ঝড়

[পশ্চিম তরঙ্গ]

ঝড়–ঝড়–ঝড় আমি–আমি ঝড়–

শন–শন–শনশন শন–ক্কড়ক্কড় ক্কড়–

কাঁদে মোর আগমনি আকাশ বাতাস বনানীতে।

জন্ম মোর পশ্চিমের অস্তগিরি-শিরে,

যাত্রা মোর জন্মি আচম্বিতে

প্রাচী-র অলক্ষ্য পথ-পানে

মায়াবী দৈত্যশিশু আমি

ছুটে চলি অনির্দেশ অনর্থ-সন্ধানে!

জন্মিয়াই হেরিনু, মোরে ঘিরি ক্ষতির অক্ষৌহিণী সেনা

প্রণমি বন্দিল–‘প্রভু! তব সাথে আমাদের যুগে যুগে চেনা,

মোরা তব আজ্ঞাবহ দাস–

প্রলয় তুফান বন্যা, মড়ক দুর্ভিক্ষ মহামারি সর্বনাশ!’

বাজিল আকাশ-ঘণ্টা, বসুধা-কাঁসর;

মার্তণ্ডের ধূপদানি–মেঘ-বাষ্প-ধূমে-ধূমে ভরাল অম্বর!

উল্কার হাউই ছোটে, গ্রহ উপগ্রহ হতে ঘোষিল মঙ্গল;

মহাসিন্ধু-শঙ্খে বাজে অভিশাপ-আগমনি কলকল কল কলকল কল কলকল কল!

‘জয় হে ভয়ংকর, জয় প্রলংকর’ নির্ঘোষি ভয়াল

বন্দিল ত্রিকাল-ঋষি।

ধ্যান-ভগ্ন রক্ত-আঁখি আশিস দানিল মহাকাল।

উল্লম্ফিয়া উঠিলাম আকাশের পানে তুলি বাহু,

আমি নব রাহু!

হেরিলাম সেবারতা মহীয়সী মহালক্ষ্মী প্রকৃতির রূপ,

সহসা সে ভুলিয়াছে সেবা, আগমন-ভয়ে মোর

প্রস্তর-শিখার সম নিশ্চল নিশ্চুপ!

অনুমানি যেন কোনো সর্বনাশা অমঙ্গল ভয়

জাগি আছে শিশুর শিয়র-পাশে ধ্যানমগ্না মাতা, শ্বাস নাহি বয়।

মনে হল ওই বুঝি হারা-মাতা মোর! মৌনা ওই জননীর

শুভ্র শান্ত কোলে

–প্রহ্লাদকুলের আমি কাল-দৈত্য-শিশু–

ঝাঁপাইয়া পড়িলাম ‘মা আমার’ বলে।

নাহি জানি কোন্ ফণিমনসার হলাহল-লোকে–

কোন্ বিষ-দীপ-জ্বালা সবুজ আলোকে–

নাগমাতা কদ্রু-গর্ভে জন্মেছি সহস্রফণা নাগ

ভীষণ তক্ষকশিশু! কোথা হয় নাগনাশী জন্মেজয়-যাগ–

উচ্চারিছে আকর্ষণ-মন্ত্র কোন্ গুণী–

জন্মান্তর-পার হতে ছুটে চলি আমি সেই মৃত্যু-ডাক শুনি!

মন্ত্র-তেজে পাংশু হয়ে ওঠে মোর হিংসা-বিষ-ক্রোধ-কৃষ্ণ প্রাণ,

আমার তুরীয় গতি–সে যে ওই অনাদি উদয় হতে

হিংসাসর্প-যজ্ঞমন্ত্র-টান!

ছুটে চলি অনন্ত তক্ষক ঝড়–

শন–শন–শনশন শন

সহসা কে তুমি এলে হে মর্ত্য-ইন্দ্রাণী মাতা,

তব ওই ধূলি-আস্তরণ

বিছায়ে আমার তরে জাতকের জন্মান্তর হতে?

লুকানু ও-অঞ্চল-আড়ালে, দাঁড়ালে আড়াল হয়ে মোর মৃত্যু-পথে!

ব্যর্থ হল অঞ্চল-আড়াল; বহ্নি-আকর্ষণ

মন্ত্র-তেজে ব্যাকুল ভীষণ

রক্তে রক্তে বাজে মোর–শনশন শন–

শন–শন–ওই শুন দূর–

দূরান্তর হতে মাগো, ডাকে মোরে অগ্নি-ঋষি বিষহরি সুর!

জননী গো চলিলাম অনন্ত চঞ্চল,

বিষে তব নীল হল দেহ, বৃথা মা গো দাব-দাহে পুড়ালে অঞ্চল!

ছুটে চলি মহা-নাগ, রক্তে মোর শুনি আকর্ষণী,

মমতা-জননী

দাহে মোর পড়িল মুরছি;

আমি চলি প্রলয়-পথিক–দিকে দিকে মারী-মরু রচি।

ঝড়–ঝড়–ঝড় আমি–আমি ঝড়–

শন–শন–শনশন শন–ক্কড়ক্কড় ক্কড়–

কোলাহল-কল্লোলের হিল্লোল-হিন্দোল–

দুরন্ত দোলায় চড়ি–‘দে দোল দে দোল’

উল্লাসে হাঁকিয়া বলি, তালি দিয়া মেঘে

উন্মদ উন্মাদ ঘোর তুফানিয়া বেগে!

ছুটে চলি ঝড়–গৃহ-হারা শান্তি-হারা বন্ধ-হারা ঝড়–

স্বেচ্ছাচার-ছন্দে নাচি !ক্কড়ক্কড় ক্কড়

কণ্ঠে মোর লুণ্ঠে ঘোর বজ্র-গিটকিরি,

মেঘ-বৃন্দাবনে মুহুছুটে মোর বিজুরির জ্বালা-পিচকিরি!

উড়ে সুখ-নীড়, পড়ে ছায়া-তরু,নড়ে ভিত্তি রাজ-প্রাসাদের,

তুফান-তুরগ মোর উরগেন্দ্র-বেগে ধায়।

আমি ছুটি অশান্ত-লোকের

প্রশান্ত-সাগর-শোষা উষ্ণশ্বাস টানি।

লোকে লোকে পড়ে যায় প্রলয়ের ত্রস্ত কানাকানি!

ঝড়–ঝড়–উড়ে চলি ঝড় মহাবায়-পঙ্খিরাজে চড়ি,

পড়-পড় আকাশের ঝোলা শামিয়ানা

মম ধূলিধ্বজা সনে করে জড়াজড়ি!

প্রমত্ত সাগর-বারি–অশ্ব মম তুফানির খর ক্ষুর-বেগে

আন্দোলি আন্দোলি ওঠে। ফেনা ওঠে জেগে

ঝটিকার কশা খেয়ে অনন্ত তরঙ্গ-মুখে তার!

আমি যেন সাপুড়িয়া     মারি মন্ত্র-মার–

ঢেউ-এর মোচড়ে তাই     মহাসিন্ধু-মুখে

জল-নাগ-নাগিনিরা আছাড়ি পিছাড়ি মরে ধুঁকে!

প্রিয়া মোর ঘূর্ণিবায়ু     বেদুইন-বালা

চূর্ণি চলে ঝঞ্ঝা-চুর মম আগে আগে।

ঝরনা-ঝোরা তটিনীর নটিনি-নাচন-সুখ লাগে

শুষ্ক খড়কুটো ধূলি শীত-শীর্ণ বিদায়-পাতায়

ফাল্গুনী-পরশে তার।–আমার ধমকে নুয়ে যায়

বনস্পতির মহা মহিরুহ, শাল্মলি, পুন্নাগ, দেওদার,

ধরি যবে তার

জাপটি পল্লব-ঝুঁটি, শাখা-শির ধরে দিই নাড়া;

গুমরি কাঁদিয়া ওঠে প্রণতা বনানী,

চচ্চড় করে ওঠে পাহাড়ের খাড়া শির-দাঁড়া!

প্রিয়া মোর এলোমেলো গেয়ে গান আগে আগে চলে;

পাগলিনি কেশে ধূলি চোখে তার মায়া-মণি ঝলে।

ঘাগরির ঘূর্ণা তার ঘূর্ণি-ধাঁধা লাগায় নয়নালোকে মোর।

ঘূর্ণিবালা হাসির হররা হানি বলে–‘মনোচোর।

ধরো তো আমারে দেখি’–

ত্রস্ত-বাস হাওয়া-পরি, বেণি তার দুলে ওঠে সুকঠিন মম ভালে ঠেকি।

পাগলিনি মুঠি মুঠি ছুঁড়ে মারে রাঙা পথধূলি,

হানে গায় ঝরনা-কুলুকুচু, পদ্ম-বনে আলুথালু খোঁপা পড়ে খুলি!

আমি ধাই পিছে তার দুরন্ত উল্লাসে;

লুকায় আলোর বিশ্ব চন্দ্র সূর্য তারা পদভর-ত্রাসে!

দীর্ঘ রাজপথ-অজগর সংকুচিয়া ওঠে ক্ষণে ক্ষণে,

ধরণি-কূর্মপৃষ্ঠ দীর্ণ জীর্ণ হয়ে ওঠে মত্ত মোর প্রমত্ত ঘর্ষণে।

পশ্চাতে ছুটিয়া আসে মেঘ ঐরাবত-সেনাদল

গজগতি-দোলা-ছন্দে; স্বরগে বাজে বাদল-মাদল!

সপ্ত সাগর শোষি শুণ্ডে শুণ্ডে তারা–

উপুড় ধরণি-পৃষ্ঠে উগারে নিযুত লক্ষ বারি-তীর-ধারা।

বয়ে যায় ধরা-ক্ষত-রসে

সহস্র পঙ্কিল স্রোত-ধার।

চণ্ডবৃষ্টি-প্রপাত-ধারা-ফুলে

বরষার বুকে ঝলে জল-মালা-হার।

আমি ঝড়, হুল্লোড়ের সেনাপতি; খেলি মৃত্যু-খেলা

ঘূর্ণনীয়া প্রিয়া-সাথে। দুর্যোগের হুলাহুলি মেলা

ধায় মম অশ্রান্ত পশ্চাতে!

মম প্রাণরঙ্গে মাতি নিখিলের শিখী-প্রাণ মুহু-মুহু মাতে!

শ্যাম স্বর্ণ পত্রে পুষ্পে কাঁপে তার অনন্ত কলাপ।–

দারুণ দাপটে মম জেগে ওঠে অগ্নিস্রাব-জ্বলন্ত-প্রলাপ

ভূমিকম্প-জরজর থরথর ধরিত্রীর মুখে!

বাসুকি-মন্দার সম মন্থনে মম সিন্ধুতট ভরে ফেনা-থুকে।

জেগে ওঠে মম সেই সৃষ্টি-সিন্ধু-মন্থন-ব্যথায়

রবি শশী তারকার অনন্ত বুদবুদ!–উঠে ভেঙে যায়

কত সৃষ্টি কত বিশ্ব আমার আনন্দ-গতিপথে।

শিবের সুন্দর ধ্রুব-আঁখি

যমের আরক্ত ঘোর মশাল-নয়ন-দীপ মম রথে।

জয়ধ্বনি বাজে মোর স্বর্গদূত ‘মিকাইলের’ আতশি-পাখায়।

অনন্ত-বন্ধন-নাগ-শিরস্ত্রাণ শোভে শিরে! শিখী-চূড়ায় তায়

শনির অশনি ওই ধূমকেতু-শিখা,

পশ্চাতে দুলিছে মোর অনন্ত আঁধার চিররাত্রি-যবনিকা!

জটা মোর নীহারিকাপুঞ্জ-ধূম পাটল পিঙ্গাস,

বহে তাহে রক্ত-গঙ্গা নিপীড়িত নিখিলের লোহিত নিষ্কাশ।

ঝড়–ঝড়–ঝড় আমি–আমি   ঝড়–

ক্কড়ক্কড় ক্কড়–

বজ্র-বায়ু দন্তে-দন্তে ঘর্ষি চলি ক্রোধে!

ধূলি-রক্ত বাহু মম বিন্ধ্যাচল সম রবিরশ্মি-পথ রোধে।

ঝঞ্ঝনা-ঝাপটে মম

ভীত কূর্ম সম

সহসা সৃষ্টির খোলে নিয়তি লুকায়।

আমি ঝড়, জুলুমের জিঞ্জির-মঞ্জীর বাজে ত্রস্ত মম পায়!

ধাক্কার ধমকে মম খান খান নিষিদ্ধের নিরুদ্ধ দুয়ার,

সাগরে বাড়ব লাগে,     মড়ক দুয়ার্কি ধরে আমার ধুয়ার!

কৈলাসে উল্লাস ঘোষে ডম্বরু ডিণ্ডিম

দ্রিম দ্রিম দ্রিম!

অম্বর-ডঙ্কার ডামাডোল

সৃজনের বুকে আনে অশ্রু-বন্যা ব্যথা-উতরোল।

ভাণ্ডারে সঞ্চিত মম দুর্বাসার হিংসা ক্রোধ শাপ।

ভীমা উগ্রচণ্ডা ফেলে উল্কারূপী অগ্নি-অশ্রু, সহিতে না পারি মম তাপ!

আমি ঝড়, পদতলে ‘আতঙ্ক’-কুঞ্জর, হস্তে মোর ‘মাভৈঃ’-অঙ্কুশ।

আমি বলি, ছুটে চলো প্রলয়ের লাল ঝাণ্ডা হাতে,–

হে নবীন পরুষ পুরুষ!

স্কন্ধে তোলো উদ্ধত বিদ্রোহ-ধ্বজা; কণ্টক-অশঙ্ক রে নির্ভীক!

পুরুষ ক্রন্দন-জয়ী,–দুঃখ দেখে দুঃখ পায়–ধিক তারে ধিক

আমি বলি, বিশ্ব-গোলা নিয়ে খেলো লুফোলুফি খেলা!

বীর নিক বিপ্লবের লাল-ঘোড়া,

ভীরু নিক পারে-ধাওয়া পলায়ন-ভেলা!

আমি বলি, প্রাণানন্দে পিয়ে নে রে বীর,

জীবন-রসনা দিয়া প্রাণ ভরে মৃত্যু-ঘন ক্ষীর!

আমি বলি, নরকের ‘নার’ মেখে নেয়ে আয় জ্বালা-কুণ্ড সূর্যের হাম্মামে।

রৌদ্রের-চন্দন-শুচি, উঠে বসো গগনের বিপুল তাঞ্জামে!

আমি ঝড় মহাশত্রু স্বস্তি-শান্তি-শ্রীর,

আমি বলি, শ্মশান-সুষুপ্তি শান্তি–

জয়নাদ আমি অশান্তির।

পশ্চিম হইতে পূর্বে ঝঞ্ঝনা-ঝাঁঝর

ঝঞ্ঝা-জগঝম্প ঘোর–বাজায়ে চলেছি ঝড়–

ঝনাৎ ঝনাৎ ঝন

ঝমরঝমরঝন ঝননঝননশন

শনশনশন

হুহু হুহু হুহু–

সহসা কম্পিত-কণ্ঠ-ক্রন্দন শুনি কার–‘উহু! উহু উহু উহু!’

সজল কাজল-পক্ষ্ম কে সিক্তবসনা একা ভিজে–

বিরহিণী কপোতিনী, এলোকেশ কালোমেঘে পিঁজে।

নয়ন-গগনে তার নেমেছে বাদল, ভিজিয়াছে চোখের কাজল,

মলিন করেছে তার কালো আঁখি-তারা

বায়ে-ওড়া কেতকীর পীত পরিমল!

এ কোন্ শ্যামলী পরি পুবের পরিস্থানে কেঁদে কেঁদে যায়–

নবোদ্ভিন্ন কুঁড়ি-কদম্বের ঘন যৌবন-ব্যথায়!

জেগেছে বালার বুকে এক বুক ব্যথা আর কথা,

কথা শুধু প্রাণে কাঁদে,

ব্যথা শুধু বুকে বেঁধে, মুখে ফোটে শুধু আকুলতা!

কদম্ব তমাল তাল পিয়াল-তলায়

দূর্বাদল-মখমলে শ্যামলী-আলতা তার মুছে মুছে যায়!

বাঁধে বেণি কেয়া-কাঁটা বনে।

বিদেশিনি দেয়াশিনি একমনে দেয়া-ডাক শোনে!

দাদুরির আদুরি কাজরি

শোনে আর আঁখি-মেঘ-কাজল গড়ায়ে

দুখ-বারি পড়ে ঝরঝরি।

ঝিমঝিম রিমঝিম–রিমিরিমি রিম ঝিম

বাজে পাঁইজোর–

কে তুমি পুরবি বালা? আর যেন নাহি পাই জোর

চলা-পায়ে মোর, ও-বাজা আমারও বুকে বাজে।

ঝিল্লির ঝিমানি-ঝিনিঝিনি

শুনি যেন মোর প্রতি রক্ত-বিন্দু-মাঝে!

আমি ঝড়? ঝড় আমি?–না, না, আমি বাদলের বায়!

বন্ধু! ঝড় নাই

কোথায়?

ঝড় কোথা? কই?–

বিপ্লবের লাল-ঘোড়া ওই ডাকে ওই–

ওই শোনো, শোনো তার হ্রেষার চিক্কুর,

ওই তার ক্ষুর-হানা মেঘে!–

না, না, আজ যাই আমি, আবার আসিব ফিরে,

হে বিদ্রোহী বন্ধু মোর! তুমি থেকো জেগে!

তুমি রক্ষী এ রক্ত-অশ্বের,

হে বিদ্রোহী অন্তর্দেবতা!–শুনো শুনো মায়াবিনী ওই ডাকে ফের–

পুবের হাওয়ায়–

যায়–যায়–সব ভেসে যায়

পুবের হাওয়ায়–

  হায়!–