» » পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : এই দুই বৎসর

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : এই দুই বৎসর

এই দুই বৎসরের মধ্যে চন্দ্রনাথের সহিত তাহার বাটীর সম্বন্ধই ছিল না। শুধু অর্থের প্রয়োজন হইলে সরকারকে পত্র লিখিত, সরকার লিখিত ঠিকানায় টাকা পাঠাইয়া দিত।

দুঃখ করিয়া হরকালী মধ্যে মধ্যে পত্র লিখিতেন। ব্রজকিশোর ফিরিয়া আসিবার জন্য অনুরোধ করিয়া চিঠি দিতেন। মণিশঙ্করও দুই-একখানা পত্র লিখিয়াছিলেন যে, তাঁহার শারীরিক অবস্থা ক্রমশঃ মন্দ হইয়া আসিতেছে, এ সময় একবার দেখিবার ইচ্ছা করে।

প্রথমে চন্দ্রনাথ সে-সকল কথায় কর্ণপাত করিত না, কিন্তু, যেদিন হরিবালা লিখিলেন, তুমি সুবিধা পাইলে একবার আসিয়ো, কিছু বলিবার আছে, সেই দিন চন্দ্রনাথ তল্পি বাঁধিয়া গাড়িতে উঠিল।

হরিবালা যদি কিছু কহেন, যদি কোন পত্র, যদি কোন হস্তলিপি দেখাইতে পারেন, যদি সেই বিগত সুখের একটু আভাস তাহাতে দেখিতে পাওয়া যায়,—তাহা হইলে—কিছু নয়। তথাপি চন্দ্রনাথ বাটী অভিমুখে ছুটিয়া আসিতে চাহিল। কিন্তু এতখানি পথ যে আশায় ভর করিয়া ছুটিয়া আসিল, বাটীতে আসিয়া তাহার কিছুই মিলিল না। হরিবালার সহিত সাক্ষাৎ হইলে জিজ্ঞাসা করিল, ঠানদিদি, আর কিছু বলবে না?

না, আর কিছু না।

নিরাশ হইয়া চন্দ্রনাথ কহিল, তবে কেন মিথ্যা ক্লেশ দিয়ে ফিরিয়ে আনলে?

বাড়ি না এলে কি ভাল দেখায়? তাহার পর দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল, দাদা, যা হবার হয়েছে—এখন তুমি সংসারী না হ’লে আমাদের দুঃখ রাখবার স্থান থাকবে না।

চন্দ্রনাথ বিরক্ত হইয়া মুখ ফিরাইয়া বলিল, তা আমি কি করব?

কিন্তু মণিশঙ্কর কিছুতেই ছাড়িলেন না। হাত ধরিয়া বলিলেন, বাবা, আমাকে মাপ কর। সেই দিন থেকে যে জ্বালায় জ্বলে যাচ্চি তা শুধু অন্তর্যামীই জানেন।

চন্দ্রনাথ বিপন্ন হইল, কিন্তু কথা কহিতে পারিল না।

মণিশঙ্কর পুনরপি বলিতে লাগিলেন, আবার বিবাহ ক’রে সংসারধর্ম পালন কর। আমি তোমার মনোমত পাত্রী অন্বেষণ করে রেখেচি, শুধু তোমার অভিপ্রায় জানবার অপেক্ষায় এখনও কথা দিইনি। বাবা, এক সংসার গত হ’লে লোকে কি দ্বিতীয় সংসার করে না?

চন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে কহিল, এক সংসার গত হয়েচে—সে সংবাদ পেলে পারি।

দুর্গা—দুর্গা—এমন কথা বলতে নেই বাবা।

চন্দ্রনাথ চুপ করিয়া রহিল।

মণিশঙ্কর হঠাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিলেন, আমার মনে হয়, আমিই তোমাকে সংসারত্যাগী করিয়েচি। এ দুঃখ আমার ম’লেও যাব না।

চন্দ্রনাথ বহুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিল, কোথায় সম্বন্ধ স্থির করেচেন?

মণিশঙ্কর চক্ষু মুছিয়া উঠিয়া বসিলেন। বলিলেন, কলকাতায়; তুমি একবার নিজে দেখে এলেই হয়।

চন্দ্রনাথ কহিল, তবে কালই যাব।

মণিশঙ্কর আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, তাই করো। যদি পছন্দ হয় আমাকে পত্র লিখো, আমি বাটীর সকলকে নিয়ে একেবারে কলকাতায় উপস্থিত হব। কিছুক্ষণ থামিয়া বলিলেন, আমার আর বাঁচবার বেশি দিন নেই চন্দ্রনাথ, তোমাকে সংসারী এবং সুখী দেখলেই স্বচ্ছন্দে যেতে পারব।

পরদিন চন্দ্রনাথ কলিকাতায় আসিল। সঙ্গে মাতুল ব্রজকিশোরও আসিয়াছিলেন। কন্যা দেখা শেষ হইলে ব্রজকিশোর বলিলেন, কন্যাটি দেখিতে মা-লক্ষ্মীর মত।

চন্দ্রনাথ মুখ ফারাইয়া রহিল, কোনও মতামত প্রকাশ করিল না।

স্টেশনে আসিয়া টিকিট লইয়া দুইজনে গাড়িতে উঠিলে ব্রজকিশোর জিজ্ঞাসা করিলেন, তবে বাবাজী, পছন্দ হয়েছে ত?

চন্দ্রনাথ মাথা নাড়িয়া বলিল, না।

ব্রজকিশোর যেন আকাশ হইতে পড়িলেন,—এমন মেয়ে, তবু পছন্দ হ’ল না?

চন্দ্রনাথ মাথা নাড়িয়া বলিল, না।

ব্রজকিশোর মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, তিনি সরযূকে দেখেন নাই।

তাহার পর নির্দিষ্ট স্টেশনে ট্রেন থামিলে ব্রজকিশোর নামিয়া পড়িলেন। চন্দ্রনাথ এলাহাবাদের টিকিট লইয়াছিল।

ব্রজকিশোর বলিলেন, তবে কতদিনে ফিরবে?

কাকাকে প্রণাম জানিয়ে বলবেন, শীঘ্র ফেরবার ইচ্ছা নেই।

মণিশঙ্কর সে কথা শুনিয়া কপালে করাঘাত করিয়া কহিলেন, যা হয় হবে। আমার দেহটা একটু ভাল হ’লেই নিজে গিয়ে বউমাকে ফিরিয়ে আনব। মিথ্যা সমাজের ভয় ক’রে চিরকাল নরকে পচতে পারব না—আর সমাজই বা কে? সে ত আমি নিজে।

হরকালী এ সংবাদ শুনিয়া দন্তে দন্তে ঘর্ষণ করিয়া বলিলেন, মরবার আগে মিন্‌সের বায়াত্তুরে ধরেচে! সরকারকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, চন্দ্রনাথ কি বললে?

সরকার কহিল, আজ পর্যন্ত কত টাকা কাশীতে পাঠানো হয়েচে?

শুধু এই জিজ্ঞেস করেছিল—আর কিছু না?

না।

হরকালী মুখের ভাব অতি ভীষণ করিয়া চলিয়া গেলেন।