চন্দ্রনাথ একজন উচ্চ বংশীয় ব্রাহ্মণ। সম্প্রতি তার পিতা গত হয়েছে। সে কাশীতে তার পিতার এক পুরনো ভৃত্যের বাড়িতে উঠে। সেখানে তার সরযূর সাথে দেখা হয়। সরযূর মা সুলোচনা সেই ভৃত্যের বাড়িতে কাজ করে। চন্দ্রনাথ সরযূকে পছন্দ করে এবং বিয়ে করে। কিন্তু তার কাকাকে না জানানোয় তিনি রাগান্বিত হন। তার চাচাত বোন নির্মলা বৌদি দেখতে তার বাড়িতে আসে এবং নতুন বৌদিকে তার খুব পছন্দ হয়। এদিকে হরিদয়াল ঘোষাল নামে এক লম্পট তার কাকা মণিশঙ্কর মুখার্জির কাছে সুলোচনা সম্পর্কিত একটি চিঠি পাঠায়। সুলোচনার নিম্নবর্ণের কথা জানতে পেরে চন্দ্রনাথ তার গর্ভবতী স্ত্রীকে রেখে চলে যায়। সরযূ মণি খুড়োর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখানে তার একটি ছেলে সন্তান হয়। মণিশঙ্কর কাকা তার ভুল বুঝতে পেরে চন্দ্রনাথকে সরযূকে ফিরিয়ে আনতে পাঠায়। কাশী গিয়ে সে জানতে পারে সরযূ মণি খুড়োর বাড়িতে আছে। সেখানে গিয়ে চন্দ্রনাথের তার স্ত্রী আর ছেলের সাথে দেখা হয়। অন্যদিকে মণি খুড়ো তাদের সম্ভাব্য বিরহে অনমনে হয়ে যায় এবং মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

 চন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের একটি জনপ্রিয় উপন্যাস। এই উপন্যাসটিতে চন্দ্রনাথ এবং সূর্যের প্রেমের গল্প বর্ণনা করা হয়েছে। শরৎচন্দ্র যেভাবে কোমল বয়সে দৃহ বন্ধনে আবদ্ধ চন্দ্রনাথ এবং সূর্যের প্রেম দেখিয়েছেন তা আশ্চর্যজনক। পাঠক ভাবনায় নিমজ্জিত হবেন এই ভেবে যে শরৎচন্দ্র জীবনের বিভিন্ন সমস্যা এবং সামাজিক বাধা ভেঙে কিভাবে সময়ের সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হয় তা রক্ষণশীল সমাজে এইভাবে উপস্থাপন করেছেন।

চন্দ্রনাথ ১৩২০ সালের বৈশাখ থেকে আশ্বিন সংখ্যা পর্যন্ত ‘যমুনা’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১২ মার্চ ১৯১৬ খৃষ্টাব্দে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন রায় এম. সি. সরকার বাহাদুর এণ্ড সন্স। এর চতুর্দশ সংস্করণে নিম্নলিখিত বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয়—

“চন্দ্রনাথ গল্পটি আমার বাল্যরচনা। তখনকার দিনে গল্পে উপন্যাসে কথোপকথনে যে ভাষা ব্যবহার করা হইত এই বইখানিতে সেই ভাষাই ছিল। বর্তমান সংস্করণে মাত্র ইহাই পরিবর্তিত করিয়া দিলাম। ইতি, ১৮ই আশ্বিন ১৩৪৪।

গ্রন্থাকার”

১৮ই জুন, ১৯২০ খৃষ্টাব্দে ‘শরৎচন্দ্রের গ্রন্থাবলী’র তৃতীয় খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বসুমতী সাহিত্য-মন্দির কর্তৃক প্রকাশিত।

‘চন্দ্রনাথে’র ছাপা নিয়ে বেশ গোলযোগের সৃষ্টি হয়। ‘চন্দ্রনাথে’র পাণ্ডুলিপি সুরেন্দ্রনাথের কাছ থেকে উপেন্দ্রনাথের হাতে আসবার পর ‘যমুনা’য় প্রকাশিত হবে বলে বিজ্ঞাপন বেরোয়। অসন্তুষ্ট সুরেন্দ্রনাথ উপেনবাবুর কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি ফেরত চেয়ে পাঠান। উপেনবাবুর কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি নিয়ে সুরেনবাবু ‘চন্দ্রনাথে’র পাণ্ডুলিপি রেঙ্গুনে শরৎচন্দ্রের নিকট পাঠালে, তিনি সংশোধন করে ফণীন্দ্র পালের কাছে ফেরত দিলেন ‘যমুনা’য় প্রকাশের জন্য। ১৩ই জানুয়ারী, ১৯১৩ উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে লিখেছেন শরৎচন্দ্র: “…যদি ‘চন্দ্রনাথ’ পাঠান সম্ভব হয় এবং সুরেনের যদি অমত না থাকে, তাহলে যা সাধ্য সংশোধন করে ফণীকে পাঠাব…”। ঐ বছরের ২৬ এপ্রিল তিনি উপেন্দ্রনাথকে লিখেছেন: “…শুধু একটা চন্দ্রনাথ লইয়া এত হাঙ্গামা। অথচ, সেটা যে কি রকম ভাবে ফণী পালের কাগজে বার হবে ঠিক বুঝিতে পারিতেছি না।

“তোমরা সব দিক না বুঝিয়া, সব দিক না সামলাইয়া হঠাৎ একটা বিজ্ঞাপন দিয়া অনেকটা নির্বোধের কাজ করিয়াছ। এবং তাহারি ফল ভুগিতেছ। দোষ তোমাদেরি—আর বড় কারু নয়। ফণী পালের জন্য তুমি কতকটা যে false position-এ পড়িয়াছ তাহা প্রতি পদে দেখিতে পাইতেছি।

“আমি আরও বিপদে পড়িয়াছি। একে আমার একেবারে ইচ্ছা নয়, ‘চন্দ্রনাথ’ যেমন আছে তেমনি ভাবে ছাপা হয়, অথচ সেটা খানিকটা ছাপা হয়েও গেছে। আবার বাকীটাও হাতে পাই নাই। সুরেনের বড় ভয়, পাছে ও জিনিসটা হারিয়ে যায়। ওরা আমার লেখাকে হৃদয় দিয়া ভালবাসে—বোধ করি তাই এদের এত সার্থকতা।”

মে মাসে (১৯১৩) উপেনবাবুকে অপর একটি পত্রে লিখেছেন: “আমি ত ‘চন্দ্রনাথ’কে একেবারে নূতন ছাঁচে ঢালবার চেষ্টায় আছি, অবশ্য গল্প (plot) ঠিক তাই থাকবে।”

যমুনা সম্পাদক ফণীন্দ্রনাথ পালকে ২ ফেব্রুয়ারি (১৯১৩) শরৎচন্দ্র লেখেন, “‘চন্দ্রনাথ’ নিয়ে কি একটা বোধ করি হাঙ্গামা আছে তাই বলি ওতে আর কাজ নেই। *** চন্দ্রনাথ আর চাইবেন না। যদি দরকার হয় আমি আবার লিখে দেব। সে লেখা ভাল বৈ মন্দ হবে না।” অপর একটি পত্রে ফণীন্দ্রনাথকে লেখেন: “চন্দ্রনাথ লইয়া ভারী গোলমাল হইতেছে। না জানিয়া হাতে না পাইয়া এইসব বিজ্ঞাপন প্রভৃতি দেওয়া ছেলেমানুষির একশেষ। তাহারা সমস্ত বই ‘চন্দ্রনাথ’ দিবে না; এজন্য মিথ্যা চেষ্টা করিবেন না। তবে, নকল করিয়া একটু একটু করিয়া পাঠাইবে। অনেক ভুলভ্রান্তি আছে, সেগুলি সংশোধন করিতে যদি পাই ত ছাপা হতে পারে, অন্যথা নিশ্চয় নয়। *** যদি চন্দ্রনাথ বৈশাখেই শুরু হইয়াই গিয়া থাকে (অবশ্য সে অবস্থায় আর উপায় নাই) তাহা হইলেও আমাকে বাকীটা পরিবর্তন পরিবর্জন ইত্যাদি করিতেই হইবে। বৈশাখে যতুটু বাহির হইয়াছে দেখিতে পাইলে আমি বাকীটা হাতে না পাইলেও খানিকটা খানিকটা করিয়া লিখিয়া দিব।

“সেদিন গিরীনের পত্র পাই—তাঁহাদের সহিত উপীনের ‘চন্দ্রনাথ’ লইয়া কিছু বকাবকির মত হইয়া গিয়াছে। তাঁরা যদিও আপনার প্রতি বিরূপ নন, তত্রাচ এই ঘটনাতে এবং “কাশীনাথের” ‘সাহিত্যে’ প্রকাশ হওয়া ব্যাপারে তাঁরা ‘চন্দ্রনাথ’ দিতে সম্মত নন। তাঁরা আমার লেখাকে বড় ভালবাসেন। হারিয়ে যায় এই ভয় তাঁদের। এবং পাছে আর কোন্ কাগজওয়ালা ওটা হাতে পায় এই জন্য সুরেন নকল করিয়া একটু একটু করিয়া পাঠাইবার মতলব করিয়াছে। ‘চন্দ্রনাথ’ যদি বৈশাখে ছাপা হইয়া গিয়া থাকে আমাকে চিঠি লিখিয়া কিংবা তার দিয়া জানান ‘Yes or No’. আমি তারপরে সুরেনকে আর একবার অনুরোধ করিয়া দেখিব। এই বলিয়া অনুরোধ করিব যে আর উপায় নাই দিতেই হইবে। *** শুধু চন্দ্রনাথ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হইয়া রহিলাম। ওটা কেমন গল্প, কি রকম লেখার প্রণালী না জেনে প্রকাশ করা উচিত নয় বলে ভয় হচ্ছে। ‘চন্দ্রনাথ’ ছাপাবেন না, কারণ যদি ছাপানই মনে হয় ত একটু নূতন করে দিতে হবে।” (২৮ মার্চ ১৯১৩ খ্রী.)।