‘ইন্দিরা’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কুশলী হাতে নির্মিত শ্রেষ্ঠ চরিত্রগুলোর একটি নয়। তারপরও এই উপন্যাসের বিশেষত্ব কী? এই রচনাকে বাংলাসাহিত্যের ছোটগল্প রচনার প্রথম সফল প্রচেষ্টার একটি হিসেবে দেখা হয়। প্রকাশিত হয়েছিল ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। লেখকের নিজের সম্পাদিত কাগজে। পরবর্তীতে যেটি উপন্যাসের আকার গ্রহণ করে। ১৮৯৩ সালে ‘ইন্দিরা’ লেখকের জীবদ্দশায় প্রথম উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয়। এর আগ পর্যন্ত সবগুলো সংস্করণে এটি ছোটগল্পের মর্যাদাই পেয়েছিল। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ইন্দিরার জবানিতে সেই সময়ের যে সমাজচিত্র আঁকা হয়, তাতে দেখা যায় উনিশ বছরের এক তরুণীকে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পথে ডাকাতের মুখে পড়তে হয়। এত দেরীতে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা বলা হলেও ইন্দিরাকে বাল্যবিবাহের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর শ্বশুর পুত্রবধূকে নিয়ে যেতে লোক পাঠালেও ইন্দিরার বাবা মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে অস্বীকৃতি জানান। কুড়ি বছর বয়সী জামাতার উপার্জন করতে না শেখা পর্যন্ত মেয়েকে নিজের কাছেই রেখে দেওয়া সমীচীন মনে করেন। ইন্দিরার জবানিতে স্বামী উপেন্দ্রের যে প্রতিজ্ঞার কথা জানা যায়, পরিবারের প্রতিপালনের জন্য নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যে সংকল্পের বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে তৎকালীন সময়ের নারীর ভক্তি ও স্বামীর জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষার এক অসম বাস্তবতার চিত্র উঠে আসে। কিন্তু ইন্দিরার স্বামীর বাড়ি যাওয়ার পথটা অতটা সহজ হয়নি। পথিমধ্যে ডাকাতের কবলে পড়তে হয়। তৎকালীন গ্রামীণ সমাজের জীবনযাপনের এমনই এক চিত্র উঠে আসে যেখানে পিত্রালয় মহেশপুর থেকে শ্বশুরবাড়ী মনোহরপুর যেতে দশ ক্রোশ পথের দূরত্ব। ব্রিটিশদের হাতে মাইল ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলায় দূরত্ব পরিমাপের জন্য ‘ক্রোশ’-ই প্রধানত ব্যবহার হতো। ক্রোশ গণনায় মাইলের হিসাবের রকমফের ছিল। অঞ্চলভেদে এক ক্রোশ সমান দুই মাইল থেকে এমনকী চার মাইল পর্যন্তও হিসাব করা হতো।

উপন্যাসে ঘটনাপ্রবাহে ইন্দিরার শ্বশুরবাড়ি যাত্রার পথে যে বৃহৎ দীঘি পড়ে, যেটা ডাকাতদের আস্তানা, সেই কালোদীঘি নামক স্থানেই ইন্দিরা ডাকাতদের কবলে পড়ে। ইন্দিরার সহযাত্রী ষোলজন বাহক, চারজন দারোয়ান ও অন্যান্য লোক থাকা সত্ত্বেও তাকে ডাকাতদের হাতে জিম্মি হতে হয়। সঙ্গীসাথীহারা ইন্দিরার শরীর থেকে মূল্যবান রত্নালঙ্কারসহ এমনকি গায়ের দামী বস্ত্র পর্যন্ত লুট করে ঘন জঙ্গলে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয়। সেখান থেকে তার যে যাত্রা, সেই দৃশ্যের বর্ণনা বাংলা গল্পে সচরাচর দেখা যায় না। সেই যাত্রায় ইন্দিরাকে পোহাতে হয় বাঘ-ভালুকের ভয় ও ক্ষুধাতৃঞ্চার জা্বালা। সাপ-কাঁটার উৎপাত সহ্য করে রাত কাটানোর মতো শিউরে ওঠা গল্প ইন্দিরার জবানিতে উঠে আসে। সেই দুর্বিষহ যাত্রার মধ্যেই নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যেভাবে সাধারণ কায়স্থ এক গাঁয়ের তরুণী প্রথম গঙ্গাদর্শন করে, যে উৎফুল্লতা চোখেমুখে অনুভব করে, আহ্লাদে ভরিয়ে তোলে প্রাণ, তার ভেতর দিয়ে ইন্দিরা সেই সময়ের নারীদের অবগুণ্ঠিত জীবনের মধ্যে হঠাৎ ধরা দেওয়া উচ্ছ্বাস প্রকাশের মুহূর্তগুলো দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলে।

উপন্যাসের চরিত্রের দৃশ্যায়নের মধ্যেই পাঠকের মনে প্রশ্ন তোলে, ‘সত্য সত্যই কেহ স্ত্রীকে বনে দিয়া আসিলে লোকে তাকে মহাপাপী বলে; কিন্তু রামচন্দ্র সীতাকে বলে দিয়াছিলেন, তাঁহাকে কেহ মহাপাপী বলে না কেন?’

উপন্যাসের বিস্তারে ধীরে ধীরে লেখকের একটি আদর্শিক অবস্থান স্পষ্ট হয়। ইন্দিরা হয়ে ওঠে লেখকের আদর্শের ঘোড়া। স্ত্রীলোকই পৃথিবীর কন্টক, নারী জাতি হতেই পৃথিবীর যত অনিষ্ট ঘটে। ইন্দিরার পতিভক্ত রূপ তাকে অন্ধকার আদর্শের দিকে ধাবিত করতে থাকে। তার মুখ ফুঁড়ে বেরাতে থাকে অনির্বচনীয় অন্ধত্ব, ‘যহারা বলে বিধবার বিবাহ দাও, ধেড়ে মেয়ে নহলে বিবাহ দিও না, মেয়েকে পুরুষ মানুষের মত নানা শাস্ত্রে পণ্ডিত কর, তাহারা পতিভক্তিতত্ত্ব বুঝিবে কি?’

অথচ ডাকাতের হাতে পড়া ইন্দিরা অবর্ণনীয় দুঃখ-সংগ্রামের মধ্যে শেষপর্যন্ত স্বামীর দেখা পেলেও নিঃসংশয়ে নিজের পরিচয় দিতে পারে না। পতিকেই সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করে, ‘যদি এখন তাঁহার দেখা পান, তবে কি করিবেন?’ পতি সহসা উত্তর দেয়, ‘তাকে ত্যাগ করিব।’

এই নির্দয় বচন তাকে স্তম্ভিত করলেও ইন্দিরা নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। যে নারীকে কুলত্যাগকারিণী সন্দেহে ত্যাগ করার কথা মুহূর্তও না ভেবে বলার সাহস রাখে, সে-ই যে তার আপন স্ত্রী, একথা তার স্বামী ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে না। অথচ এমনই এক কুলত্যাগকারিণী নারী ভেবে সে নিজের স্ত্রীকে কাছে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। স্ত্রীকে ডাকাতের দল তুলে নিয়েছিল বলে তাকে ঘরে তুললে জাত যাবে এই ভয় তার আছে। কিন্তু একইসাথে এক কুলটা নারীকে ঘর তুলতে সে ভয় পায় না। ইন্দিরা সবকিছু জেনেও পতির সম্মান রক্ষায় সর্বোচ্চ সংযম ও কষ্ট সহ্য করে নিজেকে প্রমাণ করতে প্রবৃত্ত হয়।

প্রকৃতপক্ষে উপন্যাসটির মধ্য দিয়ে লেখক এমনই এক সমাজবাস্তবতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন, যেখানে ইন্দিরা তার স্বামীর পরিচয় পাওয়া সত্ত্বেও নিজের পরিচয় দিনের পর দিন গোপন রাখতে বাধ্য হয়। স্বামী উপেন্দ্র একটি বালিকাকে কৈশোরেই স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ার পরও দীর্ঘদিন তার প্রতি সামাজিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়। এমনকী নিজের স্ত্রীকে দীর্ঘদিনের অদেখার পর পুনরায় দেখা হলে চিনতে ব্যর্থ হয়। উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে স্বামীর সঙ্গে ইন্দিরার শ্বশুরবাড়ী যাত্রার সুখকর দৃশ্য ও তৎপরপরবর্তী ঘটনাবলী দিয়ে। আর এর ভেতর দিয়ে আড়ালে পড়ে থাকে নারীর প্রতি সেই সময়ের পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর ত্রুটিসমূহ।

ফজলুল কবিরী

ইন্দিরা উপন্যাসের পরিচ্ছেদ সমূহ

Leave a Reply