» » সপ্তম পরিচ্ছেদ : সুলোচনা কোথায়?

সপ্তম পরিচ্ছেদ : সুলোচনা কোথায়?

কিন্তু সুলোচনা কোথায়? আজ তিন দিন ধরিয়া হরিদয়াল আহার, নিদ্রা, পূজা-পাঠ, যাত্রীর অনুসন্ধান, সব বন্ধ রাখিয়া তন্ন তন্ন করিয়া সমস্ত কাশী খুঁজিয়াও যখন তাহাকে বাহির করিতে পারিলেন না, তখন ঘরে ফিরিয়া আসিয়া শিরে করাঘাত করিয়া বলিলেন, বিশ্বেশ্বর! এ কি দুর্দৈব? অনাথাকে দয়া করিতে গিয়া শেষে কি পাপ সঞ্চয় করিলাম!

গলির শেষে কৈলাসখুড়োর বাটী। হরিদয়াল সেখানে আসিয়া দেখিলেন, কেহ নাই। ডাকিলেন, খুড়ো, বাড়ি আছ?

কেহ সাড়া দিল না দেখিয়া তিনি ঘরের মধ্যে আসিলেন, দেখিলেন, কৈলাস প্রদীপের আলোকে নিবিষ্টচিত্তে সতরঞ্চ সাজাইয়া একা বসিয়া আছে; বলিলেন, খুড়ো, একাই দাবা খেলচ?

খুড়া চাহিয়া দেখিয়া বলিলেন, এস বাবাজী, এই চালটা বাঁচাও দেখি।

হরিদয়াল বিরক্ত হইয়া মনে মনে গালি পাড়িয়া কহিলেন, নিজের জাত বাঁচে না, ও বলে কিনা দাবার চাল বাঁচাও!

কৈলাসের কানে কথাগুলো অর্ধেক প্রবেশ করিল, অর্ধেক করিল না। জিজ্ঞাসা করিলেন, কি বল বাবাজী?

বলি, সেদিনের ব্যাপারটা সব শুনেছিলে?

কি ব্যাপার?

সেই যে আমাদের ভিতরের সেদিনকার গোলযোগ!

কৈলাস কহিলেন, না বাবাজী, ভাল শুনতে পাইনি। গোলযোগ বোধ করি খুব আস্তে আস্তে হয়েছিল; কিন্তু সেদিন তোমার দাবাটা আচ্ছা চেপেছিলাম!

হরিদয়াল মনে মনে তাহার মুণ্ডপাত করিয়া কহিলেন, তা ত চেপেছিলে, কিন্তু কথাগুলো কিছুই শোননি?

কৈলাস ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিলেন, না, কিছুই প্রায় শুনতে পাইনি। অত আস্তে আস্তে গোলমাল করলে কি ক’রে শুনি বল? কিন্তু সেদিনকার খেলাটা কি রকম জমেছিল, মনে আছে? মন্ত্রীটা তুমি কোনমতেই বাঁচাতে পারতে না— আচ্ছা, এই ত ছিল, কৈ বাঁচাও দেখি কেমন—

হরিদয়াল বিরক্ত হইয়া বলিলেন, মন্ত্রী চুলোয় যাক! জিজ্ঞেস করি, সেদিনকার কথাবার্তা কিছু শোননি?

খুড়া হরিদয়ালের বিরক্ত মুখের দিকে চাহিয়া এইবার একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, কি জানি বাবাজী, স্মরণ ত কিছুই হয় না।

হরিদয়াল ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া গম্ভীরভাবে বলিলেন, আচ্ছা সংসারের যেন কোন কাজই না করলে, কিন্তু পরকালটা মান ত?

মানি বৈ কি!

তবে! সেকালের একটা কাজও করেছ কি? একদিনের তরেও মন্দিরে গিয়েছিলে কি?

কৈলাস বিস্মিত হইয়া বলিলেন, কি বল দয়াল, মন্দিরে যাইনি! কত দিন গিয়েছি।

দয়াল তেমনি গম্ভীর হইয়াই বলিতে লাগিলেন, তুমি এই বিশ বৎসর কাশীবাসী হয়েছ, কিন্তু বোধ হয় বিশ দিনও ঠাকুর দর্শন করনি—পূজা-পাঠ ত দূরের কথা!

কৈলাস প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন, না দয়াল, বিশ দিনের বেশি হবে; তবে কি জান বাবাজী, সময় পাই না ব’লেই পূজোটুজোগুলো হয়ে উঠে না। এই দেখ না, সকাল বেলাটা শম্ভু মিশিরের সঙ্গে এক চাল বসতেই হয়—লোকটা খেলে ভাল।

এ বাজি শেষ হ’তেই দুপুর বেজে যায়, তারপর আহ্নিক সেরে পাক করতে, আহার করতে বেলা শেষ হয়। তারপর বাবাজী, গঙ্গা পাঁড়ের—তা যাই বল, লোকটার খেলার বড় তারিফ—আমাকে ত সেদিন প্রায় মাত করেছিল। ঘোড়া আর গজ দু’টো দু’কোণ থেকে চেপে এসে—আমি বলি বুঝি—

আঃ থামো না খুড়ো—দুপুর বেলা কি কর, তাই বল।

দুপুর বেলা! গঙ্গা পাঁড়ের সঙ্গে—তার গজ দু’টো—এই কালই দেখ না—

দয়াল অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বাধা দিয়া বলিলেন, হয়েচে, হয়েচে—দুপুর বেলা গঙ্গা পাঁড়ে আর সন্ধ্যার পর মুকুন্দ ঘোষের বৈঠকখানা—আর তোমার সময় কোথায়!

কৈলাস চুপ করিয়া রহিলেন—হরিদয়াল অধিকতর গম্ভীর হইয়া উপদেশ দিতে লাগিলেন, কিন্তু খুড়ো, দিনও ত আর বেশি নেই। পরকালের জন্যও প্রস্তুত হওয়া উচিত, আর সে কথা কিছু কিছু ভাবাও দরকার। দাবার পুঁটলিটা আর সঙ্গে নিতে পারবে না।

কৈলাস হঠাৎ হোহো করিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন, না না দয়াল, দাবার পুঁটুলিটা বোধ করি সঙ্গে নিতে পারব না। আর প্রস্তুত হ’বার কথা বলচ বাবাজী? প্রস্তুত আমি হয়েই আছি। যেদিন ডাক আসবে, ঐটে কারো হাতে তুলে দিয়ে সোজা রওনা হয়ে পড়ব—সেজন্যে চিন্তার বিষয় আর কি আছে?

কিছুই নেই? কোন শঙ্কা হয় না?

কিছু না, বাবাজী, কিছু না। যেদিন কমলা আমার চলে গেল, যেদিন কমলচরণ আমার মুখের পানেই চোখ রেখে চোখ বুজলে, সেদিন থেকেই শঙ্কা, ভয় প্রভৃতি উপদ্রবগুলো তাদের পিছনে পিছনেই চলে গেল—কেমন ক’রে যে গেল, সে কথা একদিনের তরে জানতে পারলাম না বাবাজী—বলিতে বলিতে বৃদ্ধের চোখ দু’টি ছলছল করিয়া আসিল।

দয়াল বাধা দিয়া বলিলেন, থাক সে-সব কথা। এখন আমার কথাটা শুনবে?

বল বাবাজী।

দয়াল তখন সেদিনের কাহিনী একে একে বিবৃত করিযা শেষে বলিলেন, এখন উপায়?

শুনিতে শুনিতে কৈলাসের সদাপ্রফুল্ল মুখশ্রী পাংশুবর্ণ হইল। কাতরকণ্ঠে তিনি বলিলেন, এমন হয় না, হরিদয়াল। সুলোচনা সতী-সাবিত্রী ছিলেন।

দয়াল কহিলেন, আমিও তাই ভেবেছিলাম, কিন্তু স্ত্রীলোকে সকলই সম্ভব।

ছি, অমন কথা মুখে এনো না। মানুষ-মাত্রেই পাপপুণ্য ক’রে থাকে—এতে স্ত্রী-পুরুষের কোন প্রভেদ দেখিনে। বাবাজী, তোমার জননীর কথা কি স্মরণ হয় না, সে স্মৃতি একেবারে মুছে ফেলেচ?

হরিদয়াল লজ্জিত হইলেন, অথচ বিরক্তও হইলেন, কিছুক্ষণ অধোমুখে থাকিয়া তিনি বলিলেন, কিন্তু এখন যে জাত যায়।

কৈলাস বলিলেন, একটা প্রায়শ্চিত্ত কর। অজানা পাপের প্রায়শ্চিত্ত নেই কি?

আছে, কিন্তু এখানকার লোকে আমাকে যে একঘরে করবে?

করলেই বা—

হরিদয়াল এবার বিষম ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, করলেই বা! কি বলছ! একটু বুঝে বল খুড়ো।

বুঝেই বলছি, দয়াল! তোমার বয়সও কম হয়নি—বোধ করি পঞ্চাশ পার হ’ল। এতটা বয়স জাত ছিল, বাকি দু’চার বছর না হয় নাই রইল, বাবাজী, এতই কি তাতে ক্ষতি?

ক্ষতি নেই? জাত যাবে, ধর্ম যাবে, পরকালে জবাব দেব কি?

কৈলাস কহিলেন, এই জবাব দেবে যে একজন অনাথাকে আশ্রয় দিয়েছেলে।

হরিদয়াল চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিলেন। কথাটা তাঁহার মনের সঙ্গে একেবারেই মিলল না। কিছুক্ষণ পরে বলিলেন, তবে সুলোচনার জামায়ের ঠিকানা দেব না।

কিছুতেই না। এক ব্যাটা বদমায়েস—মাতাল—সে ভয় দেখিয়ে তোমার কাছে টাকা আদায় করবে, আর এক ভদ্র-সন্তানের কাছে টাকা আদায় করবে, আর তুমি তার সাহায্য করবে?

কিন্তু না করলে যে আমার সর্বস্ব যায়! একজনও যজমান আসবে না। আমি খাব কি ক’রে?

কৈলাস বলিলেন, সে ভয় করো না। আমি সরকার বাহাদুরের কল্যাণে বিশ টাকা পেন্সন পাই, খুড়োভাইপোর তাতেই চলে যাবে। আমরা খাব, আর দাবা খেলব, ঘর থেকে কোথাও বেরোব না।

বিরক্ত হইলেও এরূপ বালকের মত কথায় হরিদয়াল হাসিয়া বলিলেন, খুড়ো, আমার বোঝা তুমিই বা কেন ঘাড়ে নেবে, আর আমিই বা কেন পরের হাঙ্গামা মাথায় বয়ে জাত-ধর্ম খোয়াব? তার চেয়ে—

কৈলাস বলিলেন, ঠিক ত। তার চেয়ে তাদের নাম-ধাম ঠিকানা ব’লে দিয়ে একজন দরিদ্র বালিকাকে তার স্বামী, সংসার, সন্মান, সমস্ত হ’তে বঞ্চিত ক’রে এই বুড়ো হাড়গোড়গুলো ভাগাড়ের শিয়াল-কুকুরের গ্রাস থেকে বাঁচাতে হবে! বাঁচাও গে বাবাজী, কিন্তু আমাকে বলতে এসে ভাল করনি। তবে যখন মতলব নিতেই এসেছ, তখন আর একটা কথা ব’লে দিই। ৺কাশীধাম, মা অন্নপূর্ণার রাজত্ব। এখানে বাস ক’রে তাঁর সতী মেয়েদের পিছনে লেগে মোটের উপর বড় সুবিধা হবে না বাবা।

হরিদয়াল ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, খুড়ো কি এবার শাপ-সম্পাত করচ!

না। তোমরা কাশীর পাণ্ডা, স্বয়ং বাবার বাহন, আমাদের শাপ-সম্পাত তোমাদের লাগবে না—সে ভয় তোমার নেই, কিন্তু যে কাজে হাত দিতে যাচ্চ, বাবা, সে বড় নিরাপদ জিনিস নয়। সতী-সাবিত্রীকে যমে ভয় করে। সেই কথাটাই মনে করিয়ে দিচ্চি। অনেকদিন একসঙ্গে দাবা খেলেচি—তোমাকে ভালও বাসি।

হরিদয়াল জবাব দিলেন না, মুখ কালি করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

কৈলাস বলিলেন, বাবাজী, কথাটা তাহ’লে রাখবে না?

হরিদয়াল বলিলেন, পাগলের কথা রাখতে গেলে পাগল হওয়া দরকার।

কৈলাস চুপ করিয়া রহিলেন, হরিদয়াল বাহির হইয়া গেলেন।

কৈলাস দাবার পুঁটুলিটা টানিয়া লইয়া গ্রন্থি বাঁধিতে বাঁধিতে মনে মনে ভাবিলেন, বোধ হয় ওর কথাই ঠিক। আমার পরামর্শ হয়ত সংসারে সত্যই চলে না। মানুষ মরিলে লোকাভাব হইলে কেহ কেহ ডাকিতে আসে—দাহ করিতে হইবে। রোগ হইলে ডাকিতে আসে—শুশ্রূষা করিতে হইবে। আর সতরঞ্চ খেলিতে আসে। কৈ, এত বয়স হইল, কেহ ত কখন পরামর্শ করিতে আসে নাই!

কিন্তু অনেক রাত্রি পর্যন্ত ভাবিয়াও তিনি স্থির করিতে পারিলেন না, কেন, এই সূর্যের আলোর মত পরিষ্কার এবং স্ফটিকের মত স্বচ্ছ জিনিসটা লোক-গ্রাহ্য হয় না, কেন এই সহজ প্রাঞ্জল ভাষাটা সংসারের লোক বুঝিয়া উঠিতে পারে না।

সেই রাত্রেই হরিদয়াল অনেক চিন্তার পর মন স্থির করিয়া চন্দ্রনাথের খুড়ো, মণিশঙ্করকে পত্র লিখিয়া দিলেন যে, চন্দ্রনাথ স্বেচ্ছায় এক বেশ্যা-কন্যা বিবাহ করিয়া ঘরে লইয়া গিয়াছেন।