দেনা পাওনা

‘দেনা-পাওনা’ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় মাসিক ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার ১৩২৭ বঙ্গাব্দের আষাঢ় থেকে আশ্বিন, পৌষ ও চৈত্র, ১৩২৮ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ, শ্রাবণ, কার্তিক ও চৈত্র, ১৩২৯ বঙ্গাব্দের বৈশাখ, আষাঢ় ও শ্রাবণ সংখ্যায়। ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে (১৪ই আগস্ট, ১৯২৩) প্রথম পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। ‘ষোড়শী’ নামে এই উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী।

এই নাটক নিয়ে আরেকটি ঘটনাও ঘটে, যা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখক জীবনের একটি কলঙ্ক হিসেবেই সাহিত্যের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থেকে যাবে। যার কারণে, শিবরাম চক্রবর্তী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ক্ষমা করতে পারেননি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। অথচ একসময় এই শরৎচন্দ্রকেই ঈশ্বরের মতো শ্রদ্ধা করতেন শিবরাম। নিজের একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপিও নিয়ে গেছিলেন শরৎবাবুর কাছে। ‘যদি দুটো লাইন লিখে দেন ভূমিকায় তাহলে একটা প্রকাশক জোটে’ এই আশায়। লিখেও দিয়েছিলেন কথাশিল্পী। সেই সম্পর্কই এক ঘটনায় চুরমার হয়ে গেল।

পূর্বেই বলেছি ‘দেনাপাওনা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী। নাম হয়েছিল ‘ষোড়শী’। সকলেই জানে সে কথা। স্বয়ং লেখকও জানেন। অথচ সেই নাটক যখন ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশ পেল সেখানে নাট্যকারের নাম বদলে শরৎচন্দ্রের নাম! শিবরামের বদলে শরৎবাবুর নাম দিলে পত্রিকা বিক্রি হবে বেশি।

সম্পাদকের যুক্তিতে চুপ থাকলেন শিবরাম। নাটক নিয়ে গেলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ীর কাছে। নাটক পড়ে উচ্ছ্বসিত নাট্যাচার্য। ‘‘অসাধারণ নাট্যরূপ দিয়েছেন! আমি করব।’’ শুরু হল শো। প্রায় প্রতিদিনই হাউসফুল। এদিকে তখন দেনার দায়ে জর্জরিত খোদ নাট্যকার শিবরাম। নাট্যাচার্যকে বললেন, ‘‘শিশিরবাবু, কিছু টাকা পেলে ভাল হয়। নাটকে আমার লভ্যাংশ থেকে যদি কিছু দিতেন।’’ নাটকের বেনিফিট শোয়ের দিন শিবরামকে আসতে বললেন শিশির কুমার। যথা সময়ে গেলেনও তিনি।

শো শেষে সাজঘরে গিয়ে হাত পাততেই শিশিরকুমার বললেন, ‘‘দেরি করে ফেললেন। আজ টিকিট বিক্রির সব টাকা একটি থলেতে ভরা ছিল, শো শেষ হতেই শরৎবাবু সাজঘরে এসে সব টাকা নিয়ে চলে গেলেন।’’

‘‘সে কী! আপনি বললেন না আমার কথা!’’ হতবাক শিবরাম।

“বলেছিলাম। শরৎবাবু উত্তরে আমায় বললেন, ‘শিবরাম টাকা দিয়ে কী করবে? বিয়ে-থা করেনি, কিচ্ছু না। ছেলেপুলে নেই, ঘর-সংসার নেই, টাকার তার কীসের দরকার?’ আমি বললাম তবু কিছু দিন অনুগ্রহ করে…। খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে ও। আজ আসবে ও কিছু টাকার আশায়।’ শুনে বললেন, ‘না না। এই বেনিফিট নাইটের বখরা ওকে দিতে যাব কেন? এ রাত্তিরে টিকিট বিক্রি হয়েছে আমার নামে। এর মধ্যে শিবরাম আসছে কোথা থেকে!’ বলে টাকার থলে নিয়ে একটু বেশিই তাড়াতাড়ি চলে গেলেন শরৎবাবু। হয়ত আপনার মুখোমুখি যাতে না হতে হয় সেই জন্যই।’’

শিশিরকুমারের কাছে এই কথা শুনে চুপ শিবরাম। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না! মাথা নিচু করে ফিরে আসছেন, পিছন থেকে ডাক দিলেন শিশিরকুমার, ‘‘দাঁড়ান একটু।’’ বলে একজনকে বললেন, ‘‘আমার চেকবইটা নিয়ে আয় তো।’’

চেকবই এল। ‘‘আমার অ্যাকাউন্টে কত আছে জানিস?’’

‘‘একশো কুড়ি টাকা।’’

‘‘শিবরামবাবু, আপনার নামের বানান বলুন।’’

‘‘আমার তো কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই নেই।’’

“বেশ তাহলে এই একশো কুড়ি টাকারই একটা সেলফ চেক কেটে দিলাম। আমার আর কিছু নেই, বিশ্বাস করুন, থাকলে সেটুকুও দিতাম। কিছু মনে করবেন না।’’

সেই চেক হাতে নিয়ে ক্ষতবিক্ষত মনে ফিরে এসেছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী। কথাশিল্পীর প্রতি জমে ওঠা এত দিনের শ্রদ্ধা যেন চোখের সামনে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল। যে শিবরাম কখনও কারও নিন্দা করেননি, সেই তিনিও ‘দরদি’ কথাশিল্পীর এমন আঘাত ভুলতে পারেননি জীবেনর শেষ দিন পর্যন্ত।

এবার আসি ‘দেনা পাওনা’র কাহিনীতে।

লোকে বলে চণ্ডীগ্রাম দেবোত্তর সম্পত্তি। কিন্তু ক্রমে সে সম্পত্তির দখল চলে গেছে রক্ষক ও ভক্ষকদের কবলে। জমিদার কালিকামোহন বাবুর মৃত্যুর পর চণ্ডীগ্রামের জমিদার হন জীবনানন্দ চৌধুরী। এই মদ্যোপায়ী, নিষ্ঠুর জমিদারের অত্যাচার থেকে বাঁচার কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না গ্রামের লোকজন। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহসও তাদের নেই। কারণ জীবনানন্দের এক হুকুমে তার লোকজন মানুষ হত্যাও করতে পারে আর মেয়েমানুষ তার ও তার লোকজনের কাছে তামাশার জিনিস মাত্র।

তারাদাস চক্রবর্তী জমিদারের খাজনার টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় জমিদারের কয়েকজন পেয়াদা এসে তার মেয়েকে গালমন্দ করতে থাকে। এসব শুনে তারাদাসের মেয়ে ষোড়শী নিজেই ছুটে যায় এই অত্যাচারী জমিদাদের মুখোমুখি হতে। আর সেখানেই বাধে বিপদ।

ষোড়শী একজন ভৈরবী, চণ্ডী দেবীর সেবিকা। বয়স তেইশ-চব্বিশ। গ্রামের লোকেরা তাকে সম্মানের চোখে দেখে। অথচ, সেই ভৈরবীকে মাতাল জমিদার তাচ্ছিল্য করে আর সারা রাত এক কক্ষে আবব্ধ করে রাখে। পরদিন সকালে তারাদাস গ্রামের লোকজন আর পুলিশ নিয়ে আসে জমিদারকে ধরিয়ে দিতে, এই বলে যে সে তার লোকজন দিয়ে জোর করে ষোড়শীকে তুলে এনেছে। আর এই ছিল নিষ্ঠুর জমিদারকে গ্রাম থেকে বিদায় করার এক সুযোগ, যা ষোড়শী নিজেও জানত। পুলিশ ষোড়শীর কাছে ঘটনা জানতে চাইলে সে জানায়, জমিদারের লোকজন তাকে ধরে আনেনি, সে স্বেচ্ছায় এসেছে। তারাদাস ক্ষেপে গিয়ে মেয়ের বিরুদ্ধে চলে যায়। পুরো গ্রাম জুড়ে বদনাম রটে ষোড়শী ভৈরবীর। গ্রামের লোকেরা আর তাকে এই গ্রামে থাকতে দিবে না।

কিন্তু এমন কাজ কেন করল ষোড়শী? কেন সে নিষ্ঠুর জমিদারকে বাঁচাল? কী হয়েছিল লোকজন আসার পূর্বে যাতে ষোড়শী এই সিদ্ধান্ত নেয়? এই সকল প্রশ্নের জবাব নিয়েই রচিত হয়েছে দরদী কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘দেনা পাওনা’।

জমিদার জীবনানন্দ চৌধুরীর বিবাহিতা পরিত্যক্তা স্ত্রী, চণ্ডীগড়ের ভৈরবী ষোড়শী। ষোড়শীকে যখন চণ্ডীগ্রামের লোকেরা পরিত্যাগ করে, তখনও সে স্বামীর অনিষ্ট কামনা করেনি। তার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে, ঘৃণিত চরিত্রের অধিকারী, অত্যাচারী, লম্পট, পাপপুণ্য জ্ঞানহীন জীবানন্দের আমূল পরিবর্তনের ঘটনা এই উপন্যাসের মূল বিষয়। ষোড়শীর নারী প্রবৃত্তির সঙ্গে সমাজ ও প্রচলিত সংস্কারের দ্বন্দ্বের অত্যন্ত চমৎকার বর্ণনা এখানে তুলে এনেছেন শরৎচন্দ্র। আবার দেহধর্মগত নীতিবোধকে প্রাধান্য দান করে সতীত্বকে যাচাই করা চলে না— ‘প্রেম সতীত্ব অপেক্ষা মহত্তর’ ঔপন্যাসিকের এই জীবনোপলব্ধির পরিচয়ও দেনা-পাওনা’ উপন্যাসে উজ্জ্বলরূপে প্রস্ফুটিত।

এই উপন্যাস অবলম্বনে ‘প্রেমাঙ্কুর আতর্থী’ ১৯৩১ সালে ‘দেনা-পাওনা’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। নিউ থিয়েটার্স প্রযোজিত এই চলচ্চিত্রটি হিন্দি চলচ্চিত্র ‘আলম আরা’র পাশাপাশি ভারতবর্ষের প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র। পরবর্তীতে ‘দেনা-পাওনা’ চলচ্চিত্রটি হিন্দিতে ‘পূজারিন্’ নামে পুনর্নির্মিত হয়েছিল।