পঁচিশ

গরুর গাড়ির নীচে চাদর মুড়ি দিয়া গাড়োয়ান শুইয়াছিল, সে ষোড়শীর পায়ের শব্দ অনুভবে বুঝিয়া কহিল, মা, শৈবাল-দীঘি ত দশ-বারো ক্রোশের পথ, একটু রাত থাকতে বার না হলে পৌঁছতে কাল প্রহর বেলা উৎরে যাবে।

ষোড়শী বলিল, আচ্ছা, তাই হবে। কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া আসিয়া কহিল, কোথায় যাচ্চি বোধ করি শুনতে পেলেন?

জীবানন্দ কহিল, পেলাম বৈ কি।

ষোড়শী কহিল, বেশী দূরে নয়। আপনার আক্রোশ এ পথটুকু অনায়াসে খুঁজে বার করতে পারবে।

কিন্তু তোমার ওপর আক্রোশ ত আমার নেই।

ঘর খুলিয়া ষোড়শী প্রবেশ করিল, কহিল, আমার একটিমাত্র কম্বল গাড়িতে পাতা। আপনাকে বসতে দিই এমন কিছু নেই। নির্মলবাবু হলে আঁচল বিছিয়ে দিতাম, কিন্তু আপনাকে ত তা মানাবে না। এই বলিয়া সে মুচকিয়া একটু হাসিয়া ঘরের কোণ হইতে একখানি কুশাসন গ্রহণ করিয়া মেঝের উপর পাতিয়া দিয়া বলিল, যদি অপরাধ না নেন ত—

জীবানন্দ নিঃশব্দে উপবেশন করিয়া নীরব হইয়াই রহিল।

এতবড় শ্লেষের উত্তর না পাইয়া ষোড়শী মনে মনে বিস্মিত হইল। প্রদীপের আলো অতিশয় ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছিল, ষোড়শী উজ্জ্বল করিয়া দিয়া সেটা হাতে করিয়া জীবানন্দের মুখের কাছে আনিয়া মুহূর্তকাল স্থিরভাবে থাকিয়া কহিল, কি ভাবচেন বলুন ত?

আমার ভাবনার কি অন্ত আছে?

অন্ত না থাকে আদি ত আছে, তাই বলুন।

জীবানন্দ মাথা নাড়িয়া কহিল, না, তাও নেই। যার অন্ত নেই তার আদিও থাকে না।

ষোড়শীর মুখে আসিয়া পড়িল, ও-সকল কেবল দর্শনশাস্ত্রের বুলি—শুধু বাক্য—ও লইয়া সংসার চলে না, কিন্তু জীবানন্দের মুখ দেখিয়া তাহার নিজের মুখে স্বর বাহির হইল না। মনে মনে সে সত্যই বিস্ময়াপন্ন হইয়া অনুভব করিল, একটা কেবল সুচতুর উত্তর দিবার জন্যই এ কথা আজ সে বলে নাই, এ লইয়া আর বাদানুবাদ করিতে সে চাহে না। যাহাকে একান্তই নিষ্ফল বলিয়া বুঝিয়াছে সে লইয়া আর তর্ক কেন?

সেইখানে চুপ করিয়া কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া ষোড়শী উঠিয়া গিয়া প্রদীপ রাখিয়া হাত ধুইল, কহিল, আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?

কি?

এই ঘরে একদিন আমার কাছে আপনি চেয়ে খেয়েছিলেন, আজ তেমনি আমার চাওয়ায় আপনাকে খেতে হবে।

দাও। ক্ষিদেও পেয়েচে।

সে জানি। আমরা পুরুষমানুষের মুখের পানে চাইলেই টের পাই। বলিয়া ষোড়শী জল-হাতে মুছিয়া লইয়া সামনেই ঠাঁই করিয়া দিল। দেবীর প্রসাদ আজ ছিল না, কিন্তু প্রজারা আজ তাহাকে অনেক-কিছু দিয়া গিয়াছিল, তাহাই পাতায় করিয়া সাজাইয়া আনিতে ষোড়শী রান্নাঘরে চলিয়া গেলে একাকী চারিদিকে চাহিয়া সেদিনের সেই দোয়াত ও কলমটা কুলঙ্গির উপরে তাহার চোখে পড়িল। মিনিট-দুই চিন্তা করিয়া সে তাহা পাড়িয়া আনিল। পকেট হইতে একখানা চিঠি বাহির করিয়া তাহার সাদা অংশটা ছিঁড়িয়া লইয়া প্রদীপের সুমুখে আসিয়া সে পত্র লিখিতে বসিল। বোধ হয় তিন-চারি ছত্রের বেশী নয়, শেষ করিয়া ভাঁজ করিল, এবং উপরে ষোড়শীর নাম লিখিয়া তাহা পকেটে রাখিয়া দিল। খানিক পরে খাবার লইয়া ষোড়শী প্রবেশ করিল। শালপাতায় জলে-ভিজানো সরু ধানের চিড়া, শালপাতার ঠোঙ্গায় দধি, আর একটা পাতায় কিছু ফলমূল ও চিনি, এবং ঘটিতে করিয়া জল আনিয়া তাহার সম্মুখে রাখিয়া দিয়া একটুখানি মলিন হাসিয়া বলিল, সেদিন ধনীর দেওয়া ঠাকুরের প্রসাদ ছিল, আর আজ গরীবের ঘরের চিড়ে দই আর একটু চিনি। এ কি আপনার মুখে রুচবে?

জীবানন্দ হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসিয়া বলিল, তুমি খেতে দিলে মুখের জন্যে ভাবিনে অলকা, কিন্তু পেটে সহ্য হলে হয়; আমার আবার সেই কলিকের ব্যথাটায়—

কথা শেষ না হতেই ষোড়শী চক্ষের পলকে পাতাটা টানিয়া লইল। ব্যাকুল ম্লানমুখে কপালে করাঘাত করিয়া কহিল, আমার পোড়াকপাল, তাই ভুলেছিলাম! কিন্তু এ ত আপনাকে আমি প্রাণান্তে খেতে দিতে পারব না।

জীবানন্দ নিজের কথায় লজ্জাবোধ করিয়া কহিল, বেশী না খেলে বোধ হয় ক্ষতি হবে না।

ষোড়শী বলিল, বোধ হয়। বোধ হয় নিয়ে আপনাদের চলে, কিন্তু আমাদের চলে না।

কিন্তু এর জন্যে ত তোমার দুঃখ হবে।

ষোড়শী চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিল, দুঃখ হবে কি গো? যাবার সময় তোমার মুখের খাবার কেড়ে নিয়েচি, কিচ্ছু দিতে পারিনি—আমি তো কেঁদেই মরে যাবো। একটু মৌন থাকিয়া হঠাৎ ভারী একটা অনুনয়ের স্বরে বলিয়া উঠিল, ও-বেলা নানা ঝঞ্ঝাটে রাঁধতে পারিনি, এ-বেলা সন্ধ্যার পর রেঁধেছি। ভাত, মাছের ঝোল—

মাছের ঝোল কি-রকম?

ষোড়শী হাসিয়া কহিল, কেন, আমি কি বিধবা নাকি? আমি ত সব খাই।

এতক্ষণ পরে জীবানন্দ হাসিল, বলিল, তা হলে সেগুলি সব নিজের জন্যে রেখে আমাকে দয়া করে ফলার খাওয়াতে গেলে কেন?

ষোড়শী তৎক্ষণাৎ কহিল, আমার দোষ হয়েচে, অপরাধ হয়েচে—একশ’বার ঘাট স্বীকার করচি। যদি বলেন ত আপনার কাছে আমি দশ হাত মেপে নাকে খত দিতে পারি। এই বলিয়া সে ভিজা-চিড়ার পাতাটা তুলিয়া ভাত ও মাছের ঝোল আনিতে হাসিমুখে উঠিয়া গেল।

ষোড়শীর প্রশ্নের উত্তরে জীবানন্দ যখন বলিয়াছিল, তাহার ভাবনার আদি-অন্ত নাই, তখন সে মিথ্যা বলে নাই, বোধ করি বাড়াইয়াও বলে নাই। এ জীবনে নিজের জীবনকে সে কখনও আলোচনার বিষয় করে নাই, এবং কোনদিন কোন প্রয়োজনই তাহার মুহূর্তের প্রয়োজনকে অতিক্রম করিয়া যাইতে পায় নাই। তাই তাহার ক্ষণকালের রুমালের প্রয়োজন ক্ষণপরের ঢাকাই চাদরের ঢের বড়; তাই আস্তরণের অভাবে শয্যায় তাহার বহুমূল্য শাল পাতা, এইজন্যই সে হাতের কাছে অ্যাশ-ট্রে না পাইলে সোনার ঘড়ির ডালার উপরে জ্বলন্ত চুরুট রাখিতে লেশমাত্র ইতস্ততঃ করে না। ভবিষ্যৎ তাহার কাছে সত্যবস্তু নয়, যে আসে নাই, সেই অনাগতের প্রতি সে ভ্রূক্ষেপমাত্র করে না। নারীর যে দেহটা সে চোখে দেখিতে পায়, তাহারই প্রতি তাহার আসক্তি, কিন্তু চোখ মেলিয়া যাহাকে দেখা যায় না, সেই তাহার দেহের অতিরিক্ত যে নারীত্ব—তাহার প্রতি তাহার কোন লোভই ছিল না। কিন্তু গ্রহবশে যৌবনের একান্তে আসিয়া আজ যে গহনে সে পথ ভুলিয়াছে ইহার কোন সন্ধানই সে জানিত না। কিসের জন্য যে অলকার আশেপাশে মন তাহার অহর্নিশি ঘুরিয়া মরিতেছে, নানাবিধ কৃচ্ছ্রসাধনায় যৌবন যাহার ক্ষুব্ধ নিপীড়িত, রূপ যাহার কঠিন ও কান্তিহীন, তাহাকে অনুক্ষণ কামনা করিয়া সংসার যখন তাহার এমনি বিস্বাদ হইয়া গেল, তখন কারণাতীত এই মোহের কৈফিয়ত সে যে নিজের কাছেই খুঁজিয়া পাইত না। কোন্‌ অবিদ্যমানে এই রমণী যে তাহার কোন্‌ অপূর্ণতা সম্পূর্ণ করিয়া দিবে, কি তাহার প্রয়োজন, এই অপরিচিত চিন্তার সে কূল পাইত না।

ভাত খাইতে বসিয়া একসময় সে বিমনা হইয়া পড়িয়াছিল। সম্মুখে খোলা দোরের দিকে পিঠ করিয়া ষোড়শী বসিয়াছিল, এই একটা সাধারণ প্রশ্নের ঠিকমত জবাব না পাইয়া সে বলিয়া উঠিল, আপনি কি ভাবচেন, আমার উত্তর দিচ্চেন না?

জীবানন্দ মুখ তুলিয়া কহিল, কিসের?

ষোড়শী বলিল, এইবারে ত আপনার চণ্ডীগড় ছেড়ে বাড়ি যাওয়া উচিত? আর ত এখানে আপনার কাজ নেই।

জীবানন্দ বোধ হয় অন্যমনস্কতার জন্যই বুঝিতে পারিল না, কহিল, কাজ নেই?

ষোড়শী বলিল, কৈ, আমি ত আর দেখতে পাইনে। এ গ্রাম আপনার, একে নিষ্পাপ করবার জন্যেই আপনি এসেছিলেন। আমার মত অসতীকে নির্বাসিত করার পরে আর এখানে আপনার কি আবশ্যক আছে আমি ত দেখতে পাইনে।

কিন্তু তুমি ত অসতী নও। এই বলিয়া জীবানন্দ চোখ মেলিয়া তাহার প্রতি চাহিয়া রহিল। ক্ষণকালমাত্র তাহাদের চোখে চোখে মিলিল, তাহার পরে ষোড়শী মুখ ফিরাইয়া লইল। কিন্তু এতক্ষণ এত কথাবার্তার মধ্যে যে বস্তুটা সে লক্ষ্য করে নাই, এই ক্ষণিকের দৃষ্টিতে এই প্রথম দেখিতে পাইয়া সে যথার্থই বিস্মিত হইল।

জীবানন্দের চোখে বুদ্ধির সেই অতি-তীক্ষ্ণতা ছিল না, মুখের কথার মত চাহনি তাহার স্পষ্ট, সরল এবং স্থূল। তাহার বক্রোক্তি ও অভিমান যে এই লোকটির কাছে নিষ্ফল হইয়াছে তাহা সে প্রত্যক্ষ দেখিতে পাইল। একটু চুপ করিয়া কহিল, কিন্তু এ কথা ত এতদিন আমার চেয়ে আপনিই বেশী জানতেন।

জীবানন্দ বলিল, কিন্তু নির্মল তোমাকে ভালবাসে এ ত সত্য।

প্রত্যুত্তরে ষোড়শী তাহার আরক্ত মুখ অপরের দৃষ্টির আড়ালে রাখিয়া কহিল, সে কি আমার দোষ? আর কেউ যদি ভালবাসার কদর্যতায় জীবন আমার দুর্ভর করে তোলে, সেও কি আমার অপরাধ? কিন্তু কথাটা বলিয়া ফেলিয়াই সে তাহার মুখ দেখিয়া অনুতাপে বিদ্ধ হইয়া তাড়াতাড়ি কহিল, কিন্তু আমার দোষের জন্যে ত আর এরা দায়ী নয়। এই বলিয়া সে সম্মুখের অন্ন-পাত্রটা দেখাইয়া বলিল, খাওয়া বন্ধ হ’লো কেন? সবই যে পড়ে রইল।

না, এই ত খাচ্চি, বলিয়া সে আহারে মন দিল।

গাড়োয়ান হাঁকিয়া কহিল, মা আর কি বেশী দেরি হবে?

না বাবা, আর বেশী দেরি হবে না। গলা খাটো করিয়া কহিল, চণ্ডীগড় থেকে আপনাকে কিন্তু যেতেই হবে, তা বলে দিচ্চি।

জীবানন্দ কহিল, কোথায় যাবো বল?

কেন, আপনার নিজের বাড়িতে, বীজগাঁয়ে।

বেশ, তাই যাবো।

কিন্তু কালকেই যেতে হবে।

জীবানন্দ মুখ তুলিয়া বলিল, কালই? কিন্তু কাজ আছে যে। মাঠের জলনিকেশের একটা সাঁকো করা দরকার। এদের জমিগুলো সব ফিরিয়ে দিতে হবে, সে ত তোমারই হুকুম। তা ছাড়া মন্দিরের একটা ভালো বিলি-ব্যবস্থা হওয়া চাই—অতিথি-অভ্যাগত যারা আসে তাদের ওপর না অত্যাচার হয়—এ-সব না করেই কি তুমি চলে যেতে বলচ?

ষোড়শী মুশকিলে পড়িল। কিন্তু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এ-সব সাধু সঙ্কল্প কি কাল সকাল পর্যন্ত থাকবে?

জীবানন্দ এই পরিহাসে যোগ দিল না, চুপ করিয়া রহিল।

ষোড়শী বলিল, কিন্তু আবশ্যকের চেয়ে একটা দিনও বেশী থাকবেন না আমাকে কথা দিন। এবং সে ক’টা দিন আগেকার মত সাবধানে থাকবেন বলুন?

এ কথারও সে জবাব দিল না, নিঃশব্দে বসিয়া আহার করিতে লাগিল। ষোড়শী জিদ করিল না, কিন্তু কথার চেয়ে এই নীরবতা জীবানন্দের ভিতরের পরিবর্তন তাহার কাছে অধিকতর সুব্যক্ত করিল।

খাওয়া শেষ হইলে বাহিরে আসিয়া ষোড়শী তাহার হাতে জল ঢালিয়া দিল; একমাত্র গামছাটা পুঁটলির কাজে নিযুক্ত হইয়া আগে হইতেই গাড়ির মধ্যে স্থান লাভ করিয়াছিল, নিজের অঞ্চলটা সে তাহার হাতে তুলিয়া দিয়া শুধু কহিল, এই নিন।

জীবানন্দ হাতমুখ মুছিয়া হঠাৎ বলিল, এ কিন্তু তুমি আর কাউকে দিতে পারতে না অলকা।

ষোড়শী আঁচলটা তাহার টানিয়া লইয়া আনতমুখে শুধু কহিল, ঘরে এসে আর একটু বসুন, গুছিয়ে নিয়ে বার হয়ে পড়তে আর বেশী দেরি হবে না। আমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে তবে আপনি যেতে পাবেন।

জীবানন্দ কহিল, অর্থাৎ তোমাকে নির্বাসিত করার কাজটা নিঃশেষ করেই যেতে পারি। ভালো, আমি তাই করে যাবো, কিন্তু তোমারও একটা কাজ রইল। আমার কৃতকর্মের ফল আমি ভোগ করব না ত কে করবে—সে অভিযোগ আমি একটিবারও কারো কাছে করিনি—কিন্তু যাবার সময় তোমার কাছে শুধু এইটুকু মাত্র দাবী করব, আমি তার বেশী আর দুঃখ না পাই। এই বলিয়া সে ঘরে আসিয়া পকেট হইতে চিঠি বাহির করিয়া ষোড়শীর হাতে দিয়া কহিল, সারাদিন তোমার খাওয়া হয়নি, এইবার কিছু মুখে দাও, আমি ততক্ষণ অন্ধকারে খানিক ঘুরে আসি। ঠিক সময়ে উপস্থিত হবো। এই বলিয়া সে বাহির হইবার উপক্রম করিতেই চক্ষের পলকে ষোড়শী দ্বার রোধ করিয়া দাঁড়াইল। এত কথার মধ্যেও যে এই পরদুঃখ-বিমুখ আত্মসর্বস্ব লোকটি তাহার না খাইবার অতি তুচ্ছ ব্যাপারটি মনে রাখিয়াছে, এই কথা মনে করিয়া তাহার সূচ ফুটিল, চিঠিখানির প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এ ত আমাকেই লেখা, আপনার সুমুখেই কি এ পত্র আমি পড়তে পারিনে?

জীবানন্দ কহিল, পারো, কিন্তু অনাবশ্যক। এর জবাব দেবার ত প্রয়োজন হবে না। আমাকে দুঃখ থেকে বাঁচাবার জন্যে তার ঢের বেশী দুঃখ তুমি নিজে নিয়েচ। নইলে এমন করে হয়ত তোমাকে যেতেও হতো না। আমার শেষ অনুরোধ এতেই লেখা আছে, তা যদি রাখতে পারো তার চেয়ে আনন্দ আমার নেই।

ষোড়শী কহিল, তা হলে পড়ি?

জীবানন্দ চুপ করিয়া রহিল। ষোড়শী কাগজখানি হাতের পর মেলিয়া ধরিয়া হেঁট হইয়া সেই ছত্র-কয়েকের লিখনটুকু একনিঃশ্বাসে পড়িয়া ফেলিয়া নির্বাক্‌ ও নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। বাহিরে তাহার নাম লিখা থাকিলেও, বস্তুত এ পত্র তাহার নয়। ভিতরে ছিল—

ফকিরসাহেব,

ষোড়শীর আসল নাম অলকা। সে আমার স্ত্রী। আপনার কুষ্ঠাশ্রমের কল্যাণ কামনা করি, কিন্তু তাহাকে দিয়া কোন ছোট কাজ করাইবেন না। আশ্রম যেখানে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন সে আমার নয়, কিন্তু তাহার সংলগ্ন শৈবাল-দীঘি আমার। এই গ্রামের মুনাফা পাঁচ ছয় হাজার টাকা। আপনাকে জানি। কিন্তু আপনার অবর্তমানে পাছে কেহ তাহাকে নিরুপায় মনে করিয়া অমর্যাদা করে, এই ভয়ে আশ্রমের জন্যই গ্রামখানি তাহাকে দিলাম। আপনি নিজে একদিন আইন ব্যবসায়ী ছিলেন, এই দান পাকা করিয়া লইতে যাহা-কিছু প্রয়োজন, করিবেন; সে খরচ আমিই দিব। কাগজপত্র প্রস্তুত করিয়া পাঠাইলে আমি সহি করিয়া রেজিস্টারী করিয়া দিব।

ষোড়শী বাহিরে গিয়া তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া ফেলিয়া ফিরিয়া আসিয়া বলিল, তুমি এত খবর কোথায় পেলে? আমি যে কুষ্ঠাশ্রমের দাসী হয়ে যাচ্চি এই বা তুমি জানলে কি করে?

জীবানন্দ কহিল, কুষ্ঠাশ্রমের কথা অনেকেই জানে। আর তোমার কথা? আজই দেবতার স্থানে দাঁড়িয়ে যারা শপথ করে গেল, নিজের কানে শুনেও অন্ধকারে আমি যাদের চিনতে পারিনি, তুমি তাদের চিনলে কি করে?

ষোড়শী ইহার ঠিক জবাবটা দিতে না পারিয়া হঠাৎ বলিয়া ফেলিল, তোমার কি সংসারে আর মন নেই? সমস্ত বিলিয়ে নষ্ট করে দিয়ে কি তুমি সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে যেতে চাও নাকি?

প্রশ্নটা দুজনের কানেই অদ্ভুত ঠেকিল। জীবানন্দ প্রথমে জবাব দিতে পারিল না, কিন্তু দেখিতে দেখিতে সে কিরকম উত্তেজিত হইয়া উঠিল। বলিল, আমি সন্ন্যাসী? মিছে কথা। সংসারে আর আমি কিছুই নষ্ট করতে পারব না। এখানে আমি বাঁচতে চাই—মানুষের মাঝখানে মানুষের মত বাঁচতে চাই। বাড়ি চাই, ঘর চাই, স্ত্রী চাই, ছেলেপুলে চাই—আর মরণ যেদিন আটকাতে পারব না, সেদিন তাদের চোখের উপর দিয়েই চলে যেতে চাই। আমার অনেক গেছে, কত যে গেছে শুনলে তুমি চমকে যাবে—কিন্তু আর আমি লোকসান করতে পারব না।

ষোড়শী সভয়ে আস্তে আস্তে বলিল, কিন্তু আমি ত সন্ন্যাসিনী। পৃথিবীতে স্ত্রীলোকের অভাব নেই—কিন্তু এর মধ্যে আমাকে তুমি জড়াতে চাইচ কেন?

জীবানন্দ চুপ করিয়া রহিল। পৃথিবীতে স্ত্রীলোকের অভাব আছে কি নাই, এ কথা তাহাকে বলিবার স্পর্ধা যাহার হইল তাহাকে সে আর কি বলিবে?

গাড়োয়ান প্রাঙ্গণ হইতে তাড়া দিয়া বলিল, মা, রাত পোহাতে যে আর দেরি নেই।

চল বাবা, যাচ্চি। বলিয়া ষোড়শী তেলটুকু প্রদীপের মধ্যে ঢালিয়া দিয়া ক্ষীণ দীপশিখা সমুজ্জ্বল করিয়া দিয়া বাহির হইয়া আসিল। ঘরে তালা বন্ধ করিবার আবশ্যক ছিল না, জীর্ণদ্বারে শুধু শিকলটি তুলিয়া দিয়া, গলায় অঞ্চল দিয়া জীবানন্দের পদপ্রান্তে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া তাহার পদধূলি লইয়া কহিল, আমি চললাম।

জীবানন্দ কহিল, খাবার সময়টুকুও হল না।

না। প্রজারা জানে আমি ভোরবেলায় যাত্রা করব, তারা এসে পড়বার পূর্বেই আমার বিদায় হওয়া চাই। একটু হাসিয়া কহিল, এক-আধ দিন না খেলে আমাদের মরণ হয় না।

সঙ্গে সঙ্গে আসিয়া জীবানন্দ তাহাকে গাড়িতে তুলিয়া দিল। গাড়ি ছাড়িয়া দিলে তাহার কানের কাছে মুখ আনিয়া কহিল, অলকা, তোমার মা একদিন তোমাকে আমার হাতে দিয়েছিলেন, তবু তোমাকে পেলাম না, কিন্তু সেদিন আমাকে যদি কেউ তোমার হাতে সঁপে দিতেন, আজ বোধ হয় তুমি অন্ধকারে আমাকে এমন করে ফেলে যেতে পারতে না।

ইহার জবাব ষোড়শী খুঁজিয়া পাইল না। শুধু কথাগুলোর একটা অব্যক্ত, অপরিসীম ব্যাকুল ধ্বনি তাহার দুই কান আচ্ছন্ন করিয়া রহিল। গাড়ি মোড় ফিরিবার পূর্বেও সে মুখ বাড়াইয়া দেখিল শেষ-নিশার প্রগাঢ় অন্ধকারে ঠিক সেইখানেই সে তেমনি স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে।

রাত্রি প্রভাত হইতে তখন খুব বেশী বিলম্ব ছিল না, জীবানন্দ মাঠের পথ ধরিয়া তাহার গৃহে ফিরিল। কিছুক্ষণ হইতে একটা অস্ফুট কোলাহল তাহার কানে যাইতেছিল, কিছুদূর অগ্রসর হইতেই সুমুখের আকাশে ঊষার আরক্ত আভার মত রাঙ্গা আলো তাহার চোখে পড়িল। এবং চলার সঙ্গে সঙ্গেই এই শব্দ ও আলোক উত্তরোত্তর বাড়িয়া চলিতে লাগিল। অবশেষে কাছাকাছি আসিয়া দেখিতে পাইল, বহুলোকের ব্যর্থ চীৎকার ও ছুটাছুটির মধ্যে বীজগ্রামের জমিদার-গোষ্ঠীর প্রমোদ-ভবন, তাহার মাতামহের অত্যন্ত সাধের শান্তিকুঞ্জ অগ্নিদাহে ভস্মীভূত হইতে আর বিলম্ব নাই।