তৃতীয় পরিচ্ছেদ

মাস-দুই হইল বনমালীর মৃত্যু হইয়াছে। তাঁহার কলিকাতার এত বড় বাড়িতে বিজয়া এখন একা। তাহার দেশের বিষয়-সম্পত্তির দেখাশুনা রাসবিহারীই করিতে লাগিলেন, এবং সেই সূত্রে তাহার একপ্রকার অভিভাবক হইয়াও বসিলেন। কিন্তু নিজে থাকেন গ্রামে, সেইজন্য পুত্র বিলাসবিহারীর উপরেই বিজয়ার সমস্ত খবরদারির ভার পড়িল। সে-ই তাহার প্রকৃত অভিভাবক হইয়া উঠিল।

তখন এই সময়টায়, প্রতি ব্রাহ্মপরিবারে ‘সত্য’, ‘সুনীতি’, ‘সুরুচি’ এই শব্দগুলা বেশ বড় করিয়াই শিখানো হইত। কারণ বিদেশে পড়িতে আসিয়া হিন্দু যুবকেরা যখন পিতামাতার বিরুদ্ধে, দেবদেবীর বিরুদ্ধে, প্রতিষ্ঠিত সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া এই সমাজের বাঁধানো খাতায় নাম লিখাইয়া বসিত, তখন এই শব্দগুলাই চাড়া দিয়া তাহাদের কাঁচা মাথা ঘাড়ের উপর সোজা করিয়া রাখিত—ঝুঁকিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িতে দিতো না। তাহারা কহিত, যাহা সত্য বলিয়া বুঝিবে, তাহাই করিবে। মায়ের অশ্রুজলই বল, আর বাপের দীর্ঘনিশ্বাসই বল, কিছুই দেখিবার শুনিবার প্রয়োজন নাই। ও-সব দুর্বলতা সর্বপ্রযত্নে পরিহার করিবে, নচেৎ আলোকের সন্ধান পাইবে না। কথাগুলা বিজয়াও শিখিয়াছিল।

আজ গ্রাম হইতে বিলাসবাবু বৃদ্ধ মাতাল জগদীশের মৃত্যু-সংবাদ লইয়া আসিয়াছিলেন। বিজয়ার সে পিতৃবন্ধু বটে, কিন্তু বিলাসবাবু যখনই বলিতে লাগিলেন, কেমন করিয়া জগদীশ মদ খাইয়া মাতাল হইয়া ছাদের উপর হইতে পড়িয়া মরিয়াছে, তখন ব্রাহ্মধর্মের সুনীতি স্মরণ করিয়া বিজয়া এই দুর্ভাগা পিতৃসখার বিরুদ্ধে ঘৃণায় ওষ্ঠ কুঞ্চিত করিতে বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করিল না। বিলাস বলিতে লাগিল, জগদীশ মুখুয্যে আমার বাবারও ছেলেবেলার বন্ধু ছিলেন; কিন্তু তিনি তার মুখ পর্যন্ত দেখতেন না। টাকা ধার করতে দু’বার এসেছিল, বাবা চাকর দিয়ে তাকে ফটকের বার করে দিয়েছিলেন। তিনি সর্বদা বলেন, এই সব দুর্নীতিপরায়ণ লোকগুলোকে প্রশ্রয় দিলে, মঙ্গলময় ভগবানের শ্রীচরণে অপরাধ করা হয়।

বিজয়া সায় দিয়া কহিল, অতি সত্য কথা।

বিলাস উৎসাহিত হইয়া বক্তৃতার ভঙ্গিতে বলিতে লাগিল, বন্ধুই হোক, আর যেই হোক, দুর্বলতা-বশে কোনমতেই ব্রাহ্মসমাজের চরম আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করা উচিত নয়। জগদীশের সমস্ত সম্পত্তি এখন ন্যায়তঃ আমাদের। তার ছেলে পিতৃঋণ শোধ করতে পারে ভাল, না পারে, আইনমত আমাদের এই দণ্ডেই সমস্ত হাতে নেওয়া উচিত। বস্তুতঃ ছেড়ে দেবার আমাদের কোন অধিকার নেই। কারণ এই টাকায় আমরা অনেক সৎকার্য করতে পারি। সমাজের কোন ছেলেকে বিলাত পর্যন্ত পাঠাতে পারি; ধর্ম-প্রচারে ব্যয় করতে পারি; কত কি করতে পারি। কেন তা না করব বলুন? তা ছাড়া জগদীশবাবু কিংবা তাঁর ছেলে আমাদের সমাজভুক্ত নয় যে, তাকে দয়া করা আবশ্যক। আপনার সম্মতি পেলেই বাবা সমস্ত ঠিক করে ফেলবেন বলে আজ আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।

বিজয়া মৃত পিতার শেষ কথাগুলা স্মরণ করিয়া ভাবিতে লাগিল—সহসা জবাব দিতে পারিল না। তাহাকে ইতস্ততঃ করিতে দেখিয়া বিলাস সজোরে প্রবলকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, না, না, আপনাকে ইতস্তত করতে আমি কোন মতেই দেব না। দ্বিধা, দুর্বলতা—পাপ! শুধু পাপ নয়, মহাপাপ! আমি মনে মনে সঙ্কল্প করেছি, তার বাড়িটায় আপনার নাম করে—যা কোথাও নেই, কোথাও হয়নি—আমি তাই করব। পাড়াগাঁয়ের মধ্যে ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেশের হতভাগ্য মূর্খ লোকগুলোকে ধর্মশিক্ষা দেব। আপনি একবার ভেবে দেখুন দেখি, এদের মূর্খতার জ্বালাতেই বিরক্ত হয়ে আপনার স্বর্গীয় পিতৃদেব দেশ ছেড়েছিলেন কি না। তাঁর কন্যা হয়ে কি আপনার উচিত নয়—এই নোব্‌ল প্রতিশোধ নিয়ে তাদেরই এই চরম উপকার করা! বলুন, আপনি এ কথার উত্তর দিন।

বিজয়া বিচলিত হইয়া উঠিল। বিলাস দৃপ্তস্বরে বলিতে লাগিল, সমস্ত দেশের মধ্যে একটা কত বড় নাম, কত বড় সাড়া পড়ে যাবে, ভেবে দেখুন দেখি? হিন্দুদের স্বীকার করতেই হবে—সে ভার আমার উপর—যে, ব্রাহ্মসমাজে মানুষ আছে; হৃদয় আছে, স্বার্থত্যাগ আছে; যাঁকে তারা নির্যাতন করে দেশ থেকে বিদায় করে দিয়েছিল, সেই মহাত্মারই মহীয়সী কন্যা তাদেরই মঙ্গলের জন্য এই বিপুল স্বার্থত্যাগ করেছেন। সমস্ত ভারতবর্ষময় একটা কি বিরাট মর‍্যাল এফেক্ট হবে, বলুন দেখি। বলিয়া বিলাসবিহারী সম্মুখের টেবিলের উপর একটা প্রচণ্ড চাপড় মারিল। শুনিতে শুনিতে বিজয়া মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিল। বাস্তবিক, এত-বড় নামের লোভ সংবরণ করা আঠারো বছরের মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। তথাপি, পিতার কথাগুলি স্মরণ করিয়া সে দ্বিধাভরে জিজ্ঞাসা করিল, তাঁর ছেলের নাম শুনেচি নরেন্দ্র। এখন সে কোথায় আছে, জানেন?

জানি। হতভাগ্য পিতার মৃত্যুর পরে সে বাড়ি এসে এখন দেশেই আছে।

আপনার সঙ্গে বোধ হয় আলাপ আছে?

আলাপ? ছিঃ! আপনি আমাকে কি মনে করেন বলুন দেখি! বলিয়া বিজয়াকে একেবারে অপ্রতিভ করিয়া দিয়া বিলাসবাবু একটুখানি হাসিয়া কহিল, আমি ত ভাবতেই পারিনে যে, জগদীশ মুখুয্যের ছেলের সঙ্গে আলাপ করছি। তবে, সেদিন রাস্তায় হঠাৎ একটা পাগলের মত নূতন লোক দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম। শুনলাম, সেই নরেন মুখুয্যে।

বিজয়া কৌতূহলী হইয়া কহিল, পাগলের মত? শুনেছি নাকি ডাক্তার?

বিলাসবাবু ঘৃণায় সর্বাঙ্গ কুঞ্চিত করিয়া কহিল, ঠিক পাগলের মত। ডাক্তার? আমি বিশ্বাস করিনে। মাথায় বড় বড় চুল—যেমন লম্বা তেমনি রোগা। বুকের প্রত্যেক পাঁজরাটি বোধ করি দূর থেকে গোনা যায়—এই ত চেহারা। তালপাতার সেপাই। ছোঃ—

বস্তুতঃ চেহারা লইয়া গর্ব করিবার অধিকার বিলাসের ছিল। কারণ সে বেঁটে, মোটা এবং ভারি জোয়ান। তাহার বুকের পাঁজর বোমা মারিয়া নির্দেশ করা যাইত না। সে আরও কি বলিতে যাইতেছিল, বিজয়া বাধা দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা বিলাসবাবু, জগদীশবাবুর বাড়িটা যদি আমরা সত্যই দখল করে নিই, গ্রামের মধ্যে কি একটা বিশ্রী গোলমাল উঠবে না?

বিলাস জোর করিয়া বলিয়া উঠিল, একেবারে না। আপনি পাঁচ-সাতখানা গ্রামের মধ্যে এমন একজনও পাবেন না, যার ঐ মাতালটার উপর বিন্দুমাত্র সহানুভূতি ছিল। আহা বলে, এমন লোক ও-অঞ্চলে নেই। একটু হাসিয়া কহিল, কিন্তু তাও যদি না হত আমি বেঁচে থাকা পর্যন্ত সে চিন্তা আপনার মনে আনাও উচিত নয়। কিন্তু আমি বলি, অন্ততঃ কিছুদিনের জন্যও আপনার একবার দেশে যাওয়া কর্তব্য।

বিজয়া আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন? আমরা কখনই ত সেখানে যাইনে।

বিলাস জোর দিয়া বলিল, সেইজন্যেই ত বলি, আপনার যাওয়া চাই ই! প্রজাদের একবার তাদের মহারানীকে দেখতে দিন। আমার ত নিশ্চয়ই মনে হয়, এ সৌভাগ্য থেকে তাদের বঞ্চিত করা অপরাধ।

লজ্জায় বিজয়ার মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল; সে আনত মুখে কি-একটা বলিবার উপক্রম করিতেই, বিলাস বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, ইতস্ততঃ করবার এতে কিচ্ছু নেই। একবার ভেবে দেখুন দিকি, কত কাজ সেখানে আপনার করবার আছে! এ-কথা আজ আপনার মুখের ওপরেই আমি বলতে পারি, যে আপনার বাবা সমস্ত দেশের মালিক হয়েও যে কতকগুলো ক্ষেপা কুকুরের ভয়ে আর কখনো গ্রামে ফিরে গেলেন না, সে কি ভাল কাজ করেছিলেন? এই কি আমাদের ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ? এ যে কোন সমাজেরই আদর্শ নয়, তাতে আর ভুল কি!

বিজয়া ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, কিন্তু বাবার মুখে শুনেছি, আমাদের দেশের বাড়ি ত বাস করবার উপযুক্ত নয়।

বিলাস বলিল, আপনি হুকুম দিন, একবার বলুন সেখানে যাবেন—আমি দশ দিনের মধ্যে তাকে বাসের উপযুক্ত করে দেব। আমার উপর নির্ভর করুন, যাতে সে বাড়ি আপনার মর্যাদা সম্পূর্ণ বহন করতে পারে, আমি প্রাণপণে তার বন্দোবস্ত করে দেব। দেখুন, একটা কথা আমার বহুদিন থেকে বার বার মনে হয়—আপনাকে শুধু সামনে রেখে আমি কি যে করে তুলতে পারি, তার বোধ করি সীমা-পরিসীমা নেই।

বিজয়াকে সম্মত করাইয়া বিলাস প্রস্থান করিলে, সে সেইখানেই চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। যাহা তাহার দেশ, সেখানে সে জন্মাবধি কখনও যায় নাই বটে, কিন্তু মাঝে মাঝে পিতার মুখে তাহার কত বর্ণনাই না শুনিয়াছে ! দেশের গল্প করিতে তাঁহার উৎসাহ ও আনন্দ ধরিত না। কিন্তু তখন সে-সকল কাহিনী তাহার কিছুমাত্র মনোযোগ আকর্ষণ করিতে পারিত না; যেমন শুনিত, তেমনি ভুলিত। কিন্তু আজ কোথা হইতে অকস্মাৎ ফিরিয়া আসিয়া সেই সব বিস্মৃত বিবরণ একেবারে আকার ধরিয়া তাহার চোখের উপর দেখা দিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, তাহাদের গ্রামের বাড়ি কলিকাতার এই অট্টালিকার মত বৃহৎ ও জমকালো নয় বটে, কিন্তু সেই ত তাহার সাতপুরুষের বাস্তুভিটা! সেখানে পিতামহ-পিতামহী, প্রপিতামহ-প্রপিতামহী, তাঁদেরও বাপ-মা, এমন কত পুরুষের সুখে-দুঃখে উৎসবে-ব্যসনে যদি দিন কাটিয়া থাকে, তবে তাহারই বা কাটিবে না কেন?

গলির সুমুখে হাজরাদের তেতলা বাড়ির আড়ালে সূর্য অদৃশ্য হইল। এই লইয়া পিতার সঙ্গে তাহার কত দিন কত কথা হইয়া গেছে। তাহার মনে পড়িল, কত সন্ধ্যায় তিনি ওই ইজিচেয়ারটার উপর বসিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিয়াছিলেন, বিজয়া, আমার দেশের বাড়িতে কখনও এ দুঃখ পাইনি। সেখানে কোন হাজরার তেতলা-ছাদই আমার শেষ সূর্যাস্তটুকুকে এমন করে কোনদিন আড়াল ক’রে দাঁড়ায় নি। তুই ত জানিস নে মা, কিন্তু আমার যে চোখ-দুটি এই বুকের ভেতর থেকে উঁকি মেরে চেয়ে আছে, তারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, আমাদের ফুলবাগানের ধারের ছোট্ট নদীটি এতক্ষণ সোনার জলে টলটল করে উঠেছে; আর তার পরপারে বাঁশবনের আড়াল থেকে সূয্যিঠাকুর এখনো যাই-যাই করেও গ্রামের মায়া কাটিয়ে যেতে পারেন নি। ঐ ত মা, গলির মোড়ে দেখতে পাচ্ছিস, দিনের কাজ শেষ করে ঘরপানে মানুষের স্রোত ব’য়ে যাচ্ছে; কিন্তু এই দশ-বারো হাত জমিটুকু ছেড়ে তাদের সঙ্গে যাবার ত আর একটুও পথ নেই। এমনি করে এই সন্ধ্যাবেলায় সেখানেও উলটো স্রোত ঘরপানে বয়ে যেতে দেখেছি; কিন্তু তার প্রত্যেক গরু-বাছুরটির গোয়ালঘরের পরিচয় পর্যন্ত জানতাম, মা। বলিয়া অকস্মাৎ একটা অতি গভীর শ্বাস হৃদয়ের ভিতর হইতে মোচন করিয়া নীরব হইয়া থাকিতেন। যে গ্রাম একদিন তিনি ত্যাগ করিয়া আসিয়াছিলেন, এত সুখৈশ্বর্যের মধ্যেও যে তাহারই জন্য তাঁহার ভিতরটা কাঁদিতে থাকিত, ইহা যখন-তখন বিজয়া টের পাইত। তথাপি, একটা দিনের জন্যও সে ইহার কারণ চিন্তা করিয়া দেখে নাই; কিন্তু আজ বিলাসবাবু সেই দিকে তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া চলিয়া গেলে, পরলোকগত পিতৃদেবের কথাগুলা স্মরণ করিতে করিতে তাঁহার প্রচ্ছন্ন বেদনার হেতু অকস্মাৎ একমুহূর্তেই তাহার মনের মধ্যে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। কলিকাতার এই বিপুল জনারণ্যের মধ্যেও তিনি যে কিরূপ একাকী দিন যাপন করিয়া গেছেন, আজ তাহা সে চোখের উপর দেখিতে পাইয়া একেবারে ভয় পাইয়া গেল; এবং আশ্চর্য এই যে, যে গ্রাম, যে ভিটার সহিত তাহার জন্মাবধি পরিচয় নাই, তাহাই আজ তাহাকে দুর্নিবার শক্তিতে টানিতে লাগিল।