মিলন-মোহনায়

হায় হাবা মেয়ে, সব ভুলে গেলি দয়িতের কাছে এসে!

এত অভিমান এত ক্রন্দন সব গেল জলে ভেসে!

কূলে কূলে এত ভুলে ফুলে কাঁদা আছড়ি-পিছাড়ি তোর,

সব ভুলে গেলি যেই বুকে তোরে টেনে নিল মনোচোর!

সিন্ধুর বুকে লুকাইলি মুখ এমনই নিবিড় করে,

এমনই করিয়া হারাইলি তুই আপনারে চিরতরে–

যে দিকে তাকাই নাই তুই নাই! তোর বন্ধুর বাহু

গ্রাসিয়াছে তোরে বুকের পাঁজরে–ক্ষুধাতুর কাল রাহু!

বিরহের কূলে অভিমান যার এমন ফেনায়ে উঠে,

মিলনের মুখে সে ফিরে এমনই পদতলে পড়ে লুটে?

এমনই করিয়া ভাঙিয়া পড়ে কি বুক-ভাঙা কান্নায়,

বুকে বুক রেখে নিবিড় বাঁধনে পিষে গুঁড়ো হয়ে যায়?

তোর বন্ধুর আঙুলের ছোঁয়া এমনই কি জাদু জানে,

আবেশে গলিয়া অধর তুলিয়া ধরিলি অধর পানে!

একটি চুমায় মিটে গেল তোর সব সাধ সব তৃষা,

ছিন্ন লতার মতন মুরছি পড়িলি হারায়ে দিশা!

– একটি চুমার লাগি

এতদিন ধরে এত পথ বেয়ে এলি বেয়ে এলি কি রে হতভাগী?

গাঙ-চিল আর সাগর-কপোত মাছ ধরিবার ছলে,

নিলাজি লো, তোর রঙ্গ দেখিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে জলে।

দু’ধারের চর অবাক হইয়া চেয়ে আছে তোর মুখে,

সবার সামনে লুকাইলি মুখ কেমনে বঁধুর বুকে?

নীলিম আকাশে ঝুঁকিয়া পড়িয়া মেঘের গুণ্ঠন ফেলে

বৌ-ঝির মত উঁকি দিয়ে দেখে কুতূহলী-আঁখি মেলে।

‘সাম্পান’-মাঝি খুঁজে ফেরে তোর ভাটিয়ালি গানে কাঁদি,

খুঁজিয়া নাকাল দু’ধারের খাল–তোর হেরেমের বাঁদি!

হায় ভিখারিণী মেয়ে,

ভুলিলি সবারে, ভুলিলি আপনা দয়িতেরে বুকে পেয়ে!

তোরই মত নদী আমি নিরবধি কাঁদি রে প্রীতম লাগি,

জন্ম-শিখর বাহিয়া চলেছি তাহারই মিলন মাগি!

যার তরে কাঁদি–ধার করে তারই জোয়ারের লোনা জল

তোর মত মোর জাগে না রে কভু সাধের কাঁদন-ছল।

আমার অশ্রু একাকী আমার, হয়ত গোপনে রাতে

কাঁদিয়া ভাসাই, ভেসে ভেসে যাই মিলনের মোহানাতে,

আসিয়া সেথায় পুনঃ ফিরে যাই।–তোর মত সব ভুলে

লুটায়ে পড়ি না–চাহে না যে মোরে তারই রাঙ্গা পদমূলে!

যারে চাই তারে কেবলই এড়াই কেবলই দি তারে ফাঁকি;

সে যদি ভুলিয়া আঁখি পানে চায় ফিরাইয়া লই আঁখি!

–তার তীরে যবে আসি

অশ্রু-উৎসে পাষাণ চাপিয়া অকারণে শুধু হাসি!

অভিমানে মোর আঁখিজল জমে করকা-বৃষ্টি[১] সম,

যারে চাই তারে আঘাত হানিয়া ফিরে যায় নির্মম!

একা মোর প্রেম ছুটিবে কেবলই নিচু প্রান্তর বেয়ে,

সে কভু ঊর্ধ্বে আসিবে না উঠে আমার পরশ চেয়ে–

চাহি না তাহারে! বুকে চাপা থাকা আমার বুকের ব্যথা,

যে বুক শূন্য নহে মোরে চাহি–হব নাকো ভার সেথা!

সে যদি না ডাকে কী হবে ডুবিয়া ও-গভীর কালো নীরে,

সে হউক সুখী, আমি রচে যাই স্মৃতি-তাজ তার তীরে!

মোর বেদনার মুখে চাপিয়াছি নিতি যে পাষাণ-ভার!

তা দিয়ে রচিব পাষাণ-দেউল সে পাষাণ-দেবতার!

কত স্রোতধারা হারাইছে কূল তার জলে নিরবধি,

আমি হারালাম বালুচরে তার, গোপন-ফাল্গুনদী!

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. করকা-বৃষ্টি—শিলা-বৃষ্টি