সাত

স্টেশনে পৌঁছিয়া খবর পাওয়া গেল, কোথায় কি একটা আকস্মিক দুর্ঘটনার জন্য ট্রেনের আজ বহু বিলম্ব,—বোধ করি বা একঘণ্টারও বেশী লেট হইবে। পরিচিত স্টেশনমাস্টারটিও হঠাৎ পীড়িত হওয়ায় একজন মাদ্রাজী রিলিভিং হ্যান্ড কাল হইতে কাজ করিতেছিল, সে সঠিক সংবাদ কিছু দিতে পারিল না, শুধু অনুমান করিল যে, দেরি একঘণ্টাও হইতে পারে, দু-ঘণ্টাও হইতে পারে। বিপ্রদাস সাহেবের মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, কলকাতায় পৌঁছতে রাত্রি হয়ে যাবে, আজ কি না গেলেই চলে না?

কেন চলবে না? আমার ত—

বন্দনা বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, না বাবা, সে হয় না। একবার বেরিয়ে এসে আর ফিরে যাওয়া চলে না।

বিপ্রদাস অনুনয়ের সুরে কহিল, কেন চলবে না বন্দনা? বিশেষতঃ তুমি না খেয়ে এসেচ, সারাদিন কি উপোস করেই কাটাবে?

বন্দনা মাথা নাড়িয়া বলিল, আমার ক্ষিদে নেই। ফিরে গেলেও আমি খেতে পারব না।

সাহেব মনে মনে ক্ষুণ্ণ হইলেন, কহিলেন, এদের শিক্ষাদীক্ষাই আলাদা। একবার জিদ ধরলে আর টলান যায় না।

বিপ্রদাস চুপ করিয়া রহিল, আর অনুরোধ করিল না।

স্টেশনটি বড় না হইলেও একটি ছোটগোছের ওয়েটিং রুম ছিল। সেখানে গিয়া দেখা গেল, একজন ছোকরা বয়সের বাঙালী-সাহেব ও তাঁহার স্ত্রী ঘরখানি পূর্বাহ্ণেই দখলে আনিয়াছেন। সাহেব সম্ভবতঃ ব্যারিস্টার কিংবা ডাক্তার কিংবা বিলাতী পাশকরা প্রফেসারও হইতে পারেন। এ অঞ্চলে কোথায় আসিয়াছিলেন, সে একটা রহস্য। আরামকেদারার দুই হাতলে পদদ্বয় দীর্ঘপ্রসারিত করিয়া অর্ধসুপ্ত। আকস্মিক জনসমাগমে মাত্র চক্ষুরুন্মীলন করিলেন—ভদ্রতা-প্রকাশের উদ্যম ইহার অধিক অগ্রসর হইল না। কিন্তু মহিলাটি চেয়ার ছাড়িয়া ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। হয়ত মেমসাহেব হইয়া উঠিতে তখনও পারেন নাই, কিন্তু উঁচু গোড়ালির জুতা ও পোশাক-পরিচ্ছদের ঘটা দেখিয়া মনে হয়, এ-বিষয়ে চেষ্টার ত্রুটি হইতেছে না।

ঘরের মধ্যে আর একখানা আরামচৌকি ছিল, বন্দনা পিতাকে তাহাতে বসাইয়া দিয়া নিজে একখানি বেঞ্চি অধিকার করিয়া বসিল এবং অত্যন্ত সমাদরে বিপ্রদাসকে আহ্বান করিয়া বলিল, জামাইবাবু, মিথ্যে দাঁড়িয়ে থাকবেন কেন, আমার কাছে এসে বসুন। বৃহৎ কাষ্ঠে দোষ নেই, আপনার জাত যাবে না।

শুনিয়া বন্দনার পিতা অল্প একটুখানি হাসিলেন, কহিলেন, বিপ্রদাসের ছোঁয়াছুঁয়ির বাচ-বিচার কি খুব বেশী নাকি?

বিপ্রদাস নিজেও হাসিল, বলিল, বাচ-বিচার আছে, কিন্তু কি হলে খুব বেশী হয়, না জানলে এ প্রশ্নের জবাব দিই কি করে?

বৃদ্ধ কহিলেন, এই ধর বন্দনা যা বললে?

বিপ্রদাস কহিল, উনি না খেয়ে ভয়ানক রেগে আছেন। মেয়েরা রাগের মাথায় যা বলে তা নিয়ে আলোচনা হয় না।

বন্দনা বলিল, আমি রেগে নেই,—একটুও রেগে নেই।

বিপ্রদাস কহিল, আছ, এবং খুব বেশী রকমই রেগে আছ, নইলে আজ তুমি কলকাতায় না গিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে। তা ছাড়া তোমার আপনিই মনে পড়ত যে, এইমাত্র আমরা এক গাড়িতেই এলাম, জাত গিয়ে থাকলে আগেই গেছে, বেঞ্চিতে বসার কথাটা শুধু তোমার ছল মাত্র।

বন্দনা বলিল, হোক ছল, কিন্তু সত্যি বলুন ত মুখুয্যেমশাই, আমাদের ছোঁয়াছুঁয়ি করার জন্যে ফিরে গিয়ে আপনাকে আবার স্নান করতে হবে কিনা?

চল না, বাড়ি ফিরে গিয়ে নিজের চোখে দেখবে?

না। জানেন আপনি, মাকে প্রণাম করতে গেলে তিনি ছোঁবার ভয়ে দূরে সরে গিয়েছিলেন? বলিতে বলিতেই তাহার মুখ ক্রোধে ও লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল।

বিপ্রদাস ইহা লক্ষ্য করিল। উত্তরে শুধু শান্তভাবে বলিল, কথাটা মিথ্যে নয়, অথচ সত্যিও নয়। এর আসল কারণ তাঁর কাছে না থাকলে তুমি বুঝতে পারবে না। কিন্তু সে সম্ভাবনা ত নেই।

না, নেই।

এই তীব্র অস্বীকারের হেতু এতক্ষণে বিপ্রদাসের কাছে স্পষ্ট হইয়া উঠিল। মনে মনে তাহার ক্ষোভের অবধি রহিল না। ক্ষোভ নানা কারণে। বিমাতার সম্বন্ধে কথাটা আংশিক সত্য মাত্র এবং সে নিজেও যেন ইহাতে কতকটা জড়াইয়া গেছে। অথচ, বুঝাইয়া বলিবার সুযোগও নাই, সময়ও নাই। অন্যপক্ষে, ধীরচিত্তে বুঝিবার মত মনোবৃত্তিও বন্দনায় একান্ত অভাব। সুতরাং চুপ করিয়া থাকা ভিন্ন আর উপায় ছিল না,—বিপ্রদাস একেবারেই নীরব হইয়া রহিল।

ছোকরা সাহেব পা নীচে নামাইয়া হাই তুলিয়া বসিলেন, জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনিই জমিদার বিপ্রদাসবাবু না?

হাঁ।

আপনার নাম শুনেচি। পাশের গাঁয়ে আমার স্ত্রীর মামার বাড়ি, বেঙ্গলে যখন আসাই হল তখন ওঁর ইচ্ছে একবার দেখা করে যান। তাই আসা। আমি পাঞ্জাবে প্র্যাকটিস করি।

বিপ্রদাস চাহিয়া দেখিল, লোকটি তাহারই সমবয়সী—এক-আধ বছরের এদিক-ওদিক হইতে পারে, তার বেশী নয়।

সাহেব কহিতে লাগিল, কালই আপনার কথা হচ্ছিল। লোকে বলে আপনি ভয়ানক,— অর্থাৎ কিনা খুব কড়া জমিদার। অবশ্য দু-চারজন বামুন-পণ্ডিতে গোঁড়া হিঁদু বলে বেশ তারিফও করলে। এখন দেখচি নেহাত কথাটা মিথ্যে নয়।

অপরিচিতের এই অযাচিত আলোচনায় বন্দনা ও তাহার পিতা উভয়েই আশ্চর্য হইলেন, কিন্তু বিপ্রদাস কোন উত্তর দিল না। বোধ হয় সে এমনিই অন্যমনস্ক ছিল, যে সকল কথা তাহার কানে যায় নাই।

তিনি পুনশ্চ বলিতে লাগিলেন, আমার লেকচারে আমি প্রায়ই বলে থাকি যে, চাই রিয়েল সলিড্‌ শিক্ষা—ফাঁকিবাজি, ধাপ্পাবাজি নয়। আপনার উচিত একবার ইয়োরোপ ঘুরে আসা। সেখানকার আবহাওয়া, সেখানকার ফ্রি এয়ার ব্রিদ ক’রে না এলে মনের মধ্যে freedom আসে না,—কুসংস্কার থেকে মন মুক্ত হতে চায় না। আমি একাদিক্রমে পাঁচ বৎসর সে দেশে ছিলাম।

বন্দনার পিতা শেষ কথাটায় খুশী হইয়া কহিলেন, এ কথা সত্যি।

উৎসাহ পাইয়া তিনি গরম হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, এই ডিমোক্র্যাসির যুগে সবাই সমান, কেউ কারো ছোট নয়, এবং চাই প্রত্যেকেরই নিজের অধিকার জোর করে assert করা,—consequence তার যা-ই কেন না হোক। আমার টাকা থাকলে আপনার জমিদারির প্রত্যেক প্রজাকে আমি নিজের খরচে ইয়োরোপ ঘুরিয়ে আনতাম। নিজের right কাকে বলে, এ কথা তারা তখন নিজেরাই বুঝত।

বন্দনার বোধ করি ভারী খারাপ লাগিল, সে আস্তে আস্তে কহিল, জামাইবাবু তাঁর প্রজাদের উপর অত্যাচার করেন এ-খবর আপনাকে কে দিলে? আশা করি আপনার মামা-শ্বশুরের ওপর কোন জুলুম হয়নি?

ও—উনি বুঝি আপনার ভগিনীপতি? Thanks. না, তিনি কোন অভিযোগ করেন নি। নিজের স্ত্রীকে উদ্দেশ করিয়া সহাস্যে কহিলেন, তোমার বোনেরা যদি এইরকম হত! আপনি বোধ করি বিলেত ঘুরে এসেছেন? যাননি? যান, যান। Freedom, সাহস, শক্তি কাকে বলে, সে দেশের মেয়েরা সত্যি কি, একবার স্বচক্ষে দেখে আসুন। আমি next time যাবার সময় ওঁকে সঙ্গে নিয়ে যাব স্থির করেচি।

কেহ কোন কথা কহিবার পূর্বেই স্টেশনের সেই রিলিভিং হ্যান্ডটি মুখ বাড়াইয়া জানাইল যে ট্রেন distance signal পার হইয়াছে, আসিয়া পড়িল বলিয়া।

সকলে ব্যস্ত হইয়া প্লাটফর্মে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

গাড়ি দাঁড়াইলে দেখা গেল ছুটির বাজারে যাত্রী-সংখ্যার সীমা নাই। কোথাও তিল-ধারণের জায়গা পাওয়া কঠিন। মাত্র একখানি ফার্স্ট ক্লাস ও আর একখানি সেকেন্ড ক্লাস। সেকেন্ড ক্লাস ভরতি করিয়া একদল ফিরিঙ্গী রেলওয়ে-সারভ্যাণ্ট কলিকাতায় কি একটা খেলার উপলক্ষে চলিয়াছে, এবং বোধ হয় তাহাদেরই কয়েকজন স্থানাভাবে ফার্স্ট ক্লাসে চড়িয়া বসিয়াছে। অপর্যাপ্ত মদ ও বিয়ার খাইয়া লোকগুলার চেহারাও যেমন ভয়ঙ্কর, ব্যবহারও তেমনি বেপরোয়া। গাড়ির দরজা আটকাইয়া সকলে সমস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিল,—go —যাও—যাও!

স্টেশনমাস্টার আসিল, গার্ডসাহেব আসিল, তাহারা গ্রাহ্যই করিল না।

ছোকরা সাহেব কহিলেন, উপায়?

বন্দনা ভয়ে ভয়ে কহিল, চলুন, আজ বাড়ি ফিরে যাই।

বিপ্রদাস বলিল, না।

না ত কি? না হয় রাত্রির ট্রেনে—

ছোকরা সাহেব বলিলেন, সে ছাড়া আর উপায় কি? কষ্ট হবে, তা হোক।

বিপ্রদাস ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না। গাড়িতে চার-পাঁচজন আছে, আর চার-পাঁচজনের জায়গা হওয়া চাই।

বন্দনার পিতা ব্যাকুল হইয়া বলিলেন, চাই ত জানি, কিন্তু ওরা সব মাতাল যে!

বিপ্রদাসের সমস্ত দেহ যেন কঠিন লোহার মত ঋজু হইয়া উঠিল, কহিল, সে ওদের শখ,—আমাদের অপরাধ নয়। উঠুন, আমি সঙ্গে যাব। এবং পরক্ষণেই গাড়ির হাতল ধরিয়া সজোরে ধাক্কা দিয়া দরজা খুলিয়া ফেলিল। বন্দনার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া কহিল, এসো। ছোকরা সাহেবকে ডাকিয়া কহিল, right assert করবেন ত স্ত্রী নিয়ে উঠে পড়ুন। অত্যাচারী জমিদার সঙ্গে থাকতে ভয় নেই।

মাতাল সাহেবগুলা এই লোকটির মুখের পানে একমুহূর্ত চাহিয়া থাকিয়া নিঃশব্দে গিয়া ও-দিকের বেঞ্চে বসিয়া পড়িল।