বার

বিপুলকায় মন্দিরের প্রাচীরতলে জমিদার জীবানন্দ চৌধুরীর পালকি দুটা নিমেষে অন্তর্হিত হইল। এই অত্যন্ত আঁধারে মাত্র ওই গোটা-কয়েক আলোর সাহায্য মানুষের চক্ষে কিছুই দেখা যায় না, কিন্তু ষোড়শীর মনে হইল লোকটিকে সে যেন দিনের মত স্পষ্ট দেখিতে পাইল। এবং শুধু কেবল তিনিই নয়, তাঁহার পিছনে ঘেরাটোপ ঢাকা যে পালকিটি গেল, তাহার অবরোধের মধ্যেও যে মানুষটি নিঃশব্দে বসিয়া আছে তাহারও শাড়ির চওড়া কালাপাড়ের একপ্রান্ত ঈষন্মুক্ত দ্বারের ফাঁক দিয়া ঝুলিয়া আছে, সেটুকুও যেন তাহার চোখে পড়িল। তাহার হাতের তীর-কাটা চুড়ির স্বর্ণাভা লণ্ঠনের আলোকে পলকের জন্য যে খেলিয়া গেল এ-বিষয়েও তার সংশয় রহিল না। তাহার দুই কানে হীরার দুল ঝলমল করিতেছে, তাহার আঙুলে আঙটির পাথরে সবুজ রঙ ঠিকরাইয়া পড়িতেছে। সহসা কল্পনা তাহার বাধা পাইয়া থামিল। তাহার স্মরণ হইল এ সমস্তই সে এইমাত্র হৈমর গায়ে দেখিয়াছে। মনে পড়িয়া একাকী অন্ধকারেও সে লজ্জায় সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল। চণ্ডী! চণ্ডী! বলিয়া সে সম্মুখের মন্দিরের উদ্দেশে চৌকাঠে মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিল, এবং সকল চিন্তা দূর করিয়া দিয়া দ্বার ছাড়িয়া ভিতরে আসিয়া দাঁড়াইতে আর দুটি নর-নারীর চিন্তায় তাহার বুক ভরিয়া উঠিল। ক্ষণেক পূর্বেও সকল কথাবার্তার মধ্যেও ঝড়বৃষ্টির আশু সম্ভাবনা তাহার মনের মধ্যে নাড়া দিয়া গেছে। উপরে কালো ছেঁড়া মেঘে আকাশ আচ্ছন্ন হইতেছে, হয়ত দুর্যোগের মাতামাতি অচিরেই আরম্ভ হইয়া যাইবে। বিগত রাত্রির অর্ধেক দুঃখ ত তাহার মাথার উপর দিয়া বহিয়া গেছে, বাকী রাতটুকুও মন্দিরের রুদ্ধ দ্বারে দাঁড়াইয়া কোনমতে কাটিয়াছে, এই প্রকার শারীরিক ক্লেশ সহ্য করা তাহার অভ্যাস নয়—দেবীর ভৈরবীকে এ-সকল ভোগ করিতেও হয় না, তবুও কাল তাহার বিশেষ দুঃখ ছিল না। যে বাড়ি, যে ঘরদ্বার স্বেচ্ছায় সে তাহার হতভাগ্য পিতাকে দান করিয়া আসিয়াছে, সে-সম্বন্ধে সারাদিন আজ কোন চিন্তাই সে করে নাই; কিন্তু এখন হঠাৎ সমস্ত মন যেন তাহার একেবারে বিকল হইয়া গেল। এই নির্জন পল্লীপ্রান্তে একাকিনী এই ভাঙ্গা স্যাঁতসেঁতে গৃহের মধ্যে কি করিয়া তাহার রাত্রি কাটিবে? নিজের আশেপাশে চাহিয়া দেখিল। স্তিমিত দীপালোকে ঘরের ও-দিকের কোণ দুইটা আবছায়া হইয়া আছে, তাহারই মাঝে মাঝে ইন্দুরের গর্তগুলা যেন কালো কালো চোখ মেলিয়া রহিয়াছে, তাহাদের বুজাইতে হইবে; মাথার উপরে চালে অসংখ্য ছিদ্র, ক্ষণেক পরে বৃষ্টি শুরু হইলে সহস্রধারে জল ঝরিবে, দাঁড়াইবার স্থানটুকু কোথাও রহিবে না, এইসব লোক ডাকাইয়া মেরামত করিতে হইবে; কবাটের অর্গল নিরতিশয় জীর্ণ, ইহার সংস্কার সর্বাগ্রে আবশ্যক, অথচ দিন থাকিতে লক্ষ্য করে নাই ভাবিয়া বুকটা ছাঁৎ করিয়া উঠিল। এই অরক্ষিত, পরিত্যক্ত পর্ণকুটীরে—কেবল আজ নয়—দিনের পর দিন বাস করিবে সে কেমন করিয়া?

তাহার মনে পড়িল, এইমাত্র বিদায়ক্ষণে নির্মলের কথার উত্তরে কিছুই বলা হয় নাই, অথচ শীঘ্র আর হয়ত দেখা হইবে না। সে ভরসা দিয়া বলিয়া গেছে নিজেকে একেবারে নিরুপায় না ভাবিতে। হয়ত সহস্র কাজের মধ্যে এ কথা তাহার মনেও থাকিবে না। থাকিলেও, পশ্চিমের কোন্‌ একটা সুদূর শহরে বসিয়া সে সাহায্য করিবেই বা কি করিয়া, এবং তাহা গ্রহণ করিবেই বা সে কোন্‌ অধিকারে? আবার হৈমকে মনে পড়িল। যাইবার সময় একটিও কথা বলে নাই, কিন্তু স্বামীর আহ্বানে যখন তাঁহার হাত ধরিয়া সে অগ্রসর হইল, তখন তাঁহার প্রত্যেক কথাটিকে সে যেন নীরবে অনুমোদন করিয়া গেল। সুতরাং স্বামী ভুলিলেও ভুলিতে পারেন, কিন্তু স্ত্রী যে তাহার অনুচ্চারিত বাক্য সহজে বিস্মৃত হইবে না, ষোড়শী তাহা মনে মনে বিশ্বাস করিল।

হৈমর সহিত পরিচয় তাহার বহুদিনব্যাপীও নয়, ঘনিষ্ঠও নয়। অথচ কোনমতে দ্বার রুদ্ধ করিয়া সে যখন তাহার কম্বলের শয্যাটি বিস্তৃত করিয়া ভূমিতলে উপবেশন করিল, তখন এই মেয়েটিকে তাহার বার বার মনে হইতে লাগিল। সেই যে সে প্রথম দিনটিতেই অযাচিত তাহার দুঃখের অংশ লইয়া গ্রামের সমস্ত বিরুদ্ধ-শক্তির বিরুদ্ধে, পিতার বিরুদ্ধে, বোধ করি বা আরও একজনের বিরুদ্ধে গোপনে যুদ্ধ করিয়াছিল, সে চলিয়া গেলে কাল তাহার পাশে দাঁড়াইতে এখানে আর কেহ থাকিবে না; প্রতিকূলতা উত্তরোত্তর বাড়িয়া উঠিতেই থাকিবে, কিন্তু আপনার বলিতে, একটা সান্ত্বনার বাক্য উচ্চারণ করিতেও লোক মিলিবে না, অথচ এই ঝঞ্ঝা যে কোথায় গিয়া কি করিয়া নিবৃত্ত হইবে তাহারও কোন নির্দেশ নাই। এমনি করিয়া এই নির্বান্ধব জনহীন আলয়ে চারিদিকের ঘনীভূত অন্ধকারে একাকিনী বসিয়া সে অদূর ভবিষ্যতের সুনিশ্চিত বিপদের ছবিটাকে তন্ন তন্ন করিয়া দেখিতেছিল, কিন্তু কখন অজ্ঞাতসারে যে এই পরিপূর্ণ উপদ্রবের আশঙ্কাকে সরাইয়া দিয়া ক্ষণকালের নিমিত্ত এক অভিনব অপরিজ্ঞাত ভাবের তরঙ্গ তাহার বিক্ষুব্ধ চিত্তের মাঝে উত্তাল হইয়া উঠিল, সে জানিতে পারিল না। এতদিন জীবনটাকে সে যেভাবে পাইয়াছে সেই ভাবেই গ্রহণ করিয়াছে। সে চণ্ডীর ভৈরবী—ইহার যে দায়িত্ব আছে, কর্তৃত্ব আছে, সম্পদ আছে, বিপদ আছে—স্মরণাতীত কাল হইতে ইহার অধিকারিণীগণের পায়ে পায়ে যে পথ পড়িয়াছে, তাহা কোথাও সঙ্কীর্ণ কোথাও প্রশস্ত, পথ চলিতে কেহ বা সোজা হাঁটিয়াছেন, কাহারও বা বাঁকা পদচিহ্ন পরম্পরাগত ইতিহাসের অঙ্কে বিদ্যমান। ইহার অলিখিত পাতাগুলা লোকের মুখে মুখে কোথাও বা সদাচারের পুণ্যকাহিনীতে উদ্ভাসিত, কোথাও বা ব্যভিচারের গ্লানিতে কালো হইয়া আছে, তথাপি ভৈরবী-জীবনের সুনির্দিষ্ট ধারা কোথাও এতটুকু বিলুপ্ত হয় নাই। যাত্রা করিয়া সহজ ও দুর্গম, দুর্জ্ঞেয় ও জটিল অনেক গলিঘুঁজি অনেককেই পার হইতে হইয়াছে, তাহার সুখ ও দুঃখভোগ কম নয়; কিন্তু কেন, কিসের জন্য, এ প্রশ্নও বোধ করি কেহ কখনো করে নাই, কিংবা ইহাকে অস্বীকার করিয়া আর কোন একটা পথ খুঁজিতেও কাহারো প্রবৃত্তি হয় নাই। ভাগ্যনির্দিষ্ট সেই পরিচিত খাদের মধ্য দিয়াই ষোড়শীর জীবনের এই কুড়িটা বছর প্রবাহিত হইয়া গেছে, ইহাকে ভৈরবীর জীবন বলিয়াই সে অসংশয়ে গ্রহণ করিয়াছে; একটা দিনের তরেও আপনার জীবন নারীর জীবন বলিয়া ভাবে নাই।

চণ্ডীর সেবায়েত বলিয়া সে নিকটে ও দূরের বহু গ্রাম ও জনপদের গণনাতীত নরনারীর সহিত সুপরিচিত। কত সংখ্যাতীত রমণী—কেহ ছোট, কেহ বড়, কেহ বা সমবয়সী—তাহাদের কত প্রকারের সুখ-দুঃখ, কত প্রকারের আশা-ভরসা, কত ব্যর্থতা, কত অপরূপ আকাশকুসুমের নির্বাক ও নির্বিকার সাক্ষী হইয়া আছে; দেবীর অনুগ্রহলাভের জন্য কতকাল ধরিয়া কত কথাই না ইহারা গোপনে মৃদুকণ্ঠে তাহাকে ব্যক্ত করিয়াছে, দুঃখী জীবনের নিভৃততম অধ্যায়গুলি অকপটে তাহার চোখের উপর মেলিয়া ধরিয়া প্রসাদ ভিক্ষা চাহিয়াছে; এ-সমস্তই তাহার চোখে পড়িয়াছে, পড়ে নাই কেবল রমণীহৃদয়ের কোন্‌ অন্তস্তল ভেদিয়া এই-সকল সকরুণ অভাব ও অনুযোগের স্বর উত্থিত হইয়া এতকাল ধরিয়া তাহার কানে আসিয়া পশিয়াছে। ইহাদের গঠন ও প্রবৃত্তি এমনি কোন্‌ এক বিভিন্ন জগতের বস্তু, যাহাকে জানিবার ও চিনিবার কোন হেতু, কোন প্রয়োজন তাহার হয় নাই, সেই প্রয়োজনের প্রথম আঘাত এইখানে এই পরিত্যক্ত অন্ধকার আলয়ে এই প্রথম তাহার গায়ে লাগিল।

কাল দুর্যোগের রাত্রে নির্মলের হাত ধরিয়া নদী পার করিয়া আনিয়া সে তাঁহাকে গৃহে পৌঁছাইয়া দিয়াছিল; হয়ত দুটি লোক ছাড়া এ কথা আর কেহ জানে না, এবং এখন এইমাত্র সেই স্বল্পদৃষ্টি লোকটির আহ্বানে হৈম যে তাঁহার হাত ধরিয়া নিঃশব্দে অগ্রসর হইল, এ কথাও বোধ করি কয়েকটি লোক ছাড়া আর কেহ জানিবে না, কিন্তু কাল এবং আজিকার এই একই কর্তব্যের কত বড়ই না পার্থক্য!

আর একবার তাহার চোখের উপর হৈমর কাপড়ের পাড়টুকু হইতে, তাহার আঙুলের সবুজ রঙের আঙটি হইতে তাহার কানের হীরের দুল পর্যন্ত সমস্ত খেলিয়া গেল, এবং সর্বপ্রকার দুর্ভেদ্য আবরণ ও অন্ধকার অতিক্রম করিয়া তাহার অভ্রান্ত অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি, দৃষ্টির বাহিরে ওই মেয়েটির প্রত্যেক পদক্ষেপ যেন অনুসরণ করিয়া চলিল। সে দেখিতে পাইল, স্বামীর হাত ছাড়িয়া এইবার তাহাকে লুকাইয়া বাড়ি ঢুকিতে হইবে, সেখানে তাহার চিন্তিত ও ব্যাকুল পিতামাতার শত-সহস্র তিরস্কার ও কৈফিয়ত নিরুত্তরে মাথায় করিয়া লজ্জিত দ্রুতপদে নিজের ঘরে গিয়া আশ্রয় লইতে হইবে, সেখানে হয়ত তাহার নিদ্রিত পুত্র ঘুম ভাঙ্গিয়া বিছানায় উঠিয়া বসিয়া কাঁদিতেছে—তাহাকে শান্ত করিয়া আবার ঘুম পাড়াইতে হইবে; কিন্তু ইহাতেই কি অবসর মিলিবে? তখনও কত কাজ বাকী থাকিয়া যাইবে। অন্তরাল হইতে স্বামীর খাওয়াটুকু পর্যবেক্ষণ করা চাই—ত্রুটি না হয়; ছেলেকে তুলিয়া দুধ খাওয়াইতে হইবে—সে অভুক্ত না থাকে; পরে নিজেও খাইয়া লইয়া যেমন-তেমন করিয়া বাকী রাতটুকু কাটাইয়া আবার প্রত্যূষে উঠিয়া যাত্রার জন্য প্রস্তুত হওয়া চাই। তাহার কত রকমের প্রয়োজন, কত রকমের গুছান-গাছান। তাহার স্বামী, তাহার পুত্র, তাহার লোকজন—দাসী-চাকর তাহাকে আশ্রয় করিয়াই যাত্রা করিবে। দীর্ঘ পথে কাহার কি চাই—তাহাকেই যোগাইতে হইবে, তাহাকে সমস্ত ভাবিয়া সঙ্গে লইতে হইবে।

নিজের জীবনটাকে ষোড়শী কোনদিন পরের সঙ্গে তুলনা করিয়া দেখে নাই, আলোচনা করিবার কথাও কখনো মনে হয় নাই, তবুও সে মনের মাঝখানে গৃহিণীপনার সকল দায়িত্ব, সকল ভার, জননীর সকল কর্তব্য, সকল চিন্তাকে কে যেন কবে সুনিপুণ হাতে সম্পূর্ণ করিয়া সাজাইয়া দিয়া গেছে। তাই কিছু না জানিয়াও সে সব জানে, কখনও কিছু না শিখিয়াও হৈমর সকল কাজ তাহারি মত নিখুঁত করিয়া করিতে পারে এই কথাই তাহার মনে হইল।

অনতিদূরে একখণ্ড কাঠের উপর সংস্থাপিত মাটির প্রদীপটা নিব-নিব হইয়া আসিতেছিল, অন্যমনে ইহাকে উজ্জ্বল করিয়া দিতেই তাহার চমক ভাঙ্গিয়া মনে পড়িল সে চণ্ডীগড়ের ভৈরবী। এতবড় সম্মানিত গরীয়সী নারী এ প্রদেশে আর কেহ নাই। সে সামান্য একজন রমণীর অত্যন্ত সাধারণ গৃহস্থালীর অতি তুচ্ছ আলোচনায় মুহূর্তের জন্যও আপনাকে বিহ্বল করিয়াছে মনে করিয়া লজ্জায় মরিয়া গেল। ঘরে আর কেহ নাই, ক্ষণকালের এতটুকু দুর্বলতা জগতে কেহ কখনো জানিবেও না, শুধু কেবল যে দেবীর সেবিকা সে, সেই চণ্ডীর উদ্দেশ্যে আর একবার যুক্তকরে নতশিরে কহিল, মা, বৃথা চিন্তায় সময় বয়ে গেল, তুমি ক্ষমা করো।

রাত্রি কত হইয়াছে ঠিক জানিবার জো নাই, কিন্তু অনুমান করিল অনেক হইয়াছে। তাই শয্যাটুকু আরও একটু বিস্তৃত করিয়া এবং প্রদীপে আরও খানিকটা তেল ঢালিয়া দিয়া সে শুইয়া পড়িল। শ্রান্তচক্ষে ঘুম আসিতেও বোধ করি বিলম্ব ঘটিত না; কিন্তু বাহিরে দ্বারের কাছেই একটা শব্দ শুনিয়া চমকিয়া উঠিয়া বসিল। বাতাসেও একটু জোর ধরিয়াছিল, শিয়াল-কুকুর হওয়াও অসম্ভব নয়, তবুও ক্ষণকাল কান পাতিয়া থাকিয়া সভয়ে কহিল, কে?

বাহির হইতে সাড়া আসিল, ভয় নেই, মা, তুমি ঘুমোও – আমি সাগর।

কিন্তু এত রাত্তিরে তুই কেন রে?

সাগর কহিল, হরখুড়ো বলে দিলে, জমিদার এয়েচে, রাতটাও বড় ভাল নয়——মা একলা রয়েচে, যা সাগর, লাঠিটা হাতে নিয়ে একবার বস্‌ গে। তুমি শুয়ে পড় মা, ভোর না দেখে আমি নড়ব না।

ষোড়শী বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, তাই যদি হয় সাগর, একা তুই কি করবি, বাবা?

বাহিরের লোকটি একটু হাসিয়া কহিল, একা কেন, মা, খুড়োকে একটা হাঁক দেব। খুড়ো-ভাইপোয় লাঠি ধরলে জান ত, মা, সব। সেদিনকার লজ্জাতেই মরে আছি, একটিবার যদি হুকুম দিয়ে পাঠাতে মা।

এই দুইটি খুড়া ও ভাইপো—হরিহর ও সাগর ডাকাতি অপবাদে একবার বছর-দুই করিয়া জেল খাটিয়াছিল। জেলের মধ্যে বরঞ্চ ছিল ভাল, কিন্তু অব্যাহতি পাইয়া ইহাদের প্রতি বহুকাল যাবৎ একদিকে জমিদার ও অন্যদিকে পুলিশ কর্মচারীর দৌরাত্ম্যের অবধি ছিল না। কোথাও কিছু একটা ঘটিলে দুইদিকের টানাটানিতে ইহাদের প্রাণান্ত হইত। স্ত্রীপুত্র লইয়া না পাইত ইহারা নির্বিঘ্নে বাস করিতে, না পাইত দেশ ছাড়িয়া কোথাও উঠিয়া যাইতে।

এই অযথা পীড়ন ও অহেতুক যন্ত্রণা হইতে ষোড়শী ইহাদের যৎকিঞ্চিৎ উদ্ধার করিয়াছিল। বীজগাঁর জমিদারি হইতে বাস উঠাইয়া আনিয়া নিজের মধ্যে স্থান দিয়া এবং নানা উপায়ে পুলিশকে প্রসন্ন করিয়া জীবনযাত্রার ব্যাপারটা ইহাদের অনেকখানি সুসহ করিয়া দিয়াছিল। সেই অবধি দস্যু অপবাদগ্রস্ত এই দুইটি পরম ভক্ত ষোড়শীর সকল সম্পদে বিপদে একান্ত সহায়। শুধু কেবল নীচ জাতীয় ও অস্পৃশ্য বলিয়াই সঙ্কোচে তাহারা দূরে দূরে থাকিত, এবং ষোড়শী নিজেও কখনো কোনদিন তাহাদের কাছে ডাকিয়া ঘনিষ্ঠতা করিবার চেষ্টা করে নাই। অনুগ্রহ কেবল দিয়াই আসিয়াছে, ফিরিয়া কখনো গ্রহণ করে নাই, বোধ করি প্রয়োজনও হয় নাই। আজ এই নির্জন নিশীথে সংশয় ও সঙ্কটের মাঝে তাহাদের আড়ম্বরহীন এই স্নেহ ও নিঃশব্দ সেবার চেষ্টায় ষোড়শীর দুই চক্ষু জলে ভরিয়া গেল। মুছিয়া ফেলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা সাগর, তোদের জাতের মধ্যেও বোধ হয় আমার সম্বন্ধে কথাবার্তা হয়, না রে? কে কি বলে?

বাহির হইতে সাগর আস্ফালন করিয়া জবাব দিল, ইস্‌! আমাদের সামনে! দুই তাড়ায় কে কোথায় পালাবে ঠিক পায় না মা!

ষোড়শী তৎক্ষণাৎ সলজ্জে অনুভব করিল, ইহার কাছে এরূপ প্রশ্ন করাই তাহার উচিত হয় নাই। অতএব কথাটাকে আর না বাড়াইয়া মৌন হইয়া রহিল। অথচ চোখেও তাহার ঘুম ছিল না। বাহিরে আসন্ন ঝড়বৃষ্টি মাথায় করিয়া তাহারি খবরদারিতে একজন জাগিয়া বসিয়া আছে জানিলেই যে নিদ্রার সুবিধা হয় তাহা নয়, তাই কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া আবার সে এই কথাই পাড়িল, কহিল, যদি জল আসে তোর যে ভারী কষ্ট হবে সাগর, এখানে ত কোথাও দাঁড়াবার জায়গা নেই।

সাগর কহিল, নাই থাকল মা। রাত বেশী নেই, প্রহর-দুই জলে ভিজলে আমাদের অসুখ করে না।

বাস্তবিক ইহার কোন প্রতিকারও ছিল না, তাই আবার কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া ষোড়শী অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপিত করিল। কহিল, আচ্ছা, তোরা কি সব সত্যিই মনে করেচিস জমিদারের পিয়াদারা আমাকে সেদিন বাড়ি থেকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল?

সাগর অনুতপ্ত স্বরে কহিল, কি করবে মা, তুমি যে একলা মেয়েমানুষ! এ পাড়ায় মানুষ বলতেও কেউ নেই, আমরা খুড়ো-ভাইপোও সেদিন হাটে গিয়ে তখনও ফিরতে পারিনি। নইলে সাধ্য কি মা, তোমার গায়ে কেউ হাত দেয়!

ষোড়শী মনে মনে বুঝিল এ আলোচনাও ঠিক হইতেছে না, কথায় কথায় হয়ত কি একটা শুনিতে হইবে; কিন্তু থামিতেও পারিল না, কহিল, তাদের কত লোকজন, তোরা দুটিতে থাকলেই কি আটকাতে পারতিস?

বাহির হইতে সাগর মুখে অস্ফুট ধ্বনি করিয়া বলিল, কি হবে, মা, আর মনের দুঃখ বাড়িয়ে! হুজুরও এয়েছেন, আমরাও জানি সব। মায়ের কৃপায় আবার যদি কখনো দিন আসে, তখন তার জবাব দেব। তুমি মনে করো না, মা, হরখুড়ো বুড়ো হয়েছে বলে মরে গেছে। তাকে জানতো মাতু ভৈরবী, তাকে জানে শিরোমণিঠাকুর।

জমিদারের পাইক-পিয়াদা বহুৎ আছে তাও জানি, গরীব বলে আমাদের দুঃখও তারা কম দেয়নি, সেও মনে আছে—ছোটলোক আমরা নিজেদের জন্যে ভাবিনে, কিন্তু তোমার হুকুম হলে মা ভৈরবীর গায়ে হাত দেবার শোধ দিতে পারি। গলায় দড়ি বেঁধে টেনে এনে ওই হুজুরকেই রাতারাতি মায়ের স্থানে বলি দিতে পারি মা, কোন শালা আটকাবে না!

ষোড়শী মনে মনে শিহরিয়া কহিল, বলিস কি সাগর, তোরা এমন নিষ্ঠুর, এমন ভয়ঙ্কর হতে পারিস? এইটুকুর জন্যে একটা মানুষ খুন করবার ইচ্ছে হয় তোদের!

সাগর কহিল, এইটুকু! কেবল এইটুকুর জন্যেই কি আজ তোমার এই দশা! জমিদার এসেছে শুনে খুড়ো যেন জ্বলতে লাগল। তুমি ভেবো না মা, আবার যদি কিছু একটা হয়, তখন সেও কেবল এইটুকুতেই থেমে থাকবে!

ষোড়শী কহিল, হাঁরে সাগর, তুই কখনো গুরুমশায়ের পাঠশালে পড়েছিলি?

বাহিরে বসিয়া সাগর যেন লজ্জিত হইয়া উঠিল, বলিল, তোমার আশীর্বাদে অমনি একটু রামায়ণ-মহাভারত নাড়তে চাড়তে পারি। কিন্তু এ কথা কেন জিজ্ঞেসা করলে মা?

ষোড়শী বলিল, তোর কথা শুনলে মনে হয় খুড়ো তোর না বুঝতেও পারে, কিন্তু তুই বুঝতে পারবি। সেদিন আমাকে কেউ ধরে নিয়ে যায়নি সাগর, কেউ আমার গায়ে হাত দেয়নি, আমি কেবল রাগের মাথায় আপনি চলে গিয়েছিলাম।

সাগর কহিল, সে আমরাও শুনেচি, কিন্তু সারারাত যে ঘরে ফিরতে পারলে না, মা, সেও কি রাগ করে?

ষোড়শী এ প্রশ্নের ঠিক উত্তরটা এড়াইয়া গিয়া কহিল, কিন্তু যে জন্যে তোদের এত রাগ, সে দশা আমার ত আমি নিজেই করেচি। আমি ত নিজের ইচ্ছাতেই বাবাকে ছেড়ে দিয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েচি।

সাগর কহিল, কিন্তু এতকাল ত এ আশ্রয় নেবার ইচ্ছে হয়নি মা। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া অকস্মাৎ তাহার কণ্ঠস্বর যেন উগ্র ও উত্তপ্ত হইয়া উঠিল, কহিল, তারাদাস ঠাকুরের ওপরও আমাদের রাগ নেই, রায়মশায়কেও আমরা কেউ কিছু বলব না, কিন্তু জমিদারকে আমরা সুবিধে পেলে সহজে ছাড়ব না। জান মা, আমাদের বিপিনের সে কি করেচে? সে বাড়ি ছিল না—তার লোকজন তার ঘরে ঢুকে—

ষোড়শী তাড়াতাড়ি তাহাকে থামাইয়া দিয়া কহিল, থাক সাগর, ও-সব খবর আর তোরা আমাকে শোনাস নে।

সাগর চুপ করিল, ষোড়শী নিজেও বহুক্ষণ পর্যন্ত আর কোন প্রশ্ন করিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সাগর পুনরায় যখন কথা কহিল, তাহার কণ্ঠস্বরে গূঢ় বিস্ময়ের আভাস ষোড়শী স্পষ্ট অনুভব করিল। সাগর কহিল, মা, আমরা তোমার প্রজা, আমাদের দুঃখ তুমি না শুনলে শুনবে কে?

ষোড়শী কহিল, কিন্তু শুনেও ত অতবড় জমিদারের বিরুদ্ধে আমি প্রতিকার করতে পারব না বাছা।

সাগর কহিল, একবার ত করেছিলে। আবার যদি দরকার হয় তুমিই পারবে। তুমি না পারলে আমাদের রক্ষা করতে কেউ নেই মা।

ষোড়শী বলিল, নতুন ভৈরবী যদি কেউ হয় তাকেই তোদের দুঃখ জানাস।

সাগর চমকিয়া কহিল, তাহলে তুমি কি আমাদের সত্যিই ছেড়ে যাবে মা? গ্রামসুদ্ধ সবাই যে বলাবলি করচে—সে সহসা থামিল, কিন্তু ষোড়শী নিজেও এ প্রশ্নের হঠাৎ উত্তর দিতে পারিল না। কয়েক মুহূর্ত নীরবে থাকিয়া ধীরে ধীরে কহিল, দেখ্‌ সাগর, তোদের কাছে এ কথা তুলতে আমার লজ্জায় মাথা কাটা যায়। কিন্তু আমার সম্বন্ধে সব ত শুনেচিস? গ্রামের আরও দশজনের মত তোরা নিজেও দেখচি বিশ্বাস করেচিস, তার পরেও কি তোরা আমাকেই মায়ের ভৈরবী করে রাখতে চাস রে?

বাহিরে বসিয়া সাগর আস্তে আস্তে উত্তর দিল, অনেক কথাই শুনি মা, এবং আরও দশজনের মত আমরাও ভেবে পাইনে কেনই বা তুমি সে-রাত্রে ঘরে ফিরলে না, আর কেনই বা সকালবেলা সাহেবের হাত থেকে হুজুরকে বাঁচালে। কিন্তু সে যাই হোক মা, আমরা ক’ঘর ছোটজাত ভূমিজ তোমাকেই মা বলে জেনেচি; যেখানেই যাও আমরাও সঙ্গে যাব। কিন্তু যাবার আগে একবার জানিয়ে দিয়ে যাব।

ষোড়শী কহিল, কিন্তু তোরা ত আমার প্রজা নয়, মা-চণ্ডীর প্রজা। আমার মত মায়ের দাসী কত হয়ে গেছে, কত হবে। তার জন্যে তোরা কেনই বা ঘরদোর ছেড়ে যাবি, কেনই বা উপদ্রব অশান্তি ঘটাবি। এমন ত হতে পারে, আমার নিজেরই আর এ-সমস্ত ভাল লাগচে না।

সাগর সবিস্ময়ে কহিল, ভাল লাগচে না?

ষোড়শী বলিল, আশ্চর্য কি সাগর? মানুষের মন কি বদলায় না?

এবার প্রত্যুত্তরে লোকটি কেবল একটা হুঁ বলিয়াই খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, কিন্তু রাত আর বেশী বাকী নেই মা, আকাশে মেঘও কেটে যাচ্ছে, এইবার তুমি একটু ঘুমোও।

ষোড়শীর নিজেরও এ-সকল আলোচনা ভাল লাগিতেছিল না, তাহাতে সে অত্যন্ত শ্রান্ত হইয়াছিল। সাগরের কথায় আর দ্বিরুক্তিমাত্র না করিয়া চোখ বুজিয়া শুইয়া পড়িল। কিন্তু সে-চক্ষে ঘুম যতক্ষণ না আসিল, কেবল ঘুরিয়া ফিরিয়া উহারই কথাগুলো তাহার মনে হইতে লাগিল, এই যে লোকটি বিনিদ্রচক্ষে বাহিরে বসিয়া রহিল, তাহাকে সে ছেলেবেলা হইতেই দেখিয়া আসিয়াছে; ইতর ও অন্ত্যজ বলিয়া এতদিন শুধু তুচ্ছ ও ছোট কাজেই লাগিয়াছে, কোনদিন কোন সম্মানের স্থান পায় নাই, আলাপ করিবার কল্পনা ত কাহারও স্বপ্নেও উঠে নাই, কিন্তু আজ এই দুঃখের রাত্রে জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে মুখ দিয়া তাহার অনেক কথাই বাহির হইয়া গেছে, এবং তাহার ভালমন্দ হিসাব করিবার দিন হয়ত একদিন আসিতেও পারে; কিন্তু শ্রোতা হিসাবে এই ছোটলোকটিকে সে একান্ত ছোট বলিয়া আজ কিছুতেই ভাবিতে পারিল না।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গিলে দ্বার খুলিয়া বাহির হইয়া দেখিল সকাল আর নাই—ঢের বেলা হইয়াছে; এবং অনতিদূরে অনেকগুলা লোক মিলিয়া তাহারই রুদ্ধ দরজার প্রতি চাহিয়া কি যেন একটা তামাশার প্রতীক্ষা করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। কোথাও এতটুকু পর্দা, এতটুকু আব্রু নাই। সহসা মনে হইল, তৎক্ষণাৎ দ্বার বন্ধ না করিয়া দিলে এই লোকগুলার উৎসুকদৃষ্টি হইতে বুঝি সে বাঁচিবে না। এই ক্ষুদ্র গৃহটুকু যত জীর্ণ যত ভগ্নই হোক, আত্মরক্ষা করিবার এ-ছাড়া আর বুঝি সংসারে দ্বিতীয় স্থান নাই, এবং ঠিক সেই মুহূর্তেই দেখিতে পাইল ভিড় ঠেলিয়া এককড়ি নন্দী তাহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।সবিনয়ে কহিল, গ্রামে হুজুর পদার্পণ করেছেন, শুনেচেন বোধ হয়।

জমিদারের গোমস্তা এই এককড়ি ইতিপূর্বে কোনদিন তাহাকে আপনি বলিয়া সম্বোধন করে নাই। তাহার বিনয়, তাহার এই সম্ভাষণের পরিবর্তন ষোড়শীকে যেন বিদ্ধ করিল, কিন্তু কিছু একটা জবাব দিবার পূর্বেই সে পুনশ্চ সসম্ভ্রমে কহিল, হুজুর একবার আপনাকে স্মরণ করেচেন।

কোথায়?

এই যে কাছারিবাড়িতে। সকাল থেকে এসেই প্রজার নালিশ শুনচেন। যদি অনুমতি করেন ত পালকি আনতে পাঠিয়ে দিই?

সকলে হাঁ করিয়া শুনিতেছিল; ষোড়শীর মনে হইল তাহারা যেন এই কথায় হাসি চাপিবার চেষ্টা করিতেছে।তাহার ভিতরটা অগ্নিকাণ্ডের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিল, কিন্তু মুহূর্তে আত্মসংবরণ করিয়া কহিল, এটা তাঁর প্রস্তাব, না, তোমার সুবিবেচনা এককড়ি?

এককড়ি সসম্ভ্রমে বলিল, আজ্ঞে, আমি ত চাকর, এ স্বয়ং হুজুরের আদেশ।

ষোড়শী হাসিয়া কহিল, তোমার হুজুরের কপাল ভাল।জেলের ঘানি টানার বদলে পালকি চড়ে বেড়াচ্চেন, তাও আবার শুধু স্বয়ং নয়, পরের জন্যও ব্যবস্থা করচেন।কিন্তু বল গে এককড়ি, আমার পালকি চড়ার ফুরসত নেই—আমার ঢের কাজ।

এককড়ি কহিল, ও-বেলায় কিংবা কাল সকালেও কি একটু সময় পাবেন না?

ষোড়শী কহিল, না।

এককড়ি কহিল, কিন্তু হলে যে ভালো হতো। আর দশজন প্রজার যে নালিশ আছে।

ষোড়শী কঠোরস্বরে উত্তর দিল, বিচার করবার মত বিদ্যেবুদ্ধি থাকে ত তাঁর নিজের প্রজার করুন গে। কিন্তু আমি তোমার হুজুরের প্রজা নই, আমার বিচার করবার জন্যে রাজার আদালত আছে। এই বলিয়া সে গামছাটা কাঁধের উপর ফেলিয়া পুষ্করিণীর উদ্দেশে দ্রুতপদে প্রস্থান করিল।