদের আপনি এই মাসের মাইনেটা চুকিয়া দিয়ে জবাব দিয়ে দেবেন।

বাবা অত্যন্ত দুর্বলপ্রকৃতির মানুষ, তাঁকে জানাবার প্রয়োজন নেই।

ব্রজবাবু কম্পিতহস্তে কাগজখানি গ্রহণ করিলেন; চশমার ভিতর দিয়া নামগুলি একে একে পাঠ করিয়া তাঁহার গলা পর্যন্ত কাঠ হইয়া উঠিল। একটু সামলাইয়া কহিলেন—যে আজ্ঞে। কিন্তু এই নয়ন গাঙ্গুলী লোকটি বড় গরিব, তাঁর—

আলেখ্য কহিল—গরীবের জন্য সংসারে অন্য ব্যবস্থা আছে।

ব্রজবাবু বলিতে গেলেন, তা বটে, কিন্তু—

এ কিন্তুটা আলেখ্য শেষ করিতে দিল না, কহিল—দেখুন ম্যানেজারবাবু, এ নিয়ে আলোচনা স্বভাবতই অপ্রিয়। আমি বিশেষ চিন্তা করেই স্থির করেছি—আপনি এখন যেতে পারেন।

যে আজ্ঞা, বলিয়া বৃদ্ধ ব্রজবাবু কাগজখানি হাতে করিয়া ধীরে ধীরে প্রস্থান করিলেন। শিক্ষিতা জমিদার-কন্যার মেজাজের পরিচয় তিনি পাইয়াছিলেন, তাঁহার আর প্রতিবাদ করিতে সাহস হইল না—পাছে তাঁহার নিজের নামটাও বুড়া ও অকর্মণ্যদের তালিকাভুক্ত হইয়া পড়ে। বিশেষতঃ ইহাও তিনি নিশ্চিত জানিতেন, যাহাদের কাজ গেল, তাহারা কেবল তাঁহার মুখের কথাতেই নিরস্ত হইবে না, আবেদন-নিবেদন সহি-সুপারিশ প্রভৃতি গোলামিগিরির যাহা কিছু দুনিয়ায় প্রচলিত আছে, সমস্তই চেষ্টা করিয়া দেখিবে।

হইলও তাই। পরদিন চারখানা দরখাস্তই ব্রজবাবু আলেখ্যের ঘরে পাঠাইয়া দিলেন। অধীনের নিবেদনে বাঙ্গালাদেশের সেই মামুলি দারিদ্র্যের ইতিহাসও তাহার হেতু। প্রত্যেকেই পরিবারস্থ বিধবাগণের সংখ্যা নির্দেশ করিয়া দিয়াছে, এবং কান্নাকাটি করিয়া জানাইয়াছে যে, সে ভিন্ন তাঁহাদের দাঁড়াইবার আর কোথাও স্থান নাই। আলেখ্য কোনটাই গ্রাহ্য করিল না, এবং প্রত্যেক আবেদনপত্রের নীচেই ইংরাজি প্রথায় অত্যন্ত দুঃখিত হইয়া হুকুম দিল যে, এ বিষয়ে সে সম্পূর্ণ নিরুপায়। ব্রজবাবু ঠিক ইহাই আশা করিয়াছিলেন, তিনি সকলকেই গোপনে ডাকিয়া বলিয়া দিলেন যে, সাহেব ফিরিয়া আসা পর্যন্ত যেন তাহারা ধৈর্য ধরিয়া থাকে। কারণ, চোখের জলের কোন দাম থাকে ত সে কেবল ওই স্বেচ্ছাচারী স্বল্পবুদ্ধি বুড়ার কাছেই আদায় হইতে পারে।

দিন-তিনেক পরে একদিন সকালে আলেখ্য তাহার বসিবার ঘরের বারান্দায় বসিয়া অনেকগুলা নকশার মধ্যে হইতে তাহাদের খাবার ঘরের পেন্টিঙের ডিজাইনটা পছন্দ করিয়া বাহির করিতেছিল।

একজন অতিশয় বৃদ্ধ-গোছের লোক তাহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। লোকটা যেমন রোগা, তেমনই তাহার পরনের কাপড়-চোপড় ময়লা এবং ছেঁড়া-খোঁড়া।

আলেখ্য মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল—কে?

লোকটা সহসা জবাব দিতে পারিল না—তোতলা বলিয়া। তাহার পরে কহিল, আমি নয়ন গাঙ্গুলী।

আলেখ্য তাহাকে চিনিতে পারিয়া কঠোরভাবে বলিল—এখানে কেন?

সে কথা বলিবার চেষ্টায় আবার কিছুক্ষণ চোখ ও মুখের নানারূপ ভঙ্গী করিয়া শেষে কহিল—আমার মেয়ের নাম দুর্গা। সে বললে, বাবা তুমি তাঁর কাছে যাও, গেলেই চাকরি হবে। আমার একটি নাতি আছে, তার নাম গণপতি। তার ভারী বুদ্ধি।

ইহার চেহারা দেখিয়াই আলেখ্যের অশ্রদ্ধা জন্মিয়াছিল, এই-সকল অসংলগ্ন কথা শুনিয়া বুঝিল, যাহাদের জবাব দেওয়া হইয়াছে, এই লোকটি তাহাদের মধ্যে সবচেয়ে অপদার্থ। সে নকশার উপর হইতে চোখ না তুলিয়াই কহিল—আমার কাছে কিছু হবে না, আপনি বাইরে যান।

লোকটা তথাপি নড়িল না, সেইখানে দাঁড়াইয়া তাহার সংসারের অবস্থা বর্ণনা করিতে লাগিল। বলিল যে, এই তের টাকা বেতন ভিন্ন তাহাদের আর কিছু নাই। ব্রাহ্মণী জীবিত নাই, বছর-পাঁচেক হইল ছেলেও মারা গিয়াছে, জামাই আসামে চাকরি করিতে গিয়া সন্ন্যাসী হইয়া গিয়াছে, তাহার আর সন্ধান পাওয়া যায় না।

আলেখ্য বিরক্ত হইয়া কহিল—আপনার ঘরের খবর শোনবার আমার ইচ্ছেও নেই, সময়ও নেই; আপনি এখান থেকে যান।

গাঙ্গুলী কর্ণপাতও করিল না, সে কত কি বলিয়া চলিতে লাগিল।

আলেখ্য নিরুপায় হইয়া তখন বেহারাকে ডাকিয়া এই লোকটাকে একপ্রকার জোর করিয়াই বিদায় করিয়া দিয়া পুনরায় নিজের কাজে মন দিল।

কলিকাতা হইতে কিছু কিছু আসবাব আসিয়া পৌঁছিয়াছিল। পরদিন সকালে একটা মূল্যবান আয়না নিজের শোবার ঘরে খাটাইবার ব্যাপারে আলেখ্য নিজেই তত্ত্বাবধান করিতেছিল, হঠাৎ একটি বছর-দশেকের ছেলের হাত ধরিয়া ম্যানেজার ব্রজবাবু প্রবেশ করিলেন। ছেলেটির পরনের বস্ত্র এত ছেঁড়া যে, নাই বলিলেই হয়। খালি পা, খালি গা, এত কাঁদিয়াছে যে, চোখ দুইটি রক্তবর্ণ হইয়া ফুলিয়া উঠিয়াছে। আলেখ্য বিস্ময়াপন্ন হইয়া চাহিতে ব্রজবাবু মৃদুকন্ঠে কহিলেন—আপনাকে অসময়ে বিরক্ত করতে আসতে হ’লো—

কাজের ব্যস্ততার মধ্যে ইহাদের আকস্মিক আগমনে আলেখ্য খুশী হইতে পারে নাই। ঘোষ-সাহেবদের আসার দিন নিকটবর্তী হইয়া আসিতেছে, অথচ বাটী সাজানো-গুছানোর কাজ এখনও বিস্তর বাকি; কহিল—নিতান্ত জরুরী কাজ নাকি?

ব্রজবাবু ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, নয়ন গাঙ্গুলীর কামাইয়ের দরুন পাঁচ টাকা মাইনে কাটা হয়েছিল, কিন্তু পরে বিবেচনা করবেন বলে একটা ভরসা দিয়েছিলেন—

আলেখ্য অপ্রসন্নমুখে বলিল—সে বিবেচনার আমি আর প্রয়োজন দেখিনে।

ব্রজবাবু প্রতিবাদ করিতে বোধ হয় সাহস করিলেন না, ছেলেটিকে লইয়া নিঃশব্দে ফিরিয়া যাইতেছিলেন, আলেখ্য কৌতূহলবশে সহসা জিজ্ঞাসা করিল—ছেলেটি কে ম্যানেজারবাবু, তাঁর নাতি বোধ করি?

ছেলেটি নিজেই ঘাড় নাড়িয়া বলিল—হ্যাঁ, এবং বলিয়াই কাঁদিয়া ফেলিল। ব্রজবাবু তখন আস্তে আস্তে কহিলেন, চাকরি নেই শুনে মুদী কাল আর চাল-ডাল কিছু দিলে না, হয়ত তার বাকীও ছিল—সারাদিন খাওয়া-দাওয়া কারও হ’ল না। ছেলে-জামাইয়ের শোকে বুড়ো বয়সে ইদানীং গাঙ্গুলী মশায়ের মাথাটাও তেমন ভাল ছিল না,—কি ভাবলে কি জানি, রাত্রেই কতকগুলো কলকে ফুলের বীচি বেটে খেয়ে আত্মহত্যা করে ফেলে—এখন আবার পুলিশ না এলে দাহ পর্যন্ত হওয়া—

আলেখ্য চমকাইয়া উঠিয়া কহিল—কে আত্মহত্যা করলে?

ছেলেটি কাঁদিতেছিল, বলিল—দাদামশাই।

দাদামশাই? নয়ন গাঙ্গুলী? আত্মহত্যা করেছেন?

ব্রজবাবু বলিলেন—হাঁ, ভোরবেলায় মারা গেছেন। টাকা পাঁচটা পেলে, এদের বড় উপকার হয়। ছেলেটিকে কহিলেন—মণি, হাতজোড় করে বল, মা, আমাদের পাঁচ টাকা ভিক্ষে দিন। বল!

ছেলেটি কাঁদিতে কাঁদিতে হাতজোড় করিয়া তাঁহার কথাগুলা আবৃত্তি করিল। আর তাহার প্রতি অনিমেষ-চক্ষে চাহিয়া আলেখ্য মূর্তির মত স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

মণিকে লইয়া ব্রজবাবু চলিয়া গেলেন। নয়ন গাঙ্গুলীর মৃতদেহের প্রায়শ্চিত্ত হইতে শুরু করিয়া সৎকার পর্যন্ত কিছুই টাকার অভাবে আর আটকাইয়া থাকিবে না, যাবার সময় তাহা তিনি বুঝিয়া গেলেন; কিন্তু আলেখ্যের কাছে ঘরের পেন্টিং হইতে সাজানো-গোছানো যা-কিছু কাজ সমস্তই একেবারে অর্থহীন হইয়া গেল। সেখান হইতে বাহির হইয়া সে তাহার বসিবার ঘরে আসিয়া চুপ করিয়া বসিল।

মিস্ত্রী আসিয়া আলমারি রাখিবার জায়গা দেখাইয়া দিতে কহিলে আলেখ্য বলিল—এখন থাক।

সরকার আসিয়া খাবার কথা জিজ্ঞাসা করিলে কহিল—যা হয় হোক, আমি জানিনে।

একটা মেরামতির কাজের হুকুম লইতে আসিয়া ঠিকাদার ধমক খাইয়া ফিরিয়া গেল। আলেখ্যের কেবলই মনে হইতে লাগিল, কিছুতেই আর তাহার প্রয়োজন নাই, এদেশে আর সে মুখ দেখাইতে পারিবে না। নবীন উদ্যমে বিলাতী প্রথায়, কড়া নিয়মে কাজ করিতে গিয়া আরম্ভেই সে যে এতবড় ধাক্কা খাইবে, তা কল্পনাও করে নাই। এ কি হইয়া গেল? বিদ্বেষবশে কাহারও প্রতি সে কোন অন্যায় করে নাই—হয়ত একটা ভুল হইয়াছে, কিন্তু এত বড় শাস্তি? একেবারে সে আত্মহত্যা করিয়া তাহার প্রতিশোধ দিল!

একজন ছোট-গোছের কর্মচারীকে গোপনে ডাকাইয়া আনিয়া সে একটি একটি করিয়া সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করিল। নয়ন গাঙ্গুলী এই সংসারে চল্লিশ বৎসর একাদিক্রমে চাকরি করিয়াছে; বাস্তবিকই সে অত্যন্ত দরিদ্র, খান-দুই মাটির ঘর ছাড়া আর তাহার আপনার বলিত এত বড় পৃথিবীতে কোথাও কিছু ছিল না,—এই তেরটি টাকা বেতনের উপরই তাহাদের সমস্ত নির্ভর, ইহার কিছুই মিথ্যা নয়।

তেরটি টাকা কি-ই বা! অথচ একটা দরিদ্র পরিবারের সমস্ত খাওয়া-পরা, সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-নিরানন্দ, মাসের পর মাস বছরের পর বছর ইহাকে আশ্রয় করিয়াই জীবনধারণ করিয়াছিল।

এই টাকা কয়টি কত তুচ্ছ। তাহার অসংখ্য জোড়া জুতার মধ্যে এক জোড়ার দামও ইহাতে কুলায় না। কিন্তু আজ একটা লোক নিজের জীবন দিয়া যখন ইহার সত্যকার মূল্য তাহার চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিল, তখন বুকের ভিতর যেন ঝড় বহিতে লাগিল। ঐ সারাদিনের উপবাসী ছেলেটার ফুলিয়া ফুলিয়া কান্নার শব্দ তাহার কানের মধ্য দিয়া কোথায় কি করিয়া যে বিঁধিয়া ফিরিতে লাগিল, সে তাহার কূল-কিনারা খুঁজিয়া পাইল না।

সেইখানে চুপ করিয়া বসিয়া আলেখ্যের কত দিনের কত অর্থ-ব্যয়ের কথাই না মনে পড়িতে লাগিল। তাহার নিজের, তাহার স্বর্গগত জননীর, তাহার পরিচিত বন্ধুবান্ধবের, তাহাদের সভ্য-সমাজের কতদিনের কত উৎসব, কত আহার-বিহার, গান-বাজনার আয়োজন, কত বস্ত্র, কত অলঙ্কার, কত গাড়ি-ঘোড়া, ফুল-ফল, কত আলোর মিথ্যা আড়ম্বর,—তাহার পরিমাণ কল্পনা করিয়া তাহার শিরার রক্ত শীতল হইয়া আসিতে চাহিল।

হাতের কাছে ছোট টিপয়ের উপরে নূতন আয়নার বিলটা পড়িয়া ছিল, তাহার অঙ্কের প্রতি চোখ পড়িতেই আজ তাহার প্রথম মনে হইল, এই বস্তুটায় তাহার কতটুকুই বা প্রয়োজন, অথচ ইহারই মূল্যে একজন লোক অনায়াসে পাঁচ বৎসরকাল বাঁচিতে পারিত! আজ তাহার নিজের হাতে প্রাণ বাহির করিবার আবশ্যক হইত না!

আজ বিকালের গাড়িতে রে-সাহেবের বাড়ি আসিবার কথা। পিতার দুর্বলতার প্রতি তাহার অতিশয় অশ্রদ্ধা ছিল, ইহা সে মায়ের কাছে শিখিয়াছিল। পরের অন্যায়কে তিনি জোর করিয়া খণ্ডন করিতে পারেন না, তাঁহার চক্ষুলজ্জায় বাধে। এই দৌর্বল্যের সুযোগ লইয়া কত লোক তাঁহার প্রতি অসঙ্গত উৎপাত করিয়া আসিয়াছে, তিনি কোনদিন কোন কথা বলিতে পারেন নাই। এই-সকল পীড়নের শেষ করিয়া দিতে আলেখ্য বদ্ধপরিকর হইয়া লাগিয়াছিল। প্রাচীন, অলস ও অকেজো লোকগুলাকে বিদায় দিবার প্রস্তাবে সামান্য একটুখানি প্রতিবাদ করিয়া যখন ব্রজবাবু পূর্বের কথা তুলিয়া বলিয়াছিলেন,—সাহেবের ইহাতে সম্মতি নাই, আলেখ্য তখন সে কথায় কর্ণপাত করে নাই। পিতার চিরদিনের দুর্বলতা স্মরণ করিয়াই সে তাঁহার অবর্তমানেই এ সমস্যার মীমাংসা করিয়া ফেলিতে চাহিয়াছিল, কিন্তু আজ অক্ষম অতিবৃদ্ধ নয়ন গাঙ্গুলী যখন তাহার স্বহস্তের মৃত্যু দিয়া সংসারের একটা অপরিজ্ঞাত দিকের পর্দা তুলিয়া ফেলিল, তখন সেইদিকে চাহিয়া এই অনভিজ্ঞ মেয়েটির গভীর পরিতাপের সহিত একলা বসিয়া অনেক নূতন প্রশ্নের সমাধান করিবার আবার প্রয়োজন হইয়া পড়িল। অনুপস্থিত শক্তিহীন পিতাকে স্মরণ করিয়া সে বারবার বলিতে লাগিল, চিত্তের কোমলতা এবং দুর্বলতা এক বস্তু নয় বাবা, তোমাকে আমরা চিরদিন ভুল বুঝিয়াছি, কিন্তু কোনদিন তুমি অভিযোগ কর নাই। সেই পিতাকে মনে করিয়াই আজ সে স্পষ্ট দেখিতে পাইল, সংসার শুধুই একটা মস্ত দোকান-ঘর নয়। কেবল জিনিস ওজন করিয়া মূল্য ধার্য করিলেই মানুষের সকল কার্য সমাপ্ত হয় না। এখানে অক্ষমেরও বাঁচিয়া থাকিবার অধিকার আছে,—তাহার কাজ করিবার শক্তি লোপ পাইয়াছে বলিয়া তাহার জীবনধারণের দাবীও বিলুপ্ত করা যায় না।

আগে সকালে বিকালে কাছারি বসিত, আলেখ্য অন্যান্য অফিসের নিয়মে তাহাকে ১১টা হইতে ৪টায় দাঁড় করাইয়াছিল।

এই সময়ের অনেকখানি সময় সে নিজে গিয়া ম্যানেজারের ঘরে বসিয়া কাজকর্ম দেখিত, আজ কিন্তু সে নিজের কর্মচারীদের কাছে মুখ দেখাইতে পারিল না, আপনাকে সেইখানেই আবদ্ধ করিয়া রাখিল। খাওয়া-দাওয়া তাহার ভাল লাগিল না এবং এমনই করিয়া যখন সারাবেলা কাটিল, তখন বৈকালের দিকে জানালা দিয়া দেখিতে পাইল, সাহেবের খালি গাড়ি স্টেশন হইতে ফিরিয়া আসিল, তিনি আসেন নাই। কোথাও আসা-যাওয়া সম্বন্ধে তাঁহার কথার কখনও ব্যতিক্রম হইত না; এই দিক দিয়া সে পিতার জন্য যেমন চিন্তা বোধ করিল, তাঁহার না আসায় আর একদিকে তেমনই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল। তিনি রাগ করিবেন না, একটি কঠোর বাক্য পর্যন্তও হয়ত উচ্চারণ করিবেন না, ইহা সে নিশ্চয় জানিত; কিন্তু তাঁহার ব্যথিত নিঃশব্দ প্রশ্নের সে যে কি জবাব দিবে, কোনমতেই খুঁজিয়া পাইতেছিল না। সেই কঠিন দায় হইতে সে আজিকার মত অব্যাহতি লাভ করিয়া যেন বাঁচিয়া গেল। এই শান্তিটুকু তখনও সে নিজের মধ্যে অনুভব করিবার চেষ্টা করিতেছিল, বেহারা আসিয়া সংবাদ দিল, ঠাকুরমশাই আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

কে ঠাকুরমশাই? কোথায় তিনি?

ঠিক পর্দার আড়াল হইতে উত্তর আসিল—আমি অমরনাথ, এই বাইরেই দাঁড়িয়ে আছি।

‘আসুন’ বলিয়া আহ্বান করিয়া আলেখ্য উঠিয়া দাঁড়াইল। প্রত্যাখ্যান করিবার সময় বা সুযোগ তাহার রহিল না।

আলেখ্য হাত তুলিয়া নমস্কার করিল, কিন্তু সেদিনের মত আজও অধ্যাপক সোজা দাঁড়াইয়া রহিলেন, নমস্কার ফিরাইয়া দিবার চেষ্টামাত্রও করিলেন না। আলেখ্য লক্ষ্য করিল, কিন্তু কাহারও কোনপ্রকার আচরণেই ত্রুটি ধরিবার মত মনের জোর আজ তাহার ছিল না।

অধ্যাপক নিজেই আসন গ্রহণ করিলেন। কহিলেন, অত্যন্ত বিশেষ প্রয়োজনেই আপনার কাছে আজ আমাকে আসতে হয়েছে, না হলে আসতাম না।

এই মানুষটি গ্রামের সকল কাজেই আছেন, অতএব তিনি যে নয়ন গাঙ্গুলীর ব্যাপারেই আসিয়াছেন, আলেখ্য মনে মনে তাহা বুঝিল, এবং পিতার অবর্তমানে তাঁহাকে কি জবাব দিবে, চক্ষুর নিমেষে স্থির করিয়া লইয়া শান্ত দৃঢ়কণ্ঠে কহিল,—বলুন।

অধ্যাপক একটুখানি হাসিলেন; বলিলেন—আজ আপনি নিজের মধ্যে যে কত দুঃখ পেয়েছেন, সে আর কেউ না জানলেও আমি জানি। সে আলোচনা করতে আমি আসিনি, আমি আপনার শত্রু নই।

আলেখ্যর বোধ হইল, এই লোকটি যেন তাহাকে বিদ্রূপ করিতে আসিয়াছে, কিন্তু নিজেকে সে চঞ্চল হইতে দিল না, তেমনই সহজভাবেই কহিল—আপনার প্রয়োজন বলুন।

অধ্যাপক কহিলেন—বলছি। কাল হাটের দিন, শহর থেকে পুলিশ এসে এর মধ্যেই সমস্ত ঘিরে ফেলেছে। এ কাজ আপনি কেন করতে গেলেন?

আলেখ্য চমকিত হইল। এখানে আসার পরদিনই সে বিশেষ কোন অনুসন্ধান বা চিন্তা না করিয়াই জিলার ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট একখানা চিঠি পাঠাইয়া দিয়াছিল। হাটের সম্বন্ধে যে-সকল কথা সে লিখিয়াছিল, তাহার অধিকাংশই অতিরঞ্জিত বা সত্য-মিথ্যায় বিজড়িত। ইহার ফলাফল সে ঠিক জানিত না এবং বিলম্ব দেখিয়া ভাবিয়াছিল হয়ত সে চিঠি পৌঁছায় নাই, কিংবা পৌঁছাইলেও ম্যাজিস্ট্রেট ইহার কিছুই করিবেন না। এতদিনের ব্যবধানে চিঠির কথা সে নিজেই প্রায় ভুলিয়া গিয়াছিল, অকস্মাৎ আজ এই খবর।

আলেখ্য নরম হইয়া বলিল—বেশ ত, এলেই বা তারা, কি এমন ক্ষতি?

অধ্যাপক কহিলেন—আপনি বিদেশে ছিলেন, জানেন না, কিন্তু আমি নিশ্চয় জানি, সহজে এর শেষ হবে না—দু’চারজন মারাও যদি যায় ত আমি আশ্চর্য হব না।

আলেখ্য ভীত হইয়া বলিল—মারা যাবে? কে মারা যাবে?

অধ্যাপক কহিলেন—কে মারা যাবে, কি বলবো? হয়ত আমিও যেতে পারি।

আপনি?

বিচিত্র কি? আত্মসম্মানের জন্যে যদি মরবার প্রয়োজনই হয়, আমাকেই ত সকলের আগে যেতে হবে। কিন্তু সব কথা আপনাকে বলবার এখন আমার সময় নেই, আমাকে অনেকদূরে যেতে হবে। কাল সকালে কি একবার দেখা হতে পারে?

আলেখ্য ব্যগ্র হইয়া বলিল—পারে। আপনি যখনই আমাকে ডেকে পাঠাবেন, আমি তখনই এসে হাজির হব। বাবা নেই, আমাকে কিন্তু আপনি মিথ্যে ভয় দেখাবেন না।

তাহার ব্যাকুল কণ্ঠস্বরে আক্রমণের লেশমাত্রও ছিল না, অধ্যাপক শুধু একটুখানি হাসিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন—না, ভয় দেখানো আমার অভ্যাস নয়, কিন্তু কাল যেন সত্যই আপনার দেখা পাই।—এই বলিয়া যেমন সহজে আসিয়াছিলেন, তেমনই সহজে বাহির হইয়া গেলেন।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. মাসিক বসুমতী,’ পৌষ ১৩৩০।