ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত ‘জীবনচরিত’ চেম্বার্স বায়োগ্রাফী পুস্তকের অনুবাদ। এতে গালিলিও, নিউটন, হর্শেল, ডুবাল, জোন্স প্রভৃতির জীবনচরিত আলোচিত হয়েছে। এডুলিচার বিদ্যাসাগর রচনাবলীতে আমরা শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সংগৃহিত বিদ্যাসাগর-স্মৃতি-সংরক্ষণ-সমিতি পক্ষে রঞ্জন পাব্‌লিশিং হাউস, কলিকাতা হতে প্রকাশিত ‘বিদ্যাসাগর-গ্রন্থাবলী’র পাঠ অনুসরণ করেছি। এই গ্রন্থে ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে মুদ্রিত দশম সংস্করণের পাঠ অনুসৃত হয়েছিল।

প্ৰথম বারের বিজ্ঞাপন

জীবনচরিতপাঠে দ্বিবিধ মহোপকার লাভ হয়। প্রথমতঃ, কোন কোন মহাত্মারা অভিপ্রেতসম্পাদনে কৃতকাৰ্য্য হইবার নিমিত্ত যেরূপ অক্লিষ্ট পরিশ্রম, অবিচলিত উৎসাহ, মহীয়সী সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তর অধ্যবসায় প্রদর্শন করিয়াছেন এবং কেহ কেহ বহুতর দুর্বিষহ নিগ্ৰহ ও দারিদ্র্যনিবন্ধন অশেষ ক্লেশ ভোগ করিয়াও যে ব্যবসায় হইতে বিচলিত হয়েন নাই, তৎসমুদায় আলোচনা করিলে এক কালে সহস্র উপদেশের ফল প্রাপ্ত হওয়া যায়। দ্বিতীয়তঃ, আনুষঙ্গিক তত্তদেশের তত্তৎকালীন রীতি, নীতি, ইতিহাস ও আচার পরিজ্ঞান হয়। যে বিষয়ের অনুশীলনে এতাদৃশ মহাৰ্থলাভ সম্পন্ন হইতে পারে, তাহাকে অবশ্যই শিক্ষাকাৰ্য্যের এক প্ৰধান অঙ্গ বলিয়া অঙ্গীকার করিতে হইবে।

রবর্ট ও উইলিয়ম চেম্বর্স, বহুসংখ্যক সুপ্ৰসিদ্ধ মহানুভবদিগের বৃত্তান্ত সঙ্কলন করিয়া, ইঙ্গরেজী ভাষায় যে জীবনচরিতপুস্তক প্রচার করিয়াছেন, তাহা বাঙ্গালা ভাষায় অনুবাদিত হইলে, এতদ্দেশীয় বিদ্যার্থিগণের পক্ষে বিশিষ্টরূপ উপকার দর্শিতে পারে, এই আশয়ে আমি ঐ পুস্তকের অনুবাদে প্ৰবৃত্ত হইয়াছিলাম। কিন্তু, সময়াভাব ও অন্যান্য কতিপয় প্ৰতিবন্ধক বশতঃ, তন্মধ্যে আপাততঃ কেবল কোপর্নিকস, গালিলিয়, নিউটন, হর্শেল, গ্রোশ্যস, লিনিয়স, ডুবাল, জেস্কিন্স ও জোন্স এই কয়েক মহাত্মার চরিত অনুবাদিত ও প্ৰচারিত হইল।

ইয়ুরোপীয় পদার্থবিদ্যা ও অন্যান্য বিদ্যা সংক্রান্ত অনেক কথার বাঙ্গালা ভাষায় অসঙ্গতি আছে; ঐ অসঙ্গতি পূরণার্থে কোনও কোনও স্থলে দুরূহ সংস্কৃত শব্দ প্রয়োগ ও স্থলবিশেষে তত্তৎ কথার অর্থ ও তাৎপৰ্য্য পৰ্য্যালোচনা করিয়া তৎপ্রতিরূপ নূতন শব্দ সঙ্কলন করিতে হইয়াছে; পাঠকগণের বোধসৌকর্য্যার্থে পুস্তকের শেষে তাহাদের অর্থ ও বুৎপত্তিক্রম প্রকাশিত হইল। কিন্তু সঙ্কলিত শব্দ সকল বিশুদ্ধ ও অবিসংবাদিত হইয়াছে কি না সে বিষয়ে আমি অপরিতৃপ্ত রহিলাম।

বাঙ্গালায় ইঙ্গরেজীর অবিকল অনুবাদ করা অত্যন্ত দুরূহ কৰ্ম্ম; ভাষাদ্বয়ের রীতি ও রচনাপ্রণালী পরস্পর নিতান্ত বিপরীত; এই নিমিত্ত, অনুবাদক অত্যন্ত সাবধান ও যত্নবান হইলেও অনুবাদিত গ্রন্থে রীতিবৈলক্ষণ্য, অর্থপ্রতীতির ব্যতিক্রম ও মূলার্থের বৈকল্য ঘটিয়া থাকে। আমি ঐ সমস্ত দোষ অতিক্ৰম করিবার আশয়ে অনেক স্থলে অবিকল অনুবাদ করি নাই, তথাপি এই অনুবাদে ঐ সকল দোষের ভূয়সী সম্ভাবনা আছে, সন্দেহ নাই। যাহা হউক, ইহা সাহস করিয়া বলা যাইতে পারে, এই অনুবাদ বিদ্যার্থিগণের পক্ষে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর হইবেক না। পরিশেষে অবশ্যকৰ্ত্তব্য কৃতজ্ঞতাস্বীকারের অন্যথাভাবে অধৰ্ম্ম জানিয়া, অঙ্গীকার করিতেছি, শ্ৰীযুত মদনমোহন তর্কালঙ্কার শ্ৰীযুত নীলমাধব মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি কয়েক জন বিচক্ষণ বন্ধু এ বিষয়ে যথেষ্ট আনুকূল্য করিয়াছেন।

কলিকাতা। সংস্কৃত কালেজ।

২৭এ ভাদ্র। শকাব্দাঃ ১৭৭১।

শ্ৰীঈশ্বরচন্দ্ৰশৰ্ম্মা

দ্বিতীয় বারের বিজ্ঞাপন

প্ৰায় দুই বৎসর অতীত হইল, জীবনচরিত প্ৰথম মুদ্রিত ও প্রচারিত হইয়াছিল। যৎকালে প্ৰথম প্রচারিত হয়, আমার এমন আশা ছিল না, ইহা সৰ্ব্বত্র পরিগৃহীত হইবেক। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ছয় মাসের অনধিককালমধ্যেই প্রথম মুদ্রিত সমুদায় পুস্তক নিঃশেষিত হয়। সমুদায় পুস্তক নিঃশেষিত হয়, কিন্তু গ্ৰাহকবর্গের আগ্রহনিবৃত্তি হয় নাই। সুতরাং অবিলম্বে পুনর্মুদ্রিত করা অত্যাবশ্যক হইয়াছিল। কিন্তু নানা হেতুবশতঃ আমি অনেক দিন পৰ্য্যন্ত পুনর্মুদ্রিতকরণ স্থগিত রাখিয়াছিলাম।

বাঙ্গালা ভাষায় ইঙ্গরেজী পুস্তকের অনুবাদ করিলে, প্রায় সুস্পষ্ট ও অনায়াসে বোধগম্য হয় না এবং ভাষার রীতির ভূরি ভূরি ব্যতিক্রম ঘটে। আমি ঐ সমস্ত দোষ অতিক্ৰম করিবার নিমিত্ত বিস্তর প্রয়াস পাইয়াছিলাম এবং আমার পরম বন্ধু শ্ৰীযুত মদনমোহন তর্কালঙ্কারও আমার অভিপ্ৰেতিসিদ্ধির নিমিত্ত যথেষ্ট পরিশ্রম করিয়াছিলেন। তথাপি মধ্যে মধ্যে অত্যন্ত দুর্বোধ ও অত্যন্ত অস্পষ্ট ছিল এবং স্থানে স্থানে ভাষায় রীতিরও ব্যতিক্রম ঘটিয়াছিল।

প্রথম বারের মুদ্রিত সমুদায় পুস্তক নিঃশেষিত হইলে, যখন জীবনচরিত পুনর্মুদ্রিত করিবার কল্পনা হয়, আমি আদ্যন্ত পাঠ করিয়া স্থির করিয়াছিলাম, পুনর্বার পরিশ্রম করিলেও ইহা পূর্বনির্দিষ্ট দোষসমুদায় হইতে মুক্ত হওয়া দুর্ঘট, সুতরাং সঙ্কল্প করিয়াছিলাম, আর কখনও ইঙ্গরেজী পুস্তকের অনুবাদ করিব না এবং এই পুস্তকও পুনর্মুদ্রিত করিব না। এবং সেই নিমিত্ত বাঙ্গালায় এক নূতন জীবনচরিত পুস্তক সঙ্কলন করিবার বাসনা ও উদ্যোগ করিয়াছিলাম। কিন্তু গত দুই বৎসর কাল বিষয়ান্তরে একান্ত ব্যাপৃত হইয়া এমন অবকাশশূন্য হইয়াছি যে, সে বাসনা সম্পন্ন করিতে পারি নাই এবং ত্বরায় সম্পন্ন করিতে পারিব এরূপ সম্ভাবনাও নাই।

কিন্তু যাবৎ নূতন জীবনচরিত পুস্তক প্ৰস্তুত না হইতেছে এই পুস্তক পুনর্মুদ্রিত করিলে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর হইবেক না, এই বিবেচনায় পুনর্মুদ্রিত করা আবশ্যক স্থির হওয়াতে, দ্বিতীয় বার মুদ্রিত ও প্রচারিত হইল। কোনও কোনও অংশ এক বারেই পরিত্যাগ করিয়াছি, স্থানে স্থানে অনেক পরিবর্ত্ত করিয়াছি, এবং মূলগ্রন্থ বিশদ করিবার আশয়ে মধ্যে মধ্যে কিঞ্চিৎ টীকাও লিখিয়া দিয়াছি। ফলতঃ, সুস্পষ্ট ও অনায়াসে বোধগম্য করিবার নিমিত্ত বিস্তর পরিশ্রম করিয়াছি; তথাপি আদ্যোপান্ত সুস্পষ্ট ও অনায়াসে বোধগম্য হইয়াছে কোনও মতেই সম্ভাবিত নহে। যাহা হউক, ইহা অনায়াসে নির্দেশ করিতে পারা যায়, জীবনচরিত প্ৰথম বার যেরূপ মুদ্রিত হইয়াছিল, দ্বিতীয় বারে তদপেক্ষায় অনেক অংশে সুস্পষ্ট হইয়াছে।

কলিকাতা। সংস্কৃত কলেজ।

২০এ চৈত্র। শকাব্দাঃ ১৭৭৩।

শ্ৰীঈশ্বরচন্দ্ৰশৰ্ম্মা