» » জহির রায়হান গল্পসমগ্র

কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক জহির রায়হানের বিভিন্ন সময়ে লেখা ২১ টি গল্প নিয়ে সাজানো গল্পসমগ্র; মাত্র একুশটি গল্প লিখে যেতে পেরেছিলেন তিনি। প্রত্যেকটা গল্পেই যিনি রেখেছেন দক্ষতার ছাপ। কোনো গল্পে বলেছেন অতীতের স্মৃতি আবার কোনো গল্পে বলেছেন ভাষা-আন্দোলনের কথা। কিছু গল্প ছিলো ঘোর-লাগা আবার কিছু ছিলো বিষাদে ভরা।

একুশটি বিবেকস্পর্শী, সাহসী গল্প।

বিপন্ন এক সময়ের, বিপদগ্রস্ত এক দেশের, হতভাগ্য একজন মানুষ ছিলেন তিনি। সাহসী মানুষ।

আরো কিছু যদি লিখে যেতে পারতেন!

কিছু না হোক, অন্তত আরো একুশটি গল্প।

গল্পগুলো শুধুই গল্প নয়! প্রতিটি গল্পে গভীর উপলব্ধির বিষয় আছে। প্রত্যেকটা গল্প ভীষণ শক্তিশালী। একেবারে গভীরে গিয়ে আঘাত করে।

“আচমকা সকালে উঠে গ্রেগর সামসা আবিষ্কার করল সে এক অতিকায় পোকা হয়ে বিছানায় পড়ে আছে” বা “মা আজ মারা গেছে। হয়তো কাল। আমি ঠিক জানি না”— লাইনগুলো শুনলেই আমাদের মেটামরফোসিসের কাফকা বা আউটসাইডারের ক্যামুর কথা মনে পড়ে। ঠিক তেমনি “রাত নামছে। হাজার বছরের পুরোনো সেই রাত”— শুনলেই মনে পড়ে হাজার বছর ধরের জহির রায়হানের কথা। কিন্তু তিনি তো কেবল ‘হাজার বছর ধরে’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ বা ‘বরফ গলা নদী’র মতো কালজয়ী উপন্যাসেরই স্রষ্টা নন বা ‘জীবন থেকে নেওয়া’, ‘স্টপ জেনোসাইড’ এর মতো সিনেমার নির্মাতা নন, তিনি যে অসাধারণ এক গল্পকারও তাঁর প্রমাণ এই সঙ্কলনটি। মাত্র সাঁইত্রিশ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে তাঁর লেখা গল্পের সংখ্যা সামান্যই, মাত্র ২১ টি।

জহির রায়হান সেইসব শিল্পীর একজন যাঁরা তাঁদের কর্মে, শিল্পে ছাপ রাখেন তাঁদের সমকালের, তাঁদের বিশ্বাসের। তাইতো বাঙালির উত্তাল সেইসময়ের শিল্পী জহির রায়হানের গল্পে বারবারই উঠে এসেছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, উঠে এসেছে তৎকালীন সমাজের ধর্ম ব্যবসায়ীদের স্বরূপ, চিরকালীন মধ্যবিত্তের প্রেম ও স্বপ্ন-বাস্তবতার দোলাচল আর বিপ্লবী চিন্তা।

‘সময়ের প্রয়োজনে’, ‘মহামৃত্যু’, ‘কয়েকটি সংলাপ’, ‘ম্যাসাকার’ বা ‘একুশের গল্প’ গল্পগুলোতে বারবার উঠে এসেছে ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের বয়ান। ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পে তিনি দিয়েছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণের অংশগ্রহণের এক বিচিত্র কারণের সন্ধান ; তারা প্রতিশোধ নিতে বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বা শেখ সাহেবের নির্দেশে যতটা না যুদ্ধ করেছে তার চেয়ে বেশি যুদ্ধ করেছে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বা সময়ের প্রয়োজনে। আজ পর্যন্ত শোনা যুদ্ধেন কারণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যুক্তিযুক্ত কারণ বলে এটাকেই আমার মনে হয়েছে। ‘ম্যাসাকার’ গল্পে লেখক যুদ্ধের বিরুদ্ধে দিয়েছেন এক তীব্র বার্তা, পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাধি এবং বর্তমান সভ্যতার নির্মম পরিহাস হিসেবে যুদ্ধকে উপস্থাপন করে লেখক সেইদিনের প্রত্যাশী যেদিন মানুষ তাতের সব ভুল বুঝতে পারবে, সবাই আপন করে নিতে পারবে। ‘একুশের গল্প’ তো ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত সবচেয়ে মর্মস্পর্শী গল্পগুলোর একটি। ভাষার দাবিতে শহিদ হওয়া এক ছাত্র ও তার পরিবারের করুণ বর্ণনা।

এছাড়া ‘সোনার হরিণ’ গল্পের লোকটির মতো মধ্যবিত্তদের স্বপ্ন আর বাস্তবতার পার্থক্য, ‘একটি জিজ্ঞাসা ‘ গল্পের এক বাচ্চা মেয়ের মাধ্যমে সমাজের ধনী-গরিবের বৈষম্যের চিত্রায়ণ, ‘বাঁধ’ গল্পের মাধ্যমে সম্মিলিত শারীরিক পরিশ্রমের উপযোগিতা, ‘জন্মান্তর’ গল্পের পকেটমার মন্তুর মাধ্যমে এক মানবিকতার উত্তরণ, ‘ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি’ তে বর্ণনা করেছেন নিজের আজন্ম লালিত স্বপ্নের কথা।

প্রতিটা গল্পই অসাধারণ। ছোট ছোট সরল বাক্যের মাধ্যমেই তিনি অসাধারণ মায়াজাল সৃষ্টি করেছেন। বর্ণনায় কোথাও কোনো মেদ নেই, নিতান্ত যেটুকু বলতে চান তাই একদম স্পষ্ট করে মুখের উপর বলে দিয়েছেন। তাইতো পড়তে কখনোই বিরক্তি আসে বরং বিষয়ের বৈচিত্র এবং ভাষার মুন্সিয়ানা ধাক্কা দেয় মনোজগতে। তো স্বাগতম সবাইকে এক জাদুকরের সান্নিধ্যে!

কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক জহির রায়হানের বিভিন্ন সময়ে লেখা ২১ টি গল্প নিয়ে সাজানো বইটি। প্রত্যেকটা গল্পেই যিনি রেখেছেন দক্ষতার ছাপ। কোনো গল্পে বলেছেন অতীতের স্মৃতি আবার কোনো গল্পে বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের কথা। কিছু গল্প ছিলো ঘোরলাগা আবার কিছু ছিলো বিষাদে ভরা।

  1. সোনার হরিণ : দশ বছর আগে কোনো এক ভরদুপুরে এক দম্পতি এসেছিলো ফার্নিচারের দোকানে। বিভিন্ন আসবাবপত্র তারা দু’জন ঘুরে ফিরে দেখছিল। কোনোটা পছন্দ হচ্ছিল আবার কোনোটা হচ্ছিলো না। কিন্তু পছন্দ হলেও বা কি? একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধ্যও বা কতটুকু নতুন ফার্নিচার কেনবার? কিন্তু আজ দশ বছর পরে হঠাৎ একজন কে দেখে গল্প কথকের সেই স্মৃতি টুকু মনে পড়ে গেলো— যেখানে ভালোবাসা ছিলো, ছিলো একটা ছোট্ট সংসার সাজাবার প্রবল ইচ্ছা, ছিল আত্মসম্মান। গল্পটা নতুন জীবন শুরু করা দম্পতির হলেও গল্পটার দম্পতি যেন আমাদের আশেপাশেই আছে। খুব সুন্দর ভাবে সাজানো একটা গল্প।
  2. সময়ের প্রয়োজনে : একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে একটা খাতা দেয়া হলো। লাল মলাটে বাঁধানো একটা খাতা যার বেশ কিছু জায়গায় ময়লা আর কালচে ভাব। খাতা খুলে পড়া শুরু করল সে। ধীরে ধীরে জানতে পারলো একজন মুক্তিযোদ্ধার অব্যক্ত কথা, জানতে পারলো সেসময় মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃখ, বেদনা আর হতাশাজনক অবস্থা। কিন্তু এত কিছুর পরেও সবার শক্তি একটাই ‘দেশকে ঐ পশুগুলোর হাত থেকে রক্ষা করতে হবে’।
  3. একটি জিজ্ঞাসা : বাবা করমআলী আর ছোট্ট কৌতুহলী মেয়ে মুন্নার মধ্যকার কথোপকথন। হজ নিয়ে মেয়ের বারংবার কৌতুহলী প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে বাবা হয়রান। কখনো বা প্রশ্নের জবাব না পেয়ে বাবার সাথে অভিমান করে চুপ করে বসে থাকা। মাত্র দুই পৃষ্ঠার এ গল্পের শেষটা পাঠককে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করবে।
  4. হারানো বলয় : সামান্য কেরানিগিরি করে জীবন চালানো আলমের অনেকদিন পর হঠাৎ রাস্তায় দেখা হলো আরজুর সাথে। আরজু আলমের বন্ধু আবার ভালোবাসার মানুষও বটে তবে কিছু সীমাবদ্ধতায় হয়ত সম্পর্ক টা সেভাবে হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আরজুর প্রতি আলমের শ্রদ্ধা টা যেন ঠিক আগের মতই আছে। টং এর দোকানে একসাথে বসে দুকাপ চা পান করা বা আরজুকে ঝকঝকে বালা পছন্দ করে দেওয়া। কিন্তু আলম আর আরজু দুজনেই একসময় অভাববোধ আর দায়িত্ববোধ টা মেনে নেয়। দুজন হয়ে যায় একই শহরে থাকা দু প্রান্তের দুটি জীবন।
  5. বাঁধ : গ্রামে কয়েক বছর ধরে বন্যার পানিতে ফসল সব নষ্ট হচ্ছে ওদিকে বাঁধ এ ফাটল ধরেছে যেকোনো সময়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ফসল। গ্রামের খোদাভিরু মানুষগুলো বড্ড অসহায় কেননা তাদের ডাকেও খোদা সাড়া দেননি তাই খোদা কে ডাকার জন্য চাই একজন নেক বান্দা যার ডাকে খোদা ফসল কে রক্ষা করবেন বন্যার হাত থেকে। সবার সিদ্ধান্তে তাই গ্রামে নিয়ে আসা হলো পীর মনোয়ার হাজীকে। কিন্তু ওদিকে গ্রামের লেখাপড়া জানা মাস্টার আর ছাত্ররা পীরের আগমনে যেন খুশি হতে পারলোনা। একদিকে চলছে মসজিদে খোদাকে প্রতিটি মুহূর্তে স্বরণ করা আর অন্য দিকে গায়ে গতরে খেটে কোদাল চালাচ্ছে পঞ্চাশেক যুবক। তবে জয়ী হবে কারা যুবক নাকি পীর মনোয়ার হাজী? আমাদের দেশের অনেক মানুষ এখনো ধর্ম ব্যাবসা কে কাজে লাগিয়ে মানুষ ঠকায় যার শিকার হয় এদেশের সাদা মনের মানুষগুলো।
  6. সূর্যগ্রহণ : আনোয়ার সাহেবের রুমমেট তসলিম সাহেব বেশ ভালো কবিতা লিখেন। আনোয়ার সাহেবের অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে কবিতা পড়ে শোনান। আবার ওদিকে হাসিনা প্রায়ই চিঠি লিখে পাঠায়। আনোয়ার সাহেব চিঠিগুলো পড়েন কিন্তু চিঠির কোনো উত্তর দেন না। কিন্তু কেন? ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে কেন্দ্র করে লেখা এ গল্পটি পড়ার পর এক ধরনের ঘোরলাগা কাজ করছিলো। গল্পের শেষটা ছিলো বিষাদময়।
  7. নয়া পত্তন : গ্রামের ছেলে-মেয়ে গুলোকে পড়াশোনা করানোর জন্য একটা স্কুল দেয়ার জন্য সাহায্য চেয়ে মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়াচ্ছে শনু পণ্ডিত। অথচ গ্রামের গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের যেন এ নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা ই নেই। সব আশা যখন ছেড়ে দিয়েছে শনু পণ্ডিত এমন সময়ে পাশে এসে দাঁড়ালো গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। সবাই একসাথে কাজে নেমে পড়লো স্কুল নির্মাণের।গল্পটা একদিকে যেমন প্রতিবাদের দিকে ইঙ্গিত করে তেমনি অন্যদিকে যেন মনে সাহস যোগায়। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যেকোনো কিছুই করাই সম্ভব সেটার যেন এক জীবন্ত উদাহরণ।
  8. মহামৃত্যু : একটা রক্তাক্ত লাশ নিয়ে এসেছে সবাই ধরাধরি করে। যে লাশের আপনজন বলতে সেখানে কেউ নেই। অথচ প্রতিবেশী সহ সবাই নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছে লাশ সৎকার করার, কারণ এমন সম্মান তার প্রাপ্য। এমন মহামৃত্যু সবার কপালে জোটে না, এমন সম্মানের মৃত্যু সকলে পায় না। একজন শহীদকে কেমন সম্মান দেওয়া উচিত? তাদের স্থান আসলে কোথায় সেটাই যেন লেখক বুঝিয়েছেন গল্প দিয়ে।
  9. ভাঙাচোরা : সরকারি এক কাজে কলকাতা গিয়েছিলেন সালাম সাহেব। সেখানে গিয়ে কাজ শেষে এক বোনের বাসায় ঘুরতে যান যাকে দেখেছিলেন আট বছর আগে। হঠাৎ উপস্থিত হওয়ায় চমকে যায় সে বোন। একথায় সেকথায় একসময় উঠে আসে সংসারের প্রতি স্বামী আর স্ত্রীর দায়িত্ববোধের কথা। তখন সালাম সাহেব বুঝতে পারেন বাইরে থেকে তাদের যতটা স্বাভাবিক দেখা যায় ভেতরে ভেতরে তারা ঠিক মুদ্রার উল্টো পিঠের মত। আসলে আমরা মানুষকে যেমন দেখি আসলে সবাই তেমন নয়। হাসিখুশি মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষটাও জানে ভেতরে ভেতরে সে কতটা সংগ্রাম করে চলেছে। জহির রায়হান যেন তা সহজ ভাষায় বলে গেলেন এ গল্পে।
  10. অপরাধ : মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে সালেহার বিয়ে হয় আশি বছরের এক পীরের সাথে। চার বছর ধরে সহ্য করছে পীর আর পীরের বাকি স্ত্রী গুলোর অত্যাচার অথচ কখনো প্রতিবাদ করতে পারেনি। কেননা প্রতিবাদের ভাষা তার জানা নেই। প্রতিবাদ করতে গেলেও পারেনি। একসময় পেরেছিলো সে সেই সংসার নামক জেলখানা থেকে বের হতে। কিন্তু তারপর? আমাদের সমাজে মেয়েরা সবসময়ই অবহেলিত—উপেক্ষিত। হয়ত একটা সুন্দর স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে ওঠে কিন্তু শেষ পর্যন্ত খুব কম মেয়ের ভাগ্যেই সেটা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। গল্পের সালেহা যেন এদেশের হাজারো নারীর গল্প বলে।
  11. স্বীকৃতি : আট দশটা মেয়ের মতই জীবন ছিলো মনোয়ারার। রান্না, ছেলেমেয়ে মানুষ করা, স্বামীর সেবা করা। কিন্তু এগুলোর বাইরেও যে মেয়েদের একটা জীবন আছে সেটা তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলো জামান। সমাজে মেয়েরা যে খুব অবহেলিত সেই দিক টাই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলো সে। মেয়েদেরও যে আছে নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার অধিকার, আছে নিজেদের প্রতিভাকে সকলের সামনে তুলে ধরার অধিকার। গল্পটা যেন “অপরাধ” গল্পের ঠিক বিপরীত চিত্রকে তুলে ধরে।
  12. অতি পরিচিত : বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আসলামের সহপাঠী ট্রলি বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েই বলা চলে। ট্রলির আত্নীয়দের মধ্যে কয়েকজন আবার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আর তার বাবাও বেশ উচ্চশিক্ষিত মার্জিত লোক। কিন্তু শিক্ষিত হলেও মানুষ মানুষ যে অজ্ঞ হতে পারে তা গল্পের শেষে বুঝিয়ে দিয়েছেন লেখক।
  13. ইচ্ছা-অনিচ্ছা : স্বামী হারা বিন্তি তার সন্তানগুলো নিয়ে একা বাড়িতে থাকে, আপন বলতে যার কেউ নেই। টাকা পয়সার প্রয়োজন হলে গ্রামের মহাজনের কাছে সম্পদ বন্ধক রেখে টাকা ধার নেয়। কিন্তু গ্রামের মানুষ গুলো খোদা ভীতি দেখিয়ে নীরবে শোষণ চালায় বিন্তির উপর। একদিকে সন্তানগুলোকে নিয়ে মাথা গোজার ঠাঁই খোঁজে বিন্তি অন্যদিকে গ্রামের মোল্লা-মহাজনরা চালাতে থাকে তাদের নীরব নির্যাতন। গল্পটিতে উঠে এসেছে স্বামী হারা এক নারীর বেঁচে থাকার লড়াই, উঠে এসেছে ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষকে ঠকানো কিছু লোকের কর্মকাণ্ড।
  14. জন্মান্তর : একাত্তরে আপনজন হারানো মন্তু শহরে এসে হয়ে যায় ছিচকে পকেটমার। টুকটাক এসব সাফাইয়ের কাজে তার দিন বেশ ভালো ভাবেই চলে যায়। সেজন্য অবশ্য তাকে জেলেও যেতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। সব কিছু ঠিকভাবেই চলছিলো কিন্তু এক বৃষ্টির রাতে হঠাৎ এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা। ছাতা নিয়ে মন্তু তাকে পৌছে দিলো বাড়িতে। কিন্তু সেই বৃষ্টির রাতে ঐ পরিবারের আতিথেয়তা আর হঠাৎ এক দূর্ঘটনা শুনে জীবনকে চিনতে পারলো মন্তু। ঐ পরিবার পালটে দিয়েছিলো সেদিনের সেই পকেটমার মন্তু কে। একজন পকেটমার হয়ত খারাপ হতে পারে। কিন্তু তার ভেতরটা হয়ত একজন ভালো মানুষের, যেই ভালো মানুষের চোখ দিয়ে দেখেছে মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর জীবন সংগ্রাম।
  15. পোস্টার : সদ্য চুনকাম করা দেয়ালে সাত সকালে ‘বাঁচার মত মজুরি চাই’ পোস্টার দেখেই মেজাজ বিগড়ে গিয়েছে আফজাল সাহেবের। কয়েক দফা গালমন্দ ও করলেন যারা এগুলো লাগিয়েছে তাদের। কেননা তিনি অযথা এসব পোস্টার লাগানোর কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পান না। অফিসে যাবার পর জানতে পারলেন অফিস থেকে নাকি চাকুরিজীবীদের ছাঁটাই করা হচ্ছে আর ছাঁটাইয়ের তালিকায় আছেন তিনিও। সেদিন বাড়িতে এসে আবার দেয়ালে নতুন এক পোস্টার লাগানো দেখলেন অথচ তখন আর রাগান্বিত হতে পারলেন না বরং যৌক্তিকতা খুঁজে পেলেন এই ছেলেগুলোর পোস্টার লাগানোতে। আন্দোলন আসলে কোথা থেকে আসে সেটা আমরা সকলেই জানি কিন্তু যখন কেউ নিজে এমন কোনো পরিস্থিতিতে পড়ে তখন তাকেও মেনে নিতে হয় সেই প্রতিবাদ, শিখে নিতে হয় আন্দোলনের ভাষা।
  16. ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি : এই গল্পে লেখক জহির রায়হান বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষদের নিয়ে ছবি বানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন— যাদের কেউ কেউ তীব্র কষ্ট সহ্য করতে পারে, কেউ পারে অনিচ্ছায় তার লক্ষ্য থেকে ছিটকে যেতে, আবার কেউ কেউ হঠাৎ নিজের রঙ বদলে ফেলতে। মূলত লেখক এখানে ছবি বানানোর মাধ্যমে সীমাবদ্ধ জীবনে মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন।
  17. কতকগুলো কুকুরের আর্তনাদ : রাত দুপুরে একসাথে অনেক গুলো কুকুর ডেকে উঠলো। ঘুম ভেঙে যাওয়ায় কুকুরগুলোকে হত্যা করতে নেমে এলো কত লোক। কুকুর গুলোকে হত্যা করায় আমাদের সমাজের এক শ্রেণীর কিছু মানুষ এসে করুণ কান্না জুড়ে দিলো।মাত্র এক পৃষ্ঠার এ গল্পের মাধ্যমে লেখক মানুষ হিসেবে আমাদের অবস্থানটাকে খুব সুন্দরভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।
  18. কয়েকটি সংলাপ : ২১শে ফেব্রুয়ারীর জন্য আয়োজন চলছে। কেউ সংলাপ বলবে, কেউ আবার পাঠ করবে কবিতা। মিলিটারিরা হরতাল ডাকবে ডাকুক, ১৪৪ ধারা ডাকবে ডাকুক সেটা ভঙ্গ করেই সবাই পালন করবে একুশে ফেব্রুয়ারি। তারা যেন কেউ যুবক নয় একেকজন প্রতিবাদী মূর্তি। তাদের হটাতে পারবে না কেউ। তারা দিতে জানে ভাষার মর্যাদা, প্রকাশ করতে জানে ভাষার প্রতি তাদের ভালোবাসা। ভাষার প্রতি আসলে শ্রদ্ধা কেমন হওয়া উচিত অন্তত সেটা জানার জন্য হলেও এ গল্প পড়া উচিত সবার।
  19. দেমাক : বাস-ড্রাইভার রহিম শেখ সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাড়ি ফিরে একটু আয়েশ করেন। কিন্তু রহিম শেখের এমন জীবন যেন সহ্য করতে পারে না প্রতিবেশী রহমত আর তার স্ত্রী। রহিম শেখের সুখ যেন তাদের দু’চোখের বিষ। প্রায়ই রহিমের মেয়ের সাথে তর্কাতর্কি হয় রহমতের স্ত্রীর। একদিন হঠাৎ এক দূর্ঘটনায় পড়লেন রহিম শেখ। তারপর? গল্পটা লেখা আমাদের সমাজের এক শ্রেণির মানুষদের নিয়ে যারা কখনোই সন্তুষ্ট থাকতে পারে না; তাদের দেমাকের জোরে তারই এক জলজ্যান্ত উদাহরণ যেন এই দেমাক গল্পটি।
  20. ম্যাসাকার : একজন মিলিটারি হাসপাতালের ডাক্তার। হাসপাতালে যেমন দিয়ে চলেছেন যোদ্ধাদের সেবা তেমনি চোখের সামনে দেখেছেন কত তাজা প্রাণ মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে অথচ পারেননি তাদের রক্ষা করতে। একদিন এক সুন্দরী মেয়ের সাথে দেখা হলো ডাক্তারের। মেয়েটা অভিযোগ আনলো এই যুদ্ধের বিপক্ষে। কি লাভ এ যুদ্ধ করে, যে যুদ্ধ হাজারো নিরপরাধ প্রাণ কেড়ে নিতে পারে? যে যুদ্ধ পারে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে? একজন ডাক্তারের বয়ানে পুরো গল্পটা যেন নিয়ে গিয়েছিলো অন্য এক জগতে। ডাক্তারের চোখে দেখেছি যুদ্ধ চলাকালীন মানুষের উন্মত্ততা। লু-ই-সা-র শেষ পরিণতিটা কোনো পাষাণ হৃদয়কে কাঁদাতে যথেষ্ট।
  21. একুশের গল্প : তিন বন্ধু একসাথে থাকতো ঘুরত ফিরত। তার মধ্যে অন্যতম একজন হলো তপু। কিন্তু তপু হারিয়ে গিয়েছিলো ভাষা আন্দোলনের দিন। ফিরেও এসেছিলো আবার, কিন্তু যেভাবে ফিরে এসেছিলো সেভাবে ওর বন্ধুরা বাদে কেউ তপুকে চিনতে পারেনি। তিন বন্ধু, ভালোবাসার মানুষ আর ভাষা। ভাষার প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলে কেউ নিজের ভালোবাসার মানুষের হাত ছেড়ে দিয়ে মিছিলে যেতে পারে, এই গল্প তার জীবন্ত উদাহরণ।

Leave a Reply