শিক্ষার বিরোধ[১]

এতদিন এদেশে শিক্ষার ধারা একটা নির্বিঘ্ন নিরুপদ্রব পথে চলে আসছিল। সেটা ভাল কি মন্দ, এ বিষয়ে কারও কোন উদ্বেগ ছিল না। আমার বাবা যা পড়ে গেছেন, তা আমিও পড়ব। এর থেকে তিনি যখন দু’পয়সা করে গেছেন, সাহেব-সুবোর দরবারে চেয়ারে বসতে পেয়েছেন, হ্যাণ্ডশেক করতে পেয়েছেন, তখন আমিই বা কেন না পারবো? মোটামুটি এই ছিল দেশের চিন্তার পদ্ধতি। হঠাৎ একটা ভীষণ ঝড় এল। কিছুদিন ধরে সমস্ত শিক্ষাবিধানটাই বনিয়াদ সমেত এমনি টলমল করতে লাগল যে, একদল বললেন পড়ে যাবে। অন্যদল সভয়ে মাথা নেড়ে বললেন, না, ভয় নেই—পড়বে না। পড়লও না। এই নিয়ে প্রতিপক্ষকে তাঁরা কটু কথায় জর্জরিত করে দিলেন। তার হেতু ছিল। মানুষের শক্তি যত কমে আসে, মুখের বিষ তত উগ্র হয়ে ওঠে। বাইরে গাল তাঁরা ঢের দিলেন, কিন্তু অন্তরে ভরসা বিশেষ পেলেন না। ভয় তাঁদের মনের মধ্যেই রয়ে গেল, দৈবাৎ বাতাসে যদি আবার কোনদিন জোর ধরে ত এই গোড়া-হেলা নড়বড়ে অতিকায়টা হুমড়ি খেয়ে পড়তে মুহূর্ত বিলম্ব করবে না।

এমনি যখন অবস্থা তখন শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিলেত থেকে ফিরে এলেন, এবং পূর্ব ও পশ্চিমের শিক্ষার মিলন সম্বন্ধে উপর্যুপরি কয়েকটা বক্তৃতায় তাঁর মতামত ব্যক্ত করলেন।

রবীন্দ্রনাথ আমার গুরুতুল্য পূজনীয়। সুতরাং মতভেদ থাকলেও প্রকাশ করা কঠিন। কেবলি ভয় হয় পাছে অজ্ঞাতসারে তাঁর সম্মানে কোথাও লেশমাত্র আঘাত করে বসি। কিন্তু এ তো কেবলমাত্র ব্যক্তিগত মতামতের আলোচনা নয়,—যা তাঁরও বহু পূজ্য,—সেই দেশের সঙ্গে এ বিজড়িত। তাঁর কথা নিয়ে কয়েকটা Anglo-Indian কাগজ একেবারে উল্লসিত হয়ে উঠেছে। থেকে থেকে তাদের প্যাঁচালো উপদেশের আর বিরাম নেই। আর কিছু না হোক দেশের হিতাকাঙ্খায় এদের যখন বুক ফাটতে থাকে তখনি ভয় হয়, ভেতরে কোথাও একটা বড় রকমের গলদ আছে। বিশেষ করে বাঙ্গালী পরিচালিত একখানা Anglo-Indian কাগজ। এর মুখের ত আর কামাই নেই। নিজের বুদ্ধি দিয়ে কবির কথাগুলো বিকৃত, বিধ্বস্ত করে অবিশ্রাম বলছে—আমরা বলে বলে গলা ভেঙ্গে ফেলেছি, ফল হয়নি,—এখন রবিবাবু এসে রক্ষে করে দিলেন। যথা—

“And if there were any among educated Bengalees, who were wavering and vacillating, knowing not what to do,—to exclude the West or to stick to the East—Rabindranath’s recent Calcutta lectures have gone a great way towards making up their minds. They have given up their sitting-on-the-fence posture; they have jumped off on the Western side.”

অর্থাৎ আমরা দেশের শিক্ষিত সমাজ বেড়ার ডগায় বসেছিলাম, পশ্চিম-প্রত্যাগত কবির ইঙ্গিতে ‘জয়রাম’ বলে পশ্চিম দিকেই লাফিয়ে পড়লাম! বাঁচা গেল! শিক্ষিত সমাজের এতদিনে একটা কিনারা হল! কিন্তু শিক্ষিতের দল যা নিয়ে এতবড় রৈরৈ করেন, যাঁদের অশিক্ষিত অজ্ঞ প্রভৃতি বিশেষণে অভিহিত করতে বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ অনুভব করেন না,—তাঁদের যুক্তিতর্কে এর কি মূল্য দাঁড়ায় একবার সেটাও ওজন করা ভাল। কিন্তু মোটের উপর পূর্ব ও পশ্চিমের শিক্ষার মিলনে আসল কথা কবি কি বলেছেন?

প্রথম কথা বলেছেন এই যে, আজকের দিনে পশ্চিম জয়ী হয়েছে সুতরাং সেই জয়ের কৌশলটা তাদের কাছে আমাদের শেখা চাই। বেশ। দ্বিতীয় কথা, লড়াইয়ের পরে, পশ্চিম শোকাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করছে, ‘ভারতের বাণী কৈ?’ অতএব তাদের সেটা বলে দেওয়া আবশ্যক। এও ভাল কথা। আমি যতদূর জানি অসহযোগপন্থীর কেউ এ বিষয়ে কোন আপত্তি করে না। তৃতীয় দফায় কবি উপনিষদের ঋষিবাক্য উদ্ধৃত করে বলেছেন, “ঈশাবাস্যমিদং সর্ব্বম্‌” অতএব “মা গৃধঃ”। চমৎকার কথা,—কারও কোন দ্বন্দ্ব নেই। এ যে একটা তত্ত্ব নয়, সমস্ত দুনিয়ায় এও কেউ লোকসমাজে অস্বীকার করে না, অথচ মানুষের এমন পোড়া স্বভাব যে, সে সরল ও সহজ সত্য কিছুতেই সোজা করে বলে মিটিয়ে নেবে না। আপন আপন স্বার্থ ও প্রয়োজন মত, তার মধ্যে অসংখ্য sub-clause, অগণিত qualification-এর আমদানি করে তাকে এমনি ভারাক্রান্ত করে তুলবে যে, তত্ত্বকথা আপনি হেঁয়ালি হয়ে দাঁড়াবে। তখন অসঙ্কোচে তাকে সত্য বলে চিনে নেওয়াই কঠিন। শুধু এই জন্যই উপস্থিত fact গুলোই সংসারে সত্যের মুখোশ পরে, মানুষের কর্ম ও চিন্তার ধারার মধ্যে অনধিকার প্রবেশ করে, অপরিমেয় অনর্থের সূচনা করে দেয়।

কবি প্রথমেই বলেছেন :

“এ কথা মানতেই হবে যে, আজকার দিনে পৃথিবীতে পশ্চিমের লোক জয়ী হয়েছে। পৃথিবীকে তারা কামধেনুর মত দোহন করেছে, তাদের পাত্র ছাপিয়ে গেল।…অধিকার ওরা কেন পেয়েছে? নিশ্চয়ই সে কোন একটা সত্যের জোরে।”

আজকের দিনে এ কথা অস্বীকার করবার জো নেই যে, পৃথিবীর বড় বড় ক্ষীরভাণ্ডেই সে মুখ জুবড়ে আছে,—তার পেট ভরে দুই কস বেয়ে দুধের ধারা নেমেছে—কিন্তু আমরা উপবাসী দাঁড়িয়ে আছি।

এ একটা fact; আজকের দিনে একে কিছুতেই ‘না’ বলবার পথ নেই,—আমরা উপবাসী রয়েছি সত্যই কিন্তু তাই বলেই কি এই কথা মানতেই হবে যে, এ অধিকার পেয়েছে তারা নিশ্চয়ই একটা সত্যের জোরে? এবং এই সত্য তাদের কাছ থেকে আমাদের শিখতেই হবে। লোহা মাটিতে পড়ে, জলে ডোবে, এ একটা fact, কিন্তু একেই যদি মানুষে চরম সত্য মেনে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকত ত আজকের দিনে নীচে, জলের উপর এবং ঊর্ধ্বে আকাশের মধ্যে লোহার জাহাজ ছুটে বেড়াতে পারত না। উপস্থিত কালে যা fact তাই কেবল শেষ কথা নয়। মাসের ১লা তারিখে যে লোকটা তার বিদ্যের জোরে আমার সারা মাসের মাইনে গাঁট কেটে নিয়ে ছেলেপুলে সমেত আমাকে অনাহারে রাখলে, কিংবা মাথায় একটা বাড়ি মেরে সমস্ত কেড়ে নিয়ে রাস্তার ওপরে চাটের দোকানে বসে ভোজ লাগালে—এ ঘটনা সত্য হলেও কোন সত্য অধিকারে বলতে পারব না, কিংবা এ দুটো মহাবিদ্যে শেখবার জন্যে তাদের শরণাপন্ন হতে হবে এও স্বীকার করতে পারব না। তা ছাড়া গাঁটকাটা কিছুতেই বলে দেবে না পয়সা কোথায় রাখলে কেটে নেওয়া যায় না, অথবা ঠেঙালেও শিখিয়ে দেবে না কি করে তার মাথায় উলটে লাঠি মেরে আত্মরক্ষা করা যায়। এ যদি বা শিখতেই হয়, ত সে অন্য কোথাও—অন্ততঃ তাদের কাছে নয়। কবি জোর দিয়ে বলেছেন, এ কথা মানতেই হবে পশ্চিম জয়ী হয়েছে এবং সে শুধু তাদের সত্য বিদ্যার অধিকারে। হয়ত মানতেই হবে তাই। কারণ সম্প্রতি সেই রকমই দেখাচ্ছে। কিন্তু কেবল মাত্র জয় করেছে বলে এই জয় করার বিদ্যাটাও সত্য বিদ্যা, অতএব শেখা চাই-ই, এ কথা কোন মতেই মেনে নেওয়া যায় না। গ্রীস একদিন পৃথিবীর রত্নভাণ্ডার লুটে নিয়ে গিয়েছিল, রোমও তাই করেছিল। আফগানেরাও বড় কম করেনি,—কিন্তু সেটা সত্যের জোরেও নয়, সত্য হয়েও থাকেনি। দুর্যোধন একদিন শকুনির বিদ্যার জোরে জয়ী হয়ে পঞ্চপাণ্ডবকে দীর্ঘকাল ধরে বনে-জঙ্গলে উপবাস করতে বাধ্য করেছিল, সেদিন দুর্যোধনের পাত্র ছাপিয়ে গিয়েছিল, তার ভোগের অন্নে কোথাও একটি তিলও কম পড়েনি, কিন্তু তাকেই সত্য বলে মেনে নিলে যুধিষ্ঠিরকে ফিরে এসে সারা জীবন কেবল পাশাখেলা শিখেই কাটাতে হোতো। সুতরাং সংসারে জয় করা বা পরের কেড়ে নেওয়ার বিদ্যাটাকেই একমাত্র সত্য ভেবে লুব্ধ হয়ে ওঠাই মানুষের বড় সার্থকতা নয়। তা ছাড়া জয় কি কেবল নির্ভর করে বিজেতার উপরেই? আফগান যখন হিন্দুস্থান জয় করেছিল, সে কি তার নিজের গুণে? হিন্দুস্থান দেশ হারিয়েছিল তার নিজের দোষে। সেই ত্রুটি সংশোধন করার বিদ্যে তার নিজের মধ্যেই ছিল, বিজেতা আফগানের কাছে শেখবার কিছুই ছিল না।

আবার এমন দৃষ্টান্তও ইতিহাসে দুষ্প্রাপ্য নয় যখন বিজেতাই পরাজিতের কাছে কি বিদ্যা, কি ধর্ম, কি সভ্যতা, কি ভদ্রতা সমস্তই শিক্ষা করে আর একদিন মানুষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কে বলেছে, সত্যকার বিষয় যদি কিছু তার থাকে তা শিখতে হবে না? কে বলেছে, তার দ্বার পশ্চিমমুখো থাকলে তাকে অহিন্দু বলে বয়কট করতে হবে? কি পদার্থবিদ্যা, কি রসায়নশাস্ত্র, কি ধনবিজ্ঞান—এ-সকল পশ্চিমি বিদ্যে শেখবার আবশ্যক নেই বলে কে বিবাদ করছে? বিবাদ যদি কিছু থাকে সে তার বিদ্যার উপরে নয়—সে তার শেখানোর ভান করার ওপর, শিক্ষার বদলে কুশিক্ষার আয়তনের ওপর। এতকাল এই তামাশায় যোগ দিয়ে পাগলের মত সবাই নেচে বেড়াচ্ছিল, এখন হঠাৎ জন-কয়েক লোকের চৈতন্য হওয়ায় তারা পেছিয়ে দাঁড়িয়ে এই ফাঁকিটাকে কেবল আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে—এই ত দেখি আসলে মতভেদের কারণ।

এই বস্তুটাকেই একটু বিশদ করে দেখবার চেষ্টা করা যাক। পশ্চিমের পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্র যতখানি বেড়ে উঠেছে গত যুদ্ধের সময়, এতখানি এইটুকু সময়ের মধ্যে বোধ করি আর কখনো হয়নি। মানুষ মারবার নব নব কৌশল এরা যত আবিষ্কার করেছে ততই আনন্দে দম্ভে এদের বুক ভরে উঠেছে। এই বিজ্ঞানের সাহায্যে আগুন দিয়ে, বিষ দিয়ে পুড়িয়ে গ্রামকে গ্রাম, শহরকে শহর ধ্বংস করবার কত ফন্দিই না এরা বার করেছে এবং আরও কত বার করত এই যুদ্ধটা আরও কিছুদিন অগ্রসর হলে। সৌভাগ্য এবং সভ্যতার বোধ করি এদের এই একটিমাত্র মাপকাঠি—কে কত অল্প পরিশ্রমে কত বেশী মানব হত্যা করতে পারে। এদের কাছে বিজ্ঞানের এইটাই হচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড় প্রয়োজন। এ যে দেখতে না পায় সে অন্ধ এবং এই বিদ্যাটা অপরকে এরা শিখাতে পারে, কিংবা শেখবার সুযোগ দিতে পারে, অতি বড় কবি-কল্পনাতেও এ আমি ভাবতে পারি না। কথা উঠতে পারে, মানবের কল্যাণকর এমন কি কিছুই এর থেকে আবিষ্কৃত হয়নি? হয়েছে বৈ কি। কিন্তু সে নিতান্তই by-product-এর মত বলা যেতে পারে। হোক by-product কিন্তু সে যখন মানবের হিতার্থে, তখন সেই বিদ্যাগুলো আয়ত্ত করেও ত আমরা মানুষ হতে পারি! হয়ত পারি। কিন্তু ঠিক ও উপায়ে নয়। পশ্চিমের সভ্যতার অহঙ্কার অভ্রভেদী। আমাদের এবং আমাদের মত আরও অনেক দুর্ভাগা জাতির কাঁধে যখনই ওরা চেপে থাকে তখনই ঘরে বাইরে এই কৈফিয়ত দেয় যে, এগুলো দেখতে শুনতে মানুষের মত হলেও ঠিক মানুষ নয়। অন্ততঃ সাবালক মানুষ নয়, ছেলেমানুষ। বেলজিয়ম যখন রবারের জন্য নিগ্রোদের দেশে গিয়ে নিগ্রোদেরই হাত কেটে দিত তখনও সেই অজুহাতই তারা দিয়েছিল যে, এরা আমাদের হুকুম মানতে চায় না। এরা অসভ্য। অতএব আমরা গায়ে পড়ে এদের সভ্য করবার, মানুষ করবার ভার যখন নিয়েছি তখন মানুষ এদের করতেই হবে। অতএব শিক্ষার জন্য এদের কঠোর শাস্তি দেওয়া একান্তই আবশ্যক। তথাস্তু বলা ছাড়া ওর যে আর কি জবাব আছে আমি জানি না। আমাদের অর্থাৎ ভারতবাসীর সম্পর্কে প্রশ্ন উঠলেও ইংরাজ ঠিক এই জবাবটাই দিয়ে আসছে যে, এরা অর্ধসভ্য—ছেলেমানুষ। এদের দেশে প্রচুর অন্ন, কিন্তু পাছে অবোধ শিশুর মত বেশি খেয়ে পীড়িত হয়ে পড়ে তাই এদের মুখের গ্রাস নিজেদের দেশে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি—সে এদেরই ভালোর জন্যে।

আবার টাকাকড়িগুলো পাছে অপব্যয় করে নষ্ট করে ফেলে তাই সে-সমস্ত দয়া করে আমরাই খরচ করে দিচ্ছি; সেও এদেরই মঙ্গলের নিমিত্ত। এমনি সব ভালো করার কত কি অফুরন্ত কাহিনী ডেকে হেঁকে প্রচার করছেন—কত কষ্ট করে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে এদের মানুষ করতে এসেছি;—কারণ মানুষ করার sacred duty যে আমাদেরই ওপরে। কিন্তু আঃ,—গেলাম! By law established হয়ে এই ইণ্ডিয়ানগুলোকে মানুষ করতে করতেই হয়রান হয়ে মোলাম।

ভগবান জানেন কবে এরা আবার by law disestablished হবে! কবে আমরা মানুষ হয়ে এদের দুশ্চিন্তা মুক্ত করতে পারব! দেড়-শ’ বছর ধরে তালিম দেওয়া চলছে, কিন্তু মানুষ আর হলাম না। কবে যে হতে পারব সেও ওরাই জানে আর জগদীশ্বর জানেন। কিন্তু ঐ দেড়-শ’ বছরেও যদি ওই মোহ আমাদের ঘুচে না থাকে, যে এদের শিক্ষা-ব্যবস্থায় সত্যিই একদিন মানুষ হয়ে উঠব, সত্যি সত্যিই আমাদের মানুষ করে নিজেদের মৃত্যুবাণ স্বেচ্ছায় আমাদের হাতে তুলে দিতে এরা ব্যাকুল, তা হলে আমি বলি আমাদের কোন কালে মানুষ না হওয়াই উচিত! ভগবান যেন কোন দিন এই দুর্ভাগাদের পরে প্রসন্ন না হন!

বস্তুতঃ, এ কথা বোঝা কি এতই কঠিন যে, বিজ্ঞানের যে শিক্ষায় মানুষ যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠে, তার আত্মসম্মান জাগ্রত হয়ে দাঁড়ায়, সে উপলব্ধি করে সেও মানুষ, অতএব স্বদেশের দায়িত্ব শুধু তারই, আর কারও নয়,—পরাজিতের জন্য এমনি শিক্ষার ব্যবস্থা বিজেতা কি কখনও করতে পারে? তার বিদ্যালয়, তার শিক্ষার বিধি সে কি নিজের সর্বনাশের জন্যেই তৈরি করিয়ে দেবে? সে কেবলমাত্র এইটুকুই দিতে পারে যাতে তার নিজের কাজগুলি সুশৃঙ্খলায় চলে। তার আদালতে বিচারের বহুমূল্য অভিনয় করতে উকীল, মোক্তার, মুন্সেফ, হুকুম মত জেলে দিতে ডেপুটি, সব্‌ডেপুটি, ধরে আনতে থানায় ছোট-বড় পিয়াদা, ইস্কুলে ডুবালের পিতৃভক্তির গল্প পড়াতে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মাস্টার, কলেজে ভারতের হীনতা ও বর্বরতার লেকচার দিতে নখদন্তহীন প্রফেসার, আফিসে খাতা লিখতে জীর্ণ-শীর্ণ কেরানী,—তার শিক্ষাবিধান এর বেশি দিতে পারে এও যে আশা করতে পারে, সে যে পারে না কি আমি তাই শুধু ভাবি। অথচ কবি বলেছেন বাঁচবার বিদ্যা, কিংবা মানুষ হবার বিদ্যা আছে কেবল শুক্রাচার্যের হাতে, আজ তার বাড়ি পশ্চিমে। সুতরাং মানুষ হতে যদি চাই তার আশ্রমে আজ আমাদের দৌড়াতেই হবে, ‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়’। অমৃত-লোকের লোক হয়েও কচকে তার শিষ্যত্ব স্বীকার করতে হয়েছিল। হয়েছিল সত্য, কিন্তু বিদ্যা ত কচ সহজে আদায় করতে পারেনি, গুরুদেবের ভোজ্য পদার্থ পর্যন্ত হতে হয়েছিল। কিন্তু দিনকাল এখন বদলে গেছে,—আমাদের দুরদৃষ্টে যদি গুরুদেবের ভোজনপর্ব পর্যন্ত হয়েই নাটক সমাপ্ত হয়ে যায়, তামাশার বাকী আর কিছু থাকবে না।

কিন্তু আমাদেরই বা এত দুঃখ, এত বেদনা কেন? কবি বলেছেন, সেটা একেবারে নিছক আমাদের নিজেরই অপরাধ। আমি কিন্তু এই উক্তিটাকে পুরোপুরি স্বীকার করতে পারিনে। আমার মনে হয় প্রত্যেক মানব-জীবনের দুঃখের অধ্যায়েই আর অপরাধ ছাড়াও একটা জিনিস আছে যা তার অদৃষ্ট, যে বস্তু তার দৃষ্টির বাহিরে, এবং যার ওপর তার কোন হাত নেই। তেমনি একটা সমগ্র জাতিরও দুঃখের মূলে তার দোষ ছাড়াও এমন বস্তু আছে যা তার সাধ্যের অতীত, যা তার দুর্ভাগ্য।

আমাদের দেশের ইতিহাস যাঁরা আলোচনা করেছেন তাঁরা বোধ হয় সম্পূর্ণ অসত্য বলে এ কথা উড়িয়ে দেবেন না। দুঃখ ও হীনতার মূলে আমাদের অদৃষ্ট বস্তুও অনেকটা দায়ী, যার ওপর আমাদের কর্তৃত্ব ছিল না। কিন্তু কবি এ কথা সম্পূর্ণ অশ্রদ্ধা করে উপমাচ্ছলে একটা গল্প বলেছেন। গল্পটা এই :

“মনে কর এক বাপের দুই ছেলে। বাপ স্বয়ং মোটর হাঁকিয়ে চলেন। তাঁর ভাবখানা এই, ছেলেদের মধ্যে মোটর চালাতে যে শিখবে মোটর তারই হবে। ওর মধ্যে একটি চালাক ছেলে আছে, তার কৌতূহলের অন্ত নেই। সে তন্ন তন্ন করে দেখে গাড়ি চলে কি করে। অন্য ছেলেটি ভালমানুষ, সে ভক্তিভরে বাপের পায়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, তাঁর দুই হাত মোটরের হাল যে কোন্‌ দিকে কেমন করে ঘোরাচ্চে তার দিকেও খেয়াল নেই। চালাক ছেলেটি মোটরের কল-কারখানা পুরোপুরি শিখে নিলে এবং একদিন গাড়িখানা নিজের হাতে বাগিয়ে নিয়ে ঊর্ধ্বস্বরে বাঁশী বাজিয়ে দৌড় মারল। গাড়ি চালাবার শখ দিন রাত এমনি তাকে পেয়ে বসল যে, বাপ আছেন কি নেই সে হুঁশই তার রইল না। তাই বলেই তার বাপ যে তাকে তলব করে গালে চড় মেরে তার গাড়িটা কেড়ে নিলেন তা নয়; তিনি স্বয়ং যে রথের রথী, ছেলেও সেই রথেরই রথী, এতে তিনি প্রসন্ন হলেন। ভালমানুষ ছেলেটি দেখলে ভায়াটি তার পাকা ফসলের ক্ষেত লণ্ডভণ্ড করে তার মধ্যে দিয়ে দিনে দুপুরে হাওয়া গাড়ি চালিয়ে বেড়াচ্চে, তাকে রোখে কার সাধ্য, তার সামনে দাঁড়িয়ে বাপের দোহাই পাড়লে ‘মরণং ধ্রুবম্‌’,—তখনো সে বাপের পায়ের দিকে তাকিয়ে রইল, আর বললে আমার আর কিছুতে দরকার নেই।”

এই গল্পের সার্থকতা যে কি আমি বুঝতে পারিনি। ছেলে-দুটি কে তা অনুমান করা শক্ত নয়; কিন্তু এক ছেলের প্রতি আর এক ছেলের অকারণ দৌরাত্ম্য দেখে যে বাপ প্রসন্ন হন, তিনি যে কিরূপ বাপ তা বোঝা যায় না! তবে এ কথা বেশ বোঝা যায়, এমন বাপের পায়ের দিকে যে ছেলে তাকিয়ে থাকে,—তা তিনি যত বড় রথেরই রথী হোন, তার ‘মরণং ধ্রুবম্‌’।

অতঃপর কবি এই দুটি ছেলের জীবন-বৃত্তান্তও দিয়েছেন। মোটর-হাঁকানো ছেলেটি ত ম্যাজিক থেকে বিজ্ঞানের ক্লাসে প্রোমোশন পেলে, কিন্তু যে ছেলেটির ‘মরণং ধ্রুবম্‌’ সে তার ম্যাজিক ও তন্ত্র-মন্ত্র নিয়েই পড়ে রইল। এই তন্ত্র-মন্ত্রের পরে কঠোর কটাক্ষ কবি পূর্বেও করেছেন। তাঁর ‘অচলায়তনে’ এ নিয়ে হাসি-তামাশা অনেক হয়ে গেছে, যাঁরা ওয়াকিফ্‌হাল তাঁরা এর মীমাংসা করবেন, কিন্তু আমার মনে হয় এখানে এ সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন।

বিশ্ববস্তুর পেছনে যে কোন-একটা অজ্ঞেয় শক্তি আছে, মানব ইতিহাসে এ একটা প্রাচীন তথ্য। এবং আজ বিংশ শতাব্দীতেও কূলকিনারা তার তেমনি অজ্ঞাত। সেই অজ্ঞেয় শক্তিকে প্রসন্ন করে কাজ আদায়ের চেষ্টা মানুষ চিরদিন করে আসছে,—আজও তার উপায় বার হয়নি, অথচ আজও তার অবসান নেই। এই উপায় আবিষ্কারের পথে কি করে যে প্রার্থনা একদিন ম্যাজিকে অর্থাৎ মন্ত্র-তন্ত্রে এবং ম্যাজিক আর একদিন প্রার্থনায় চেহারা বদলে দাঁড়ায় এ তর্ক তুলে পুঁথি বাড়াতে আমার সাধ নেই। ঈশ্বরের ধারণার অভিব্যক্তির ইতিহাসের এই অংশটা বিজ্ঞানের পরিণতির প্রশ্নে আমার অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়।

সে যাই হোক, এই মোটর-হাঁকানো ছেলেটির উন্নতির হেতুবাদ এবং সেই পায়ের-দিকে-তাকানো ভালো ছেলেটির দুঃখের বিবরণ কবি এইখানে একবারে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। যথা :

“পূর্বদেশে আমরা যে সময় রোগ হলে ভূতের ওঝাকে ডাকচি, দৈন্য হলে গ্রহ-শান্তির জন্যে দৈবজ্ঞের দ্বারে দৌড়াচ্চি, বসন্তমারীকে ঠেকিয়ে রাখবার ভার দিচ্চি শীতলা দেবীর পরে, আর শত্রুকে মারবার জন্যে মারণ-উচ্চাটন মন্ত্র আওড়াতে বসেচি, ঠিক সেই সময় পশ্চিম মহাদেশে ভল্‌টেয়ারকে একজন মেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, শুনেচি নাকি মন্ত্রগুণে পালকে পাল ভেড়া মেরে ফেলা যায়, সে কি সত্য? ভল্‌টেয়ার জবাব দিয়েছিলেন, নিশ্চয়ই মেরে ফেলা যায় কিন্তু তার সঙ্গে যথোচিত পরিমাণে সেঁকো বিষ চাই থাকা। ইউরোপের কোন কোণে-কানাচে যাদু-মন্ত্রের পরে বিশ্বাস কিছুমাত্র নেই এমন কথা বলা যায় না, কিন্তু এ সম্বন্ধে সেঁকো বিষটার প্রতি বিশ্বাস সেখানে প্রায় সর্ববাদিসম্মত। এই জন্যেই ওরা ইচ্ছা করলেই মারতে পারে এবং আমরা ইচ্ছে না করলেও মরতে পারি।”

কবির এ অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে বলার আর কিছু নেই। আমাদের সব মরাই উচিত, এমন কি, সেঁকো বিষ খেতেও কারো আপত্তি করা কর্তব্য নয়। কিন্তু এই কি সত্য? ভল্‌টেয়ার বেশী দিনের লোক নন, তাঁর মত পণ্ডিত ও জ্ঞানী তখন সে দেশে বড় সুলভ ছিল না, অতএব এ কথা তাঁর মুখে কিছুই অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিত নয়, কিন্তু তখনকার দিনে অজ্ঞান ও বর্বরতায় কি এ দেশটা এতখানিই নীচের ধাপে নেবে গিয়েছিল যে ঠিক এমনি কথা বলবার লোক এখানে কেউ ছিল না যে বলে, “বাপু, ভূতের ওঝা না ডাকিয়ে বৈদ্যের বাড়ি যাও, মারতে চাও ত অন্য পথ অবলম্বন কর, কেবল ঘরে বসে নিরালায় মারণ-মন্ত্র জপ করলেই কার্য সিদ্ধ হবে না!” ইউরোপের জয়গান করতে আমি নিষেধ করিনে, কিংবা যে হাতি দঁকে পড়ে গেছে তাকে নিয়ে আস্ফালন করবারও আমার রুচি নেই, কিন্তু তাই বলে ভূতের ওঝা ও মারণ-উচ্চাটন মন্ত্র-তন্ত্রের ইঙ্গিতও নির্বিবাদে হজম করতে পারিনে! ‘গোরা’ বলে বাঙ্গালা সাহিত্যে একখানি অতি সুপ্রসিদ্ধ বই আছে; কবি যদি একবার সেখানি পড়ে দেখেন ত দেখতে পাবেন তার একান্ত স্বদেশভক্ত গ্রন্থকার গোরার মুখ দিয়ে বলেছেন,—“নিন্দা পাপ, মিথ্যা নিন্দা আরও পাপ, এবং স্বদেশের মিথ্যা নিন্দার মত পাপ সংসারে অল্পই আছে।”

কবি বলেছেন, যাদু-মন্ত্রের পরিণতিই হচ্ছে বিজ্ঞানে। কোনও একটা বস্তু কত দিক থেকে যে পরিণত হয়ে ওঠে সে স্বতন্ত্র কথা, কিন্তু এই কি ঠিক যে ইউরোপ তার যাদুবিদ্যার নালা এক লাফে ডিঙিয়ে গেল, আর আমরা দেশসুদ্ধ লোক মিলে ঘাড়-মোড় ভেঙ্গে সেই পাঁকেই চিরকাল পুঁতে রইলাম। বাইরের দিকে বিশ্ববস্তু যে একটা প্রকাণ্ড কল, এর অখণ্ড, অব্যাহত নিয়মের শৃঙ্খল যে যাদুবিদ্যায় ভাঙ্গে না, সংসারে যা-কিছু ঘটে তারই একটা হেতু আছে, এবং সেই হেতু কঠোর আইন-কানুনে বাঁধা, অর্থাৎ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের যথার্থ জনক-জননী বিশ্ব-জগতে কার্য-কারণের সত্য ও নিত্য সম্বন্ধের ধারণা কি এই দুর্ভাগ্য পূর্বদেশে কারও ছিল না? এবং এই তত্ত্ব প্রচারের চেষ্টা কি পশ্চিম হতে আমদানি না করতে পারলে আমাদের ভাগ্যে মারণ-উচ্চাটন মন্ত্র-তন্ত্রের বেশি আর কিছুই মিলতে পারে না? পশ্চিমের বিদ্যার অনেক গুণ থাকতে পারে, কিন্তু সে যদি আমাদের নিজেদের প্রতি কেবল অনাস্থাই এনে দিয়ে থাকে, আমাদের জ্ঞান, আমাদের ধর্ম, আমাদের সমাজ-সংস্থান, আমাদের বিদ্যাবুদ্ধি সকলের প্রতি যদি শুধু অশ্রদ্ধাই জন্মিয়ে দিয়ে থাকে, ত মনে হয়, লুব্ধচিত্তে পশ্চিমের শুক্রাচার্যের পানে আমাদের না তাকানোই ভাল। বস্তুতঃ এই ত নাস্তিকতা।

আমি পূর্বেই বলেছি, যে-শিক্ষায় মানুষ সত্যকারের মানুষ হয়ে উঠতে পারে—অন্ততঃ তাদের মানুষের ধারণা যা, —তা’ তারা আমাদের দেয়নি, দেবে না এবং আমার বিশ্বাস দিতে পারেও না। এই সুদীর্ঘকাল পশ্চিমের সংসর্গেও যে আমরা কি হয়ে আছি, মাত্র সেইটুকুই কি এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ নয়? পেয়েছি কেবল এই শিক্ষা—যাতে নিজেদের সর্ববিষয়ে অবজ্ঞা এবং তাদের যা কিছু সমস্তের পরেই আমাদের গভীর শ্রদ্ধা জন্মে গেছে। আর তাদের ভিতরের দ্বার এমন অবরুদ্ধ বলেই অবনতিও আজ আমাদের এত গভীর। সেটা ত জানবার পথ নেই, তাই শুধু তাদের বাহিরের সাজসজ্জা দেখে একদিকে নিজেদের প্রতি যেমন ঘৃণা, অন্য দিকে তাদের প্রতিও ভক্তির আবেগ একেবারে শতধারে উৎসারিত হয়ে উঠেছে। তাই, একদিন আমাদের দেশের একদল লোক নির্বিচারে ঠিক করেছিলেন, ঠিক ওদের মত হতে না পারলে আর আমাদের মুক্তি নেই! ওদের জাতিভেদ নেই—অতএব সেটা ঘোচানো চাই, ওদের স্ত্রী-স্বাধীনতা আছে—অতএব সেটা না হলেই নয়, তাদের খাওয়া-দাওয়ার বাচ-বিচার নেই—সুতরাং ওটা না তুললেই আর রক্ষা নেই, তাদের মন্দির নেই—অতএব আমাদেরও গীর্জার ব্যবস্থা চাই, তারা ভাড়া করে ধর্ম-প্রচারক রাখে সুতরাং আমাদেরও ওটা অত্যাবশ্যক—এমনি কত কি! কেবল গায়ের চামড়াটা বদলাবার ফন্দি তাঁরা খুঁজে পাননি, নইলে আজ তাঁদের চেনাও যেত না! অথচ, আমি এর দোষ-গুণের বিচার করচি নে, আমি সরলচিত্তে বলছি, কোন দল বা ব্যক্তিবিশেষকে আক্রমণ করবার আমার লেশমাত্র অভিরুচি নেই, আমি কেবল এর mentality-টাই আপনাদের গোচর করবার প্রয়াস করচি। এই যে বিদেশের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ ও স্বদেশের প্রতি নিদারুণ বিরাগ, এ শুধু সম্ভবপর হয়েছিল তাদের অন্দরের পথটা চিরদিন বন্ধ ছিল বলে। তাই এদের সংসর্গে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের চোখে ওদের বাইরের মোহটা এমনি পেয়ে বসেছিল যে, এ তত্ত্ব আবিষ্কার করতে তাঁদের মুহূর্ত বিলম্ব ঘটেনি যে, বাইরে থেকে যেটুকু দেখা যাচ্ছে, কেবল সেইটুকুর হুবহু নকল করলেই, তাঁরাও অমনি মানুষ হয়ে ওদের অন্তরে পঙ্‌ক্তি-ভোজনে সরাসরি বসে যেতে পারবেন। সংসারে যা-কিছু অজ্ঞাত, গোপন, যার ভিতরে প্রবেশের পথ নেই, তার প্রতি বাইরের লোকের লোভের অবধি থাকে না। তাই এ কথা তাঁদের স্বতঃসিদ্ধের মত মেনে নিতে কোথাও কিছুমাত্র বাধেনি যে, মানুষ হবার সত্যকার সজীব মন্ত্রটি কেবল ওদের এই নিগূঢ় মর্মস্থানটিতেই চাপা দেওয়া আছে, কোন মতে ওর সন্ধান না পেলে আমাদের মনুষ্যজন্ম সার্থক করবার দ্বিতীয় পন্থা নেই। এই ভ্রান্তিটা চোখ মেলে দেখবার আজ দিন এসেছে।

শিক্ষার বিরোধ আসলে এইখানে। সে শুধু দেহের গঠনে নয়, সে অন্তরের আত্মায়। এই যে শিক্ষার প্রণালী নিয়ে বিবাদ-বিসংবাদ চলেছে,—ওদের শিক্ষা অত্যন্ত মহার্ঘ, অত বড় বড় বাড়ি কি হবে? কি হবে টানা পাখায়? কাজ কি আমার টেবিল চেয়ারে,—দূর করে দাও মোটা মাইনের বিলিতী প্রফেসার—তার খরচ যোগাতেই যে দেশের বাপ-মা পাগল হয়ে গেল,—এমনি আরও কত শত। এর কোনটাই মিথ্যে নয়, কিন্তু এও আমার কাছে তুচ্ছ মনে হয়, যখন ভাবি পশ্চিম ও পূর্বের শিক্ষার সংঘর্ষ ঠিক কোন্‌খানে? এদের সত্য মিলনের যথার্থ অন্তরায় কোথায়? একি কেবল গোটা-কতক সাজগোজ বদলালেই হবে?

টেবিল-চেয়ারের বদলে লম্বা লম্বা মাদুর পেতে, ইলেক্‌ট্রিক ফ্যানের পরিবর্তে তালপাখা এনে, কিংবা মোটা মাইনের প্রফেসারের বদলে রোগা মাইনের দিশী অধ্যাপক আমদানি করে কিংবা বড়জোর বিদেশী ভাষার মিডিয়মের স্থানে স্বদেশী ভাষায় লেক্‌চারের আইন করলেই দুঃখ দূর হবে? দুঃখ কিছুতেই ঘুচবে না, যতক্ষণ না সেই শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়, যাতে দেশের বহির্মুখী বীতশ্রদ্ধ মন আর একবার অন্তর্মুখী ও আত্মস্থ হয়। মনের মিলনই বা কি, আর শিক্ষার মিলনই বা কি, সে কেবল হতে পারে সমানে সমানে শ্রদ্ধার আদান-প্রদানে। এমন কাঙালের মত, ভিক্ষুকের মত কিছুতেই হবে না। হলেও সে শুধু একটা গোঁজামিল হবে,—তাতে কল্যাণ নেই, গৌরব নেই, দেশকে সে কেবল হীনতা ও লাঞ্ছনাই দেবে, কোন দিন মনুষ্যত্ব দেবে না।

আমার এ-সব কথার কথা নয়,—উদ্দীপনাপূর্ণ স্বদেশী লেক্‌চার নয়,—সত্য সত্যই যা আমি সত্য বলে বুঝেছি তাই কেবল আপনাদের কাছে বলছি। মানুষের একপ্রকার শিক্ষা আছে, যা কেবল নিছক ব্যক্তিগত সুখ ও সুবিধার খাতিরে মানুষে অর্জন করতে চায়। যে mentality থেকে আমাদের এদেশে কেউ কেউ ইংরিজী ভাষাটা সাহেবের গলায় বলাটাকেই চরম উন্নতি জ্ঞান করে, এবং এই mentality-রই এক ধাপ নীচের লোকগুলো জাহাজে এবং রেলগাড়িতে সাহেবি পোশাক ছাড়া কিছুতেই বেড়াতে চায় না। এবং এই জিনিসটা এত ইতর, এত ক্ষুদ্র যে, এ কেন হয়, এর কি উদ্দেশ্য এ বিষয় আলোচনা করতেও ঘৃণা বোধ হয়। কিন্তু আমি নিশ্চয় জানি এই ছদ্মবেশের হীনতা, এই আপনার কাছ থেকে আপনাকে লুকোবার পাপ, এবং গভীর লাঞ্ছনা আপনারা অনায়াসেই উপলব্ধি করতে পারবেন। এবং প্রসঙ্গক্রমে এ কথা কেন যে উত্থাপিত করলাম তাও বুঝতে আপনাদের বাকী থাকবে না।

এইখানে জাপানের কথা স্মরণ করে কেউ কেউ বলতে পারেন, এই যদি সত্য, তবে জাপান আজ এমন হলো কিসের জোরে? তার চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেকার ইতিহাসটা একবার ভেবে দেখ! ভেবে আমি দেখেছি। পশ্চিমের শুক্রাচার্যের শিষ্যত্বের জোরেই যদি সে আজ বড় হয়ে থাকে, তবে বড়ত্বটাও মেপে দেখেছি আমরা শুক্রাচার্যেরই মাপকাঠি দিয়ে। কিন্তু মানবত্ব বিকাশের সেই কি শেষ মানদণ্ড? জাতীয় জীবনে এই দু’ শো পাঁচ শো বছরের ঘটনাই কি তার চরম ইতিহাস?

আমি জাপানের ইতিহাস জানিনে। তার কি ছিল এবং কি হয়েছে এ বিষয়ে আমি অনভিজ্ঞ, কিন্তু এই তার পার্থিব উন্নতির মূলে, পশ্চিমের সভ্যতার পদতলে যদি তার আত্মসমর্পণের সূচনাই করে থাকে, ত তারস্বরে আনন্দধ্বনি করবার বোধ হয় বেশি কারণ নেই। এবং এমনি দুর্দিন যদি কখনো ভারতের ভাগ্যে ঘটে,—সে তার বিগত জীবনের সমস্ত tradition বিস্মৃত হয়ে ঠিক অতখানি উন্নত হয়েই ওঠে, এক কালো চামড়া ছাড়া পশ্চিমের সঙ্গে তার কোন প্রভেদই না থাকে, ত ভারতের ভাগ্য-বিধাতা উপরে বসে সে দিন হাসবেন কি নিজের চুল ছিঁড়বেন বলা কঠিন।

কোন বড় জিনিসই কখনো নিজের অতীতের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে, নিজের শক্তির প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে হয় না—হবার জো-ই নেই। তাদের যে বিদ্যাটার প্রতি আমাদের এত লোভ, তা তাদের মাথায় হাত বুলিয়েই শিখে নিই, বা পায়ে তেল মাখিয়েই অর্জন করি—এর ফল অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী যদি না সে দেশের প্রতিভার ভিতর থেকে সৃষ্ট হয়ে ওঠে, এর মূল যদি না জাতির অতীতের মর্মস্থল বিদীর্ণ করে এসে থাকে। এই ফুল সমেত বৃক্ষশাখা, তা সে বর্ণে ও গন্ধে যত দামীই হোক, একদিন শুখোবেই শুখোবে, কোন কৌশলই তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

এই সত্যটা আজ আমাদের একান্তই বোঝবার দিন এসেচে যে, ঠকিয়ে-মজিয়েই হোক বা কেড়ে-বিকড়েই হোক, নানা দেশ থেকে টেনে এনে জমা করাটাই দেশের সম্পদ নয়। যথার্থ সম্পদ দেশের প্রয়োজনের মধ্যে থেকেই গড়ে ওঠে। তার অতিরিক্ত যা সে শুধুই ভার, নিছক আবর্জনা। পরের দেখে আমরাও যেন ওই ঐশ্বর্যের প্রতি লুব্ধ হয়ে না উঠি। আমাদের জ্ঞান, আমাদের অতীত আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছিল, আজ অপরের শিক্ষার মোহে যদি নিজের শিক্ষাকে হেয় মনে করে থাকি ত সে পরম দুর্ভাগ্য। ঐ যে ট্রাম, ঐ যে মোটর পথের উপর দিয়ে বায়ুবেগে ছুটেছে, ঐ যে ঘরে ঘরে electric পাখা ঘুরচে, ঐ যে শহরের আলোর মালার আদি অন্ত নেই, ঐ যে শত সহস্র বিদেশী সভ্যতার তোড়জোড় বিদেশ থেকে বয়ে এনে জমা করেচি, ওর কোনটাই কি আমাদের যথার্থ সম্পদ? বিগত যুদ্ধের দিনের মত আবার যদি কোন দিন ওর আমদানির মূল শুকিয়ে যায় ত ভোজবাজির মত ওদের অস্তিত্ব এ দেশ থেকে উঠে যেতে বিলম্ব হবে না। ও-সকল আমরা সৃষ্টি করিনি, করতেও জানিনে। পরের কাছ থেকে বয়ে আনা। আজ ও-সকল আমাদের না হলেও নয়, অথচ, ওর কোনটাই আমাদের যথার্থ প্রয়োজনের ভিতর দিয়ে গড়ে ওঠেনি। এই যে দেখাদেখি প্রয়োজন, এ যদি আমরা গড়তেও না পারি, ছাড়তেও না পারি তা হলে দুষ্ট-ক্ষুধার মত ও কেবল আমাদের একদিকে প্রলুব্ধ এবং অন্যদিকে পীড়িতই করতে থাকবে। কিন্তু পশ্চিম ওদের সৃষ্টি করেচে নিজের গরজ থেকে। তাদের সভ্যতায় ও-সকল চাই-ই চাই। ঐ যে বড় বড় মানোয়ারী জাহাজ, ওই যে গোলা-গুলি-কামান-বন্দুক-গ্যাসের নল, ওই যে উড়ো এবং ডুবো জাহাজ, ও-সমস্তই ওদের সভ্যতার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তাই কোনটাই ওদের বোঝা নয়, তাই ওদের পরিণতি, ওদের নিত্য নব আবির্ভাব দেশের প্রতিভার ভিতর থেকেই বিকশিত হয়ে উঠচে। দূর থেকে আমরা লোভ করতেও পারি, নিতান্ত নিরীহ গোছের বাবুয়ানির সরঞ্জাম কিনেও আনতে পারি কিন্তু বাণিজ্যজাহাজই বল, আর মোটরগাড়িই বল, যতক্ষণ না সে নিজেদের প্রয়োজনে, নিজের দেশে, নিজের জিনিসের মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করে, ততক্ষণ যেমন করে এবং যত টাকা দিয়েই না তাদের সংগ্রহ করে আনি, সে আমাদের সত্যকারের ঐশ্বর্য নয়। তাই ম্যানচেস্টারের সূক্ষ্ম বস্ত্র, গ্লাসগো লিনেন এবং মসলিন, স্কট্‌ল্যান্ডের পশমী শীতবস্ত্র,—তা সে আমাদের যত শীতই নিবারণ করুক এবং দেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করুক, কোনটাই আমাদের যথার্থ সম্পদ নয়—নিছক আবর্জনা।

কিন্তু আমি একটু সরে গেছি। আমি বলছিলাম যে মানুষ কেবল সত্যকারের প্রয়োজনেই সৃষ্টি করতে পারে এবং সৃষ্টি করা ছাড়া সে কখনো সত্যকারের সম্পদও পায় না। কিন্তু পরের কাছে শিখে মানুষে বড়জোর সেইটুকুই তৈরি করতে পারে, কিন্তু তার বেশি সে সৃষ্টি করতে পারে না। সৃষ্টি করাটা শক্তি, সেটা দেখা যায় না,—এমন কি পশ্চিমের দ্বারস্থ হয়েও না। এই শক্তির আধার নিজের প্রতি বিশ্বাস,—আত্মনির্ভরতা। কিন্তু যে শিক্ষা আমাদের আত্মস্থ হতে দেয় না, অতীতের গৌরব-কাহিনী মুছে দিয়ে আত্মসম্মানে অবিশ্রাম আঘাত করে, কানের কাছে কেবলি শোনাতে থাকে আমাদের পিতা-পিতামহেরা কেবল ভূতের ওঝা আর মন্ত্র-তন্ত্র, দৈবজ্ঞ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন, তাঁদের কার্যকারণের সম্বন্ধজ্ঞান বা বিশ্বজগতের অব্যাহত নিয়মের ধারণাও ছিল না—তাই আমদের এ দুর্দশা, তা হলে সে শিক্ষায় যত মজাই থাক, তার সঙ্গে অবাধ কোলাকুলি একটু দেখে শুনে করাই ভাল।

পশ্চিমের সভ্যতার আদর্শে মানুষ মারবার শতকোটি মন্ত্র-তন্ত্র, পরের দেশে তার মুখের গ্রাস অপহরণ করবার ততোধিক কল-কারখানা, এ সমস্তই তার প্রয়োজনে তার নিজের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেচে,—কিন্তু ঠিক ঐ-সকল আমাদের দেশের সভ্যতার আদর্শে প্রয়োজন কিনা আমি জানি না। কিন্তু কবি বলেছেন, এই-সকল মহৎ কার্য করেছে তারা নিশ্চয় কোন একটি সত্যের জোরে। অতএব ওটা আমাদের শেখা চাই, কারণ বিদ্যেটা তাদের সত্য। এবং পরক্ষণেই বলেছেন, কিন্তু শুধু ত বিদ্যা নয়, বিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে শয়তানিও আছে, সুতরাং শয়তানির যোগেই ওদের মরণ।

হতেও পারে। কিন্তু যে লোক শুধু মারণ-উচ্চাটন বিদ্যে শিখে মন্ত্র জপতে শুরু করেছে, তার কোন্‌টা সত্য আর কোন্‌টা শয়তানি নির্ণয় করা কঠিন। কবি আমাদের মুখে একটা কথা গুঁজে দিয়ে বলেছেন :

“ঐ কথাটাই ত আমরা বার বার বলচি। ভেদবুদ্ধিটা যাদের (অর্থাৎ পশ্চিমের) এত উগ্র, বিশ্বটাকে তাল পাকিয়ে এক-এক গ্রাসে গেলবার জন্যে যাদের লোভ এতবড় হাঁ করেচে, তাদের সঙ্গে আমাদের কোন কারবার চলতে পারে না, কেননা ওরা আধ্যাত্মিক নয়, আমরা আধ্যাত্মিক। ওরা অবিদ্যাকেই মানে, আমরা বিদ্যাকে; এমন অবস্থায় ওদের সমস্ত শিক্ষা-দীক্ষা বিশেষমত পরিহার করা চাই।”

এমন কথা যদি কেউ বলেও থাকে ত খুব বেশি অন্যায় করেছে আমার মনে হয় না। Physics, Chemistry হিন্দু কি ম্লেচ্ছ এ কথা কেউ বলে না। বিদ্যার জাত নেই এ কথা সত্য, কিন্তু তাই বলে culture জিনিসটারও জাত নেই এ কথা কিছুতেই সত্য নয়। এবং ওদের শিক্ষা যদি কেউ বিষের মত পরিহারের ব্যবস্থাই দিয়ে থাকে, ত সে কেবল এই জন্যেই, বিদ্যার জন্যে নয়। আর এই যদি ঠিক হয় যে, তারা কেবল অবিদ্যাকেই মানে এবং আমরা মানি বিদ্যাকে, তা হলে এ দুটোর সমন্বয়ের উপায় বইয়ের মধ্যে, প্রবন্ধের মধ্যে শ্লোক তুলে তুলে হতেও পারে, কিন্তু একটাকে আর একটার গিলে না খেয়ে বাস্তব জগতে যে কিভাবে সমন্বয় হতে পারে আমি জানিনে। যাদের গেলবার মত বড় হাঁ আছে তারা গিলবেই—মনু বা উপনিষদের দোহাই মানবে না। অন্ততঃ এতকাল যে মানেনি সে ঠিক।

পশ্চিমের এতবড় লঙ্কাকাণ্ডের পরেও যে আজ সেই ল্যাজটার ওপরে মোড়কে মোড়কে সন্ধিপত্রের স্নেহসিক্ত কাগজ জড়ান চলছে, এবং এত মারের পরেও যে তার নাড়ী বেশ তাজা আছে তাতে আশ্চর্য হবার আছে কি? এই মহাযুদ্ধ যারা যথার্থ বাধিয়েছিল তাদের দুপক্ষই চমৎকার সুস্থ দেহে ও বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। যারা মরবার তারা মরেছে। এবং ফের যদি আবশ্যক হয় তাদেরই আবার মরবার জন্যে জড়ো করা হবে।

সুতরাং এদের মধ্যে আজ যদি কেউ শোকাকুল-চিত্তে কবিকে প্রশ্ন করে থাকে, ‘ভারতের বাণী কৈ?’ তা হলে সন্দেহ হয় তারা কিঞ্চিৎ রসিকতা করছে! এবং এই জন্যেই তাদের নিমন্ত্রণ করে ঘরে ডেকে এনে নিভৃতে ‘মা গৃধঃ’ মন্ত্র দিয়ে বশ করা যাবে,—এ ভরসা কবির থাকলেও আমার নেই। কারণ বাঘের কানে ‘বিষ্ণু-মন্ত্র’ ফুঁকলে বৈষ্ণব হয় কি না আমি ভেবে পাইনে।

আরও একটা কথা। পশ্চিমের সভ্যতার একটা মস্ত মূলমন্ত্র হচ্চে standard of living বড় করা। আমাদের দেশের মূল নীতির সঙ্গে এর পার্থক্য আলোচনা করবার স্থান আমার নেই কিন্তু ওদের সমাজ-নীতির যেমন interpretationই দেওয়া যাক তার আসল কথা হচ্ছে ধনী হওয়ার। ওদের সামাজিক ব্যবস্থা, ওদের সভ্যতা, ওদের ধনবিজ্ঞান—এর সঙ্গে যার সামান্য পরিচয়ও আছে, এ সত্য সে অস্বীকার করবে না। এ ধনী হওয়ার অর্থ ত কেবল সংগ্রহ করাই নয়! সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশীকেও তেমনি ধনহীন করে তোলাও এর অন্য উদ্দেশ্য। নইলে, শুধু নিজে ধনী হওয়ার কোন মানেই থাকে না! সুতরাং কোন একটা সমস্ত মহাদেশ যদি কেবল ধনী হতেই চায় ত অন্যান্য দেশগুলোকে সে ঠিক সেই পরিমাণে দরিদ্র না করেই পারে না। তবু এই একটা কথা নিত্য নিয়ত মনে রাখলে দুরূহ সমস্যার আপনি মীমাংসা হয়ে যায়। এই তার মেদ-মজ্জাগত সংস্কার, এই তার সমস্ত সভ্যতার ভিত্তি, এর পরেই তার বিরাট সৌধ অভ্রভেদী হয়ে উঠেছে। এরই জন্যে তার সমস্ত শিক্ষা, সমস্ত সাধনা নিয়োজিত। আজ আমার কথায়, আমাদের ঋষিবাক্যে সে কি তার সমস্ত civilisation-এর কেন্দ্র নড়িয়ে দেবে? আমাদের সংসর্গে তার বহু যুগ কেটে গেল, কিন্তু আমাদের সভ্যতার আঁচটুকু পর্যন্ত সে কখনো তার গায়ে লাগতে দেয়নি। আপনাকে এমনি সতর্ক, এমনি স্বতন্ত্র, এমনি শুচি করে রেখেছে যে কোনদিন এর ছায়াটুকু মাড়ায় নি। এই সুদীর্ঘ কালের মধ্যে এ দেশের রাজার মাথার কোহিনূর থেকে পাতালের তলে কয়লা পর্যন্ত, যেখানে যা-কিছু আছে, কিছুই তার দৃষ্টি এড়ায় নি। এটা বোঝা যায়, কারণ, এই তার সত্য, এই তার সভ্যতার মূল-শিকড়। এই দিয়েই সে তার সমাজ-দেহের সমস্ত সভ্যতার রস শোষণ করে, কিন্তু আজ খামকা যদি সে ভারতের আধিভৌতিক সত্যবস্তুর বদলে ভারতের আধ্যাত্মিক তত্ত্ব-পদার্থের inquiry করে থাকে ত আনন্দ করব কি হুঁশিয়ার হব—চিন্তার কথা।

ইউরোপ ও ভারতের শিক্ষার বিরোধ আসলে এইখানে,—এই মূলে। আমাদের ঋষিবাক্য যত ভালই হোক তারা নেবে না, কারণ তাতে তাদের প্রয়োজন নেই। সে তাদের সভ্যতার বিরোধী। আর তাদের শিক্ষা তারা আমাদের দেবে না—কথাটা শুনতে খারাপ কিন্তু সত্য। আর দিলেও তার যেটুকু ভিক্ষা সেটুকু না নেওয়াই ভাল। বাকীটুকু যদি আমাদের সভ্যতার অনুকূল না হয়, সে শুধু ব্যর্থ নয়, আবর্জনা। তাদের মত পরকে মারতে যদি না চাই, পরের মুখের অন্ন কেড়ে খাওয়াটাই যদি সভ্যতার শেষ না মনে করি ত মারণমন্ত্র যত সত্যই হোক তার প্রতি নির্লোভ হওয়াই ভাল।

আর একটা কথা বলেই আমি এবার এ প্রবন্ধ শেষ কোরব। সময়ের অভাবে অনেক বিষয়ই বলা হোল না,—কিন্তু এই অবান্তর কথাটা না বলেও থাকতে পারলাম না যে, বিদ্যা এবং বিদ্যালয় এক বস্তু নয়; শিক্ষা ও শিক্ষার প্রণালী এ-দুটো আলাদা জিনিস। সুতরাং কোন একটা ত্যাগ করাই অপরটা বর্জন করা নয়। এমনও হতে পারে বিদ্যালয় ছাড়াই বিদ্যালাভের বড় পথ। আপাতদৃষ্টিতে কথাটা উলটো মনে হলেও সত্য হওয়া অসম্ভব নয়। তেলে জলে মেশে না, এ দুটো পদার্থও একেবারে উলটো, তবু তেলের সেজ জ্বালাতে যে মানুষ জল ঢালে সে কেবল তেলটাকেই নিঃশেষে পুড়িয়ে নিতে। যারা এ তত্ত্ব জানে না তাদের একটু ধৈর্য থাকা ভাল।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ১৩২৮ সালে ‘গৌড়ীয় সর্ববিদ্যায়তনে’ পঠিত।