চব্বিশ

মেজদিদিকে জোর করিয়া একটা চেয়ারে বসাইয়া বন্দনা তাহার পায়ে আলতা পরাইয়া দিতেছিল। এই মঙ্গলাচারটুকু অন্নদা তাহাকে শিখাইয়া দিয়া নিজে আত্মগোপন করিয়াছে। তাহার চোখ রাঙ্গা, অবিরত অশ্রুবর্ষণে চোখের পাতা ফুলিয়াছে—বন্দনার প্রশ্নের উত্তরে সে সংক্ষেপে বলিয়াছিল, বৌকে মুখ দেখাতে আমি পারবো না।

তুমি পারবে না কেন অনুদি, তোমার লজ্জা কিসের?

আমার লজ্জা এই জন্যে যে, এর আগে মরিনি কেন? শুধু দ্বিজুকেই ত মানুষ করিনি বন্দনাদিদি, বিপিনকেও করেছিলুম। ওর মা যখন মারা গেল কার হাতে দিয়েছিল তার দু’মাসের ছেলেকে? আমার হাতে। সেদিন কোথায় ছিলেন দয়াময়ী? কোথায় ছিল তাঁর মেয়ে-জামাই? বলিতে বলিতে সে মুখে আঁচল চাপিয়া দ্রুতপদে অন্যত্র সরিয়া গেল। মেঝেয় বসিয়া নিজের জানুর উপর দিদির পা-দুটি রাখিয়া বন্দনার আলতা পরানো যেন আর শেষ হইতে চাহে না।

টপ করিয়া একফোঁটা তপ্ত অশ্রু সতীর পায়ের উপর পড়িল। হেঁট হইয়াও সে বন্দনার মুখ দেখিতে পাইল না। কিন্তু হাত বাড়াইয়া তাহার চোখ মুছাইয়া বলিল, তুই কেন কাঁদচিস বল ত বন্দনা?

বন্দনা তেমনি নতমুখে বাষ্পরুদ্ধ-কণ্ঠে কহিল, কাঁদচে ত সবাই মেজদি। আমিই ত একা নয়।

সবাই কাঁদছে বলে তোকেও কাঁদতে হবে, এত লেখাপড়া শিখে এই বুঝি তোর যুক্তি হলো?

দিদির কথা শুনিয়া বন্দনা মুহূর্তের জন্য মুখ তুলিয়া চাহিল, বলিল, যুক্তি দেখিয়ে কাঁদতে হবে নইলে মানুষে কাঁদবে না, তোমার যুক্তিটা বুঝি এই মেজদি?

সতী হাত দিয়া তাহার মাথাটা নাড়িয়া দিয়া সস্নেহে কহিল, তর্কবাগীশের সঙ্গে তর্কে পারবার জো নেই। তা বলিনি রে, তা আমি বলিনি। ওরা ভেবেছে আমার সব বুঝি গেলো তাই ওদের কান্না, কিন্তু সত্যি ত তা নয়। আমার এক দিকে রয়েছেন স্বামী, অন্য দিকে ছেলে,—সংসারে কোন ক্ষতিই আমার হয়নি ভাই, আমার জন্যে তুই শোক করিস নে। দুঃখ আমার নেই।

বন্দনা বলিল, দুঃখ যেন তোমার না-ই থাকে মেজদি। কিন্তু তোমার দুঃখটাই সংসারে সব নয়। তোমার কতখানি গেলো সে তুমি জানো, কিন্তু কেঁদে কেঁদে যারা চোখ অন্ধ করলে তাদের লোকসান কে পুরোবে বলো ত?

একটু থামিয়া বলিল, মুখুয্যেমশাই পুরুষমানুষ, যা খুশি উনি বলুন, কিন্তু যাবার ক্ষণে আজ শুকনো চোখে যেন তুমি বিদায় নিও না দিদি। সে ওদের বড় বিঁধবে।

কাদের বিঁধবে রে বন্দনা?

কাদের? জানো না তুমি তাদের? তোমার ন’বছর বয়েসে এসেছিলে এই পরের বাড়িতে, সেই বাড়িকে বছরের পর বছর ধরে তোমায় আপনার করে দিলে যারা, আজকের একটা ধাক্কাতেই তাদের ভুলে গেলে মেজদি? তোমার শাশুড়ী, তোমার দেওর, তোমার সংসারের দাস-দাসী, আশ্রিত-পরিজন, ঠাকুরবাড়ি, অতিথিশালা, গুরু-পুরুত—এদের অভাব পূর্ণ হবে শুধু স্বামী-পুত্র দিয়ে? আর কেউ নেই জীবনে—শুধু এই?

বন্দনা বলিতে লাগিল, এ কাদের মুখের কথা জানো মেজদি, যে সমাজে আমরা মানুষ হয়েছি তাদের। তুমি ভেবেছো স্বামীভক্তির এই শেষ কথা? স্ত্রীর এর বড়ো ভাববার কিছু নেই? এ তোমার ভুল। কলকাতায় চলো আমার মাসীর বাড়িতে, দেখবে এ কথা সেখানে পুরনো হয়ে আছে,—এর বেশি তারা ভাবেও না, করেও না। অথচ,—কথার মাঝখানে সে থামিয়া গেল। তাহার হঠাৎ মনে হইল কে যেন পিছনে দাঁড়াইয়া, ফিরিয়া দেখিল দ্বিজদাস। কখন যে সে নিঃশব্দে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে উভয়ের কেহই টের পায় নাই। লজ্জা পাইয়া বন্দনা কি যেন বলিতে গেল, দ্বিজদাস থামাইয়া দিয়া কহিল, ভয় নেই, মাসীকেও চিনিনে, তাঁর দলের কাউকেও জানিনে,—আপনার কথা তাঁদের কাছে প্রকাশ পাবে না। কিন্তু আসলে আপনার ভুল হচ্চে। পৃথিবীতে জন্তু-জানোয়ারের দল আছে, তাদের আচরণ ফরমূলায় বাঁধা যায়, কিন্তু মানুষের দল নেই। একজোটে এমন গড়পড়তা বিচার তাদের চলে না। সকাল থেকে আজ এই কথাটাই ভাবছিলুম। মাসীর দল থেকে টেনে অনায়াসে আপনাকে দাদার দলে ভর্তি করা যায়, আবার দয়াময়ীর দল থেকে বার করে স্বচ্ছন্দে ঐ মৈত্রেয়ীকে আপনার মাসীর দলে চালান করা চলে। বাজি রেখে বলতে পারি কোথাও একতিল বিভ্রাট বাধবে না। বাঃ রে মানুষের মন! বাঃ রে তার প্রকৃতি!

সতী আশ্চর্য হইয়া কহিল, এ কথার মানে ঠাকুরপো?

দ্বিজদাস ততোধিক বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল, তোমার কাছেও মানে? দ্বিজুর কাজ, দ্বিজুর কথার মানেই যদি থাকবে বৌদি, এতকাল দয়াময়ী-বিপ্রদাসের দরবারে না গিয়ে তোমার কাছেই তার সব আরজি পেশ হতো কেন? মানে বোঝার গরজ তোমার নেই বলেই ত? আজ যাবার দিনেও সেইটুকু থাক বৌদি, ঠিক-বেঠিকের চুলচেরা বিচারে কাজ নেই। এই বলিয়া সুমুখে আসিয়া সে তাহার পায়ের উপর মাথা রাখিয়া প্রণাম করিল। এমন সে করে না। পায়ের কাঁচা আলতার রঙ তাহার কপালে লাগিয়াছে, সতী ব্যস্ত হইয়া আঁচলে মুছাইয়া দিতে গেল, সে ঘাড় নাড়িয়া মাথা সরাইয়া বলিল, দাগ আপনিই মুছে যাবে বৌদি, একটা দিন থাকে থাক। কথাটা কিছুই নয়, দ্বিজু হাসিয়াই বলিল, কিন্তু শুনিয়া বন্দনার দু’চোখ জলে ভরিয়া গেল। লুকাইতে গিয়া সে আর মুখ তুলিতে পারিল না।

দ্বিজদাস বলিল, আমি এসেছিলুম তাগাদা দিতে। সময় হয়ে আসছে, দাদা ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। জিনিসপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, বাসুকে জামা-কাপড় পরিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিয়েছি, মাঙ্গলিকের আয়োজন কে করে দিলে জানিনে, কিন্তু তাও হাতের কাছে পেয়ে গেলুম। ভয় হয়েছিল অনুদি হয়ত ডুবে মরেছেন, কিন্তু সন্দেহ হচ্চে কোথাও বেঁচেই আছেন। নইলে ওগুলো এলো কি করে? কিন্তু খুঁজে পাওয়া যখন তাঁকে যাবে না তখন খুঁজেও কাজ নেই। ওদিকে দয়াময়ীর মহল অর্গলবদ্ধ। সঙ্কট-উত্তরণের যে পন্থা তিনি অবলম্বন করেছেন তাতে করবার কিছু নেই। তবে শ্রীমতী মৈত্রেয়ীকে বলে যেতে পারো যথাসময়ে মা’র কানে তা পৌঁছবে। কিন্তু আমি বলি প্রয়োজন নেই। এবার তুমি একটু তৎপর হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসবে চলো, বৌদি, তোমাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে এসে আমি নিস্তার পাই, একটু কাজে মন দিতে পারি।

সতী ম্লান হাসিয়া কহিল, আমাকে বিদায় করতে ঠাকুরপোর ভারী তাড়া।

আমার কাজ পড়ে রয়েছে যে।

কি কাজ শুনি?

এর আগে কখনো ত শুনতে চাওনি বৌদি। যখন যা চেয়েছি জিজ্ঞাসা না করেই চিরকাল দিয়ে এসেছো। এ তোমার শোনার যোগ্য নয়।

সতী এবং বন্দনা উভয়েই ক্ষণকাল নীরবে তাহার প্রতি চাহিয়া রহিল, তার পরে সতী বলিল, তুমি যাও ঠাকুরপো, আর আমার দেরি হবে না। বন্দনাকে কহিল, তুইও এখানে দেরি করিস নে বোন, — যত শীঘ্র পারিস বোম্বায়ে ফিরে যা। কলকাতায় যাবার দরকার নেই, কাকা সেখানে একলা রয়েছেন মনে রাখিস।

বন্দনা দ্বিজুর মতো পায়ে মাথা রাখিয়া প্রণাম করিল, পায়ের ধূলা লইয়া মাথায় দিল, বলিল, না মেজদি, মাসীর বাড়িতে আর না। সেদিকের পাট উঠিয়ে দিয়েই বেরিয়েছিলুম এ কখনো ভুলব না। এই বলিয়া সে আঁচলে অশ্রু মুছিয়া কহিল, হয়ত কালই বোম্বায়ে ফিরবো, কিন্তু তুমিও যাবার আগে এই ভরসা দিয়ে যাও মেজদি, আবার যেন শীঘ্র তোমাদের দেখতে পাই।

সতী মনে মনে কি আশীর্বাদ করিল সে-ই জানে, হাত বাড়াইয়া তাহার চিবুক স্পর্শ করিয়া চুম্বন করিল, হাসিমুখে বলিল, সে ত তোর নিজের হাতে বন্দনা। কাকাকে বলিস বিয়ের নেমন্তন্নপত্র দিতে, যেখানে থাকি গিয়ে হাজির হবোই। একটুখানি থামিয়া বোধ হয় মনে মনে চিন্তা করিল বলা উচিত কিনা, তার পরে বললি, ভারী সাধ ছিল এ-বাড়িতে তুই পড়বি। ঠাকুরপোর হাতে তোকে সঁপে দিয়ে, তোর হাতে সংসারের ভার বাসুর ভার সব তুলে দিয়ে মায়ের সঙ্গে কৈলাসদর্শনে যাবো, ফিরতে না পারি না-ই পারলুম,—কিন্তু, মানুষ ভাবে এক হয় আর। এই বলিয়া সে চুপ করিল। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া পুনরায় কহিল, এ বাড়িতে আমি যা পেয়েছিলুম জগতে কেউ তা পায় না। আবার সবচেয়ে বেশী করে পেয়েছিলুম আমার শাশুড়ীকে। কিন্তু তাঁর সঙ্গেই বিচ্ছেদ ঘটলো সবচেয়ে বেশি। যাবার আগে প্রণাম করতে পেলুম না, দোর বন্ধ, চৌকাটের ধুলো মাথায় তুলে নিয়ে বললুম, মা, এই কাঠের ওপরে তোমার পায়ের ধুলো লেগে আছে, এই আমার—কথা শেষ করিতে পারিল না, কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া এইবার সে ভাঙ্গিয়া পড়িল, তাহার দু’চোখ বাহিয়া দরদর ধারে অশ্রু নামিয়া আসিল। মিনিট দুই-তিন গেল সামলাইতে, আঁচলে চোখ মুছিয়া বলিল, আর পেলুম না খুঁজে আমার অনুদিকে। সে আমার মায়েরও বড় বন্দনা। আমরা চলে গেলে তাকে বলিস ত রে, আমি রাগ করে গেছি। আবার দু’চক্ষু বাষ্পাকুল হইয়া আসিল, আবার আঁচলে মুছিয়া ফেলিল। একটা বিড়াল পুষিয়াছিল, নাম নিমু। কাজকর্মের বাড়িতে সেটা যে কোথায় গিয়াছে ঠিকানা নাই। সকাল হইতে কয়েকবার মনে পড়িয়াছে, এখনও তাহাকে মনে পড়িল। বলিল, নিমুটা যে কোথায় ডুব মারলে দেখে যেতে পেলুম না। অনুদিকে বলিস ত বন্দনা। অথচ, একটু পূর্বেই জোর করিয়া বলিয়াছিল, তাহার এক দিকে রহিলেন স্বামী, অন্য দিকে সন্তান,—সংসারে কোন ক্ষতিই তাহার হয় নাই! কথাটা কত বড়ই না মিথ্যা!

বৌদি করচো কি? বাহির হইতে দ্বিজদাসের আর একদফা তাগাদা আসিল।

যাচ্চি ভাই, হয়েছে—বলিয়া সতী তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া পড়িল।

স্টেশন হইতে দ্বিজদাস যখন একাকী ফিরিয়া আসিল তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়াছে। ঘরে ঘরে তেমনি আলো জ্বলিয়াছে, তেমনিভাবেই লোকজন আপন-আপন কাজে ব্যস্ত, এই বৃহৎ পরিবারে কোথায় কি বিপ্লব ঘটিয়াছে কেহ জানেও না। বাহিরের মহলে উপরে বিপ্রদাসের বসিবার ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ,—ও দিকটা অন্ধকার। এমন কত দিনই আলো জ্বলে না, বিপ্রদাস থাকেন কলিকাতায়, অভাবনীয় কিছুই নয়। সিঁড়ির বাঁ দিকের ঘরটায় থাকে অশোক, জানালা দিয়া চোখে পড়িল ইজি-চেয়ারে পা ছড়াইয়া বাতির আলোকে সে নিবিষ্টচিত্তে কি একখানা বই পড়িতেছে। কলেজ কামাই করিয়া অক্ষয়বাবু আজও আছেন, তাঁর ঘরটা শেষের দিকে, তিনি ঘরে আছেন কিংবা বায়ু-সেবনে বহির্গত হইয়াছেন জানা গেল না। মোটর হইতে প্রাঙ্গণে পা দিয়াই দ্বিজদাসের চোখে পড়িয়াছিল ত্রিতলের লাইব্রেরিঘরটা। সন্ধ্যার পরে এ ঘরটা প্রায় থাকে অন্ধকার, আজ কিন্তু খোলা জানালা দিয়া আলো আসিতেছে। তাহার সন্দেহ রহিল না এখানে আছে বন্দনা। বই পড়িতে নয়, চোখ মুছিতে। লোকের সংস্রব হইতে আত্মরক্ষা করিতে সে এই নির্জনে আশ্রয় লইয়াছে। আজ রাত্রিটা কোনমতে কাটাইয়া সে কাল চলিয়া যাইবে সুদূর বোম্বাই অঞ্চলে—যেখানে মানুষ হইয়া সে এত বড় হইয়াছে—যেখানে আছে তাহার পিতা, আত্মীয়-স্বজন, তাহার কত দিনের কত বন্ধু এবং বান্ধবী। কোনদিন কোন ছলে কখনো যে এ গ্রামে তাহার আবার আসা সম্ভব ভাবাও যায় না। না আসুক কিন্তু এ বাড়ি সে সহজে ভুলিবে না। বিচিত্র এ দুনিয়া,—কত অদ্ভুত অভাবিত ব্যাপারই না এখানে নিমিষে ঘটে। একটা একটা করিয়া সেই প্রথম দিন হইতে আজ পর্যন্ত সকল কথাই দ্বিজুর মনে পড়িল। সেই হঠাৎ আসা আবার তেমনি হঠাৎ রাগ করিয়া যাওয়া। মধ্যে শুধু ঘণ্টা-খানেকের আলাপ-আলোচনা। সেদিন বন্দনা সহাস্যে বলিয়াছিল, শুধু চোখের পরিচয়টাই নেই দ্বিজুবাবু, নইলে দেওরের গুণাগুণ লিখে পাঠাতে মেজদি কখনো আলস্য করেন নি। আমি সমস্ত জানি, আপনার সম্বন্ধে আমার কিছু অজানা নেই। যতদিন যত জ্বালিয়েছেন বাড়িসুদ্ধ লোককে, তার সমস্ত খবর পৌঁচেছে আমার কাছে। দ্বিজদাস জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, আমরা কেউ কারুকে চিনিনে, তবু আপনার কাছে আমার দুর্নাম প্রচার করার সার্থকতা ছিল কি? বন্দনা হাসিয়া জবাব দিয়াছিল, বোধ করি আসলে মেজদি আপনাকে দেখতে পারতেন না,—এ তারই প্রতিশোধ।

তার পরে দুজনেই হাসিয়া কথাটাকে পরিহাসে রূপান্তরিত করিয়াছিল। কিন্তু সেদিন উভয়ের কেহই ভাবে নাই এ ছিল সতীর দ্বিজুর প্রতি বন্দনার চিত্ত আকর্ষণের কৌশল। যদি কখনো বোনটিকে কাছে আনা যায়, যদি কখনো তাহার হাতে দিয়া অশান্ত দেবরটিকে শাসন মানানো চলে। কিন্তু সে ঘটিল না, তাহার গোপন বাসনা গোপনেই রহিয়া গেল,—আজও দুজনের কেহই সে-সব চিঠির অর্থ খুঁজিয়া পাইল না।

দ্বিজদাস সোজা উপরে উঠিয়া গেল। পর্দা সরাইয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিল বন্দনার কোলের উপর বই খোলা, কিন্তু সে জানালার বাহিরে চাহিয়া স্থির হইয়া আছে। একটা ছত্রও পড়িয়াছে কিনা সন্দেহ, বুঝিয়াও শুধু কথা আরম্ভ করিবার জন্যই সে প্রশ্ন করিল, কি বই পড়ছিলেন?

বন্দনা বই মুড়িয়া টেবিলে রাখিল, দাঁড়াইয়া উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনার ফিরতে এত দেরি হলো যে? কলকাতার গাড়ি ত গেছে কোন্‌ কালে।

দ্বিজদাস বলিল, দেরি হোক তবু ত ফিরেচি। না ফিরলেও ত পারতুম।

বন্দনা বলিল, অনায়াসে।

দ্বিজদাস একমুহূর্ত নীরব থাকিয়া বলিল, ঠিক এই কথাটাই আমার প্রথমে মনে হয়েছিল। গাড়ি ছেড়ে দিলে, জানালায় গলা বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাসু হাত নাড়তে লাগলো, ক্রমশঃ তার ছোট্ট হাতখানি গেল বাঁকের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে। প্রথমে মনে হলো গেলেই হতো ওদের সঙ্গে—

বন্দনা কহিল, আপনি বাসুকে ভারী ভালবাসেন, না?

দ্বিজদাস একটু ভাবিয়া বলিল, দেখুন জবাব দেবো কি, এ-সব জিনিসের আমি বোধ হয় স্বরূপই জানিনে। প্রকৃতিটা এত রুক্ষু, এমন নীরস যে, দু’দণ্ডেই সমস্ত উবে গিয়ে শুকনো বালি আবার তেমনি ধূধূ করে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে চোখে একবার জল এলো, কিন্তু তখনি আবার আপনিই শুকলো,—বাষ্পের চিহ্নও রইলো না।

বন্দনা কহিল, এ একপ্রকার ভগবানের আশীর্বাদ।

দ্বিজদাস বলিতে লাগিল, কি জানি, হতেও পারে। অথচ, এই বাসুর ভয়েই মা কাল থেকে ঘরে দোর দিয়ে আছেন। নইলে দাদার জন্যেও না, বৌদিদির জন্যেও না। মা ভাবেন বাসুকে বুঝি তিনি মানুষ করেছেন, কিন্তু হিসেব করলে দেখতে পাবেন ওর বয়সের অর্ধেক কাল কেটেছে ওঁর তীর্থবাসে। তখন কার কাছে থাকতো ও? আমার কাছে। টাইফয়েড জ্বরে কে জেগেছে ষাট দিন? আমি। আজ যাবার সময় কে দিলে সাজিয়ে? আমি। ওর জামাকাপড় থাকে আমার আলমারিতে, ওর বই-শ্লেটের জায়গা হলো আমার টেবিল, ওর শোবার বিছানা আমার খাটে। মা টানাটানি করে নিয়ে যান—কিন্তু কত রাতে ঘুম ভেঙ্গে ও পালিয়ে এসেছে আমার ঘরে।

বন্দনা নির্নিমেষে চাহিয়াছিল, বলিল, তবু ত চোখের জল শুকিয়ে যেতে এক মুহূর্তের বেশি লাগে না।

দ্বিজদাস কহিল, না। এই আমার স্বভাব। ওকে নিয়ে আমার ভাবনা শুধু এই যে, সে পড়বে গিয়ে তার বাপ–মায়ের হাতে। আপনি বলবেন, জগতে এই ত স্বাভাবিক, এতে ভয়ের কি আছে? কিন্তু স্বাভাবিক বলেই বিপদ হয়েছে এই যে, এত বড় উলটো কথাটা মানুষকে আমি বোঝাবো কি করে!

বন্দনা এ কথা বলিল না যে, বুঝাইবার প্রয়োজনই বা কি! অন্যপক্ষে বাপ-মায়ের বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ সত্য বলিয়া বিশ্বাস করাও তাহার কঠিন, বিশেষতঃ, বিপ্রদাসের বিরুদ্ধে। কিন্তু কোন তর্ক না করিয়া সে নীরব হইয়াই

রহিল।

পরক্ষণে বক্তব্য স্পষ্টতর করিতে দ্বিজদাস নিজেই কহিল, একটা সান্ত্বনা বৌদি রইলেন কাছে, নইলে দাদার হাতে দিয়ে আমার তিলার্ধ শান্তি থাকতো না।

বন্দনা কহিল, আপনি ত নির্বিকার, বাসুর ভালোমন্দ নিয়ে আপনার মাথাব্যথা কিসের? যা হয় তা হোক না।

শুনিয়া দ্বিজদাসের মুখের উপর সুতীক্ষ্ণ বেদনার ছায়া পড়িল, কিন্তু সে মৌন হইয়া রহিল।

বন্দনা কহিল, দাদার প্রতি গভীর বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার কথা একদিন আপনার নিজের মুখে শুনেছিলাম। সে-ও কি ওই চোখের জলের মতো এক নিমিষে শুকিয়ে গেল? কিংবা যে লোক নিজের দোষে সর্বস্বান্ত হয় তাকে বিশ্বাস করা চলে না এই কি অবশেষে বলতে চান?

দ্বিজদাস বিস্ময় ও ব্যথায় অভিভূত চক্ষে ক্ষণকাল তাহার প্রতি চাহিয়া রহিল, তাহার পরে দুই হাত এক করিয়া ললাট স্পর্শ করিয়া ধীরে ধীরে বলিল, না, সে আমি বলিনি। আমি বলছিলুম তৃষ্ণার জলের জন্যে মানুষে সমুদ্রের কাছে গিয়ে যেন হাত না পাতে। কিন্তু দাদার সম্বন্ধে আর আলোচনা নয়, বাইরের লোকে তা বুঝবে না।

এ কথায় বন্দনা অন্তরে অত্যন্ত আহত হইল, কিন্তু প্রতিবাদেরও কিছু খুঁজিয়া না পাইয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল।

দ্বিজদাস একেবারে অন্য কথা পাড়িল, জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি কালই বোম্বায়ে যাবেন?

বন্দনা বলিল, হাঁ।

অশোকবাবুই নিয়ে যাবেন?

হাঁ, তিনিই।

দ্বিজদাস বলিল, বোম্বাই-মেল এখান থেকে বেশী রাতে যায়, কাল আপনাদের আমি স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসবো। কিন্তু দিনের বেলায় থাকতে পারবো না, একটু কাজ আছে।

বাবাকে একটা তার করে দেবেন।

আচ্ছা।

মিনিট-দুই নীরব থাকিয়া, ইতস্ততঃ করিয়া দ্বিজদাস কহিল, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেসা করবো প্রায় ভাবি, কিন্তু নানা কারণে দিন বয়ে যায়, জিজ্ঞেসা করা আর হয় না। কাল চলে যাবেন, সময় আর পাবো না। যদি রাগ না করেন বলি।

বলুন।

দেরি হইতে লাগিল।

বন্দনা কহিল, রাগ করবো না, আপনি নির্ভয়ে বলুন।

দ্বিজদাস বলিল, কলকাতার বাড়ি থেকে মা একদিন রাগ করে বৌদিদিকে নিয়ে হঠাৎ চলে এলেন আপনার মনে পড়ে?

পড়ে।

কারণ না জেনে আপনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন। মন খুব খারাপ ছিল, আমার ঘরে এসে সেদিন একটা কথা বলেছিলেন যে আমাকে আপনার ভাল লাগে। মনে পড়ে?

পড়ে। কিন্তু খুব লজ্জার সঙ্গেই মনে পড়ে।

সে কথার মূল্য কিছু নেই?

না।

দ্বিজদাস ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া বলিল, আমিও তাই ভাবি। ওর মূল্য কিছু নেই।

একটু পরে কহিল, বৌদি বলেছিলেন আপনার মাসির ইচ্ছে অশোকের সঙ্গে আপনার বিবাহ হয়। সে কি স্থির হয়ে গেছে?

বন্দনা বলিল, এ আমাদের পারিবারিক কথা। বাইরের লোকের সঙ্গে এ আলোচনা চলে না।

দ্বিজদাস বলিল, আলোচনা ত নয়, শুধু একটা খবর।

বন্দনা তিক্তকণ্ঠে কহিল, আপনার সঙ্গে এমন কোন আত্মীয়-সম্বন্ধ নেই যাতে এ প্রশ্ন আপনি করতে পারেন। দ্বিজুবাবু, আপনি শিক্ষিত লোক, এ কৌতূহল আপনার লজ্জাকর। শুনিয়া দ্বিজদাস সত্যই লজ্জা পাইল, তাহার মুখ ম্লান হইয়া গেল। বলিল, আমার ভুল হয়েছে বন্দনা। স্বভাবতঃ আমি কৌতূহলী নই, পরের কথা জানবার লোভ আমার খুব কম। কিন্তু কি করে জানিনে আমার মনে হতো যে-কথা সংসারে কাউকে বলতে পারিনে আপনাকে পারি। যে বিপদে কাউকে ডাকা চলে না, আপনাকে চলে। আপনি—

তাহার কথার মাঝখানেই বন্দনা হাসিয়া বলিল, কিন্তু এই যে বললেন দাদার আলোচনা বাইরের লোকের সঙ্গে করতে আপনি চান না। আমি ত পর, একেবারে বাইরের লোক।

দ্বিজদাস কহিল, তাই যদি হয়, তবু আপনিই বা কেন তাঁর সম্বন্ধে আমাকে অশ্রদ্ধার খোঁটা দিলেন? জানেন না কি হচ্চে আমার? দীপালোকে স্পষ্ট দেখা গেল তাহার চোখের কোণ-দু’টা অশ্রুবাষ্পে ছলছল করিয়া আসিয়াছে।

মৈত্রেয়ী ঘরে ঢুকিল। বলিল, দ্বিজুবাবু, আপনি কখন বাড়ি এলেন আমরা ত কেউ জানতে পারিনি?

দ্বিজদাস ফিরিয়া দাঁড়াইল, বলিল, জানবার খুব দরকার হয়েছিল নাকি?

মৈত্রেয়ী কহিল, বেশ কথা। আপনি কাল খাননি, আজ খাননি,—এ আর কেউ না জানুক আমি জানি। চলুন মার ঘরে।

কিন্তু মার দরজা ত বন্ধ।

মৈত্রেয়ী বলিল, বন্ধই ছিল, কিন্তু আমি ছাড়িনি। মাথা খোঁড়াখুঁড়ি করে দোর খুলিয়েছি, তাঁকে স্নান করিয়েছি, আহ্নিক করিয়েছি, জোর করে দুটো ফল মুখে গুঁজে দিয়ে খাইয়ে তবে ছেড়েচি। বলছিলেন, দ্বিজু না খেলে খাবেন না। বললাম, সে হবে না মা, আপনার এ আদেশ আমি মানতে পারবো না। কিন্তু তখন থেকে সবাই আমরা আপনার পথ চেয়ে আছি। চলুন, আপনার খাবার রেখে এসেছি মার ঘরে।

দ্বিজদাস অবাক হইয়া রহিল। ইহার এত কথা সে পূর্বে শোনে নাই। বলিল, চলুন।

মৈত্রেয়ী বন্দনাকে উদ্দেশ করিয়া বলিল, আপনিও আসুন। মা আপনাকে ডাকছেন। এই বলিয়া সে দ্বিজদাসকে একপ্রকার গ্রেপ্তার করিয়া লইয়া গেল। সকলের পিছনে গেল বন্দনা।

নিজের ঘরের মধ্যে দয়াময়ী ছিলেন বিছানায় শুইয়া। অনুজ্জ্বল দীপালোকে তাঁহার শোকাচ্ছন্ন মুখের প্রতি চাহিলে ক্লেশ বোধ হয়। পরিস্ফীত দুই চক্ষু আরক্ত, সদ্যস্নাত আর্দ্র কেশগুলি আলুথালু বিপর্যস্ত। শিয়রে বসিয়া কল্যাণী হাত বুলাইয়া দিতেছিল, অন্য দিকে একটা চেয়ারে শশধর, দূরে আর একটা চেয়ারে বসিয়া অক্ষয়বাবু। দ্বিজদাস ঘরে ঢুকিতেই দয়াময়ী মুখ ফিরিয়া শুইলেন, এবং পরক্ষণেই একটা অস্ফুট ক্রন্দনের অবরুদ্ধ আক্ষেপে তাঁহার সর্বদেহ কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিল। বন্দনা নীরবে ধীরে ধীরে গিয়া তাঁহার পায়ের কাছে বসিল, এতবড় ব্যথার দৃশ্য বোধ করি সে কখনো কল্পনা করিতেও পারিত না। বহুক্ষণ পর্যন্ত সকলেই নির্বাক, এই স্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া প্রথমে কথা কহিল শশধর! বলিল, কাল থেকে শুনচি না খেয়েই আছো,—যা হোক দু’টো মুখে দাও।

দ্বিজদাস বলিল, হাঁ।

মেঝের উপর ঠাঁই করিয়া মৈত্রেয়ী সযত্নে খাবার গুছাইয়া দিতেছিল, সেইদিকে চাহিয়া শশধর পুনশ্চ কহিল, তোমার ফিরতে এত দেরি হল যে! তাঁরা গেলেন ত সেই আড়াইটার গাড়িতে?

হাঁ।

শশধর একটুখানি হাসির ভান করিয়া বলিল, অথচ, কলকাতার বাড়িটা ত শুনেচি তোমার।

দ্বিজদাস কহিল, আমার বাড়িতে দাদার প্রবেশ নিষেধ নাকি?

শশধর কহিল, তা বলিনি। বরঞ্চ তিনিই যেন এই ভাবটা দেখিয়ে গেলেন। এ বাড়ি ছেড়েও ত তাঁর যাবার দরকার ছিল না, একটা মিটমাট করে নিলেই ত পারতেন।

দ্বিজদাস বলিল, মিটমাটের পথ যদি খোলা ছিল আপনি করে নিলেন না কেন?

আমি করে নেবো? শশধর অত্যন্ত বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল, এ কিরকম প্রস্তাব? আমাকে অপমান করলেন তিনি আর মিটমাট করবো আমি? মন্দ যুক্তি নয়! এই বলিয়া সে টানিয়া টানিয়া হাসিতে লাগিল। হাসি থামিলে দ্বিজদাস বলিল, যুক্তি মন্দ দিইনি শশধরবাবু। মেয়েরা কথায় বলে পর্বতের আড়ালে থাকা। দাদা ছিলেন সেই পর্বত, আপনি ছিলেন তাঁর আড়ালে। এখন মুখোমুখি দাঁড়ালুম আমি আর আপনি। মান-অপমানের পালা সাঙ্গ হয়ে ত যায়নি,—মাত্র শুরু হলো।

তার মানে?

মানে এই যে, আমি আপনার বাল্যবন্ধু বিপ্রদাস নই,—আমি দ্বিজদাস।

শশধরের মুখের হাসি ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হইল, ভয়ানক গম্ভীরকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, তোমার কথার অর্থ কি বেশ খুলে বল দিকি?

দাদার বন্ধু বলিয়া শশধর ‘তুমি’ বলিয়া ডাকিলেও দ্বিজদাস তাহাকে ‘আপনি’ বলিয়াই সম্বোধন করিত, বলিল, আপনার এ কথা মানি যে অর্থ আজ স্পষ্ট হওয়াই ভালো। আমার দাদা সেই জাতের মানুষ যারা সত্যরক্ষার জন্যে সর্বস্বান্ত হয়, আশ্রিতের জন্যে গায়ের মাংস কেটে দেয়, ওদের আদর্শ বলে কি এক অদ্ভুত বস্তু আছে যার জন্যে পারে না এমন কাজ নেই,— ওরা একধরনের পাগল,—তাই এই দুর্দশা। কিন্তু আমি নিতান্ত সাধারণ মানুষ, আপনার সঙ্গে বেশী প্রভেদ নেই। ঠিক আপনার মতই আমার হিংসে আছে, ঘৃণা আছে, প্রতিশোধ নেবার শয়তানি বুদ্ধি আছে, সুতরাং দাদাকে ঠকিয়ে থাকলে আপনাকেও ঠকাবো, তাঁর নাম জাল করে থাকলে স্বচ্ছন্দে আপনাকে জেলে পাঠাবো,—অন্ততঃ চেষ্টার ত্রুটি হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না দু পক্ষই একদিন পথের ভিখিরি হয়ে দাঁড়াই। বিজ্ঞজনের মুখে শুনি এমনিই নাকি এর পরিণতি। তাই হোক।

শশধর উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল, মা, শুনচেন আপনার দ্বিজুর কথা? ওর যা মুখে আসে বলতে ওকে বারণ করে দিন।

দ্বিজদাস বলিল, মাকে নালিশ জানিয়ে লাভ নেই শশধরবাবু। উনি জানেন আমি বিপিন নই,—মাতৃবাক্য দ্বিজুর বেদবাক্য নয়। দ্বিজু তাল ঠুকে স্পর্ধার অভিনয় করে না এ কথা মা বোঝেন।

কাহারো মুখে কথা নাই, উভয়ের অকস্মাৎ এইরূপ বাদ-প্রতিবাদ যেন সম্পূর্ণ অভাবিত। বিস্ময়ে ও ভয়ে সকলেই স্তব্ধ হইয়া গিয়াছিল। শশধর বুঝিল ইহা পরিহাস নয়,—অতিশয় কঠোর সঙ্কল্প। উত্তর দিতে গিয়া আর তাহার কণ্ঠস্বরে পূর্বের প্রবলতা ছিল না, তথাপি জোর দিয়াই বলিয়া উঠিল, এই শেষ। এখানে আর আমি জলগ্রহণ পর্যন্ত করবো না।

দ্বিজদাস বলিল, কি করে করছিলেন এতক্ষণ এই ত আশ্চর্য শশধরবাবু।

কল্যাণী কাঁদিয়া বলিল, ছোড়দা, অবশেষে তুমিই কি আমাদের মারতে চাও? মায়ের পেটের ভাই তুমি, তুমিই করবে আমাদের সর্বনাশ?

দ্বিজদাস বলিল, তুই ভাবিস চোখের জল ফেলে বার বার এড়ানো যায় সর্বনাশ? কোথাও বিচার হবে না, তোদেরই হবে বারংবার জিত? দাদা নেই বটে, তবুও খেতে যখন পাবিনে আসিস আমার কাছে, তখন তোর কান্না শুনবো,—এখন নয়।

দয়াময়ী নিঃশব্দে অনেক সহিয়াছিলেন, আর পারিলেন না, চীৎকার করিয়া উঠিলেন, দ্বিজু, তুই যা এখান থেকে। এমনি করে গালিগালাজ করতে কি বিপিন তোরে শিখিয়ে দিয়ে গেল?

কে শিখিয়ে দিয়ে গেল বলচো? বিপিন?

হাঁ, সে-ই। নিশ্চয় সে।

দ্বিজদাসের ওষ্ঠাধর মুহূর্তের জন্য কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, বলিল, আমি যাচ্চি। কিন্তু মা, নিজেকে অনেক ছোট করেচো, আর ছোট করো না। এই বলিয়া সে বাহির হইয়া গেল।

নিজের ঘরে আসিয়া দ্বিজদাস চুপ করিয়া বসিয়া ছিল, ঘণ্টা–দুই পরে মৈত্রেয়ী আসিয়া প্রবেশ করিল, তাহার হাতে খাবারের পাত্র, বলিল, খাবার সব নতুন করে তৈরি করে নিয়ে এলুম, খেতে বসুন। এই ঘরেই ঠাঁই করে দিই।

এ আপনাকে কে বলে দিলে?

কেউ না। কাল থেকে আপনি খাননি সে কি আমি জানিনে?

এত লোকের মধ্যে আপনার জানার প্রয়োজন?

মৈত্রেয়ী মাথা হেঁট করিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। জবাব না পাইয়া দ্বিজদাস বলিল, আচ্ছা, ঐখানে রেখে যান। এখন ক্ষিদে নেই, যদি হয় পরে খাবো।

মৈত্রেয়ী ঘরের একধারে আসন পাতিয়া, খাবার রাখিয়া সমস্ত সযত্নে ঢাকা দিয়া চলিয়া গেল। পীড়াপীড়ি করিল না, বলিল না যে ঠাণ্ডা হইয়া গেলে খাওয়ার অসুবিধা ঘটিবে।

রাত্রি বোধ করি তখন বারোটা বাজিয়াছে, দ্বিজদাস চেয়ার ছাড়িয়া উঠিল। সামান্য কিছু খাইয়া শুয়ে পড়িবে এই মনে করিয়া হাতমুখ ধুইতে বাহিরে আসিয়া দেখিল দ্বারের বাহিরে কে-একজন বসিয়া আছে। বারান্দার স্বল্প আলোকে চিনিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে?

আমি মৈত্রেয়ী।

দ্বিজদাসের বিস্ময়ের সীমা নাই, কহিল, এত রাতে আপনি এখানে কেন?

খেতে বসে যদি কিছু দরকার হয় তাই বসে আছি।

এ আপনার ভারী অন্যায়। একে ত প্রয়োজন নেই, আর যদিই বা হয় বাড়িতে আর কি কেউ নেই?

মৈত্রেয়ী মৃদুকণ্ঠে বলিল, ক’দিনের নিরন্তর পরিশ্রমে সকলেই ক্লান্ত। কেউ জেগে নেই, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।

দ্বিজদাস বলিল, আপনি নিজেও ত কম খাটেন নি, তবে ঘুমোলেন না কেন?

মৈত্রেয়ী উত্তর দিল না, চুপ করিয়া রহিল।

দ্বিজদাসের অপেক্ষাকৃত রুক্ষ স্বর এবার অনেকটা নরম হইয়া আসিল, বলিল, এভাবে বসে থাকাটা বিশ্রী দেখতে। আপনি ভেতরে এসে বসুন, যতক্ষণ খাই তদারক করুন। এই বলিয়া সে মুখহাত ধুইতে জলের ঘরে চলিয়া গেল।

ইতিপূর্বে মৈত্রেয়ীর সহিত দ্বিজদাস কম কথাই কহিয়াছে। প্রয়োজনও হয় নাই, ইচ্ছাও করে নাই। এখন আলাপটা কিভাবে চালাইবে ভাবিতে ভাবিতে ফিরিয়া আসিয়া দেখে, না আছে খাবারের পাত্র, না আছে মৈত্রেয়ী নিজে। ব্যাপারটা ইতিমধ্যে কি ঘটিল অনুমান করিবার পূর্বেই কিন্তু সে ফিরিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল, ঢাকা খুলে দেখি সমস্ত শুকিয়ে শক্ত হয়ে উঠেছে, তাই আবার আনতে গিয়েছিলুম। বসুন।

দ্বিজদাস কহিল, ধূঁয়া উঠছে দেখচি। এতরাত্রে ও-সব আবার পেলেন কোথায়?

মৈত্রেয়ী বলিল, ঠিক করে রেখে এসেছিলুম। যখনি বললেন খেতে দেরি হবে তখনি জানি এ-সব না রাখলে হয়ত খাওয়াই হবে না।

দ্বিজদাস ভোজনে বসিয়া প্রথমে রন্ধন-নৈপুণ্যের প্রশংসা করিয়া জানিল ইহার কতকগুলি মৈত্রেয়ীর স্বহস্তের তৈরি। সেগুলি বারংবার অনুরোধ করিয়া সে দ্বিজদাসকে বেশি করিয়া খাওয়াইল। এ বিদ্যায় সে ব্যুৎপন্ন,—জানে কি করিয়া খাওয়াইতে হয়।

দ্বিজদাস হাসিয়া কহিল, বেশি খেলে অসুখ করবে যে।

না, করবে না। কাল থেকে উপোস করে আছেন, একে বেশি খাওয়া বলে না।

কিন্তু আমিই ত কেবল না খেয়ে নেই, এ বাড়িতে বোধ করি অনেকেই আছেন।

মৈত্রেয়ী বলিল, অনেকের কথা জানিনে, কিন্তু মাকে যে কি করে দুটো খাওয়াতে পেরেচি সে শুধু আমিই জানি। আমি না থাকলে কতদিন যে তিনি দোর বন্ধ করে অনাহারে থাকতেন আমার ভাবলে ভয় হয়। কিন্তু আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না, শুনলে বড় লজ্জা করে। আমি কত ছোট।

দ্বিজদাস কহিল, সেই ভালো, তোমাকে আর ‘আপনি’ বলবো না। কিন্তু তুমি অন্নদাদিদির খবর নিয়েছিলে?

মৈত্রেয়ী কহিল, তার আবার কি হলো? সেও কি না খেয়ে আছে নাকি?

এতক্ষণ মৈত্রেয়ীর কথাগুলি তাহার বেশ লাগিতেছিল, একটা প্রসন্নতার বাতাস এই দুঃখের মধ্যেও যেন তাহার মনটাকে মাঝে মাঝে স্পর্শ করিয়া যাইতেছিল, কিন্তু এই শেষ কথাটায় চিত্ত তাহার মুহূর্তে বিরূপ হইয়া উঠিল, কহিল, অনুদির সম্বন্ধে এভাবে কথা বলতে নেই। হয়ত শুনেচো সে আমাদের দাসী, কিন্তু এ বাড়িতে তাঁর চেয়ে বড় আমার কেউ নেই। আমাদের মানুষ করেচেন।

মৈত্রেয়ী বলিল, তা শুনেচি। কিন্তু কত বাড়িতেই ত পুরনো দাস-দাসী ছেলেপুলে মানুষ করে। তাতে নতুন কি আছে? আচ্ছা, আপনার খাওয়া হয়ে গেলে তাঁর খবর নেবো।

দ্বিজদাস নিরুত্তরে ক্ষণকাল তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। হঠাৎ মনে হইল, সত্যিই ত, এমন কত পরিবারেই ঘটিয়া থাকে, যে ভিতরের কথা জানে না, তাহার কাছে শুধু বাহিরের ঘটনায় একান্ত বিস্ময়কর ইহাতে কি আছে! কঠোর বিচার হালকা হইয়া আসিল, কহিল, অনুদি না খেয়ে থাকলেও এত রাত্রে আর খাবেন না। তাঁর জন্যে আজকে ব্যস্ত হবার দরকার নেই।

আবার কয়েক মিনিট নিঃশব্দে কাটিলে দ্বিজদাস জিজ্ঞাসা করিল, মৈত্রেয়ী, পরকে এমন সেবা করতে শিখলে তুমি কার কাছে? তোমার মার কাছে কি?

মৈত্রেয়ী বলিল, না, আমার দিদির কাছে। তাঁর মতো স্বামীকে যত্ন করতে আমি কাউকে দেখিনি।

দ্বিজদাস হাসিয়া বলিল, স্বামী কি পর? আমি পরকে যত্ন করার কথা জিজ্ঞেসা করেছিলুম।

ওঃ—পর? বলিয়াই মৈত্রেয়ী হাসিয়া সলজ্জে মুখ নীচু করিল।

দ্বিজদাস বলিল, আচ্ছা, বলো তোমার দিদির কথা।

মৈত্রেয়ী বলিল, দিদি কিন্তু বেঁচে নেই। তিন বছর হলো একটি ছেলে আর দুটি মেয়ে রেখে মারা গেছেন। চৌধুরীমশাই কিন্তু একটা বছরও অপেক্ষা করলেন না, আবার বিয়ে করলেন। কত বড় অন্যায় বলুন ত!

দ্বিজদাস বলিল, পুরুষমানুষে তাই করে। ওরা অন্যায় মানে না।

আপনিও কি তাই করবেন নাকি?

আগে একটাই ত করি, তার পরে অন্যটার কথা ভাববো।

মৈত্রেয়ী বলিল, এমন করে বললে ত চলবে না। তখন আপনার বৌদিদি ছিলেন, কিন্তু এখন তিনি নেই। মাকে দেখবে কে?

দ্বিজদাস বলিল, কে দেখবে জানিনে মৈত্রেয়ী, হয়ত মেয়ে-জামাই দেখবে, হয়ত আর কেউ এসে তাঁর ভার নেবে,—সংসারে কত অসম্ভবই যে সম্ভব হয় কেউ নির্দেশ করতে পারে না। আমাদের কথা থাক, তোমার নিজের কথা বলো।

কিন্তু আমার নিজের কথা ত কিছু নেই।

কিছুই নেই? একেবারে কিচ্ছু নেই?

মৈত্রেয়ী প্রথমে একটু জড়সড় হইয়া পড়িল, তার পরে একটু হাসিয়া বলিল,—ও আমি বুঝেচি। আপনি চৌধুরীমশায়ের কথা কারো কাছে শুনেছেন বুঝি? ছি ছি, কি নির্লজ্জ মানুষ, দিদি মরতে প্রস্তাব করে পাঠালেন আমাকে বিয়ে করবেন।

তার পরে?

মৈত্রেয়ী বলিল, চৌধুরীমশায়ের অনেক টাকা, বাবা-মা দুজনেই রাজী হয়ে গেলেন, বললেন, আর কিছু না হোক লীলার ছেলে-মেয়েগুলো মানুষ হবে। যেন সংসারে আমার আর কিছু কাজ নেই দিদির ছেলে মানুষ করা ছাড়া। বললুম, ও কথা তোমরা মুখে আনলে আমি গলায় দড়ি দেবো।

কেন, এত আপত্তি তোমার কিসের?

আপত্তি হবে না? জগতে এতবড় অশান্তি আর কিছু আছে নাকি?

দ্বিজদাস বলিল, এ কথা তোমার সত্যি নয়। জগতে সকল ক্ষেত্রেই অশান্তি আসে না মৈত্রেয়ী। আমার মা দাদাকে মানুষ করেছিলেন।

মৈত্রেয়ী বলিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার ফল হলো কি? আজকের মত দুঃখের ব্যাপার এ বাড়িতে আর কখনো এসেছে কি?

দ্বিজদাস স্তব্ধ হইয়া রহিল। ইহার কথা মিথ্যা নয়, কিন্তু সত্যও কিছুতে নয়। মিনিট দুই-তিন অভিভূতের মত বসিয়া অকস্মাৎ যেন তাহার চমক ভাঙ্গিয়া গেল, বলিল, মৈত্রেয়ী, প্রতিবাদ আমি করবো না। এ পরিবারে মহাদুঃখ এলো সত্যি, তবু জানি, তোমার এ কথা সাধারণ মেয়েদের অতি তুচ্ছ সাংসারিক হিসেবের চেয়ে বড় নয়। বলিয়াই সে উঠিয়া দাঁড়াইল, তাহার খাওয়া শেষ হইয়া গিয়াছিল।

পরদিন সমস্ত দুপুরবেলা সে বাড়ি ছিল না, কি কাজে কোথায় গিয়াছিল সে-ই জানে। সন্ধ্যার অন্ধকারে নিঃশব্দে বাড়ি ফিরিয়া সোজা গিয়া দাঁড়াইল বন্দনার গৃহের সম্মুখে, ডাকিল, আসতে পারি?

কে, দ্বিজুবাবু? আসুন।

দ্বিজদাস ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিল বন্দনার বাক্স গুছানো শেষ হইয়াছে, যাত্রার আয়োজন প্রায় সম্পূর্ণ। কহিল, সত্যিই চললেন তাহলে? একটা দিনও বেশি রাখা গেল না?

তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বন্দনার ইচ্ছা হইল না বলে, তবু বলিতেই হইল,—যেতেই ত হবে, একটা দিন বেশি রেখে আমাকে কি লাভ বলুন?

দ্বিজদাস বলিল, লাভের কথা ত ভাবিনি, শুধু ভেবেচি সবাই গেল—এতবড় বাড়িতে বন্ধু কেউ আর রইলো না।

বন্দনা কহিল, পুরনো বন্ধু যায়, নতুন বন্ধু আসে, এমনিই জগৎ দ্বিজুবাবু। সেই আশায় ধৈর্য ধরে থাকতে হয়,—চঞ্চল হলে চলে না।

দ্বিজদাস উত্তর দিল না, চুপ করিয়া রহিল।

বন্দনা বলিল, সময় বেশী নেই, কাজের কথা দুটো বলে নিই। শুনেছেন বোধ হয় শশধরবাবু কল্যাণীকে নিয়ে চলে গেছেন?

না শুনিনি, কিন্তু অনুমান করেছিলুম।

যাবার পূর্বে একফোঁটা জল পর্যন্ত তাঁদের খাওয়াতে পারা গেল না। দু’জনে এসে মাকে প্রণাম করে বললেন, আমরা চললুম। মা বললেন, এসো। তার পরে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রইলেন। এই বলিয়া বন্দনা নীরব হইল। যে কারণে তাহার যাওয়া, যে-সকল কথা মায়ের সম্মুখে দ্বিজু গত রাত্রে বলিয়াছিল, তাহার উল্লেখমাত্র করিল না।

কয়েক মুহূর্ত মৌন থাকিয়া পুনশ্চ কহিল, মা ভারী ভেঙ্গে পড়েছেন। দেখলে মায়া হয়,—লজ্জায় কারো কাছে যেন মুখ দেখাতে পারেন না। মৈত্রেয়ী ওঁর যে সেবা করছে বোধ হয় আপন মেয়েতে তা পারে না। মা সুস্থ হয়ে যদি ওঠেন সে শুধু ওর যত্নে। মেয়েটি বেশ ভাল, কিছুদিন ওকে ধরে রাখার চেষ্টা করবেন এই আমার অনুরোধ।

তাই হবে।

দ্বিজুবাবু, যাবার আগে আর একটি অনুরোধ করে যাবো?

করুন।

আপনাকে বিয়ে করতে হবে।

কেন?

বন্দনা বলিল, এই বৃহৎ পরিবার নইলে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। আপনাদের অনেক ক্ষতি হলো জানি কিন্তু যা রইলো সেও অনেক। আপনাদের কত দান, কত সৎকাজ, কত আশ্রিত-পরিজন, কত দীন-দরিদ্রের অবলম্বন আপনারা,—আর সে কি শুধু আজ? কত দীর্ঘকাল ধরে এই ধারা বয়ে চলেচে আপনাদের পরিবারে—কোনদিন বাধা পায়নি, সে কি এখন বন্ধ হবে? দাদার ভুলে যা গেলো সে ছিল বাহুল্য, সে ছিল প্রয়োজনের অতিরিক্ত। যাক সে। যা রেখে গেলেন শান্তমনে তাকেই যথেষ্ট বলে নিন। সেই অবশিষ্ট আপনার অক্ষয় অজস্র হোক, প্রতিদিনের প্রয়োজনে ভগবান অভাব না রাখুন, আজ বিদায় নেবার পূর্বে তাঁর কাছে এই প্রার্থনা জানাই।

দ্বিজদাসের চোখের জল আসিয়া পড়িল।

বন্দনা বলিতে লাগিল, আপনার বাবা অখণ্ড ভরসায় দাদার ওপর সর্বস্ব রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু তা রইলো না। পিতার কাছে অপরাধী হয়ে রইলেন। কিন্তু সেই ত্রুটি যদি দৈন্য এনে তাঁদের পুণ্য কর্ম বাধাগ্রস্ত করে, কোনদিন মুখুয্যেমশাই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারবেন না। এই অশান্তি থেকে তাঁকে আপনার বাঁচতে হবে।

দ্বিজদাস অশ্রু সংবরণ করিয়া বলিল, দাদার কথা এমন করে কেউ ভাবেনি বন্দনা, আমিও না। এ কি আশ্চর্য!

ভাগ্য ভালো যে, বাতিদানের ছায়ার আড়ালে সে বন্দনার মুখের চেহারা দেখিতে পাইল না। বলিল, দাদার জন্যে সকল দুঃখই নিতে পারি, কিন্তু তাঁর কাজের বোঝা বইবো কি করে—সাহস পাইনে যে! সেই-সব দেখতেই আজ বেরিয়েছিলুম। তাঁর ইস্কুল, পাঠশালা, টোল, মুসলমান ছেলেদের জন্যে মক্‌তব,—আর সেই কি দু-একটা? অনেকগুলো। প্রজাদের জল-নিকাশের একটা খাল কাটা হচ্চে, বহুদিন ধরে তার টাকা যোগাতে হবে। কাগজপত্রের সঙ্গে একটা দীর্ঘ তালিকা পেয়েছি—শুধু দানের অঙ্ক। তারা চাইতে এলে কি যে বলব, জানিনে।

বন্দনা কহিল, বলবেন তারা পাবে। তাদের দিতেই হবে। কিন্তু জিজ্ঞেসা করি, এতকাল তিনি কিছুই কি কাউকে জানান নি?

না।

এর কারণ?

দ্বিজদাস বলিল, সুকৃতি গোপন করার উদ্দেশ্যে নয়। কিন্তু জানাবেন কাকে? সংসারে তাঁর বন্ধু কেউ ত ছিল না। দুঃখ যখন এসেছে একাকী বহন করেছেন, আনন্দ যখন এসেছে তাকেও উপভোগ করেছেন একা। কিংবা, জানিয়ে থাকবেন হয়ত তাঁর ঐ একটি মাত্র বন্ধুকে—এই বলিয়া সে উপরের দিকে চাহিয়া কহিল, কিন্তু সে খবর আত্মীয়—স্বজন জানবে কি করে? জানেন শুধু তিনি আর তাঁর ঐ অন্তর্যামী।

বন্দনা কৌতূহলী হইয়া প্রশ্ন করিল, আচ্ছা দ্বিজবাবু, আপনার কি মনে হয় মুখুয্যেমশাই কাউকে কোনদিন ভালোবাসেন নি? কোন মানুষকেই না?

দ্বিজদাস বলিল, না, সে তাঁর প্রকৃতিবিরুদ্ধ। মানুষের সংসারে এতবড় নিঃসঙ্গ একলা মানুষ আর নেই। তার পরে বহুক্ষণ অবধি উভয়েই নীরব হইয়া রহিল।

বন্দনা জোর করিয়া একটা ভার যেন ঝাড়িয়া ফেলিয়া দিল, বলিল, তা হোক গে দ্বিজুবাবু। তাঁর সমস্ত কাজ আপনাকে তুলে নিতে হবে,—একটিও ফেলতে পারবেন না।

কিন্তু আমি ত দাদা নই, একলা পারবো কেন বন্দনা?

একলা ত নয়, দু’জনে নেবেন। তাই ত বলেছি আপনাকে বিয়ে করতে হবে।

কিন্তু ভালো না বাসলে আমি বিয়ে করবো কি করে?

বন্দনা আশ্চর্য হইয়া তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, এ কি বলছেন দ্বিজুবাবু? এ কথা ত আমাদের সমাজে শুধু আমরাই বলে থাকি। কিন্তু আপনাদের পরিবারে কে কবে ভালোবেসে বিয়ে করেছে যে আপনার না হলে নয়! এ ছলনা ছেড়ে দিন।

দ্বিজদাস বলিল, এ বিধি আমাদের বাড়ির নয় বটে, কিন্তু সেই নজিরই কি চিরদিন মানতে হবে? তাতেই সুখী হবো এ বিশ্বাস আর নেই।

বন্দনা বলিল, বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তর্ক চলে না, সুখের জামিন দিতেও পারবো না, কারণ সে ধন যাঁর হাতে তাঁর ঠিকানা জানিনে। অদ্ভুত তাঁর বিচারপদ্ধতি,—তত্ত্ব-অন্বেষণ বৃথা। কিন্তু বিয়ের আগে নয়ন-মন-রঞ্জন পূর্বরাগের খেলা দেখলুম অনেক, আবার একদিন সে অনুরাগ দৌড় দিলে যে কোন্‌ গহনে, সে প্রহসনও দেখতে পেলুম অনেক। আমি বলি ও-

ফাঁদে পা দিয়ে কাজ নেই দ্বিজুবাবু, সোনার মায়ামৃগ যে বনে চরে বেড়াচ্চে বেড়াক, এ বাড়িতে সমাদরে আহ্বান করে এনে কাজ নেই।

দ্বিজদাস মৃদু হাসিয়া কহিল, তার মানে সুধীরবাবু দিয়েছে আপনার মন ভয়ানক বিগড়ে।

বন্দনা হাসিয়া বলিল, হাঁ। কিন্তু মনের তখনও যেটুকু বাকী ছিল বিগড়ে দিলেন আপনি, আবার তার পরে এলেন অশোক! এখন পোড়া অদৃষ্টে উনি টিকে থাকলে বাঁচি।

উনিটি কে? অশোক? তাঁকে আপনার ভয়টা কিসের?

ভয়টা এই যে তিনিও হঠাৎ ভালোবাসতে শুরু করেছেন।

কেউ ভালবাসার ধার দিয়েও যাবে না এই বুঝি আপনার সঙ্কল্প?

হাঁ, এই আমার প্রতিজ্ঞা। বিয়ে যদি কখনো করি, মস্ত সুখের আশায় যেন মস্ত বিড়ম্বনায় না পা দিই। তাই অশোকবাবুকে কাল সতর্ক করে দিয়েছি, আমাকে ভালোবাসলেই আমি ছুটে পালাবো।

শুনে তিনি কি বললেন?

বললেন না কিছুই, শুধু দু’চোখ মেলে চেয়ে রইলেন। দেখে বড় দুঃখ হলো দ্বিজবাবু।

দুঃখ যদি সত্যিই হয়ে থাকে ত আজও আশা আছে। কিন্তু জানবেন এ-সব শুধু মাসীর বাড়ির ঘোরতর প্রতিক্রিয়া,—শুধু সাময়িক।

বন্দনা বলিল, অসম্ভব নয়, হতেও পারে। কিন্তু শিখলুম অনেক। ভাবি, ভাগ্যে এসেছিলুম কলকাতায়, নইলে কত জিনিস ত অজানা থেকে যেতো।

দ্বিজদাস কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, বেশী সময় আর নেই, এবার শেষ উপদেশ আমাকে দিয়ে যান কি আমাকে করতে হবে।

বন্দনা পরিহাসের ভঙ্গীতে মাথাটা বারকয়েক নাড়িয়া বলিল, উপদেশ চাই? সত্যিই চাই নাকি?

দ্বিজদাস বলিল, হাঁ। সত্যিই চাই। আমি দাদা নই, আমার বন্ধুর প্রয়োজন, উপদেশের প্রয়োজন। বিবাহ করতে আমাকে বলে গেলেন, আমি তাই করবো। কিন্তু ভালোবাসা না পাই, বন্ধুত্ব না পেলে যত ভার দিয়ে গেলেন, আমি বইবো কি করে?

দ্বিজুর মুখে পরিহাসের আভাস মাত্র নাই, এ কণ্ঠস্বর বন্দনাকে বিচলিত করিল, কহিল, ভয় নেই দ্বিজুবাবু, বন্ধু আসবে, সত্যিকার প্রয়োজনে ভগবান তাকে আপনার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে যাবেন, এ বিশ্বাস রাখবেন।

প্রত্যুত্তরে দ্বিজু কি একটা বলিতে গেল কিন্তু বাধা পড়িল। বাহির হইতে মৈত্রেয়ীর সাড়া পাওয়া গেল,—দ্বিজুবাবু আছেন এ ঘরে? মা আপনাকে একবার ডাকচেন।

দ্বিজু উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল, বারোটায় গাড়ি, সাড়ে এগারোটায় বার হতে হবে। ঠিক সময়ে এসে ডাক দেবো। মনে থাকে যেন। এই বলিয়া সে ব্যস্ত হইয়া বাহির হইয়া গেল।