» » ষোড়শ পরিচ্ছেদ : চন্দ্রনাথ

ষোড়শ পরিচ্ছেদ : চন্দ্রনাথ

চন্দ্রনাথ এলাহাবাদের টিকিট কিনিয়াছিল, কিন্তু পথিমধ্যে অকস্মাৎ সঙ্কল্প পরিবর্তন করিয়া কাশী আসিয়া উপস্থিত হইল।

সঙ্গে যে দুইজন ভৃত্য ছিল, তাহারা গাড়ি ঠিক করিয়া জিনিসপত্র তুলিল; কিন্তু চন্দ্রনাথ তাহাতে উঠিল না; উহাদিগকে ডাকবাংলায় অপেক্ষা করিয়া থাকিবার হুকুম দিয়া পদব্রজে অন্য পথে চলিয়া গেল। পথে চলিতে তাহার ক্লেশ বোধ হইতেছিল। মুখ শুষ্ক, বিবর্ণ, নিজের প্রতি পদক্ষেপ নিজের বুকের উপরেই যেন পদাঘাতের মত বাজিতে লাগিল, তথাপি চন্দ্রনাথ চলিতে লাগিল, থামিতে পারিল না। ক্রমেই হরিদয়ালের বাটীর দূরত্ব কমিয়া আসিতেছে। এ সমস্তই যে তাহার বিশেষ পরিচিত পথ! গলির মোড়ের সেই ছোট চেনা দোকানটি—ঠিক তেমনি রহিয়াছে। দোকানের মালিক ঠিক তত বড় ভুঁড়িটি লইয়াই মোড়ার উপর বসিয়া ফুলুরি ভাজিতেছে। চন্দ্রনাথ একবার দাঁড়াইল, দোকানদার চাহিয়া দেখিল, কিন্তু সাহেবী পোশাক-পরা লোকটিকে সাহস করিয়া ফুলুরি কিনিতে অনুরোধ করিতে পারিল না, একবার চাহিয়াই সে নিজের কাজে মন দিল।

চন্দ্রনাথ চলিয়া গেল। এই মোড়ের শেষে—আর ত তাহার পা চলে না। সঙ্কীর্ণ কাশীর পথে যেন বিন্দুমাত্র বাতাস নাই, শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্লেশ হইতেছে, দুই-এক পা গিয়া সে দাঁড়ায়—আবার চলে, আবার দাঁড়ায়, পথ আর ফুরায় না, তথাপি মনে হয়, এ পথ যেন না ফুরায়! পথের শেষে না জানি কিবা দেখিতে হয়! তারপর হরিদয়ালের বাটীর সম্মুখে আসিয়া সে দাঁড়াইল। বহুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল, ডাকিতে চাহিল, কিন্তু গলা শুকাইয়া গিয়াছে।

বদ্ধ-স্বর, ভগ্ন-শব্দ করিয়া থামিয়া গেল। ঘড়ি খুলিয়া দেখিল, নয়টা বাজিয়া গিয়াছে, তখন সাহস করিয়া ডাকিল, ঠাকুর, দয়ালঠাকুর! কেহ উত্তর দিল না। পথ দিয়া যাহারা চলিয়া যাইতেছিল, অনেকেই চন্দ্রনাথের রীতিমত সাহেবী পোশাক দেখিয়া ফিরিয়া চাহিল। চন্দ্রনাথ আবার ডাকিল, দয়ালঠাকুর!

এবার ভিতর হইতে স্ত্রী-কণ্ঠে উত্তর আসিল, ঠাকুর বাড়ি নেই।

যে উত্তর দিল সে একজন বাঙ্গালী দাসী।

সে দ্বার পর্যন্ত আসিয়া চন্দ্রনাথের পোশাক-পরিচছদ দেখিয়া লুকাইয়া পড়িল কিন্তু মাতৃভাষায় কথা কহিতে শুনিয়া একেবারে ভয়ে অভিভূত হইয়া পলাইয়া গেল না। অন্তরাল হইতে বলিল, ঠাকুর বাড়ি নেই।

কখন আসবেন?

দুপুরবেলা।

চন্দ্রনাথ ভিতরে প্রবেশ করিল। আনন্দ, শঙ্কা ও লজ্জা তিনের সংমিশ্রণে বুকের ভিতর কাঁপিয়া উঠিল—ভিতরে সরযূ আছে। কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করিয়া আর কাহাকেও দেখিতে পাইল না। জিজ্ঞাসা করিল, বাড়িতে আর কেউ নেই?

না।

তারা কোথা?

কারা?

একজন স্ত্রীলোক—

এই আমি ছাড়া আর ত কেউ এখানে নাই!

একটা ছোট ছেলে?

না, কেউ না।

চন্দ্রনাথ পইঠার উপরে বসিয়া পড়িল, এরা তবে গেল কোথায়?

দাসী বিব্রত হইয়া পড়িল। বলিল, না গো, এখানে কেউ থাকে না। আমি আর ঠাকুরমশাই থাকি। এক মাসের মধ্যে কোন যজমানও আসেনি।

চন্দ্রনাথ স্তব্ধ হইয়া মাটির দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল। মনে যে-সব কথা উঠিতেছিল, তাহা অন্তর্যামীই জানেন। বহুক্ষণ পরে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কতদিন এখানে আছ?

প্রায় দেড় বছর।

তবুও কাউকে দেখনি? একজন গৌরবর্ণ স্ত্রীলোক আর একটি ছেলে, না হয় মেয়ে, না হয় শুধু ঐ স্ত্রীলোকটি, কেউ না, কাউকে দেখনি?

না, আমি কাউকে দেখিনি।

কারো মুখে কোন কথা শোননি?

না

চন্দ্রনাথ আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিল না। সেইখানে দয়ালঠাকুরের অপেক্ষা করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার সেই সরযূ আর বাঁচিয়া নাই, তাহা সে বেশ বুঝিতেছিল, তথাপি শুনিয়া যাওয়া উচিত, এই জন্যই বসিয়া রহিল। এক-একটি মিনিট এক-একটি বৎসর বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।

দ্বিপ্রহর উত্তীর্ণ হইলে হরিদয়াল ঠাকুর বাটী আসিলেন। প্রথম দৃষ্টিতে তিনি চমকিত হইলেন, পরে চিনিতে পারিয়া শুষ্কস্বরে কহিলেন, তাইত, চন্দ্রবাবু যে, কখন এলেন?

চন্দ্রনাথ ভগ্নকণ্ঠে কহিল, অনেকক্ষণ, এরা কোথায়?

হ্যাঁ এরা—তা এরা—

চন্দ্রনাথ টলিতে টলিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। প্রাণপণ-শক্তিতে নিজেকে সংবরণ করিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কবে শেষ হ’ল?

কি শেষ হল?

চন্দ্রনাথ শুষ্ক-ভগ্নকণ্ঠে চিৎকার করিয়া বলিল, সরযূ কবে মরেছে ঠাকুর?

ঠাকুর এবার বুঝিয়া বলিলেন, মরবে কেন, ভালই আছে।

কোথায় আছে?

কৈলাসখুড়োর বাড়িতে।

সে কোথায়?

এই গলির শেষে। কাঁটালতলার বাড়িতে।

কপাল টিপিয়া ধরিয়া চন্দ্রনাথ পুনর্বার বসিয়া পড়িল। বহুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, তাহার পর শান্তকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, সে এখানে নেই কেন?

দয়ালঠাকুর ভাবিলেন, মন্দ নয়; এবং মিথ্যা লজ্জিত হইবার কোন কারণ নাই ভাবিয়া সাহস সঞ্চয় করিয়া বলিলেন, আপনি যাকে বাড়িতে জায়গা দিতে পারলেন না, আমি দেব কি বলে? আমারো ত পাঁচজনকে নিয়েই কাজ?

চন্দ্রনাথ বুঝিল, এ কথা সম্পূর্ণ সত্য। একটু ভাবিয়া বলিল, কৈলাসখুড়ার বাড়িতে কেমন ক’রে গেল?

তিনি নিজে নিয়ে গেছেন।

কে তিনি?

কাশীবাসী একজন দুঃখী ব্রাহ্মণ।

সরযূ তাঁকে আগে থেকেই চিনত কি?

হ্যাঁ, খুব চিনত।

তাঁর বয়স কত?

বুড়া হরিদয়াল মনে মনে হাসিয়া বলিলেন, তাঁর বয়স বোধ হয় ষাট-বাষট্টি হবে। সরযূকে মা ব’লে ডাকেন।

সেখানে আর কে আছে?

একজন দাসী, সরযূ আর বিশু।

বিশু কে?

সরযূর ছেলে।

চন্দ্রনাথ দাঁড়াইয়া বলিল, যাই।

হরিদয়াল গতিরোধ করিলেন না। চন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। গলির শেষে আসিয়া একজনকে জিজ্ঞাসা করিল, কৈলাসখুড়ার বাড়ি কোথায় জান? সে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইয়া দিল।

চন্দ্রনাথ একেবারে ভিতরে প্রবেশ করিল। সম্মুখে কাহাকেও দেখিতে পাইল না, শুধু সুন্দর হৃষ্টপুষ্ট-দেহ একটি শিশু ঘরের সম্মুখের বারান্ডায় বসিয়া একথালা জল লইয়া সর্বাঙ্গে মাখিতেছিল এবং মাঝে মাঝে পরম পরিতোষের সহিত দেখিতেছিল, তাহার কচি মুখখানির কালো ছায়া কেমন করিয়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া তাহার সহিত সহাস্যে পরিহাস করিতেছে। চন্দ্রনাথ তাহাকে একেবারে বুকে তুলিয়া লইয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। শিশু বিস্ময় বা ভয়ের চিহ্ন প্রকাশ করিল না। দেখিলে বোধ হয়, অপরিচিত লোকের ক্রোড়ে যাওয়া তাহার কাছে নূতন নহে। সে চন্দ্রনাথের নাকের উপর কচি হাতখানি রাখিয়া, মুখপানে চাহিয়া বলিল, তুমি কে?

চন্দ্রনাথ গভীর-স্নেহে তাহার মুখচুম্বন করিয়া বলিল, আমি বাবা।

বাবা?

হ্যাঁ বাবা, তুমি কে?

আমি বিতু!

চন্দ্রনাথ ঘড়ি-চেন বুক হইতে খুলিয়া লইয়া তাহার গলায় পরাইয়া দিল, পকেট হইতে ছুরি, পেন্সিল, মনিব্যাগ যাহা পাইল, তাহাই পুত্রের হস্তে গুঁজিয়া দিল; হাতের কাছে আর কিছুই খুঁজিয়া পাইল না যাহা পুত্রহস্তে তুলিয়া দেওয়া যায়।

বিশু অনেকগুলি দ্রব্য হাতের মধ্যে পাইয়া পুলকিত হইয়া বলিল, বাবা!

চন্দ্রনাথ নিঃশব্দে তাহার ছোট মুখখানি নিজের মুখের উপর চাপিয়া ধরিয়া বলিল, বাবা!

এই সময় লখীয়ার মা বড় গোল করিল। সে হঠাৎ জানালার ভিতর দিয়া দেখিতে পাইল যে, একজন সাহেব ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া বিশুকে কোলে লইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। সে নিঃশ্বাস রুদ্ধ করিয়া একেবারে রান্নাঘরে ছুটিয়া গেল। বাটীতে আজ কৈলাসচন্দ্র নাই, অনেক দিনের পর তিনি বিশ্বেশ্বরের পূজা দিতে গিয়াছিলেন; সরযূও এই কিছুক্ষণ হইল মন্দির হইতে ফিরিয়া আসিয়া রন্ধন করিতে বসিয়াছিল। লখীয়ার মা সেইখানে ছুটিয়া গিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, মাইজি!

কি রে!

ঘরের ভেতরে সাহেব ঢুকে বিশুকে কোলে ক’রে ঘুরে বেড়াচ্চে।

সরযূ আশ্চর্য হইয়া বলিল, সে আবার কি? বলিয়া দ্বারের অন্তরাল হইতে দেখিতে চাহিল, দেখিতে পাইল না।

লখীয়ার মা তাহার বস্ত্র ধরিয়া টানিয়া বলিল, যেয়ো না—বাবাজী আসুন।

সরযূ তাহা শুনিল না, তাহার বিশ্বাস হয় নাই। অগ্রসর হইয়া যাহা দেখিল, তাহাতে বোধ হইল, দাসীর কথা অসত্য নহে, একজন সাহেবের মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে এবং অস্ফুটে বিশ্বেশ্বরের সহিত কথা কহিতেছে। সাহসে ভর করিয়া সে জানালার নিকটে গেল। যাহার ছায়া দেখিলে সে চিনিতে পারিত, তাহাকে চক্ষের নিমিষে চিনিতে পারিল—তাহার স্বামী—চন্দ্রনাথ!

ভিতরে প্রবেশ করিয়া, গলায় আঁচল দিয়া, পায়ের উপর মাথা রাখিয়া প্রণাম করিয়া, সরযূ মুখ তুলিয়া দাঁড়াইল।

চন্দ্রনাথ বলিল, সরযূ!