চব্বিশ

বিমলবাবু যখন রাখালের খোঁজ করিতেছিলেন, সে তখন কলিকাতার বাহিরে। রেণু ও ব্রজবাবুকে বৃন্দাবন পৌঁছাইয়া দিতে গিয়াছে। ফিরিয়া আসিয়া বিমলবাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিলে বিমলবাবু অভিযোগ করিলেন, একটা দিন অপেক্ষা করলেই আমার সঙ্গে ব্রজবাবুর দেখা হতো। তুমি কেন তার ব্যবস্থা করলে না রাজু? তোমাকে তো আমি চিঠি লিখেছিলাম।

ওরা যে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ এড়াবেন বলেই তাড়াতাড়ি করে চলে গেলেন।

তার কারণ?

তা জানি না। তবে কাকাবাবুর চেয়ে রেণুই বেশি ব্যস্ত হয়েছিল।

বুঝেচি।

বিমলবাবু কতক্ষণ মৌন রহিয়া পরে বলিলেন, বৃন্দাবনে কোথায় ওদের রেখে এলে?

গোবিন্দজীর মন্দিরের কাছাকাছি একটি গলিতে। বাড়িখানি বড়, অনেক ঘর ভাড়াটে থাকে। এঁরা নিয়েচেন দুখানি শোবার ঘর, একটু রান্নার জায়গা। ভাড়া সামান্যই।

বিমলবাবু চিন্তিত-মুখে বলিলেন, তুমি ছাড়া ওদের দেখাশোনার কেউই রইলো না। আমার মনে হয়, অন্ততঃ কিছুদিনও এ-সময়ে বৃন্দাবনে গিয়ে তোমার থাকা দরকার।

কিন্তু তার ফলে আমার জীবিকা যে এখানে অচল হয়ে দাঁড়াবে!

বিমলবাবু নতমস্তকে চিন্তা করিতে লাগিলেন।

অনেকক্ষণ নিঃশব্দে কাটিয়া গেল। রাখাল বলিল, আপনি অদৃষ্ট মানেন কি-না জানি না, আমি কিন্তু মানি।

রাখালের কথার উত্তর না দিয়া বিমলবাবু বলিলেন, তুমি বোধ হয় শুনেচো—তারক হাইকোর্টে বেরুচ্ছে। প্র্যাক্‌টিশ মন্দ হচ্চে না। মনে হয় ওর উন্নতি হবেই। ছেলেটির বড় হবার আকাঙ্ক্ষা খুব। অনেক আশা করেছিলাম, ওর হাতে রেণুকে দেবো। কিন্তু ব্রজবাবুর সঙ্গে তো এ-বিষয়ে আলোচনারই সুযোগ হ’লো না।

রাখাল বিস্মিত হইয়া বিমলবাবুর পানে চাহিয়া রহিল।

বিমলবাবু পুনরায় বলিলেন, তোমার নতুন-মারও তাই ইচ্ছে ছিল। শুনলে হয় তো ব্রজবাবুও রাজি হতেন।

রাখাল মৃদু-কণ্ঠে কহিল, কিন্তু তারক কি রাজি হয়েচে?

তাকে এখনও বলা হয়নি। তবে তোমার নতুন-মা তাকে আভাসে কতকটা জানিয়ে রেখেচেন।

রাখাল আবার বলিল, আপনার কি মনে হয়, সে এ প্রস্তাবে সম্মত হবে?

বিমলবাবু বলিলেন, সম্মত না হবার তো কোন কারণ দেখি না। রেণু সকল দিক দিয়েই যোগ্যপাত্রী। একটিমাত্র ত্রুটি তার বাপ এখন দরিদ্র। কিন্তু মায়ের যা কিছু আছে রেণুই পাবে। তারক নিজে তোমার নতুন-মাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা-ভক্তি করে, তাঁরই কাছে সে রয়েচে, সুতরাং কোনদিক দিয়েই তার অমত করার কারণ দেখা যায় না।

রাখাল চুপ করিয়া রহিল।

বিমলবাবু বলিলেন, রাজু, তোমাকে একটি কাজ করতে হবে।

রাখাল বলিল, কি বলুন!

তারকের কাছে এই বিবাহের প্রস্তাবটা তোমাকে ভুলতে হবে।

রাখাল আশ্চর্য্য হইয়া বলিল, আপনি কি শোনেননি রেণু বিবাহ করতে একেবারেই অসম্মত?

তাকে রাজি করবার ভার আমার। তুমি তারকের কাছে কথাটা উত্থাপন করে তার মতামতটা আমাকে জানালে, আমি নিজে বৃন্দাবনে গিয়ে রেণুকে সম্মত করিয়ে আনতে পারবো।

রাখাল বলিল, আপনি ভুল করছেন। রেণু বা তারক কেউই এ বিবাহে সম্মত হবে মনে হয় না।

বিমলবাবু বলিলেন, রেণুর কথা থাক্।

তারক কেন রাজি হবে না বল তো?

সে আমি—কি করে বলবো? তবে সম্ভবতঃ হবে না বলেই মনে হয়। তুমি একবার প্রস্তাব করেই দেখ না।

আচ্ছা।

 

বাসায় ফিরিয়া বাহিরের পরিচ্ছদ না ছাড়িয়াই বিছানার উপর লম্বা হইয়া রাখাল শুইয়া পড়িল। চক্ষু বুজিয়া সম্ভব অসম্ভব কত কি ভাবনা ভাবিতে ভাবিতে খাওয়ার সময় উত্তীর্ণ হইয়া গেল, খেয়াল রহিল না।

বুড়ি নানী কিছুদিন যাবৎ অসুস্থ হইয়া শয্যাগত আছে, কাজ করিতে আসিতে পারে না, তার দৌহিত্রকে কাজে পাঠায়। নানীর নাতির বয়স বেশি নয়। বছর তেরো-চৌদ্দ হইবে। নাম নীলু। খুব হাসিখুশি স্ফূর্তিবাজ ছেলেটি, সর্ব্বদা কণ্ঠে গুন-গুন করিয়া গানের সুর লাগিয়াই আছে। কাজকৰ্ম্ম বেশ চটপট করিতে পারে, তবে প্রায় প্রতিদিনই রাখালের দুটা-একটা চায়ের পেয়ালা পিরিচ, না হয় কাচের প্লেট বা গ্লাস তার হাতে ভাঙিয়া থাকে। যখনই সে অপ্রতিভ মুখে লম্বা জিভ কাটিয়া রাখালের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়ায়, রাখাল তাহার চেহারা দেখিয়া বুঝিতে পারে আজ আবার কাচের জিনিস একটা গেল। কাচের ভাঙা টুকরাগুলি সাবধানে ফেলিয়া দিতে বলিয়া রাখাল তাহাকে ভবিষ্যতে কাচের সামগ্রী সতর্কভাবে নাড়াচাড়া করিবার সদুপদেশ দেয়। তৎক্ষণা প্রবলভাবে মাথা হেলাইয়া সম্মতি জ্ঞাপন করিয়া আবার তিন লাফে নীলু ছুটিয়া চলিয়া যায়। রাখাল তাহার নানী বুড়ির নাতিকে আদর করিয়া ডাকে নীলুখুড়ো!

বেলা চারটার সময় নীলু আসিয়া যখন রাখালকে ডাকিয়া জাগাইল, চোখ রগড়াইয়া বিছানায় উঠিয়া বসিয়া তাহার খেয়াল হইল, আজ খাওয়া হয় নাই। বিমলবাবুর সহিত দেখা করিয়া বাড়ি ফিরিয়া কাপড়-জামা না ছাড়িয়া বিছানায় শুইয়াছিল, কখন যে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে টের পায় নাই।

ঘড়ির পানে চাহিয়া রাখাল নিজের ’পরে বিরক্ত হইল। আজকাল তাহার যেন কি হইয়াছে! ঘরদুয়ার, কাজকর্ম্ম, বেশভূষা, শরীর-স্বাস্থ্য কোনদিকে আর মনোযোগ নাই। এমন কি সবদিন খাওয়া-দাওয়ারও খেয়াল থাকে না তার। এ ভাল নয়। গরীব মানুষ সে। এ-রকম খামখেয়াল বড় মানুষদেরই সাজে। যাহাদের প্রতিবারের পেটের অন্ন প্রতিদিনের উপার্জ্জনের উপর নির্ভর করে, তাহাদের এ অন্যমনস্কতা শোভা পায় না। বারংবার সুদীর্ঘ কামাই করার দরুণ তাহার টিউশনিগুলি একে একে গিয়াছে। কেবল একটিমাত্র টিউশনি আজও কোনক্রমে টিকিয়া আছে, সে কেবল রাখাল তাহাদের সময়-অসময়ের একমাত্র বিশ্বস্ত কাজের মানুষ বলিয়া টিউটররূপে তার মূল্য না থাকিলেও, বন্ধু হিসাবে, বিশ্বস্ত কাজের লোক হিসাবে মূল্য আছে। নিজের লেখাপড়ার কাজও এইসব ঝঞ্ঝাটে বন্ধ রহিয়াছে। যাত্রার পালা লেখা ও বেনামীতে নাটক রচনায় বহুদিন আর হাত দিতে পারে নাই। ব্যাঙ্কের ও পোস্টঅফিসের পাশ বহিতে জমার ঘর শূন্য হইয়া আসিয়াছে। খাবারের দোকানে, মুদির দোকানে এবং গোয়ালার কাছে কিছু টাকা বাকী পড়িয়াছে। যদিও সে আজকাল আর নিজের পরিচ্ছন্ন পোষাক-পরিচ্ছদের সৌখিন বিলাসে একেবারেই মনোযোগী নয়—তবুও দর্জ্জি ও ধোবার বিল বোধহয় বেশ কিছু জমিয়াই আছে।

নীলুর ডাকে রাখাল উঠিয়া মুখ ধুইতে ধুইতে বলিল, নীলুখুড়ো, স্টোভটা ধরিয়ে লক্ষ্মী ছেলের মতো চায়ের জলটা চড়িয়ে দাও দিকি।

নীলু ঘরের সম্মুখে দালানে এঁটো বাসন দেখিতে না পাইয়া বিস্মিত হইয়া রাখালের নিকটে আসিয়াছিল। উদ্বিগ্ন-স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, বাবু, আপনার কি অসুখ করেচে?

রাখাল তাহার মুখের পানে তাকাইয়া বলিল, কে বললে রে?

কিচ্ছু খাননি যে!

রাখাল হাসিয়া বলিল, না, অসুখ করেনি। এমনিই আজ খাইনি। তুমি এখন একটা কাজ কর তো নীলুখুড়ো। চায়ের জলটা দিয়ে ঐ মোড়ের দোকান থেকে গরম সিঙাড়া কিছু নিয়ে এসো, চায়ের সঙ্গে খাওয়া যাবে।

নীলু স্টোভ জ্বালিয়া চায়ের জল বসাইয়া খাবার আনিতে চলিয়া গেল। রাখাল চা তৈয়ার করিতে বসিল। একবার মনে হইল, এত হাঙ্গামা না করিয়া সারদার কাছে গিয়া বলিলেই তো হয়—আজ অসময়ে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম। ভাত খাইতে ভুল হইয়া গিয়াছে। ব্যস, তারপরে আর কিছু ভাবিতে হইবে না।

কল্পনায় সারদার স্তম্ভিত ক্রুদ্ধ মুখের অন্তরালে যে ব্যাকুল স্নেহের সংগুপ্ত রূপ রাখালের চোখে ভাসিয়া উঠিল, তাহা স্মরণ করিয়া বুকের ভিতর হইতে একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস বাহির হইয়া আসিল; না, সারদার নিকট যাওয়া উচিত নয়। বেচারী নিরুপায় বেদনায় মর্ম্মাহত হইবে মাত্র! রাখাল জানে, সারদার কি বিপুল আকাঙ্ক্ষা, দেব্‌তাকে নিজের হাতে সেবা-যত্ন করিবার। উন্মনা চিত্তে চায়ের সরঞ্জাম লইয়া রাখাল চা ঢালিতে প্রবৃত্ত হইল।

 

সারদা ও সবিতাতে আলাপ চলিতেছিল। সবিতা বলিলেন, তোমাদের সোনার-পুরের গল্প বলো সারদা, শুনি।

সারদা হাতে সেলাইয়ের কাজ করিতে করিতে জবাব দিল, আপনাকে যে একবার দেখেচে মা তাকে আর চিনিয়ে দিতে হবে না যে, রেণু আপনারই মেয়ে! কেবল চেহারাতেই সে আপনার মেয়ে হয়নি; বুদ্ধিতে, মর্য্যাদাশীলতায়, মনের আভিজাত্যে সে আপনারই প্রতিচ্ছবি।

সবিতা বলিলেন, সারদা, এমন করে কথা কইতে শিখলে তুমি কার কাছে? এ তো তোমার নিজের ভাষা নয়!

সারদা লজ্জিত হইয়া মাথা অবনত করিল।

রেণুর সম্বন্ধে এ সকল কথা তুমি আর কারও সাথে আলোচনা করেচো বুঝি? সারদা সলজ্জ সঙ্কোচে বলিল, হ্যাঁ সোনারপুরে দেব্‌তার সঙ্গে রেণুকে নিয়ে আমাদের আলোচনা হ’তো।

সবিতা হাসিয়া সারদার মাথায় পিঠে সস্নেহে হাত বুলাইয়া বলিলেন, তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে আমি জানি।

সারদা উৎসাহিত হইয়া বলিল, সত্যি মা, এত বেশী সাদৃশ্য বড় দেখা যায় না। রেণু যেন একেবারে আপনারই ছাঁচে গড়া।

সবিতা ত্রস্তগলায় বলিয়া উঠিলেন, না না, অমন কথা মুখে এনো না সারদা, আমার মতন যেন কিছুই না হয় তার।

সারদা একটু অপ্রস্তুত হইয়া বলিল, আচ্ছা, ও-কথা থাকুক এখন। কাকাবাবুর গল্প করি, কেমন?

সবিতা বলিলেন, বলো।

কাকাবাবু মানুষটি বড় ভাল, কিন্তু মা, সংসারে থেকেও তিনি সংসার-উদাসীন। গোবিন্দ গোবিন্দ করেই পাগল। ইহ-সংসারে গোবিন্দ ছাড়া কিছুরই প্রতি তাঁর আসক্তি আছে বলে মনে হয় না।

সবিতা রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করিলেন, নিজের মেয়ের প্রতিও না?

সবিতার শঙ্কাকুল মুখের পানে তাকাইয়া সারদা কৈফিয়তের সুরে বলিল, তিনি সংসারের সকল ভাবনা ইষ্টদেবের পায়ে সঁপে দিয়েচেন। তাঁর মেয়েও বোধ হয় তার বাইরে নয় মা।

সবিতা পাষাণ-প্রতিমার ন্যায় রহিলেন।

সারদা সান্ত্বনার স্বরে বলিল, আকুলি-ব্যাকুলি করেও তো মানুষ নিজে কিছুই পারে না। তার চেয়ে ভগবানের উপর নির্ভর করে থাকাই তো ভালো মা!

সবিতা আৰ্ত্ত-কণ্ঠে বলিলেন, তুমি বুঝবে না। তুমি নিজে সন্তানের মা হওনি যে! সন্তান যে কি, তা পুরুষমানুষ বোঝে না, যে-মেয়েরা মা হয়নি তারাও ঠিক বুঝতে পারে না। রেণুর সম্বন্ধে আজ আমি কি করে তোমার কাকাবাবুর মতো নিশ্চিন্ত থাকবো? চব্বিশ ঘণ্টা ওই গোবিন্দ গোবিন্দ করে দিনপাত করাতেই তো সংসারের সর্বনাশ ঘটেছে, ব্যবসার সর্ব্বনাশ ঘটেছে! কখনও কি চৈতন্য হ’ল না? মেয়েটার মুখ চেয়েও ধর্ম্মের ঝোঁক থেকে এখনও একটু নিবৃত্ত হতে পারলেন না।

সারদা ভীত-চক্ষে সবিতার আরক্তিম মুখের পানে তাকাইয়া রহিল। সবিতা উত্তেজিত অথচ অত্যন্ত মৃদুগলায় বলিতে লাগিলেন, এতকাল ভাবতাম আমার স্বামীর মতো স্বামী বুঝি কখনো কারও হয়নি, হবে না। এখন আমার সে ভুল ভেঙেচে। এখন বুঝেচি আমার স্বামীর মতো আত্মসর্ব্বস্ব মানুষ সংসারে অল্পই। নিজের স্ত্রী, নিজের সন্তানের প্রতিও যে-মানুষ অচেনার মতো উদাসীন, এমন মানুষের কি প্রয়োজন ছিল বিবাহ করার! বিবাহও করেচেন ওঁর গোবিন্দরই জন্য। বুঝলে সারদা, তোমরা যাকে ওঁর মহত্ত্ব বলে ভাবো, সেটা ঠিক তার উল্টো।

কার মহত্ত্ব উল্টো নতুন-মা? রাখাল ঘরে প্রবেশ করিতে কারতে হাসি-মুখে প্রশ্ন করিল।

সবিতা ঘাড় ফিরাইয়া শান্ত গলায় বলিলেন, তোমার কাকাবাবুর।

মুহূর্ত্তমধ্যে রাখালের হাস্যপ্রসন্ন মুখ গম্ভীর হইয়া উঠিল। সবিতা তাহা লক্ষ্য করিয়া হাসিয়া বলিলেন, আমার রাজু তার কাকাবাবুর এতটুকু নিন্দে সইতে পারে না।

রাখাল গম্ভীর-মুখেই বলিল, সেটা তো একটুও আশ্চর্য্য নয় মা। সংসারে কাকাবাবুরও যে নিন্দে হতে পারে, এইটেই কি সবচেয়ে আশ্চর্য্য নয়?

সবিতা বলিলেন, রাজু, আমি তোমার কাকাবাবুর নিন্দে করিনি। কিন্তু আজও যে—

রাখাল হাতজোড় করিয়া বলিল, আর কিছু বলবেন না মা। আমি আগেকার মানুষ, আজকের খবর জানিনে জানতে চাইওনে। যেটুকু আগের খবর জানি সেটুকু পাছে ভেঙে যায় সেই ভয়েই এখন সশঙ্ক হয়ে আছি।

সবিতা ক্ষণকাল রাখালের পানে চাহিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, পাগল ছেলে, এককালের জানা কখনও চিরকালের হতে পারে না। জোর করে তা করতে গেলে, হয় চোখ বুজে অন্ধ হয়ে থাকতে হয়, না হয় চরম ক্ষতির দুঃখ ভোগ করতে হয়। সংসারের এই নিয়ম। সবিতার কণ্ঠস্বরে গভীর স্নেহ উৎসারিত হইল।

রাখাল আর কথা কহিল না। সারদা উঠিয়া যাইতেছে দেখিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, তারক এখন বাড়ি আছে কি জানো সারদা?

সারদা বলিল, আজ তো কাছারি নেই। সম্ভবতঃ নীচে তাঁর অফিস-কামরাতেই আছেন।

রাখাল বলিল, তারকের সঙ্গে একটু দরকারী কথা আছে। আমি চললাম, নতুন-মা।

সবিতা বলিলেন, চা খেয়ে যেয়ো রাজু। সারদা, তুমি যে কচুরী তৈরী করেচো, রাজুকে চায়ের সঙ্গে দিতে ভুলো না।

সারদা হাসি-মুখে বলিল, সে তো উনি খেতে চাইবেন না মা, খেলেও নিন্দেই করবেন।

রাখালের মন আজ ভাল ছিল না। অন্য সময় হইলে সারদার এই কথা লইয়াই হয়তো তাহাকে ক্ষেপাইবার জন্য অনেক কিছু বলিত। চিত্ত আজ অপ্রসন্ন বলিয়াই বোধ হয় বিরসকণ্ঠে বলিল, না, ঘরের তৈরি খাবার খাওয়া আমার অভ্যাস নেই সারদা, ইচ্ছেও নেই। যাদের জন্য তৈরী করেচো, তাঁদেরই খাইয়ো।

সারদা বিস্মিত-নয়নে রাখালের পানে তাকাইয়া রহিল। তাহার বিবৰ্ণ মুখের প্রতি দৃষ্টি পড়ামাত্র রাখালের মনের মধ্যে বেদনা ধ্বক্ করিয়া উঠিল, কিন্তু কোনও কথা না কহিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

সবিতা সারদার পানে তাকাইয়া সস্নেহ সান্ত্বনার সুরে বলিলেন, ওর কথায় মনে দুঃখ পেয়ো না সারদা। আমার ’পরে রাগ করেই ও তোমাকে কঠিন কথা শুনিয়ে গেল। নানা কারণে রাজুর মনের অবস্থা এখন ভালো নেই মা।

অকারণে আকস্মিক ভর্ৎসিত হইয়া সারদা স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিল। সবিতার সান্ত্বনাবাক্যে রুদ্ধ বেদনা সংযম মানিল না। হঠাৎ ঝর্ ঝর্ করিয়া দুই চোখ বাহিয়া জল ঝরিয়া পড়িল।

অশ্রুপ্লাবিত সারদা আকুল স্বরে বলিল, আমি কি দোষ করেচি মা, দেব্‌তা যখনই যার উপরে রাগ করেন, আমাকেই বিঁধে কঠিন কথা শুনিয়ে চলে যান।

সারদাকে কাছে টানিয়া সবিতা বলিলেন, ও যে তোমাকে আপন জন বলেই মনে করে মা। তোমাকে সত্যিকারের স্নেহ করে বলেই না তোমার ’পরেই ওর যত আঘাত। ওর যে আপন বলতে সংসারে কেউ নেই সারদা।

সারদার উদ্বেলিত অশ্রুধারা তখনও সংযত হয় নাই। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে অভিমানের সুরে বলিল, আমারই যেন সংসারে সব-কেউ আছে মা। আমি তো কই যখন তখন কাউকে এমন করে কথার খোঁচায় বিঁধিনে।

সবিতা হাসিয়া বলিলেন, সকলের প্রকৃতি তো সমান হয় না মা।

সারদা বলিল, উনি জানেন, আমি সব কিছু সইতে পারি, কিন্তু ওঁর ঐ একটা বিদ্রূপ কিছুতেই সহ্য করতে পারিনে! এ জেনে-শুনে তবুও উনি আমাকে অমন করে বলেন।

সারদা চক্ষু মুছিতে মুছিতে উঠিয়া গেল।

 

রাখাল তারকের বসিবার ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সম্মুখের চেয়ারে উপবিষ্ট তারক মোকদ্দমার কাগজ-পত্র দেখিতে অভিনিবিষ্ট। রাখালের জুতোর আওয়াজে অল্প মাথা তুলিয়া তাকাইতে গিয়া চকিত হইয়া বিস্মিতকণ্ঠে বলিল, এ কি! রাখাল যে!

টেবিলের কাছাকাছি একখানি চেয়ারে বসিতে বসিতে রাখাল বলিল, কেন, আসতে নেই নাকি?

থাকবে না কেন, আসো না বলেই তো আসায় আশ্চর্য্য হচ্চি।

আসি তো প্রায়ই।

তা জানি; কিন্তু সে তো আমার কাছে নয়, অন্দর মহলে।

রাখাল হাসিয়া বলিল, অন্দরেই ডাক পড়ে, তাই সেখানে আসি।

তারক রহস্য তরল-কণ্ঠে কহিল, আজ কি সদর থেকে ডাক পেয়েচো না-কি?

না, আজ সদরকে আমারই প্রয়োজন।

নিশ্চয় কোনও মামলার ব্যাপার নয় আশা করি।

মামলাই বটে। দুনিয়ার কোন ব্যাপারটা মামলার অন্তর্গত নয় বলতে পারো?

তারক হাসিতে লাগিল।

রাখাল বলিল, শুনলাম, বেশ ভালো রকম প্র্যাক্‌টিস হচ্ছে তোমার!

মৃদু ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া তারক বলিল, তোমাকে কে বললে?

যেই বলুক, কথাটা তো সত্যিই। এবার ইতর জনদের মধ্যে মিষ্টান্ন বিতরণের ব্যবস্থা করো একদিন।

তারক বলিল, পাগল হয়েচো তুমি। কোথায় প্র্যাক্‌টিস? এখন তো শুধু সিনিয়রের দরজায় ধর্ণা দিয়ে পড়ে থাকা, আর তাঁর যত-কিছু খাটুনির বোঝা গাধার মত বওয়া।

রাখাল বলিল, তাই নাকি? তা হলে বিমলবাবু ভুল বলেচেন বোধ হয়? তারক চকিত হইয়া বলিল, বিমলবাবু তোমাকে এ-কথা বলেচেন নাকি? হ্যাঁ।

তাঁর সঙ্গে কবে দেখা হ’লো? কি বলেচেন বল তো? তারকের কণ্ঠস্বরে আগ্রহ।

রাখাল হাসিয়া বলিল, সে অনেক কথা। তুমি এখন ব্যস্ত রয়েছো। শোনবার সময় হবে কি?

হবে— হবে। তুমি বলো।

তারকের চোখে-মুখে ব্যগ্র কৌতূহল লক্ষ্য করিয়া রাখাল মনে মনে হাসিলেও মুখে নির্ব্বিকার ভাব বজায় রাখিয়া বলিল, চলো সামনের পার্কে বসে কথা কই গে।

তারক বলিল, বেশ, তাই চলো।

ব্রীফের তাড়া ক্ষিপ্র হস্তে গুছাইয়া ফিতা বাঁধিতে বাঁধিতে তারক বলিল, বোসো, বাড়ির ভিতর গিয়ে একটু চারের ব্যবস্থা করে আসি। চা খেয়ে একেবারে বেরুনো যাবে।

রাখাল বলিল, আমি যে এইমাত্র বাড়ির ভিতরে বলে এসেচি, চা খাবো না।

তারক সংক্ষেপে বলিল, তা হোক। চায়ের ব্যাপারে ‘না’ কে ‘হ্যাঁ’ করলে দোষ নেই।

তারক দ্রুতপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলে, রাখাল দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়া নানা কথা ভাবিতে লাগিল।

গায়ে মুগার পাঞ্জাবি, পায়ে গ্রিসিয়ান্ স্লিপার চড়াইয়া তারক ফিরিয়া আসিল। তার পিছু পিছু ঝি ট্রেতে করিয়া চা এবং দুই প্লেট কচুরী লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। রাখাল বিনা বাক্যব্যয়ে চায়ের পেয়ালা ও কচুরীর প্লেট লইয়া সদ্ব্যবহার শুরু করিয়া দিল। অল্প সময়ের মধ্যে প্লেট শূন্য করিয়া বলিল, তারক, তোমাদের চা-দায়িনীকে একবার স্মরণ করতে পারো?

তারক চায়ে চুমুক দিতে দিতে হাঁকিল, শিবুর মা—এদিকে শুনে যাও।

ঝি আসিলে রাখাল বলিল, বাড়ির ভিতরে গিয়ে বলো, রাজুবাবু আরও খানকয়েক কচুরী খেতে চাইলেন।

ঝি চলিয়া গেল। তারক খাইতে খাইতে হাসিয়া বলিল, রাজুবাবু খান-কয়েক কচুরী খেতে চাইচেন শুনলে এক-ঝুড়ি কচুরী এসে পড়বে কিন্তু বাড়ির ভিতর থেকে।

রাখাল দ্বিতীয় পেয়ালা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলিল, আর তারক বাবু খেতে চেয়েচেন শুনলে একগাড়ি কচুরী আসবে বোধ হয়।

কচুরীর ‘ক’ও আসবে না! শুধু সংবাদ আসবে ফুরিয়ে গেছে। বাজার থেকে গরম কচুরী এখুনি কিনে আনিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটু অপেক্ষা করতে হবে।

রাখাল হাসিল, ভ্রূকুটি করিল। বলিল, তাই নাকি?

তারক বলিল, একটুও বাড়িয়ে বলিনি।

আধঘোমটা টানা প্রৌঢ়া দাসী শিবুর মা অহেতুক অতি-সঙ্কোচে জড় সড় হইয়া এক প্লেট গরম কচুরী আনিয়া রাখালের সামনে ধরিয়া দিল। তারক হাসিয়া বলিল, দেখলে তো? একেবারে ডজন হিসেবে এসে গেছে।

রাখাল মৃদু হাসিয়া শিবুর মাকে উদ্দেশ করিয়া বলিল, আমি তো রাক্ষস নই বাছা! এতগুলো কচুরী এনেচো কেন? তা এনেচো যখন, খাচ্ছি সবগুলিই। কিন্তু কচুরী তুমি বাপু ভালো তৈরী করতে পারোনি, বুঝলে? যা ঝাল দিয়েচো— পেটের ভিতর পর্য্যন্ত জ্বালা করচে। একটু ঝালটা কম দিলেই ভালো করতে।

শিবুর মা অবগুণ্ঠনটি আরও খানিক টানিয়া লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া অস্ফুটকণ্ঠে কহিল, কচুরী তো আমি তৈরী করিনি। দিদিমণি করেচেন।

ও! তাই কচুরীতে এত ঝাল।

 

তারককে লইয়া রাখাল যখন পার্কে গিয়া বসিল, অপরাহ্ণ হইয়াছে।

তারক বলিল, বহুদিন বাদে তোমার সঙ্গে পার্কে বেড়াতে আসা হলো আজ।

প্রত্যুত্তরে রাখাল একটু শুষ্ক হাসিল। তারক তাহা লক্ষ্য করিয়া মনে মনে ঈষৎ অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করিলেও বাহিরে সহজভাব বজায় রাখিয়া বলিল, হ্যাঁ, কি বলবে বলছিলে? বিমলবাবুর কাছে তুমি কি শুনেচো আমার সম্বন্ধে?

রাখাল বলিল, শুনেচি তুমি খুব ভালো কাজকর্ম্ম করচো। তোমার ভবিষ্যৎ অতিশয় উজ্জ্বল। তোমার মত উদ্যোগী ও পরিশ্রমী যুবার জীবনে উন্নতি অনিবাৰ্য্য।

রাখালের কণ্ঠে বিদ্রূপের সুর না থাকিলেও তাহার বলিবার ভঙ্গিতে তারক উহাকে উপহাস বলিয়াই মনে করিল। ভিতরে ভিতরে জ্বলিয়া গেলেও বাহিরে শান্তভাবেই বলিল, তোমাকে ডেকে বিমলবাবুর হঠাৎ এ-সব কথা বলার মানে কি?

তা কি করে জানবো!

তারক গম্ভীর হইয়া পড়িল। জিজ্ঞাসা করিল, তোমার আর কিছু বলবার আছে কি?

রাখাল বলিল, আছে।

সেটা বলে ফেলো। বিকাল-বেলায় নিশ্চিন্ত হয়ে বসে পার্কে হাওয়া খাওয়ার উপযুক্ত বড়মানুষ আমি নই। দেখেইচ তো তুমি, কাজ ফেলে রেখে উঠে এসেচি।

তারকের উষ্মায় রাখাল হাসিল। বলিল, ওকালতি পেশা যাদের, তাদের অতো অধৈর্য্য হতে নেই হে। একটু থামিয়া পুনরায় বলিল, একটা গুরুতর বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্যই তোমাকে এখানে ডেকে আনলাম তারক!

তারক নির্ব্বাক রহিল।

রাখাল গম্ভীর-মুখে বলিল, তোমার বিয়ের প্রস্তাব এনেচি।

রাখালের মুখের পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া তারক বলিল, পরিহাস করচো?

পরিহাস করবার জন্য তোমার কাজের ক্ষতি করে এখানে ডেকে আনিনি। সত্যিই আমি তোমার বিবাহের প্রসঙ্গ তুলতে এসেচি।

তা হলে ওটা আর না তুলে এইখানেই সাঙ্গ করে ফেলা ভালো। কারণ বিবাহ করার মত সঙ্গতি ও সুমতি কোনটাই আমার হয়নি, দেরি আছে।

রাখাল বলিল, ধরো এ বিবাহে যদি তোমার সঙ্গতির অভাব পূর্ণ হয়ে যায়?

তা হলেও নয়। কারণ, আমি নিজে উপার্জ্জনশীল না হওয়া পর্য্যন্ত বিবাহের দায়িত্ব নিতে নারাজ।

ধরো, এ-বিবাহ দ্বারা যদি তোমার উপার্জ্জনের দিক দিয়েও সত্ত্বর উন্নতি ঘটে? তা হলে তো আপত্তি নেই।

তারক সন্দিগ্ধ-নয়নে রাখালের মুখের পানে চাহিয়া বলিল, পাত্রী কে? কোন উকীল-ব্যারিস্টারের মেয়ে বুঝি?

না। নিতান্ত সঙ্গতিহীন নিরাশ্রয়ের কন্যা।

তবে যে বললে—এ বিবাহে—

হ্যাঁ, ঠিকই বলেচি। দরিদ্রের কন্যা বিবাহ করেও সম্পত্তিলাভ একেবারে বিচিত্র নয়। ধরো, তার কোনও ধনী আত্মীয়ের যাবতীয় সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারিণী সে—

কে সে মেয়েটি?

তুমি রাজী কি না আগে বলো।

পরিচয় না জেনে বলতে পারবো না।

কি পরিচয় চাও জিজ্ঞেসা করো। মেয়ের বংশ পরিচয়, রূপ, গুণ, শিক্ষা?

তারক ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া বলিল, ভাবী পত্নী সম্বন্ধে সবই জানা দরকার।

রাখাল অল্পক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, পাত্রী সুন্দরী বললে অল্প বলা হবে, পরমাসুন্দরী। গুণবতী, বুদ্ধিমতী, সুশিক্ষিতা। উচ্চ ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেচে। পিতা এককালে ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন বটে, বর্ত্তমানে কপর্দ্দকশূন্য। পিতৃ-সম্পত্তি না পেলেও পাত্রী মাতৃধনের অধিকারিণী। সে ধনের পরিমাণও নিতান্ত সামান্য নয়। কুলে মেলে গোত্রে তোমাদের পাল্‌টি ঘর। সকল দিক দিয়ে যে কোনও সুপাত্রের যোগ্য পাত্রী।

পাত্রীর পিতার নাম, ধাম ও উপস্থিত পেশা কি জানতে পারি?

তারই উপরে কি তোমার মতামত নির্ভর করচে?

না—হ্যাঁ, তা সম্পূর্ণ না হোক, কতকটা নির্ভর করে বৈকি!

রাখাল আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া, পরে আস্তে আস্তে বলিল, পাত্রীর পিতা তোমার অচেনা নয়। আমি ব্রজবিহারীবাবুর মেয়ের কথা বলচি—

তারক চমকাইয়া উঠিল, সে কি? তুমি কোন মেয়েটির কথা বলচো?

রেণুর।

তুমি কি উন্মাদ হয়েছো রাখাল? তারকের কণ্ঠে তীব্র বিস্ময় ধ্বনিত হইয়া উঠিল। রাখাল তারকের প্রতি অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, উম্মাদ হলে তো ভালো হ’তো; কিন্তু হতে পারচি কই?

উত্তেজিত কণ্ঠে তারক বলিল, হতে আর বাকিই বা কি? নইলে, নতুন-মার মেয়ে রেণুর সঙ্গে কখনো আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে পারো?

রাখাল বলিল, তা, এতে তোমার এত বিস্মিত বা উত্তেজিত হওয়ার কি আছে?

যথেষ্ট আছে। এ নিশ্চয় তোমার ষড়যন্ত্র! তুমি নতুন-মাকেও বোধ হয় এই পরামর্শ দিয়েছো?

রাখাল নির্লিপ্তভাবেই বলিল, না। আমার পরামর্শের অপেক্ষা রাখেননি। ওঁরা বহুপূর্ব্ব থেকে রেণুর জন্য তোমাকে পাত্র নির্ব্বাচন করে রেখেছেন। আমি জানতাম না এ-খবর।

তারক দৃঢভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল, হতেই পারে না—মিথ্যে কথা।

রাখাল স্থির-কণ্ঠে বলিল, দেখ তারক, তুমি বেশ জানো, আমি মিথ্যে কথা বলিনে।

তারকের চড়া গলা এবার নিম্নগ্রামে নামিয়া আসিল, বলিল, তুমি কেন রেণুকে বিবাহ করো না।

রাখাল উত্তর দিল, আমি যোগ্য পাত্র নই। রেণুর অভিভাবকেরা এ-কথা জানেন।

তারক সবিদ্রূপ-কণ্ঠে বলিল, আর হতভাগ্য আমিই বুঝি হলাম সব-রকমে তাঁদের কন্যার সুযোগ্য পাত্ৰ?

তুমি পাশ করা বিদ্বান ছেলে—বুদ্ধিমান, স্বাস্থ্যবান, চরিত্রবান।

হ্যাঁ, অনেকগুলি বাণ ছুঁড়ে মারলে, কিন্তু এটা কি বিবেচনায় এলো না, যে, ঐ মেয়েকে আমি আমার পিতৃবংশের কুলবধুরূপে গ্রহণ করতে পারিনে! গরীব হতে পারি, কিন্তু মর্য্যাদাহীন এখনও হইনি।

রাখাল ক্রোধস্তম্ভিত কণ্ঠে হাকিল, তারক—

সত্য বলতে ভয় করো কিসের জন্য? তুমি নিজে ঐ মেয়েকে বিয়ে করে আনতে পারো—

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তারকের পানে তাকাইয়া রাখাল বলিল, সেই মেয়েরই মায়ের আশ্রয়ে থেকে, তাঁরই সাহায্য নিয়ে, নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে বুঝি তোমার বংশমর্য্যাদা ও কৌলীন্যের গৌরব উজ্জ্বল হয়ে উঠেচে? তারক নিজের মনুষ্যত্বকে দলিত করে যদি উন্নতির রাস্তা তৈরী করো, তোমাকে অবনতির অতলেই ঠেলে নিয়ে যাবে জেনো।

তারক ক্ষিপ্তের মত লাফাইয়া উঠিল। বলিল, শাট আপ। মুখ সামলে কথা কও রাখাল! তুমি জানো কি এদের প্রত্যেকটি পয়সা আমি হিসেব করে শোধ করে দেবো? এই সৰ্ত্তেই আমি কর্জ্জরূপে এ সাহায্য গ্রহণ করেছি ওদের কাছে।

রাখাল হাসিয়া উঠিল। বলিল, ও, তাই নাকি? তবে আর কি? কর্জ্জ শোধ যখন করে দেবে, ওদের সঙ্গে তোমার কৃতজ্ঞতার সম্পর্ক আর কি থাকতে পারে। কি বল? না হয় কিছু সুদ ধরে দিলেই হবে!

তারক রুক্ষ-গলায় বলিল, দেখো রাখাল, এসব বিষয় নিয়ে বিদ্রূপ করো না। নিজে যা পারো না, অন্যকে তা করবার জন্য বলতে তোমার লজ্জা করে না?

সে-কথার জবাব না দিয়া রাখাল বলিল, তোমার সম্বন্ধে তা হলে দেখছি ভুল করিনি। আমি জানতাম তুমি এই রকম কিছু বলবে। তবু যখন শুনলাম, নতুন-মা নাকি তোমাকে এ-সম্বন্ধে আগেই একটু জানিয়ে রেখেচেন, তখন আশা করেছিলাম হয়তো বা তোমার অমত না-ও হতে পারে!

তারক দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, নতুন-মা কোনদিন এমন কথা আমাকে বলেননি, বলতে সাহসও করবেন না জেনো। তিনি জানেন, তারক রাখাল নয়। এ প্রস্তাব রাখালের কাছে করতে পারেন, কিন্তু তারকের কাছে নয়।

উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া তারক দ্রুতপদে হন্ হন্ করিয়া পার্ক হইতে বাহির হইয়া গেল।