» » দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : হরিদয়ালের বাটীতে

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : হরিদয়ালের বাটীতে

হরিদয়ালের বাটীতে পুরাতন দাসীটি পর্যন্ত নাই। বামুন-ঠাকরুন ত সম্পূর্ণ নিরুদ্দেশ। সরযূ যখন প্রবেশ করিল, তখন বাটীতে কেহ নাই, শূন্য বাটী হাহা করিতেছে। বৃদ্ধ সরকার কাঁদিয়া কহিল, মা, আমি তবে যাই?

সরযূ প্রণাম করিয়া নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। সরকার কাঁদিতে কাঁদিতে প্রস্থান করিল—দয়ালঠাকুরের আগমন পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে পারিল না—ইচ্ছাও ছিল না।

সন্ধ্যার সময় দয়াল বাটী আসিলেন। সরযূকে দয়াল বসিয়া থাকিতে দেখিয়া বলিলেন, কে?

সরযূ প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। মুখ তুলিয়া বলিল, আমি।

সরযূ!—দয়াল বিস্মিত হইয়া মনোযোগ-সহকারে দেখিলেন, সরযূর গাত্রে একখানিও অলঙ্কার নাই, পরিধেয় বস্ত্র সামান্য, দাসদাসী কেহ সঙ্গে আসে নাই, অদূরে একটা বাক্স মাত্র পড়িয়া আছে। ব্যাপারটা সমস্ত বুঝিয়া লইয়া বিদ্রূপ করিয়া বলিলেন, যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই হয়েচে। তাড়িয়ে দিয়েচে?

সরযূ মৌন হইয়া রহিল।

দয়ালঠাকুর তখন অতিশয় কর্কশ-কণ্ঠে কহিলেন, এখানে তোমার স্থান হবে না। একবার আশ্রয় দিয়ে আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েচে—আর নয়।

সরযূ মাথা হেঁট করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মা কোথায়?

মাগী পালিয়েচে। আমাকে ডুবিয়ে দিয়ে স’রে পড়েচে, যেমন চরিত্র, সেইরূপ করেচে। রাগে তাঁহার সর্বাঙ্গ পুড়িয়া যাইতেছিল, হঠাৎ ব্যঙ্গ করিয়া বলিয়া উঠিলেন, বলা যায় না—হয়ত কোথাও খুব সুখেই আছে।

সেইখানে সরযূ বসিয়া পড়িল। সে যে অবশেষে তাহার মায়ের কাছেই ফিরিয়া আসিয়াছিল।

দয়াল বলিতে লাগিলেন, আমি তোমাকে স্থান দিয়ে জাত হারাতে চাইনে! যারা আদর ক’রে নিয়ে গিয়েছিল, শেষকালে তারা কি তোমার মাথা রাখবার একটু কুঁড়েও বেঁধে দিতে পারেনি, তাই রেখে গেছে আমার কাছে? যাও এখান থেকে।

এবার সরযূ কাঁদিয়া ফেলিল, বলিল, দাদামশাই, মা নেই, আমি যাব কোথায়?

হরিদয়ালের শরীরে আর মায়া-মমতা নাই। তিনি স্বচ্ছন্দে বলিলেন, কাশীর মত স্থানে তোমাদের স্থানাভাব হয় না। সুবিধামত একটা খুঁজে নিয়ো। তিনি নাকি বড় জ্বালায় জ্বলিতেছিলেন, তাই এমন কথাটাও কহিতে পারিলেন।

সরযূর স্বামী তাঁহাকে গৃহে স্থান দেয় নাই, হরিদয়াল দিবেন কেন? ইহাতে তাঁহাকে দোষ দিবার কিছু নাই, সরযূ তাহা বুঝিল। কিন্তু তাহারও যে আর দাঁড়াইবার স্থান নাই। স্বামীর গৃহে দু’দিনের আদর-যত্নে অতিথির মত গিয়াছিল—এখন বিদায় হইয়া আসিয়াছে। এ সংসারে, সেই যত্নপরায়ণ গৃহস্থ আর ফিরিয়া দেখিবে না, অতিথিটি কোথায় গেল! বড় যাতনায় তাহার নীরব-অশ্রু গণ্ড বাহিয়া পড়িতেছিল। এই তাহার সতেরো বছর বয়স—তাহার সব সাধ ফুরাইয়াছে! মাতা নাই, পিতা নাই, স্বামী পরিত্যাগ করিয়াছেন। দাঁড়াইবার স্থান নাই, আছে শুধু কলঙ্ক, লজ্জা আর বিপুল রূপযৌবন ।

এ নিয়ে বাঁচা চলে, কিন্তু সরযূর চলে না। সে ভাবিতেছিল, তাহার কত আয়ু, আর কতদিন বাঁচিতে হইবে! যতদিন হউক, আজ তাহার নূতন জন্মদিন। যদিও দুঃখকষ্টের সহিত তাহার পূর্বেই পরিচয় ঘটিয়াছে, কিন্তু এরূপ তীব্র অপমান এবং লাঞ্ছনা কবে সে ভোগ করিয়াছে? দয়ালঠাকুর উত্তরোত্তর উত্তেজিত-কণ্ঠে কথা কহিতেছিলেন, এবার চিৎকার করিয়া উঠিলেন, ব’সে রইলে যে?

সরযূ আকুলভাবে জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় যাব?

আমি তার কি জানি ?

সরযূ রুদ্ধকণ্ঠে বলিল, দাদামশাই, আজ রাত্রি—

দূর দূর, একদণ্ডও না।

এবার সরয়ূ উঠিয়া দাঁড়াইল। চকিতে মনে একটু সাহস হইল, মনে করিল, যাহার কাছে শত অপরাধেও ভিক্ষা চাহিবার অধিকার ছিল, তাহার কাছেই যখন চাহি নাই, তখন পরের কাছে চাহিব কি জন্য? মনে মনে বলিল, আর কিছু না থাকে কাশীর গঙ্গা ত এখনও শুকায় নাই, সে সমাজের ভয়ও করে না, তাহার জাতিও যায় না; এ দুঃখের দিনে একটি দুঃখী মেয়েকে স্বচ্ছন্দে কোলে তুলিয়া লইবে। আমার আর কোথাও আশ্রয় না থাকে সেখানে থাকিবেই। সরযূ চলিতে লাগিল, কিন্তু চলিতে পারিল না, আবাব বসিয়া পড়িল।

দয়ালঠাকুর ভাবিলেন, এমন বিপদে তিনি জন্মে পড়েন নাই। তাঁহার গলাটা শুকাইয়া আসিতেছিল; পাছে অবশেষে দমিয়া পড়েন, এই ভয়ে চিৎকার করিয়া কহিলেন, অপমান না হলে বুঝি যাবে না? এই বেলা দূর হও—

এমন সময় সহসা বাহির হইতে ডাক আসিল, বাবাজী!

হরিদয়াল ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন । ঐ বুঝি খুড়ো আসচে। বলিতে বলিতেই কৈলাসচন্দ্র এক হাতে দাবার পুঁটুলি, অপর হাতে হুঁকা লইয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। তিনি যে এইমাত্র আসিয়াছিলেন, তাহা নহে; গোলমাল শুনিয়া বাহিরে দাঁড়াইয়া হরিদয়ালের তিরষ্কার ও গালিগালাজ শুনিতেছিলেন । তাই যখন ভিতরে প্রবেশ করিলেন, তখন হাতে দাবার পুঁটুলি ও হুঁকা ছিল, কিন্তু মুখে হাসি ছিল না। সোজা সরযূর কাছে আসিয়া দাঁডাইয়া কহিলেন, সরযূ যে! কখন এলে মা?

সরযূ কৈলাসখুড়োকে চিনিত, প্রণাম করিল।

তিনি আশীর্বাদ করিলেন, এস মা, এস। তোমাদের ছেলের বাড়িতে না গিয়ে এখানে কেন মা? তাহার পর হুঁকা নামাইয়া রাখিয়া সরযূর টিনের বাক্সটা একেবারে কক্ষে তুলিয়া লইয়া বলিলেন, চল মা, সন্ধ্যা হয়। কথাগুলি তিনি এরূপভাবে কহিলেন, যেন তাহাকে লইবার জন্যই আসিয়াছিলেন!

সরযূ কোন কথাই পরিস্কার বুঝিতে পারিল না, অধোমুখে বসিয়া রহিল।

কৈলাসচন্দ্র ব্যস্ত হইলেন, কহিলেন, তোর বুড়ো ছেলের বাড়ি যেতে লজ্জা কি? সেখানে কেউ তোকে অপমানের কথা বলবে না, মা-ব্যাটায় মিলে নূতন করে ঘরকন্না করব। চল মা, দেরি করিস নে।

সরযূ তথাপি উঠতে পারিল না। হরিদয়াল হাঁকিয়া বলিলেন, খুড়ো, কি করচো?

কিছু না বাবাজী। কিন্তু তখনই সরযূর খুব নিকটে আসিয়া হাতখানি প্রায় ধরিয়া ফেলিবার মত করিয়া নিতান্ত কাতরভাবে বলিলেন, চল্‌ না মা, বসে বসে কেন মিছে কটু কথা শুনচিস?

সরযূ উঠিয়া দাঁডাইল দেখিয়া হরিদয়াল কহিলেন, খুড়ো কি একে বাড়ি নিয়ে যাচ্চ?

খুড়ো জবাব দিলেন, না বাবা, রাস্তায় বসিয়ে দিতে যাচ্চি।

ব্যঙ্গোক্তি শুনিয়া হরিদয়াল বিরক্ত হইয়া বলিলেন, কিন্তু খুড়ো কাজটি ভাল হচ্চে না। কাল কি হবে, ভেবে দেখো।

কৈলাস তাহার উত্তর দিলেন না, কিন্তু সরযূকে কহিলেন, শিগ্‌গির চল না মা, নইলে আবার হয়ত কি ব’লে ফেলবে।

সরযূ দরজার বাহিরে আসিয়া পড়িল। কৈলাসচন্দ্রও ঘাড়ে বাক্স লইয়া পশ্চাতে চলিলেন।

হরিদয়াল পিছন হইতে কহিলেন, খুড়ো, শেষে কি জাতটা দেবে?

কৈলাসচন্দ্র না ফিরিয়াই বলিলেন, বাবাজী, নাও ত দিতে পারি।

আমাদের সঙ্গে তবে আহার বন্ধ হ’ল।

কৈলাসচন্দ্র এবার ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, কবে কার বাড়িতে দয়াল, কৈলাসখুড়ো পাত পেতেছে?

তা না পাত, কিন্তু সাবধান করে দিচ্চি।

কৈলাস ভ্রূ-কুঞ্চিত করিলেন। তাঁহার সুদীর্ঘ কাশীবাসের মধ্যে আজ তাঁহার এই প্রথম ক্রোধ দেখা দিল। বলিলেন, হরিদয়াল, আমি কি কাশীর পাণ্ডা, না যজমানের মন জুগিয়ে অন্নের সংস্থান করি? আমাকে ভয় দেখাচ্চ কেন? আমি যা ভাল বুঝি, তাই চিরদিন করেচি, আজও তাই করব। সেজন্য তোমার দুর্ভাবনার আবশ্যক নেই।

হরিদয়াল শুষ্ক হইয়া কহিলেন, তোমার ভালর জন্য—

থাক বাবাজী! যদি এই পঁয়ষট্টি বছর তোমার পরামর্শ না নিয়েই কাটাতে পেরে থাকি, তখন বাকি দু’চার বছর পরামর্শ না নিলেও আমার কেটে যাবে। যাও বাবাজী, ঘরে যাও।

হরিদয়াল পিছাইয়া পড়িলেন।

কৈলাসচন্দ্র বাটীতে পৌঁছিয়া বাক্স নামাইয়া সহজভাবে বলিলেন, এ ঘরবাড়ি সব তোমার মা, আমি তোমার ছেলে। বুড়োকে একটু-আধটু দেখো, আর তোমার নিজের ঘরকন্না চালিয়ে নিয়ো, আর কি বলব?

কৈলাসের আর কোন কথা কহিবার ছিল কি না, বলিতে পারি না, কিন্তু সরযূ বহুক্ষণ অবধি অশ্রু মুছিতে মুছিতে ভাবিয়া দেখিল, তাহার কোন কথাই আর বলিবার নাই।

সরযূ আশ্রয় পাইল।