বার

কৈলাস তীর্থযাত্রায় পথের দুর্গমতার বিবরণ শুনিয়া মামীরা পিছাইয়াছেন, দয়াময়ীর নিজেরও বিশেষ উৎসাহ দেখা যায় না, তথাপি তাঁহার কলিকাতায় কাটিল পাঁচ-ছয়দিন দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট ও গঙ্গাস্নান করিয়া। কাজের লোকের হাতেই কাজের ভার পড়ে, এ বাটীর প্রায় সমস্ত দায়িত্বই আসিয়া ঠেকিয়াছে বন্দনার কাছে। সতী কিছুই করে না, সকল ব্যাপারে বোনকে দেয় আগাইয়া, নিজে বেড়ায় শাশুড়ীর সঙ্গে ঘুরিয়া। তবু কোথাও বাহির হইতে হইলে তাহাকে ডাক দিয়া বলে, বন্দনা, আয় না ভাই আমাদের সঙ্গে। তুই সঙ্গে থাকলে কাউকে কোন কথা জিজ্ঞেসা করতে হয় না।

বিপ্রদাসেরও আজ কাল করিয়া বাড়ি যাওয়া ঘটে নাই, মা কেবলি বাধা দিয়া বলেন, বিপিন চলিয়া গেলে তাঁহাকে বাড়ি লইয়া যাইবে কে? সেদিন সন্ধ্যায় তিনি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখিয়া ফিরিয়া আসিলেন, বিপ্রদাসকে ডাকাইয়া আনিয়া উত্তেজনার সহিত বলিতে লাগিলেন, বিপিন, তুই যাই বলিস, বাবা, লেখাপড়া জানা মেয়েদের ধরনই আলাদা।

বিপ্রদাস বুঝিল, এ বন্দনার কথা। জিজ্ঞাসা করিল, কি হয়েছে মা?

দয়াময়ী বলিলেন, কি হয়েছে? আজ মস্ত একটা লালমুখো সার্জেন এসে আমাদের গাড়ি আটকালে। ভাগ্যে মেয়েটা সঙ্গে ছিল, ইংরিজিতে কি দু’কথা বুঝিয়ে বললে, সাহেব তক্ষনি গাড়ি ছেড়ে দিলে। নইলে কি হ’ত বল ত? হয়ত সহজে ছাড়ত না, নয়ত থানায় পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেত—কি বিভ্রাটই ঘটত! তোর নতুন পাঞ্জাবী ড্রাইভারটা যেন জন্তু।

বিপ্রদাস হাসিয়া কহিল, কি করেছিলে তোমরা—ধাক্কা লাগিয়েছিলে?

বন্দনা আসিয়া দাঁড়াইল। দয়াময়ী ঘাড় নাড়িয়া সায় দিয়া উচ্ছ্বসিত-কণ্ঠে কহিলেন, তোমার কথা বিপিনকে তাই বলছিলুম মা, লেখাপড়া জানা মেয়েদের ধরনই আলাদা! তুমি সঙ্গে না থাকলে সবাই আজ কি বিপদেই পড়তুম! কিন্তু সমস্ত দোষ সেই মেমবেটির। চালাতে জানে না তবু চালাবে। জানে না—তবু বাহাদুরি করবে।

বিপ্রদাস সহাস্যে কহিল, লেখাপড়া জানা মেয়েদের ধরনই ঐ রকম মা। মেমসাহেব নিশ্চয়ই লেখাপড়া জানে।

মা ও বন্দনা দুজনেই হাসিলেন। বন্দনা কহিল, মুখুয্যেমশাই, সেটা মেমসাহেবের দোষ, লেখাপড়ার নয়। মা, আমি রান্নাঘরটা একবার ঘুরে আসি গে। কাল দ্বিজুবাবুর আটার রুটি ঠাকুর শক্ত করে ফেলেছিল, তাঁর খাবার সুবিধে হয়নি। এই বলিয়া সে চলিয়া গেল।

দয়াময়ী স্নেহের চক্ষে সেই দিকে ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, সকল দিকে দৃষ্টি আছে। কেবল লেখাপড়াই নয় বিপিন, মেয়েটা জানে না এমন কাজ নেই। আর তেমনি মিষ্টি কথা। ভার দিয়ে নিশ্চিন্দি—সংসারের কিচ্ছুটি চেয়ে দেখতে হয় না।

বিপ্রদাস কহিল, ম্লেচ্ছ বলে আর ঘেন্না কর না ত মা?

দয়াময়ী বলিলেন, তোর এক কথা! ম্লেচ্ছ হতে যাবে কিসের জন্যে,—ওর মা একবার বিলেত গিয়েছিল বলেই লোকে মেমসাহেব বলে দুর্নাম রটালে। নইলে আমাদের মতই বাঙালী ঘরের মেয়ে। বন্দনা জুতো পরে—তা পরলেই বা! বিদেশে অমন সবাই পরে। লোকজনের সামনে বার হয়—তাতেই বা দোষ কি? বোম্বায়ে ত আর ঘোমটা দেওয়া নেই—ছেলেবেলা থেকে যা শিখেচে তাই করে। আমার যেমন বৌমা তেমনি ও। বাপের সঙ্গে চলে যাবে বলচে—শুনলে মন কেমন করে বাবা।

বিপ্রদাস কহিল, মন কেমন করলে চলবে কেন মা? বন্দনা থাকতে আসেনি,—দুদিন পরে ওকে যেতে ত হবেই।

দয়াময়ী কহিলেন, যাবে সত্যি, কিন্তু ছেড়ে দিতে মন চায় না,—ইচ্ছে করে চিরকাল ধরে রেখে দিই।

বিপ্রদাস ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিল, সে ত আর সত্যিই হবার জো নেই মা—পরের মেয়েকে অত জড়িও না। দুদিনের জন্যে এসেছে সেই ভালো। এই বলিয়া সে কিছু অন্যমনস্কের মত বাহিরে চলিয়া গেল।

কথাটা দয়াময়ীর বেশ মনঃপূত হইল না। কিন্তু সে ক্ষণকালের ব্যাপার মাত্র। বলরামপুরে ফিরিবার কেহ নাম করেন না, তাঁহাদের দিনগুলা কাটিতে লাগিল যেন উৎসবের মত—হাসিয়া, গল্প করিয়া এবং চতুর্দিকে পরিভ্রমণ করিয়া। সকলের সঙ্গেই হাস্য-পরিহাসে এতটা হাল্কা হইতে দয়াময়ীকে ইতিপূর্বে কেহ কখনও দেখে নাই,— তাঁহার অন্তরে কোথায় যেন একটা আনন্দের উৎস নিরন্তর প্রবাহিত হইতেছিল, তাঁহার বয়স ও প্রকৃতিসিদ্ধ গাম্ভীর্যকে সেই স্রোতে মাঝে মাঝে যেন ভাসাইয়া দিতে চায়।

সতীর সঙ্গে আভাসে-ইঙ্গিতে প্রায়ই কি কথা হয়, তাহার অর্থ শুধু শাশুড়ী-বধূই বুঝে, আরও একজন হয়ত কিছু-একটা অনুমান করে সে অন্নদা। সস্ত্রীক পাঞ্জাবের ব্যারিস্টারসাহেব এতদিন থাকিয়া কাল বাড়ি গেছেন, তাঁহাদের উভয়ের নামই বসন্ত, এই লইয়া দয়াময়ী যাইবার সময়ে কৌতুক করিয়াছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি করাইয়া লইয়াছেন যে, কর্মস্থলে ফিরিবার পূর্বে আবার দেখা দিয়া যাইতে হইবে। হয় কলিকাতায়, নয় বলরামপুরে। রায়সাহেবের পা ভাল হইয়াছে, আগামী সপ্তাহে তিনি বোম্বাই যাত্রা করিবেন, দয়াময়ী নিজে দরবার করিয়া বন্দনার কিছুদিনের ছুটি মঞ্জুর করাইয়া লইয়াছেন, সে যে বোম্বায়ের পরিবর্তে বলরামপুরে গিয়া অন্ততঃ আরও একটা মাস দিদির কাছে অবস্থান করিবে এ ব্যবস্থা পাকা হইয়াছে।

মুখুয্যেদের মামলা-মকদ্দমা হাইকোর্টে লাগিয়াই থাকে, একটা বড়রকম মামলার তারিখ নিকটবর্তী হইতেছিল, তাই বিপ্রদাস স্থির করিল আর বাড়ি না গিয়া এই দিনটা পার কারিয়া দিয়া সকলকে লইয়া দেশে ফিরিবে। নানা কাজে তাহাকে সর্বদাই বাহিরে থাকিতে হয়, আজ ছিল রবিবার, দয়াময়ী আসিয়া হাসিমুখে বলিলেন, একটা মজার কথা শুনেচিস বিপিন?

বিপ্রদাস আদালতের কাগজ দেখিতেছিল, চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, কহিল, কি কথা মা?

দয়াময়ী বলিলেন, দ্বিজুদের কি-একটা হাঙ্গামার মিটিং ছিল আজ, পুলিশে হতে দেবে না, আর ওরা করবেই। লাঠালাঠি মাথা ফাটাফাটি হ’তই, শুনে ভয়ে মরি—

সে গেছে নাকি?

না। সেই কথাই ত তোকে বলতে এলুম। কারও মানা শুনবে না, এমন কি ওর বৌদিদির কথা পর্যন্তও না, শেষে শুনতে হ’ল বন্দনার কথা।

খবরটা যত মজারই হোক মায়ের সুপরিচিত মর্যাদায় কোথায় যেন একটু ঘা দিল। বিপ্রদাস মনে মনে বিস্মিত হইয়াও মুখে শুধু বলিল, সত্যি নাকি?

দয়াময়ী হাসিয়া জবাব দিলেন, তাই ত হ’ল দেখলুম। কবে নাকি ওদের শর্ত হয়েছিল এখানে একজন জুতো পরবে না, চাল- চলনে এ বাড়ির নিয়ম লঙ্ঘন করবে না, আর তার বদলে অন্যজনকে তার অনুরোধ মেনে চলতে হবে। বন্দনা ওর ঘরে ঢুকে শুধু বললে, দ্বিজুবাবু, শর্ত মনে আছে ত? আপনি কিছুতে আজ যেতে পাবেন না। দ্বিজু স্বীকার করে বললে, বেশ তাই হবে, যাব না। শুনে আমার ভাবনা ঘুচল বিপিন। কি করে আসবে, কি ফ্যাসাদ বাধবে—কর্তা বেঁচে নেই, কি ভয়ে ভয়েই যে ওকে নিয়ে থাকি তা বলতে পারিনে।

বিপ্রদাস চুপ করিয়া রহিল। মা বলিতে লাগিলেন, আগে তবু ওর ইস্কুল-কলেজ, পড়াশুনা, একজামিন-পাস করা ছিল, এখন সে বালাই ঘুচেছে, হাতে কাজ না থাকলে বাইরের কোন্‌ ঝঞ্ঝাট যে কখন ঘরে টেনে আনবে তা কেউ বলতে পারে না। ভাবি, শেষ পর্যন্ত এত বড় বংশের ও একটা কলঙ্ক হয়ে না দাঁড়ায়।

বিপ্রদাস হাসিয়া ঘাড় নাড়িল, কহিল, না, মা সে ভয় ক’র না, দ্বিজু কলঙ্কের কাজ কখনো করবে না।

মা বলিলেন, ধর যদি হঠাৎ একটা জেল হয়েই যায়? সেই আশঙ্কা কি নেই?

বিপ্রদাস কহিল, আশঙ্কা আছে মানি, কিন্তু জেলের মধ্যে ত কলঙ্ক নেই মা, কলঙ্ক আছে কাজের মধ্যে। তেমন কাজ সে কোনদিন করবে না। ধর যদি আমারি কখন জেল হয়,—হতেও ত পারে, তখন কি আমার জন্যে তুমি লজ্জা পাবে মা? বলবে কি বিপিন আমার বংশের কলঙ্ক?

কথাটা দয়াময়ীকে শূল-বিদ্ধ করিল। কি জানি কোন নিহিত ইঙ্গিত নাই ত? এই ছেলেটিকে বুকে করিয়া এতবড় করিয়াছেন, বেশ জানিতেন, সত্যের জন্য, ধর্মের জন্য বিপ্রদাস পারে না এমন কাজ নাই। কোন বিপদ, কোন ফলাফলই সে গ্রাহ্য করে না অন্যায়ের প্রতিবাদ করিতে। যখন তাহার মাত্র আঠারো বৎসর বয়স তখন একটি মুসলমান-পরিবারের পক্ষ লইয়া সে একাকী এমন কাণ্ড করিয়াছিল যে কি করিয়া প্রাণ লইয়া ফিরিতে পারিল তাহা আজও দয়াময়ীর সমস্যার ব্যাপার। বন্দনার মুখে সেদিনকার ট্রেনের ঘটনা শুনিয়া তিনি শঙ্কায় একেবারে নির্বাক হইয়া গিয়াছিলেন। দ্বিজুর জন্য তাঁহার উদ্বেগ আছে সত্য, কিন্তু অন্তরে ঢের বেশী ভয় আছে তাঁহার এই বড় ছেলেটির জন্য। মনে মনে ঠিক এই কথাই ভাবিতেছিলেন। বিপ্রদাস কহিল, কেমন মা, কলঙ্কের দুর্ভাবনা গেল ত? জেল হঠাৎ একদিন আমারও হয়ে যেতে পারে যে!

দয়াময়ী অকস্মাৎ ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিলেন, বালাই ষাট! ও-সব অলুক্ষণে কথা তুই বলিস নে বাবা। তার পরেই কহিলেন, জেল হবে তোর আমি বেঁচে থাকতে? এতদিন ঠাকুর-দেবতাকে ডেকেচি তবে কেন? এত সম্পত্তি রয়েচে কিসের জন্যে? তার আগে সর্বস্ব বেচে ফেলব, তবু এ ঘটতে দেব না, বিপিন।

বিপ্রদাস হেঁট হইয়া তাঁহার পদধূলি লইল, দয়াময়ী সহসা তাহাকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া কহিলেন, দ্বিজুর যা হয় তা হোক গে, কিন্তু তুই আমার চোখের আড়াল হলে আমি গঙ্গায় ডুবে মরব বিপিন। এ সইতে আমি পারব না, তা জেনে রাখিস। বলিতে বলিতে কয়েক ফোঁটা জল তাঁহার চোখ দিয়া গড়াইয়া পড়িল।

মা, এ বেলা কি—, বলিতে বলিতে বন্দনা ঘরে ঢুকিল। দয়াময়ী তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া চোখ মুছিয়া ফেলিলেন, বন্দনার বিস্মিত মুখের প্রতি চাহিয়া সহাস্যে কহিলেন, ছেলেটাকে অনেকদিন বুকে করিনি তাই একটু সাধ হলে নিতে।

বন্দনা কহিল, বুড়ো ছেলে—আমি কিন্তু সকলকে বলে দেব।

দয়াময়ী প্রতিবাদ করিয়া কহিলেন, তা দিও কিন্তু বুড়ো কথাটি মুখে এনো না মা। এই ত সেদিনের কথা, বিয়ের কনে উঠানে এসে দাঁড়িয়েচি, আমার পিসশাশুড়ী তখনও বেঁচে, বিপিনকে আমার কোলে ফেলে দিয়ে বললেন, এই নাও তোমার বড়ছেলে বৌমা। কাজকর্মের ভিড়ে অনেকক্ষণ কিছু খেতে পায়নি—আগে খাইয়ে ওকে ঘুম পাড়াও গে, তার পরে হবে অন্য কাজ। তিনি বোধ হয় দেখতে চাইলেন আমি পারি কিনা—কি জানি পেরেচি কিনা! এই বলিয়া তিনি আবার হাসিলেন।

বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, আপনি তখন কি করলেন মা?

দয়াময়ী বলিলেন, ঘোমটার ভেতর থেকে চেয়ে দেখি একতাল সোনা দিয়ে গড়া জ্যান্ত পুতুল, বড় বড় চোখ মেলে আশ্চর্য হয়ে আমার পানে তাকিয়ে আছে। বুকে করে নিয়ে দিলুম ছুট। আচার-অনুষ্ঠান তখন অনেক বাকী, সবাই হৈচৈ করে উঠলো, আমি কিন্তু কান দিলুম না। কোথায় ঘর, কোথায় দোর চিনিনে—যে দাসীটি সঙ্গে দৌড়ে এসেছিল সে ঘর দেখিয়ে দিলে, তাকেই বললুম, আন ত ঝি আমার খোকার দুধের বাটি, ওকে না খাইয়ে আমি এক পা নড়ব না। সেদিন পাড়া-প্রতিবেশী মেয়েরা কেউ বললে বেহায়া, কেউ বললে আরো কত কি, আমি কিন্তু গ্রাহ্যই করলুম না। মনে মনে বললুম, বলুক গে ওরা। যে রত্ন কোলে পেলুম তাকে ত আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আমার সেই ছেলেকে তুমি বল কিনা বুড়ো!

ত্রিশ বৎসর পূর্বের ঘটনা স্মরণ করিতে অশ্রুজলে ও হাসিতে মিশিয়া মুখখানি তাঁহার বন্দনার চোখে অপূর্ব হইয়া দেখা দিল, অকৃত্রিম স্নেহের সুগভীর তাৎপর্য এমন করিয়া উপলব্ধি করার সৌভাগ্য তাহার আর কখন ঘটে নাই। অভিভূত চক্ষে ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া সে আপনাকে সামলাইয়া লইল, হাসিয়া বলিল, মা, আপনার দুটি ছেলের কোন্‌টিকে বেশী ভালবাসেন সত্যি করে বলুন ত?

শুনিয়া দয়াময়ী হাসিলেন, বলিলেন, অসম্ভব সত্যি হলেও বলতে নেই মা, শাস্ত্রে নিষেধ আছে।

বন্দনা বাহিরের লোক, সবেমাত্র পরিচয় হইয়াছে, ইহার সম্মুখে এই-সকল পূর্বকথার আলোচনায় বিপ্রদাস অস্বস্তিবোধ করিতেছিল, কহিল, বললেও তুমি বুঝবে না বন্দনা, তোমার কলেজের ইংরিজি পুঁথির মধ্যে এ-সব তত্ত্ব নেই; তার সঙ্গে মিলিয়ে যাচাই করতে গিয়ে মায়ের কথা তোমার ভারী অদ্ভুত ঠেকবে। এ আলোচনা থাক।

শুনিয়া বন্দনা খুশী হইল না, কহিল, ইংরিজি পুঁথি আপনিও ত কম পড়েন নি মুখুয্যেমশাই, আপনিই বা তবে বোঝেন কি করে?

বিপ্রদাস বলিল, কে বললে মাকে আমরা বুঝি বন্দনা,—বুঝিনে। এ-সব তত্ত্ব শুধু আমার এই মায়ের পুঁথিতেই লেখা আছে—তার ভাষা আলাদা, অক্ষর আলাদা, ব্যাকরণ আলাদা। সে কেবল উনি নিজেই বোঝেন—আর কেউ না। হাঁ মা, যা বলতে এসেছিলে সে ত এখনও বললে না?

বন্দনা বুঝিল এ ইঙ্গিত তাহাকে। কহিল, মা, এ-বেলার রান্নার কথা আপনাকে জিজ্ঞেসা করতে এসেছিলুম—আমি যাই, কিন্তু আপনিও একটু শীঘ্র করে আসুন। সব ভুলে গিয়ে আবার যেন ছেলে কোলে করে বসে থাকবেন না। এই বলিয়া বিপ্রদাসকে সে একটু কটাক্ষ করিয়া চলিয়া গেল।

সে চলিয়া গেলে দয়াময়ীর মুখের পরে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়িল, ক্ষণকাল ইতস্ততঃ করিয়া দ্বিধার কণ্ঠে কহিলেন, বিপিন তুই ত খুব ধার্মিক, জানিস ত বাবা, মাকে কখনও ঠকাতে নেই!

বিপ্রদাস বলিল, দোহাই মা, অমন করে তুমি ভূমিকা ক’র না। কি জিজ্ঞাসা করবে কর।

দয়াময়ী কহিলেন, তুই হঠাৎ আজ ও-কথা বললি কেন যে তোরও জেল হতে পারে?

কৈলাসে যাবার সঙ্কল্প এখনও ত্যাগ করিনি বটে, কিন্তু আর ত আমি এক পাও নড়তে পারব না বিপিন।

বিপ্রদাস হাসিয়া ফেলিল, কহিল, কৈলাসে পাঠাতে আমিও ব্যস্ত নই মা, কিন্তু সে দোষ আমার ঘাড়ে শেষকালে যেন চাপিও না। ওটা শুধু একটা দৃষ্টান্ত,—দ্বিজুর কথায় তোমাকে বোঝাতে চেয়েছিলুম যে কেবল জেলে যাবার জন্যই কারও বংশে কলঙ্ক পড়ে না।

দয়াময়ী মাথা নাড়িলেন—ওতে আমি ভুলব না বিপিন। এলোমেলো কথা বলার লোক তুই নয়—হয় কি করেচিস, নয় কি-একটা করার মতলবে আছিস। আমাকে সত্যি করে বল।

বিপ্রদাস কহিল, তোমাকে সত্যি করেই বলচি আমি কিছুই করিনি। কিন্তু মানুষের মনের মধ্যে কত রকমের মতলব আনাগোনা করে তার কি কোন সঠিক নির্দেশ দেওয়া চলে মা?

দয়াময়ী পূর্বের মত মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না, তাও না। নইলে তোকে দেখলেই কেন আজকাল আমার এমন মন-কেমন করে? তোকে মানুষ করেচি, আমি বেঁচে থাকতেই শেষকালে এতবড় নেমকহারামি করবি বাবা? বলিতে বলিতেই তাঁহার দুই চোখ জলে পরিপূর্ণ হইয়া গেল।

বিপ্রদাস বিপন্ন হইয়া বলিল, অমঙ্গল কল্পনা করে যদি তুমি মিথ্যে ভয় পাও মা, আমি তার কি প্রতিকার করতে পারি বল? তুমি ত জান তোমার অমতে কখন একটা কাজও আমি করিনে।

দয়াময়ী কহিলেন, কর না সত্যি, কিন্তু কাল দ্বিজুকে ডেকে পাঠিয়ে কেন বলেচ কাজকর্ম সমস্ত বুঝে নিতে?

বড় হল, আমাকে সাহায্য করবে না?

দয়াময়ী রাগ করিয়া বলিলেন, ওর কতটুকু শক্তি? আমাকে ভোলাস নে বিপিন, তুই আজ এত ক্লান্ত যে তোর প্রয়োজন হল ওর সাহায্য নেবার। কি তোর মনে আছে আমাকে খুলে বল?

বিপ্রদাস চুপ করিয়া রহিল, এ কথা বলিল না যে, তিনি নিজেই এইমাত্র দ্বিজদাসের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে চিন্তা করিতে তাহাকে বলিতেছিলেন। কিন্তু ইহারই আভাস পাওয়া গেল দয়াময়ীর পরবর্তী কথায়। বলিতে লাগিলেন, আমাদের এ পুণ্যের সংসার, ধর্মের পরিবার, এখানে অনাচার সয় না। আমাদের বাড়ি নিয়মের কড়াকড়িতে বাঁধা। তোর বিয়ে দিয়েছিলুম আমি সতেরো বছর বয়সে,—সে তোর মত নিয়ে নয়,—আমাদের সাধ হয়েছিল বলে। কিন্তু দ্বিজু বলে, সে বিয়ে করবে না। ও এম. এ. পাস করেছে, ওর ভাল-মন্দ বোঝবার শক্তি হয়েছে, ওর ওপর কারও জোর খাটবে না। সে যদি সংসারী না হয় তাকে আমার বিশ্বাস নেই, আমার শ্বশুরের বিষয়-সম্পত্তিতে সে যেন হাত দিতে না আসে।

বিপ্রদাস জিজ্ঞাসা করিল, দ্বিজু কবে বললে সে বিয়ে করবে না?

প্রায়ই ত বলে। বলে, বিয়ে করবার লোক অনেক আছে, তারা করুক। ও করবে শুধু দেশের কাজ। তোরা ভাবিস এখানে এসে পর্যন্ত আমি দিনরাত ঘুরে বেড়াই,—খুব মনের সুখে আছি। কিন্তু সুখে আমি নেই। এর ওপর তুই দিলি আজ জেলের দৃষ্টান্ত—যেন আমাকে বোঝাবার আর কোন দৃষ্টান্তই তোর হাতে ছিল না। একদিন কিন্তু টের পাবি বিপিন।

বিপ্রদাস কহিল, ওর বৌদিদিকে হুকুম করতে বল না মা?

তার কথাও সে শুনবে না।

শুনবে মা, শুনবে। সময় হলেই শুনবে। একটু হাসিয়া কহিল, আর যদি আমাকে আদেশ কর ত তার পাত্রীর সন্ধান করতে পারি।

বন্দনা আসিয়া ঘরে ঢুকিল, অনুযোগের সুরে কহিল, কৈ এলেন না ত? আমি কতক্ষণ ধরে বসে আছি মা!

চল মা, যাচ্ছি।

বিপ্রদাস কহিল, আমাদের অক্ষয়বাবুর সেই মেয়েটিকে তোমার মনে আছে মা? এখন সে বড় হয়েচে। মেয়েটি যেমন রূপে তেমনি গুণে। আমাদেরই স্ব-ঘর, বল ত গিয়ে দেখে আসি, কথাবার্তা বলি। আমার বিশ্বাস দ্বিজুর অপছন্দ হবে না।

না না, সে এখন থাক,—বলিয়া দয়াময়ী পলকের জন্য একবার বন্দনার মুখের পানে চাহিয়া দেখিলেন, বলিলেন, সতীর ইচ্ছে, না—না বিপিন, বৌমাকে জিজ্ঞেসা না করে সে-সব কিছু করে কাজ নেই।

বন্দনা কথা কহিল। সুন্দর শান্ত চোখে উভয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, তাতে দোষ কি মা? এই ত কলকাতায়, চলুন না দিদিকে নিয়ে আমরা গিয়ে দেখে আসি গে।

শুনিয়া দয়াময়ী বিব্রত হইয়া পড়িলেন, কি যে জবাব দিবেন ভাবিয়া পাইলেন না।

বিপ্রদাস কহিল, এ উত্তম প্রস্তাব মা। অক্ষয়বাবু স্বধর্মনিষ্ঠ পণ্ডিত ব্রাহ্মণ, সংস্কৃতের অধ্যাপক। মেয়েকে ইস্কুল-কলেজ থেকে পাস করান নি বটে, কিন্তু যত্ন করে শিখিয়েছেন অনেক। একদিন তাঁদের ওখানে আমার নিমন্ত্রণ ছিল, সেদিন মেয়েটিকে জিজ্ঞেসা করেছিলুম আমি অনেক কথা। মনে হয়েছিল, বাপ সাধ করে মেয়ের নামটি যে রেখেছিলেন মৈত্রেয়ী তা অসার্থক হয়নি। যাও না মা, গিয়ে একবার তাকে দেখে আসবে— তোমার বড়বৌ অন্ততঃ মনে মনে স্বীকার করবেন তিনি ছাড়াও সংসারে রূপসী মেয়ে আছে।

মা হাসিতে চাহিলেন। কিন্তু হাসি আসিল না, মুখে কথাও যোগাইল না,—বন্দনা পুনশ্চ অনুরোধ করিল, চলুন না মা, আমরা গিয়ে একবার মৈত্রেয়ীকে দেখে আসি গে? বেশী দূর ত নয়।

দয়াময়ী চাহিয়া দেখিলেন বন্দনার মুখের পরে এখন সে লাবণ্য আর নাই, যেন ছায়ায় ঢাকা দিয়াছে। এইবার, এতক্ষণে তিনি জবাব খুঁজিয়া পাইলেন, কহিলেন, না মা, দূর বেশী নয় জানি, কিন্তু সে সময়ও আমার নেই। চল আমরা যাই,—এ বেলায় কি রান্না হবে দেখি গে। এই বলিয়া তিনি তাহার হাত ধরিয়া ঘর হইতে বাহিরে গেলেন।