বড়দিদি

কলেজ ত্যাগ করার পর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভাগলপুর শহরের খঞ্জরপুর পল্লীতে তাঁর প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে একটি সাহিত্যসভার আয়োজন করেছিলেন। এই সময় তিনি বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস রচনা করেন, যেগুলি বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে থাকত। শরৎচন্দ্রের বাল্যবন্ধু সাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ভাগলপুর থেকে কলকাতা ফিরে যাওয়ার সময় শরৎচন্দ্রের অনুমতিতে সেই পাণ্ডুলিপিগুলি নিয়ে যান। পরে এই খাতাগুলি বিভূতিভূষণ ভট্টকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার সময় তিনি বড়দিদি উপন্যাসটি টুকে নিয়ে একটি কপি নিজের কাছে রাখেন। ১৩১৪ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসে ভারতী পত্রিকার সম্পাদিকা সরলা দেবী লাহোর থেকে কলকাতা ফিরে পত্রিকার ভার সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের ওপর অর্পণ করেন। তাঁর আগ্রহে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় সংখ্যায় তিন ভাগে বড়দিদি প্রকাশিত হয়। প্রথম দুই সংখ্যায় লেখক হিসেবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম ঊহ্য রাখা হলে এই লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কি না তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরী হয়। আষাঢ় সংখ্যায় বড়দিদির লেখক হিসেবে শরৎচন্দ্রের নাম প্রকাশ করা হয়। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে যমুনা পত্রিকার সম্পাদক ফণীন্দ্রনাথ পাল শরৎচন্দ্রের নিষেধ সত্ত্বেও এই উপন্যাস পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন।[১]

‘বড়দিদি’ ১৩১৪ সালের বৈশাখ থেকে আষাঢ় সংখ্যা পর্যন্ত সরলা দেবী সম্পাদিত ‘ভারতী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। প্রথম দুই সংখ্যায় লেখকের নাম মুদ্রিত হয়নি। ১৩২০ সালে (৩০শে সেপ্টেম্বর, ১৯১৩ খৃষ্টাব্দ) পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এইটি শরৎচন্দ্রের মুদ্রিত পুস্তকগুলির মধ্যে প্রথম। প্রকাশ করেন ‘যমুনা’ সম্পাদক ফণীন্দ্রপাল। ২০ জানুয়ারি ১৯২০ খৃষ্টাব্দে ‘শরৎচন্দ্রের গ্রন্থাবলী’র দ্বিতীয় খণ্ডের অন্তর্ভূক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়। প্রথম নাম ছিল ‘শিশু’—পরে ‘বড়দিদি’ নামে পরিবর্তিত করা হয়।

সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ‘শরৎচন্দ্রের জীবন-রহস্য’-এ লিখেছেন: “আমার কাছে ছিল শরৎচন্দ্রের লেখা ‘বড়দিদি’র কপি। সরলা দেবীকে সেটি পড়তে দিলুম। পড়ে তিনি মুগ্ধ হলেন, বললেন,—চমৎকার। এটি দাও ‘ভারতী’তে ছাপতে। এক সংখ্যায় শেষ না করে তিন চার সংখ্যায় শেষ করো। লেখকের নাম প্রথমে চেপে রেখো—শেষের সংখ্যায় লেখকের নাম প্রকাশ করো …Commercial stunt বুঝলে। লোকে ভাববে রবীন্দ্রনাথের লেখা। এ-লেখার জোরে আমাদের দেরির খেসারৎ হয়ে যাবে খন।” কিন্তু শরৎচন্দ্র নিজে ‘বড়দিদি’ সম্পর্কে বলেছেন: ‘তবে, ওটা বাল্যকালের রচনা, ছাপানো না হলেই বোধ করি ভাল হইত।’

‘শরৎ-পরিচয় গ্রন্থে সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছন: … “শ্রীজ্ঞানেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভাগলপুরে এলেন হাকিম হোয়ে। আমাদের সাহিত্য-সংঘের সভায় মাসে একদিন কোরে শরৎচন্দ্রের যে-সব লেখা আমার জিম্মায় ছিল তা পড়া হোত।

“শরৎচন্দ্রের এই লেখা (বড়দিদি) খুব ভাল লাগাতে জ্ঞানেন্দ্রবাবু বললেন, রামানন্দবাবুর সঙ্গে তাঁর বিশেষ আলাপ থাকলে সে কাজ তিনি সিদ্ধ করতে পারেন। *** আনন্দে খাতা থেকে নকল করতে লেগে গেলাম। দুটো খাতা হোয়ে গেল। লেখা শেষ হলে জ্ঞানবাবু পূজোর ছুটিতে বাড়ি গেলেন। পূজোর ছুটির পর তিনি বদলি হওয়াতে আর ভাগলপুরে ফিরে এলেন না। ‘প্রবাসী’তে লেখা বার হয়নি। …

“কিছুদিন পরে পরম বন্ধু শ্রীমান ভট্টার্জি (বিভূতি ভট্ট) চিঠি দিলেন। লেখা কিন্তু তাঁর নিজের হাতের নয়। তারপর সৌরীন ভায়ার এক চিঠি তাঁদের কাগজে (ভারতী) ‘বড়দিদি’ বার হোয়েছে। শীঘ্র বাকিটা পাঠাও। শরৎচন্দ্রকে চিঠি দিলাম। উত্তর এলো “অগত্যা”। মনে হয়, বিভূতিভূষণ ও নিরুপমা দেবী চিঠি দেওয়াতে শরৎচন্দ্র তাঁদের অনুরোধ এড়াতে পারেননি।

“‘প্রবাসী’ কাগজ থেকে ‘বড়দিদি’ প্রত্যাখ্যাত হোয়ে লেখাটি স্বর্গীয়া সরলা দেবীর হাতে যায়। তিনি সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের এবং মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে লেখাটি দিয়ে ‘ভারতী’তে প্রকাশ করার ইচ্ছা জানান। এই হাতে হাতে ঘুরতে ঘুর্তে লেখার শেষাংশটি লুপ্ত হয়। তখন তাঁরা বহরমপুরে চিঠি দিলে বিভূতি ভট্ট আমায় চিঠি দিয়ে অনুরোধ করলেন যে, বাকীটা না দিলে মুস্কিল দাঁড়িয়েছে। তার আগে সৌরীন্দ্রমোহনের চিঠি পেয়ে শরৎচন্দ্রকে জানান হয়েছিল এবং শরৎ মত দিয়েছিলেন। বুদ্ধি করে সৌরীন লেখকের নাম দেননি।[২]

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. শরৎ রচনাবলী, জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ-প্রথম ভাগ, প্রথম প্রকাশ- ১২ ভাদ্র, ১৩৮২ বঙ্গাব্দ, পুনর্মুদ্রণ কার্তিক ১৪০০, প্রকাশক, নাথ পাবলিনশিং, কলিকাতা; সম্পাদক, শৈলেন্দ্রনাথ গুহ রায় পৃষ্ঠা-৫৮৪-৫৮৬।
  2. গ্রন্থ পরিচয়, শরৎ সাহিত্য-সংগ্রহ, প্রথম সম্ভার; পৃষ্ঠা ৪১৩; প্রকাশক, সুপ্রিয় সরকার; এম. সি. সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রাইভেট লি., ১৩, বঙ্কিম চাটুজ্যে ষ্ট্রীট, কলিকাতা-১৩।