এক

ব্যারিস্টার মিস্টার আর. এম. রে ব্রাহ্ম ছিলেন না, গোঁড়া হিন্দু ত ছিলেনই না, হয়ত বা আঠারো আনা ‘বিলাত ফেরতের জাতি’ও নাও হইবেন; তবে এ কথা সত্য যে, তাঁহার পিতা-মাতা যখন আরাধ্য দেব-দেবী স্মরণ করিয়া সপ্তপুরুষের অক্ষয় স্বর্গকামনায় একমাত্র পুত্রের নাম শ্রীরাধামাধব রায় রাখিয়াছিলেন, তখন অতি বড় দুঃস্বপ্নেও তাঁহারা কল্পনা করেন নাই যে, এই ছেলে একদিন আর. এম. রে হইয়া উঠিবে, কিংবা তাহার খাদ্য অপেক্ষা অখাদ্যে এবং পরিধেয়ের পরিবর্তে অপরিধেয় বস্ত্রেই আসক্তি দুর্মদ হইয়া দাঁড়াইবে। যাই হউক, সেই পিতা-মাতারা আজ যখন জীবিত নাই এবং পরলোকে বসিয়া পুত্রের জন্য তাঁহারা মাথা খুঁড়িতেছেন কিংবা চুল ছিঁড়িতেছেন অনুমান করা কঠিন, তখন এই দিকটা ছাড়িয়া দিয়া তাঁহার যে দিকটায় মতদ্বৈধের আশঙ্কা নাই, সেই দিকটাই বলি।

ইঁহার রাধামাধব অবস্থাতেই বাপ-মায়ের মৃত্যু হয়। কলেরা রোগে সাত দিনের ব্যবধানে যখন তাঁহারা মারা যান, ছেলেকে এন্ট্রান্স পাসটুকু পর্যন্ত করাইয়া যাইতে পারেন নাই। তবে এই একটা বড় কাজ করিয়া গিয়াছিলেন যে, ছেলের জন্য জমিদারি এবং বহু প্রজার রক্তজমাট-করা অসংখ্য টাকা এবং ইহার চেয়েও বড় এক অতিশয় বিশ্বাসপরায়ণ ও সুচতুর কর্মচারীর প্রতি সমস্ত ভারার্পণ করিয়া যাইবার অবকাশ এবং সৌভাগ্য তাঁহাদের ঘটিয়াছিল। কিন্তু এ-সকল অনেক দিনের কথা। আজ ‘সাহেবে’র বয়স পঞ্চাশোর্ধে গিয়াছে, দেশের সে রাজশেখর দেওয়ানও আর নাই, সে-সব দেবসেবা, অতিথিসৎকারের পালাও বহুকাল ঘুচিয়াছে। এখন ইংরাজীনবিস ম্যানেজার এবং সেই সাবেক কালের বাড়ি-ঘরের স্থানে যে ফ্যাশনের বিল্ডিং উঠিয়াছে, মালিক মিস্টার আর. এম. রে’র মত ইহাদেরও পৈতৃকের সহিত কোন জাতীয়ত্ব নাই। অথচ, এই-সকল নবপর্যায়ের সহিতও যে যথেষ্ট সম্পর্ক রাখিয়াছেন, তাহাও নয়। কেবল দূর হইতে সত্ত্ব নিংড়াইয়া যে রস বাহির হয়, তাহাই পান করিয়া এতকাল আত্ম এবং সাহেবত্ব রক্ষা করিয়া চলিতেছিলেন। এইখানে তাঁহার কর্মজীবনের আরও দু-একটা পরিচয় সংক্ষেপে দেওয়া আবশ্যক।

ব্যারিস্টারি পাস করিয়া বিলাত হইতে দেশে ফিরিয়া তাঁহারই মত আর এক ‘সাহেবে’র বিদুষী কন্যাকে বিবাহ করেন এবং যথাক্রমে অযোধ্যা, প্রয়াগ, বোম্বাই এবং পাঞ্জাবে প্র্যাক্‌টিস করেন। ইতিমধ্যে স্ত্রী, পুত্র এবং কন্যা লইয়া বার-তিনেক বিলাত যাতায়াত করেন এবং আর যাহা করেন, তাহা এই গল্পের সম্বন্ধে নিষ্প্রয়োজন। ছেলেটি ত ডিফ্‌থিরিয়া রোগে শৈশবেই মারা যায়, এবং পত্নীও দীর্ঘকাল রোগভোগের পর বছর-তিনেক হইল নিষ্কৃতি লাভ করিয়াছেন। সেই হইতে রে সাহেবেও প্র্যাক্‌টিস বন্ধ করিয়াছেন। ঐ ঐ স্থানগুলায় যথেষ্ট-পরিমাণ অর্থ না থাকার জন্যই হউক বা স্ত্রীর মৃত্যুতে বৈরাগ্যোদয় হওয়াতেই হউক, এক সাহেবিআনা ব্যতীত আর সমস্তই ত্যাগ করিয়া তিনি একমাত্র মেয়েটিকে লইয়া পশ্চিমের একটা বড় শহরে নির্বিঘ্নে বাস করিতেছিলেন। এমনি সময়ে একদিন তাঁহার নিশ্চিন্ত শান্তি ও সুগভীর বৈরাগ্য দুই-ই যুগপৎ আলোড়িত করিয়া মহাত্মা গান্ধীর নন্‌-কোঅপারেশনের প্রচণ্ড তরঙ্গ একমুহূর্তে একেবারে অভ্রভেদী হইয়া দেখা দিল। হঠাৎ মনে হইল, এই ভয়লেশহীন শুদ্ধ শান্ত সন্ন্যাসীর সুদীর্ঘ তপস্যা হইতে যে ‘অদ্রোহ অসহযোগ’ নিমিষে বাহির হইয়া আসিল, ইহার অক্ষয় গতিবেগ প্রতিরোধ করিবার কেহ নাই। যেথায় যত দুঃখ-দৈন্য, যত উৎপাত-অত্যাচার, যত লোভ ও মোহের আবর্জনা যুগ-যুগান্ত ব্যাপিয়া সঞ্চিত হইয়া আছে, ইহার কিছুই কোথাও আর অবশিষ্ট থাকিবে না, সমস্তই এই বিপুল তরঙ্গবেগে নিশ্চিহ্ন হইয়া ভাসিয়া যাইবে।

কলিকাতার মেল ক্ষণকাল পূর্বে আসিয়াছে, বাহিরের ঢাকা বারান্দায় আরামকেদারায় বসিয়া রে-সাহেব জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলনের বিবরণ নিবিষ্টচিত্তে পাঠ করিতেছিলেন, এমন সময় নীচে গাড়িবারান্দায় মোটরের শব্দ শোনা গেল এবং মিনিট-দুই পরেই তাঁহার কন্যা আলেখ্য রায় বাহিরে যাইবার পোশাকে সজ্জিত হইয়া দেখা দিলেন। মেয়েটির রঙ ফরসা নয়; কারণ, বাঙালী ‘সাহেবদের’ মেয়েরা ফরসা হয় না, কেবল সাবান ও পাউডারের জোরে চামড়াটা পাঁশুটে দেখায়। তবে দেখিতে ভাল। মুখে-চোখে দিব্য একটি বুদ্ধির শ্রী আছে, স্বাস্থ্য ও যৌবনের লাবণ্য সর্বদেহে টলটল করিতেছে, বয়স বাইশ-তেইশের বেশি নয়; কহিল—বাবা, ইন্দুর বাড়িতে আজ আমাদের টেনিস টুর্নামেন্ট, আমি যাচ্ছি। ফিরতে যদি একটু দেরি হয় ত ভেবো না।

‘সাহেব’ কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া চাহিলেন। তাঁহার চোখের দৃষ্টি উত্তেজনায় উজ্জ্বল, মুখে আবেগ ও আশঙ্কার ছায়া পড়িয়াছে, মেয়ের কথা কানেও যায় নাই। বলিয়া উঠিলেন—আলো, এই দেখ মা, কি-সব কাণ্ড! বার বার বলেছি, এ-সব হতে বাধ্য, হয়েছেও তাই।

মেয়ে বাবাকে চিনিত। তাঁহার কাছে সংসারের যাহা কিছু ঘটে, তাহাই ঘটিতে বাধ্য এবং তিনি তাহা পূর্বাহ্ণেই জানিতেন। সুতরাং এটা যে ঠিক কোন্‌টা, তাহা আন্দাজ করিতে না পারিয়া কহিল—কি হয়েছে বাবা?

বাবা তেমনি উদ্দীপ্ত ভঙ্গীতে বলিয়া উঠিলেন—কি হয়েছে? দু’জন নন্‌-কো-অপারেটার ছাত্রকে ম্যাজিস্ট্রেট ধরে নিয়ে গিয়ে হাড়-ভাঙ্গা খাটুনির জেল দিয়েছে, আরো পাঁচ-সাত-দশজনকে ধরবার হুকুম দিয়েছে, কি জানি, এদেরই বা কি সাজা হয়! এই বলিয়া একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া নিজেই বলিলেন—আর যা হবে, তাও জানি। খাটুনির জেল ত বটেই এবং এক বছরের নীচেও যে কেউ যাবে না, তাও বেশ বোঝা যায়। এই বলিয়া তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন।

আলেখ্য এ-সকল বিষয়ে মনও দিত না, এখন সময়ও ছিল না। আসন্ন টুর্নামেন্টের চিন্তাতেই সে ব্যস্ত হইয়াছিল। কিন্তু তাহার সঙ্গীহীন, শোকজীর্ণ অকালবৃদ্ধ পিতার আগ্রহ ও আশঙ্কাকেও অবহেলা করিয়া চলিয়া যাইতে পারিল না। পাশের চেয়ারটার হাতলের উপর ভর দিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল—ছেলে দু’টি কি করেছিল বাবা?

পিতা কহিলেন—তা করেছেও কম নয়। চারিদিকে গান্ধীর নন্‌-কোঅপারেশন মত প্রচার করে বেড়িয়েছে; দেশের লোককে ডেকে বলেছে, কেউ তোমরা মারামারি কাটাকাটি করো না, কোন ব্যক্তি-বিশেষ বা ইংরাজের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করো না, কিন্তু এই অনাচারী, ধর্মহীন, সত্যভ্রষ্ট বিদেশী গভর্নমেন্টের সঙ্গেও আর কোন সম্পর্ক রেখো না, চাকরির লোভে এর দ্বারে যেয়ো না, বিদ্যের জন্যে এর স্কুল-কলেজে ঢুকো না, বিচারের আশায় আদালতের ছায়া পর্যন্ত মাড়িও না।

আলেখ্য কহিল—তার মানে, সমস্ত দেশটাকে এরা আর একবার মগের মুল্লুক বানিয়ে তুলতে চায়।

রে বলিলেন—তা ছাড়া আর কি যে হতে পারে, আমি ত ভেবে পাইনে!

আলেখ্য কহিল—তাহলে এদের জেলে যাওয়াই উচিত। বাস্তবিক, মিছামিছি সমস্ত দেশটাকে যেন তোলপাড় করে তুলেছে।

মেয়ের কথায় পিতা পূর্ণ সম্মতি দিতে পারিলেন না। একটু দ্বিধা করিয়া বলিলেন,—না, ঠিক যে মিছামিছি করছে তাও নয়, গভর্নমেন্টেরও অন্যায় আছে।

আলেখ্য গভর্নমেন্টের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে কিছুই প্রায় জানিত না। খবরের কাগজ পড়িতে তাহার একেবারে ভাল লাগিত না, দেশ বা বিদেশের কোথায় কি ঘটিতেছে, না ঘটিতেছে, এ লইয়া নিজেকে নিরর্থক উদ্বিগ্ন করিয়া তোলার সে কোন প্রয়োজন অনুভব করিত না। সুমুখের ঘড়ির দিকে চাহিয়া দেখিল, তখনও তাহার মিনিট-দশেক সময় আছে, বাবাকে একলা ফেলিয়া যাইবার পূর্বে কোন কিছু একটা অছিলায় এই স্বল্পকালটুকুও তাঁহাকে সঞ্জীবিত ও সচেতন করিয়া যাইবার লোভে কহিল—বাবা, মুখে তুমি যাই কেন না বল, ভেতরে ভেতরে কিন্তু তুমি এই সব লোকেদেরই ভালোবাসো। এই যে সেদিন হরতালের দিন ইন্দুদের মোটরের উইন্ডস্ক্রীনটা ইঁট মেরে ভেঙ্গে দিলে, তুমি শুনে বললে, এ-রকম একটা বড় ব্যাপারে ও-সব ছোটখাটো অত্যাচার ঘটেই থাকে। গাড়িতে ইন্দুর বাবা ছিলেন, ধর, যদি ইঁটটা তাঁর গায়েই লাগতো?

কন্যার অভিযোগে পিতা একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন—না না, আমাকে তুমি ভুল বুঝেছ আলো। এই সব দুরন্তপনা আমি মোটেই পছন্দ করিনে এবং যারা করে তাদের শাস্তি দিতেই বলি। কিন্তু তাও বলি, মিস্টার ঘোষের সেদিন গাড়িতে না বার হওয়াই উচিত ছিল। দেশে এতগুলো লোকের সনির্বন্ধ অনুরোধ উপেক্ষা করাই কি ভাল মা?

আলেখ্য রাগ করিয়া কহিল—অনুরোধ করলেই হল বাবা? বরঞ্চ, আমি ত বলি, অন্যায় অনুরোধ যেদিক থেকেই আসুক, তাকে অগ্রাহ্য করাই যথার্থ সাহস। এ সাহস তাঁর ছিল বলে তাঁকে বরঞ্চ ধন্যবাদ দেওয়াই উচিত।

রে-সাহেব সামান্য একটুখানি উত্তেজনার সহিত প্রশ্ন করিলেন—এ অনুরোধ অন্যায়, এ তুমি কি করে বুঝলে আলো?

আলেখ্য কহিল—তাঁর নিজের গাড়িতে চড়বার তাঁর সম্পূর্ণ অধিকার আছে। নিষেধ করাই অন্যায়।

তাহার পিতা বলিলেন—এটা অত্যন্ত মোটা কথা মা।

কন্যা কহিল—মোটা কথাই বাবা, এবং এই মোটা কথা মেনে চলবার বুদ্ধি এবং সাহসই যেন সংসারে বেশী লোকের থাকে।

সেদিন গাড়ির এই কাঁচভাঙ্গা লইয়া ইন্দুদের বাটীতে যে-সকল তীক্ষ্ণ ও কঠিন আলোচনা হইয়াছিল, সে-সকল আলেখ্যের মনে ছিল, তাহারই সূত্র ধরিয়া কণ্ঠস্বর তাহার উত্তপ্ত হইয়া উঠিল; কহিল, তিনি কিছুই অন্যায় করেন নি, বরঞ্চ যে-সব ভীতু লোক ভয়ে ভয়ে এই-সব স্বদেশী গুণ্ডাদের প্রশ্রয় দিয়েছিল, তারাই ঢের বেশী অন্যায় করেছিল বাবা, এ তোমাকে আমি নিশ্চয় বলছি।

সাহেবের মুখ মলিন হইল। কিন্তু আলেখ্যেরও চক্ষের পলকে মনে পড়িল, তাঁহার পিতা অসুস্থ শরীরেও সেদিন সকালে পায়ে হাঁটিয়া ডাক্তারখানায় গিয়েছিলেন এবং ডাক্তারের বারংবার আহ্বান সত্ত্বেও তেমনি হাঁটিয়াই বাটী ফিরিয়াছিলেন। পাছে তাহার তীক্ষ্ণ মন্তব্য ঘুণাগ্রেও পিতার কার্যের সমালোচনার মত শুনাইয়া থাকে, এই লজ্জায় সে একেবারে সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল। তাহার ভগ্নস্বাস্থ্য দুর্বলচিত্ত পিতাকে সে ভাল করিয়াই জানিত। দেহের ও মনের কোনদিন কোন তেজ ছিল না বলিয়া তিনি সংসারে সকল সুবিধা পাইয়াও কখনও উন্নতি করিতে পারেন নাই। শত্রু-মিত্র অনেকের কাছে, বিশেষ করিয়া নিজের স্ত্রীর কাছে অনেকদিন অনেক কথাই এই লইয়া তাঁহাকে শুনিতে হইয়াছে, ফলোদয় কিছুই হয় নাই। এমনি ভাবেই সারা জীবন কাটিয়াছে,—কিন্তু সেই জীবনের আজ অপর প্রান্তে পৌঁছিয়া মেয়ের মুখ হইতে সেই সকল পুরানো তিরস্কারের পুনরাবৃত্তি শুনিলে দুঃখের আর বাকি কিছু থাকে না।

আলেখ্য তাড়াতাড়ি পিতার কাছে আসিয়া তাঁহার কাঁধের উপর একটা হাত রাখিয়া আদর করিয়া কহিল—কিন্তু তাই বলে তুমি যেন ভেবো না বাবা, তোমার কোন কাজকে আমি অন্যায় মনে করি।

পিতা একটু আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—আমার কোন্‌ কাজ মা? সেদিনকার নিজের কথা তাঁহার মনেও ছিল না।

মেয়ে বাপের মুখের কাছে ঝুঁকিয়া পড়িয়া বলিল—কোন কাজই নয় বাবা, কোন কাজই নয়। অন্যায় তুমি যে কিছু করতেই পারো না। তবুও তোমাকে যারা সেদিন অসুখ শরীরে ডাক্তারখানায় হেঁটে যেতে-আসতে বাধ্য করলে, বল ত বাবা, তারা কতখানি অন্যায় অত্যাচার করেছিল।

সাহেবের ঘটনাটা মনে পড়িল। তিনি সস্নেহে মেয়ের মাথার উপর ধীরে ধীরে হাত চাপড়াইতে চাপড়াইতে বলিলেন—ওঃ, তাই বুঝি তাদের ওপর তোর রাগ আলো?

এই পিতাটিকে ভুলাইতে আলেখ্যের কষ্ট পাইতে হইত না। সে কৃত্রিম ক্রোধের স্বরে কহিল—রাগ হয় না বাবা?

বাবা হাসিয়া বলিলেন—না মা, রাগ হওয়া উচিত নয়, বরঞ্চ সে আমার বেশ ভালই লেগেছিল। ছোট-বড় উঁচু-নিচু নেই, সবাই পায়ে হেঁটে চলেছে, পা যে ভগবান দিয়েছেন, তার ব্যবহারে যে লজ্জা নেই, এ কথা সেদিন যেমন অনুভব করেছিলাম মা, এমন আর কোনদিন নয়। বহুকাল এ কথা আমার মনে থাকবে আলো।

ইহা যে কোন যুক্তি নয়, আলেখ্য তাহা মনে মনে বুঝিল, তথাপি এই লইয়া আর নূতন তর্কের সৃষ্টি করিল না। ঘড়িতে পাঁচটা বাজিতেই কহিল—চল না বাবা, আজ আমাদের টুর্নামেন্ট দেখতে যাবে। ইন্দুর মা যে কত খুশী হবেন, তা আর বলতে পারিনে।

পিতাকে কোনকালেই সহজে বাটীর বাহির করা যাইত না, বিশেষ করিয়া তাহার মায়ের মৃত্যুর পর। ঘর এবং এই ঢাকা বারান্দাটি ধীরে ধীরে তাঁহার কাছে সমস্ত পৃথিবীতে পরিণত হইতেছিল। জড়তায় দেহ ক্রমশ: ভাঙ্গিয়া আসিতেছিল, কিন্তু কোথাও বাহির হইবার প্রস্তাবেই তাঁহার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইত। মেয়ের কথায় ভয় পাইয়া তাড়াতাড়ি বলিলেন—এখন? এই অসময়ে?

মেয়ে হাসিয়া বলিল—এই ত বেড়াতে যাবার সময় বাবা।

কিন্তু আমার যে বিস্তর চিঠি লেখবার রয়েছে আলো! তুমি বরঞ্চ একটু শীঘ্র শীঘ্র ফিরো, যেন অধিক রাত না হয়, আমি ততক্ষণ হাতের কাজগুলো সেরে ফেলি। এই বলিয়া তিনি তৎক্ষণাৎ সংবাদপত্রে মনঃসংযোগ করিলেন।

এই মেয়েটির ক্ষুদ্র জীবনের একটু সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এইখানে দেওয়া প্রয়োজন। আলেখ্য নামটি মা রাখিয়াছিলেন বোধ করি নূতনত্বের প্রলোভনে। হয়ত এমন অভিসন্ধিও তাঁহার মনে গোপনে ছিল, হিন্দুদের কোন দেবদেবীর সহিতই না ইহার লেশমাত্র সাদৃশ্য কেহ খুঁজিয়া পায়; কিন্তু পিতা প্রথম হইতেই নামটা পছন্দ করেন নাই, সহজে উচ্চারণ করিতেও একটু বাধিত, তাই মেয়েকে তিনি ছোট করিয়া আলো বলিয়াই ডাকিতেন। এই সোজা নামটাই তাহার ক্রমশ: চারিদিকে প্রচলিত হইয়া গিয়াছিল। ইন্দুদের সহিত তাহার পরিচয় ছেলেবেলার। ইন্দুর মা ও তাহার মা স্কুলে একত্রে পড়িয়াছিলেন, কিছুকাল এক বোর্ডিঙে বাস করিয়াছিলেন এবং আমরণ অতিশয় বন্ধু ছিলেন।

ইন্দুর দাদা কমলকিরণ যখন বিলাতে ব্যারিস্টারি পড়িতে যায়, তখন এই শর্তই হইয়াছিল যে, সে পাস করিয়া ফিরিলে তাহারই হাতে কন্যা সম্প্রদান করিবেন। বছর-খানেক হইল কমলকিরণ পাস করিয়া কে. কে. ঘোষ হইয়া দেশে ফিরিয়াছে, তাহার পিতা-মাতা মৃত-পত্নীর প্রতিশ্রুতিও বার-কয়েক রে সাহেবের গোচর করিয়াছেন, কিন্তু এমনি দুর্বলচিত্ত তিনি যে, হাঁ কিংবা না, কোনটাই অদ্যাবধি মনস্থির করিয়া উঠিতে পারেন নাই। ইন্দুদের বাটীতে টুর্নামেন্ট দেখিবার নিমন্ত্রণমাত্রই কেন যে তিনি অমন করিয়া আপনাকে খবরের কাগজের মধ্যে নিমগ্ন করিয়া ফেলিলেন, ইহার যথার্থ হেতু মেয়ে যাহাই বুঝুক, ইন্দুর মা শুনিলে তাহার অন্যপ্রকার অর্থ করিতেন। তথাপি আলেখ্যকে বধূ করিবার চেষ্টা হইতে তিনি এখনও বিরত হন নাই। তাহার মত মেয়ে রূপে গুণে দুর্লভ নয় তিনি জানিতেন, কিন্তু রোগগ্রস্ত পিতার মৃত্যুর পরে যে সম্পত্তি তাহার হস্তগত হইবে, তাহা যে সত্যই দুর্লভ, ইহাও তিনি ভাল করিয়াই জানিতেন। অন্যপক্ষে পাত্র হিসাবে কমলকিরণ অবহেলার সামগ্রী নহে। সে শিক্ষিত রূপবান; পিতার জুনিয়ারি করিতেছে,—ভবিষ্যৎ তাহার উজ্জ্বল। মা কথা দিয়াছিলেন, আলেখ্য তাহা জানিত। ইন্দু ও তাহার জননী যখন-তখন তাহা শুনাইতেও ত্রুটি করিতেন না। সকলেই প্রায় একপ্রকার নিশ্চিত ছিলেন যে, অল্পবুদ্ধি বৃদ্ধের মনস্থির করিতে বিলম্ব হইতে পারে, কিন্তু স্থির যখন একদিন করিতেই হইবে, তখন এদিকে আর নড়চড় হইবে না। প্রমাণস্বরূপে তিনি আলেখ্যের সুমুখেই তাঁহার স্বামীকে বলিতেন, সন্দেহ করবার আমি ত কোন কারণ দেখিনে। অমত থাকলে মিঃ রে কখনও আলোকে এমন একলা আমাদের বাড়ি পাঠাতেন না। মনে মনে তিনি খুব জানেন, তাঁর মেয়ে আপনার বাড়িতে আপনার লোকজনের কাছেই যাচ্ছে। কি বলো মা আলো? কমল উপস্থিত থাকিলে মুখ তাহার রাঙ্গা হইয়া উঠিত। পুরুষেরা না থাকিলে সে সহজেই সায় দিয়া সলজ্জকণ্ঠে কহিত—বাবা ত সত্যিই জানেন, আপনি আমার মায়ের মত।

এই একটা বছর এমনিভাবেই কাটিয়া গিয়াছিল।

টেনিস টুর্নামেন্টের অদ্যকার পালা সমাপ্ত হইলে ইন্দুদের বাটীতে চা ও সামান্য কিছু জলযোগের ব্যবস্থা ছিল। সে-সকল শেষ হইতে সন্ধ্যা বহুক্ষণ উত্তীর্ণ হইয়া গেল; কিন্তু সেদিকে আলেখ্যের আজ খেয়ালই ছিল না।

সে ভাল খেলিত, কানপুর হইতে যাঁহারা আসিয়াছিলেন, তাঁহারা হারিয়া গিয়াছিলেন, সেই জয়ের আনন্দে মন তাহার আজ অত্যন্ত প্রসন্ন ছিল। তথাপি ইন্দুর গান শেষ না হইতেই তাহাকে ঘড়ির দিকে চাহিয়া অলক্ষ্যে উঠিয়া পড়িতে হইল এবং সঙ্গীহীন পিতার কথা স্মরণ করিয়া বিদায়গ্রহণের প্রচলিত আচরণটুকু পরিহার করিয়াই তাহাকে দ্রুতপদে নীচে নামিয়া আসিতে হইল। মোটর তাহার প্রস্তুত ছিল, শোফার দ্বার খুলিয়া দিতেই গাড়িতে উঠিয়া পরিশ্রান্ত দেহলতা সে এলাইয়া দিয়া বসিল। রাত্রি অন্ধকার নহে, আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে, অদূরে একটা বিলাতী লতার কুঞ্জ হইতে একপ্রকার উগ্র গন্ধে নিঃশ্বাসের বাতাস যেন ভারী হইয়া উঠিয়াছে। অত্যধিক খেলার পরিশ্রমে সে ক্লান্ত, কিন্তু যৌবনের উষ্ণ রক্ত তখনও খরবেগে শিরার মধ্যে বহিতেছে—এমন না বলিয়া চুপি চুপি আসাটা ভাল হইল না, সে ভাবিতেছে, এমন সময়ে ঠিক কানের কাছে শুনিল, হঠাৎ পালিয়ে এলে যে আলো?

আলেখ্য চকিত হইয়া উঠিয়া বসিয়া কহিল,—এঁরা কিছু বলছেন বুঝি?

কমল হাসিয়া কহিল—না। তার কারণ, আমি ছাড়া আর কেউ জানতেই পারেন নি। কিন্তু আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া শক্ত। জ্যোৎস্নার আলোকে আলেখ্যের মুখের চেহারা দেখা গেল না। সে নিজেকে সামলাইয়া লইয়া কহিল—আপনি ত জানেন, বাবা একলা আছেন, একটু রাত হলেই তিনি বড় ব্যস্ত হন।

কমল ঘাড় নাড়িয়া বলিল—জানি এবং সেই জন্যে রাত করা তোমার উচিতই নয়।

শোফার গাড়িকে প্রস্তুত করিয়া উঠিয়া বসিতেই কমল চুপি চুপি বলিল—হুকুম দাও ত তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

আলেখ্য মনে মনে লজ্জা বোধ করিল, কিন্তু না বলিতে পারিল না। শুধু জিজ্ঞাসা করিল, আপনি ফিরবেন কি করে?

কমল কহিল—চমৎকার রাত, দিব্যি বেড়াতে বেড়াতে ফিরে আসবো। তখন পর্যন্ত হয়ত এঁরা কেউ টেরও পাবেন না। এই বলিয়া সে নিজেই দরজা খুলিয়া আলেখ্যের পাশে আসিয়া উপবেশন করিল।

বেশী দূর নয়, মিনিট পাঁচ-ছয় মাত্র। অতি প্রয়োজনীয় কথার জন্য ইহাই পর্যাপ্ত। কিন্তু কোন কথাই হইল না, পাশাপাশি উভয়ে চুপ করিয়া বসিয়া। গাড়ি রে-সাহেবের ফটকে আসিয়া প্রবেশ করিল। আলেখ্যের অত্যন্ত লজ্জা করিতেছিল, মোটরের শব্দে বাবা নিশ্চয়ই বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইবেন, কিন্তু উপরের বারান্দা শূন্য, কোথাও কেহ নাই।

দু’জনে অবতরণ করিলে শোফার গাড়ি লইয়া প্রস্থান করিল। কমল মৃদুকণ্ঠে বিদায় লইয়া ফিরিল, হলে ঢুকিয়া আলেখ্য বেহারাকে সভয়ে প্রশ্ন করিল—সাহেব কোথায়?

সে সেলাম করিয়া জানাইল, তিনি উপরের ঘরেই আছেন।

আলেখ্য দ্রুতপদে সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিয়া তাহার পিতার ঘরে ঢুকিয়া একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেল। আলমারি খোলা, ঘরময় জিনিসপত্র ছড়ানো, সাহেব নিজে আর একটা বেহারাকে দিয়া বড় বড় দুটো তোরঙ্গ ভর্তি করিতেছেন।

এ কি বাবা, কোথাও যাবে নাকি?

সাহেব চমকিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন—দেখ্‌ দিকি সব কাণ্ড! তখন বলেছি, গান্ধী সর্বনাশ করবে! এই সব স্বদেশী গুণ্ডারা দেশটাকে লণ্ডভণ্ড করে তবে ছাড়বে, এ যে আমি শুরুতেই দেখতে পেয়েছি! এই বলিয়া তিনি পকেট হইতে একটা চিঠি লইয়া মেয়ের পায়ের কাছে ফেলিয়া দিলেন। বলিলেন, এদের সবাইকে ধরে জেলে না পাঠালে যে সমস্ত দেশ অরাজক হতে বাধ্য।

মাত্র ঘণ্টা তিন-চার পূর্বেই যে তিনি প্রায় উলটা কথা বলিয়াছিলেন, তাহা স্মরণ করাইয়া কোন লাভ নাই। আলেখ্য নিঃশব্দে চিঠিখানা তুলিয়া লইয়া আলোর সম্মুখে গিয়া এক নিঃশ্বাসে তাহা পড়িয়া ফেলিল। চিঠি তাঁহার ম্যানেজারের। তিনি দুঃখ করিয়া, বরঞ্চ কতকটা ক্রোধের সহিতই জানাইতেছেন যে, জমিদারির অবস্থা অতিশয় বিশৃঙ্খল। তিনি উপর্যুপরি কয়েকখানা পত্রে সকল বৃত্তান্ত সবিস্তারে নিবেদন করিয়াও প্রতিবিধানের কোন আদেশ পান নাই। অপিচ, প্রকারান্তরে তাহাদের প্রশ্রয় দেওয়াই হইয়াছে। দুর্বৃত্তরা ক্রমশ: এরূপ স্পর্ধিত হইয়া উঠিয়াছে যে, তাঁহাকেই অপমান করিয়াছে। এমন কি, তিনি লোকজন লইয়া স্বয়ং উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও অমরপুরের হাটে বিলাতী বস্ত্র বিক্রয় একপ্রকার বন্ধ করিয়া দিয়াছে। তাহাতে জমিদারির আয় অত্যন্ত কমিয়া গিয়াছে। অবশেষে নিরুপায় হইয়াই তিনি সকল ঘটনা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের গোচর করায় ইহাদের প্ররোচনায় বিদ্রোহী প্রজারা ধর্মঘট করিয়া খাজনা আদায় বন্ধ করিয়াছে। এমন কি, লুটপাটের ভয়ও দেখাইতেছে। সরকারী খাজনা জমা দিবার সময় হইয়া আসিল, কিন্তু তহবিলে কিছুমাত্র টাকা মজুদ নাই। ইহার আশু প্রতিকার প্রয়োজন। জনরব এইরূপ যে, মালিক নিজে না আসিলে কোন উপায় হইবে না।

চিঠি পড়িয়া আলেখ্যের মুখ ফ্যাকাশে হইয়া গেল। রুদ্ধকণ্ঠে বলিল—বাবা, তুমি নিজে যাচ্ছো?

বাবা বলিলেন—নিজে না গেলে কি হয় মা? যাবো আর আসবো !—একটা দিনে সমস্ত শায়েস্তা হয়ে যাবে। ঘোষ-সাহেবকে বলে যাবো, তিনি দু’বেলা এসে দেখবেন, তোমার কোন কষ্ট হবে না।

মেয়ে সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া কহিল—ম্যানেজারবাবু তোমাকে বারবার সতর্ক করেছেন, তবু তুমি কিছুই করোনি বাবা?

সাহেব সতেজে বলিলেন—করেছি বৈ কি, নিশ্চয় করেছি। বোধ হয়, চিঠির জবাবও দিয়েছি।

মেয়ে ক্ষণকাল বাপের মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া কহিল—বোধ হয় দাওনি বাবা, তুমি ভুলে গেছ।

সাহেবের গলার সুর সহসা নীচের পর্দায় নামিয়া আসিল,—কহিলেন—ভুলে যাবো কেন? এই যে সেদিন নিজের হাতে লিখে দিলাম, লোকেরা বিলিতী কাপড় যদি পরতে না চায় ত হাটে এনে কাজ নেই। তাতে লোকসান ছাড়া ত লাভ নেই কারো—

তাঁহার কথা শেষ না হইতেই আলেখ্য ভীতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিল—এ চিঠি আবার তুমি কাকে লিখলে বাবা? কৈ, ম্যানেজারবাবুর পত্রে ত এর কোন কথা নেই।

সাহেব চিন্তিত মুখে বলিলেন—ঐ যে সব কারা কলকাতা থেকে এসে গ্রামে গ্রামে নাইট ইস্কুল খুলেছে। চাষাভুষোদের সব মত জেনে আমার হুকুম চেয়েছিল,—তা বেশ ত, তারা যে ইচ্ছে করুক না, আমার কি? আমার খাজনা পেলেই হ’ল।

মেয়ে জিজ্ঞাসা করিল—তা হলে আমাদের গ্রামেও নাইট ইস্কুল খোলা হয়েছে?

বাবা সগর্বে বললেন—নিশ্চয় হয়েছে ! নিশ্চয় হয়েছে। আমিই ত বলে দিলাম, মন্দিরের নাটবাংলাটা পড়ে আছে, ইচ্ছে হয় তাতেই করুক। সামান্য একটু তেলের খরচা বৈ ত না।

মেয়ে কহিল—তেলের খরচও বোধ হয় কাছারি থেকেই দেওয়া হচ্ছে?

বাবা বলিলেন—হুকুম ত দিয়েছি, এখন না যদি করে, দূর থেকে আর কত দেখি বল?

মেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া পিতার মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া শেষে ধীরে ধীরে বলিল—বাবা, তুমি ও-ঘরে গিয়ে ব’সগে, আমি নিজে সব গুছিয়ে নিচ্ছি। তোমার সঙ্গে আমিও যাবো।

পিতা সবিস্ময়ে কহিলেন—তুমি যাবে?

আলেখ্য বলিল,—হাঁ বাবা—আমার বোধ হয়, আমি না গেলে চলবে না।