স্বদেশ ও সাহিত্য

‘স্বদেশ ও সাহিত্য’ প্রবন্ধ সঙ্কলনটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে। প্রকাশক শ্রীদীনেশচন্দ্র বর্ম্মণ, আর্য্য পাবলিশিং কোং, ২৬ নং কর্ণওয়ালিশ ষ্ট্রীট্, কলিকাতা। এটির দ্বিতীয় সংস্করণও প্রকাশ করেছিলেন শ্রীদীনেশচন্দ্র বর্ম্মণ, আর্য্য পাবলিশিং কোং, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ থেকে। প্রিণ্টার ছিলেন নারায়ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, এনারেল্ড প্রিণ্টিং ওয়ার্কস্, ১নং মুক্তারাম বাবু ষ্ট্রিট্, কলিকাতা। দ্বিতীয় সংস্করণে প্রকাশকের কথাটি ছিল না।

প্রকাশকের কথা

বাঙ্গালা সাহিত্যের এ অমূল্য রত্ন কয়টি পুরাতন সাময়িক পত্রাদির গর্ভে সমাধিস্থ ছিল। এগুলি উদ্ধার করিয়া প্রকাশ করিবার ইচ্ছা হয়। ভয়ে ভয়ে একদিন পূজ্যপাদ শরৎচন্দ্রের নিকট আমার ইচ্ছা ব্যক্ত করিয়া অনুমতি প্রার্থনা করি এবং তিনিও সানন্দে তাহা দান করেন।

আজ সেগুলি বাঙ্গলার সুধী-সমাজের হাতে অর্পণ করিতে যাইয়া আনন্দ হইতেছে, ভয়ও হইতেছে। যোগ্যতর লোক প্রকাশের ভার গ্রহণ করিলে হয়ত এ রত্নগুলির মর্য্যাদা রক্ষা হইত, সঙ্গত হইত, শোভনও হইত। তাঁহারা যাহা পারিতেন আমি হয়ত যোগ্যতা ও সঙ্গতির অভাবে তাহা পারি নাই, তথাপি আমার আশা এই যে, শরৎচন্দ্রের লেখনী যে রচনা প্রসব করিয়াছে, তাহা নিজের গৌরবে নিজেই গৌরবান্বিত, নিজের প্রভায় নিজেই উজ্জ্বল। যোগ্যতা থাকিলে প্রবন্ধগুলির বাহিরের সৌন্দর্য্য বাড়িতে পারিত বটে কিন্তু আমার অযোগ্যতায়ও বোধকরি ইহাদের ভিতরের সৌন্দর্য্য কমে নাই—কমিতে পারেও না।

কিছুদিন আগে অপর দুইটি মূল্যবান রচনা এই সম্পূর্ণ সঙ্কলনগ্রন্থ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া “তরুণের বিদ্রোহ” নামে প্রকাশ করিতে হইয়াছে। নিতান্ত বাধ্য হইয়াই তা’ করিয়াছিলাম, কেন করিয়াছিলাম তা’ বলিবার দিন আজও আসে নাই, যদি কখনো সে দিন আসে বলিব,—এ ত্রুটি সংশোধনও সেদিনই হইবে। এ অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য পাঠক সমাজের কাছে আজ শুধু মার্জ্জনা ভিক্ষা চাহিতেছি।

যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াও সমস্ত প্রবন্ধ হয়ত সংগ্রহ করিতে পারি নাই, —যদি কেহ দয়া করিয়া প্রকাশ-যোগ্য অপর কোন প্রবন্ধের সন্ধান দেন, দ্বিতীয় সংস্করণে তাহা সংযোগ করিয়া দিব। কতকগুলি অসমাপ্ত রচনা পরিত্যাগ করা উচিত মনে করিয়া তাহাই করিয়াছি। এ ছাড়াও কয়েকটি রচনা অনিবার্য্য কারণে পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে। কয়েকটি বক্তৃতা, যাহা সাময়িক পত্রাদিতেও প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহাও সংযোগ করি নাই। কারণ, যাঁহারা অনুলিপি গ্রহণ করিয়াছিলেন তাঁহারা শরৎচন্দ্রের স্বভাবসিদ্ধ ভাষার সম্মোহিনী-শক্তি বজায় রাখিতে পারেন নাই। ভাব শরৎচন্দ্রের হইলেও ভাষা কৃত্রিম। ভাষার যাদুকর শরৎচন্দ্রের স্কন্ধে সে দুষ্কৃতির ভার চাপাইতে প্রবৃত্তি হইল না।

যথাসাধ্য চেষ্টা সত্ত্বেও কয়েকটি ভুল রহিয়াই গিয়াছে। ‘ছাপাখানার ভূত’-এর দৌরাত্ম্য শারীরিক অসুস্থতা, সময়ের অভাব প্রভৃতি অজুহাত দেখাইয়া আমি তাহার দায়িত্ব এড়াইতে চাই না। সকল দায়িত্ব গ্রহণ করিয়া আমি নিজের অপারগতার জন্য পাঠকবৃন্দের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি। একটা মারাক্তক ভুলের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। মুন্সীগঞ্জে পঠিত অভভাষণটি “সাহিত্য আর্ট ও দুর্নীতি” নামে প্রকাশিত হইয়াছে। শরৎচন্দ্র ইহা অভিভাষণ হিসাবে পড়িয়াছিলেন, প্রবন্ধ হিসাবে নহে এবং ইহার কোন বিশেষ নাম দেওয়ারও তাঁহার অভিপ্রায় ছিল না। কোন মাসিক পত্রে উক্ত নামে অভিভাষণটি প্রকাশিত হওয়ায় অসাবধানতা বশতঃ এ ক্ষেত্রেও তাহাই ছাপা হইয়া গিয়াছে। এই লজ্জাকর ভুলের জন্য আমি পূজ্যপাদ শরৎচন্দ্র ও পাঠক সমাজের নিকট অপরাধী।

মোট যে কয়টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হইল তাহার কয়েকটি সম্বন্ধে দু’চারিটি কথা বলা দরকার—

পূজ্যপাদ কবি রবীন্দ্রনাথ য়ুরোপ প্রত্যাগমনের পর ১৩২৮ সালের আশ্বিন সংখ্যা ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় “শিক্ষার মিলন” শীর্ষক একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। ‘শিক্ষার বিরোধ’ সে প্রবন্ধটির প্রতিবাদ। পরে ‘শিক্ষার মিলন’ সংশোধিত ও পরিবর্ত্তিত আকারে একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা উক্ত পুস্তিকায় সন্ধান করিলে পাঠক নিরাশ হইবেন। সকল কথার সামঞ্জস্য খুঁজিতে হইলে মূল প্রবন্ধটি পড়া দরকার।

স্বর্গীয় দেশবন্ধুর কারামুক্তির পর মির্জ্জাপুর পার্কে (বর্ত্তমান শ্রদ্ধানন্দ পার্ক) দেশবাসীর পক্ষ হইতে তাঁহাকে যে অভিনন্দন পত্র দেওয়া হয়, তাহা শরৎচন্দ্রের রচনা। অভিনন্দন রচনায় প্রাণ ও নৈপুণ্যের প্রসঙ্গ বাদ দিলেও আর একটি বিশেষত্বের জন্য ইহা চিরস্মরণীয় হইবার যোগ্য। পূর্ব্বে অভিনন্দন-পত্র রচনার যে সাধারণ রীতি প্রচলিত ছিল, ইহা তাহার প্রভাব হইতে মুক্ত ত বটেই উপরন্তু বর্ত্তমান যুগের অভিনন্দন-পত্র রচনা-রীতির উপর ইহারই প্রভাব লক্ষিত হয়।

“আধুনিক সাহিত্যের কৈফিয়ৎ”, “সাহিত্য ও নীতি”, “সাহিত্যে আর্ট ও দুর্নীতি” এবং প্রসঙ্গ ক্রমে ৫৪তম বাৎসরিক জন্মতিথিতে, “বঙ্কিম-শরৎ সমিতির অভিনন্দনের উত্তরে, প্রেসিডেন্সি কলেজে পঠিত অভিভাষণে” ও অন্যান্য প্রবন্ধে একই বিষয়ের অবতারণা দেখা যায়। এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, কয়েক বৎসর পূর্ব্বে জনকয়েক শুচিবায়ুগ্রস্ত সমালোচকের কৃপায় আধুনিক সাহিত্যিকদের বিরুদ্ধে একটা তীব্র আন্দোলনের সৃষ্টি হয় এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিশেষভাবে শরৎ-সাহিত্যের প্রতিই সকলে “দুই হাত পুরিয়া বিদ্ধেষের অবর্জ্জনা নিক্ষেপ করিতে থাকেন।” উপরোক্ত প্রবন্ধগুলি তাহার প্রতিবাদে সে সময়েরই রচনা। সব ক’টি প্রবন্ধ ও অভিভাষণেই তিনি সাধারণতঃ তাঁহার সাহিত্য রচনার আদর্শ সম্বন্ধে আলোচনা করেন, বোধকরি এ জন্যই তাঁহাকে বিভিন্ন স্থানে বারবার একই কথার পুনরাবৃত্তি করিতে হইয়াছে। প্রবন্ধগুলি পড়িবার সময় কাল ও পরিস্থিতি বিস্মৃত হইলে চলিবে না।

“সাহিত্য আর্ট ও দুর্নীতি” প্রবন্ধটি পড়িবার পূর্ব্বে ১৩৩৪ শ্রাবণ সংখ্যা ‘বিচিত্রা’য় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের “সাহিত্য ধর্ম্ম” ও তাহার প্রতিবাদে এবং ভাদ্র সংখ্যায় শ্রীযুক্ত নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের ‘সাহিত্যে ধর্ম্মের সীমানা’ শীর্ষক প্রবন্ধ দুইটী পড়িলে ভাল হয়।

পরিশেষে আর একটি কথা না বলিয়া আমার বক্তব্য শেষ করিতে পারিতেছি না। পূর্ব্বেই বলিয়াছি আমার শক্তি অল্প, যোগ্যতা আরও অল্প। সুসাহিত্যিক শ্রীযুক্ত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য, শ্রীযুক্ত পঞ্চানন চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রসিদ্ধ কথা-সাহিত্যিক শ্রীযুক্ত ফণীন্দ্রনাথ পাল, শ্রীযুক্ত মণীন্দ্রনাথ রায়, সাহিত্য-পরিষৎ গ্রন্থালয় ও চৈতন্য লাইব্রেরীর সহায়তা না পাইলে সমস্ত প্রবন্ধগুলি সংগ্রহ ও প্রকাশ করা আমাদ্বারা কতদূর সম্ভব হইত ঠিক বলিতে পারি না। বিশেষ ভাবে বন্ধুবর শ্রীযুক্ত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য স্বেচ্ছায় এবং অক্লান্তভাবে প্রবন্ধ সংগ্রহ হইতে আরম্ভ করিয়া শেষ পর্য্যন্ত সকল কাজে আন্তরিক ভাবে সাহায্য না করিলে আমাদ্বারা এ কাজ সম্পূর্ণ অসম্ভব হইত। শরৎচন্দ্রের চল্লিশ বছর বয়সের দুষ্প্রাপ্য ছবিখানিও তাঁহার নিকট হইতে সংগ্রহ করিয়াছি। ‘বিচিত্রা’ সম্পাদক শ্রীযুক্ত উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম পৃষ্ঠার সুদৃশ্য ব্লকটি ছাপিতে দিয়া বিশেষ অনুগ্রহ করিয়াছেন। মৌখিক ধন্যবাদ দিয়া আমি ইঁহাদের দানের অমর্য্যাদা করিতে চাই না। পুস্তকখানার সহিত চিরকাল ইঁহাদের সহৃদয়তার কথা আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করিব।

নিবেদক—

শ্রীদীনেন্দ্রচন্দ্র বর্ম্মণ

৩১শে ভাদ্র, ১৩৩৯।