(রূপক)
তোমাতে লো ষড় ঋতু
পয়ার
অপরূপ দেখ একি, শরীরে তোমার।
একঠাঁই ষড় ঋতু, করিছে বিহার।।
নিদাঘ, বরষা, আর, শরদ হেমন্ত।
নিরখি শিশির আর দুরন্ত বসন্ত।।
এ সবার সেনা আদি, তোমাতে বিহরে।
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরদাদি, কহি পরে পরে।।
গ্রীষ্ম
তখন সিন্দূর বিন্দু, অতি খরতর।
ক্রোধভরে করে কর, বসি মুখোপর।।
সে রবি রক্তিম রাগে, শুন হেতু তার।
নিরখিল নিজ প্রিয়া, চরণে তোমার।
প্রফুল্লিতা কমলিনী, প্রেমভরে বসি।
নখরের ছলে কোলে, উপপতি শশী।।
নলিনী শশাঙ্ক সহ, করিতেছে বাস।
প্রভাকর করে তাই, প্রকোপ প্রকাশ।।
অতি ক্রোধযুক্ত রবি, হোয়েছে এবার।
তাই লো আরক্ত ছবি, দেখিতেছি তার।।
ঠেকে শিখে দিবাকর, রমণীর রীতি।
সামলিতে অন্য নারী, ধাইল ঝটিতি।।
তোমার পঙ্কজ মুখ, প্রাণের রমণী।
আগুলিতে আগে ভাগে, আইল অমনি।।
বদন সরোজ কোলে, সিন্দূর তপন।
বিশেষ কারণ তার, বুঝেছি এখন।।
পতিরে পাইয়া কোলে, সুখে আনন্দিত।
তোমার বদন পদ্ম, হোলো বিকসিত।।
শরদ
শরদের সুধাকরে, করে কত।
সে ভাব নিরখি তব, মুখে অবিরত।।
কিন্তু যে কলঙ্ক কালি, থাকে শশধরে।
সে কলঙ্ক নাহি তব, মুখের ভিতরে।।
যদিও নাহিক মৃগ, আছে কিছু তার।
মৃগের নয়ন করে, বদনে বিহার।।
বসন বারিদ পুন, হইয়াছে দূর।
পুনরায় প্রকাশিত, তপন সিন্দূর।।
কর কমলিনী সদা, আছে বিকসিত।
কঙ্কণের নাদে অলি, গায় সুললিত।।
শরদে মরাল কুল, সুখে কেলি করে।
তোমাতে মরাল ভাব, গমনের তরে।।
চন্দ্রিকা হোয়েছে প্রিয়ে, অতি পরিষ্কার।
নিরখি তাহার আভা, বরণে তোমার।।
প্রফুল্লতা কুমুদিনী, চন্দ্র মনোহরা।
হেরি তব নয়নেতে, বিষামৃত ভরা।।
যদি বল চন্দ্রকোলে, আছে কুমুদিনী।
দূর ঘুচে একত্রিত, অপূর্ব্ব কাহিনী।।
তার হেতু ইন্দীবর, তোমার নয়নে।
শরণ লোয়েছে গিয়ে, পতি নিকেতনে।।
এ সবেতে পরাভব, শরদ পলায়।
আইল স্বদল সহ, হেমন্ত তথায়।।
হেমন্ত
… … … [অস্পষ্ট]
কখনো সদয় হও, কভু মান কর।।
নিদাঘ, শরদ, বর্ষা, এই ঋতু চয়।
বিশেষ বসন্ত কাল, হয় রসময়।।
এই হেতু ধনি এই, ষড় ঋতুগণ।
তোমার সরস ভাব, করিছে বর্ণন।।
কিন্তু তাহে বর্ণিত, না হবে, তব মান।
সে মান বর্ণিতে আমি, হই ম্রিয়মাণ।।
এ কথা যদ্যপি তুমি, কহ সুলোচনা।
হেমন্ত, শিশির ছলে মানের রচনা।।
ফলত ঘটিল তাই, আমার কপালে।
মান করি নিজ দেহে, হিম দেখাইলে।।
বিরস হোয়েছে তব, মুখ সুধাকর।
মুদিত হোয়েছে দেখি, আঁখি ইন্দীবর।।
এখন কমল কর, কহে বিকসিত।
সিন্দূর রবির ছবি, নহে প্রভাণ্বিত।।
নীহার নয়ন নীর, নিরবধি বহে।
যে জল শীতল অতি, সে আমারে দহে।।
শীতের স্বভাবে বারি, হোয়েছে শীতল।
কিন্তু তব অশ্রুরূপে, দহে মোরে জল।।
শীতের প্রতাপে বহ্নি, তাপহীন হয়।
মানে তাই জ্যোতিহীন, তব নেত্রদ্বয়।।
এ সবেতে পরাভব, হেমন্ত পলায়।
আইল স্বদল সহ, শিশির তথায়।।
শিশির
নয়নের দীপ্তি হর, ঘন ঘোরতর।
কুআশায় ঢাকিয়াছে, রবি শশধর।।
ঘোমটা কুআশা ঘোর, করি দরশন।
মুখ শশী, ভালে রবি, করে আচ্ছাদন।।
থর থর কলেবর, শীতে যে প্রকার।
সেরূপ কাঁপিছে দেহ, পরশে তোমার।।
হইতেছে রোমাঞ্চিত, বিকল শরীর।
উহু উহু, ভীম-হিম, করিছে অস্থির।।
যেমন শিশিরে, কালো, স্নিগ্ধ হয় জল।
তেমনি তোমার অঙ্গ, কালো, সুশীতল।।
জল হোতে উঠে ধূম, অনল সমান।
তোমার নিশ্বাসে ধূম, যদি কর মান।।
এ সবেতে পরাভব, শিশির পলায়।
আইল স্বদল সহ, বসন্ত তথায়।।
বসন্ত
সরস বসন্ত করে, মুগ্ধ ত্রিভুবন।
তুমিও স্বরূপে মুগ্ধ, করিছ তেমন।।
সুচারু বিমল শশী, তোমার বদন।
ইন্দীবর, নেত্রবর, প্রফুল্ল এখন।।
কমলে কমল কত, কমল কাননে।
হাতে পায় পদ্ম, পদ্ম, হৃদয় বদনে।।
প্রকটিত ফুলকুল, সৌরভ কি কব।
কিন্তু সে সৌরভ পাই, মুখপদ্মে তব।।
ভ্রমর ভ্রমণ করে, শুনি গুণ গুণ।
বুঝেছি নূপুর তব, করে রুণ রুণ।।
কিবা কুহু কুহু করে, কোকিল কলাপ।
বুঝেছি সে রব তব, মধুর আলাপ।।
তোমার সুগন্ধ যুক্ত, কমল বদন।
তাহা হোতে আসিতেছে, মৃদু শ্বাস ঘন।।
মুখের সৌরভ লোয়ে, আসিছে নিশ্বাস।
নাবুঝে কহিছে, লোক, দক্ষিণ বাতাস।।
পায় তব পাশে, আশ্রয় নিশ্বাসে,
এ সৌরভ তথা তাই।।
বসন্ত বৃক্ষের ডালে, নবীন পল্লব।
তাহার প্রমাণ দেখি, অধরেতে তব।।
বসন্তে প্রকাশ পায়, স্মরধনু শর।
তা হেরি কটাক্ষে তব, ভ্রূযুগ উপর।।
কিন্তু প্রাণ তব স্থানে, নিজে নাই স্মর।
কেবল রোয়েছে তার, ধনু আর শর।।
বুঝেছি কারণ সখি, যাহে নাহি স্মর।
পলায়েছে মনসিজ, হেরে কুচ হর।।
শক্ত নহে শিব সহ, করিবারে রণ।
ধনুর্ব্বাণ ফেলে দিয়ে, পলালো মদন।।
দেখ দেখ বিধুমুখি, ঈশ্বর কৌশল।
স্থাপিত কোরেছে ঋতু, তোমাতে সকল।।
—সংবাদ প্রভাকর’, ১৮ মার্চ্চ, ১৮৫৩