কামিনী
ত্রিপদী
দেখি কি হে ভয়ঙ্কর,
গরজিয়ে গর গর,
ব্যাপিল গগনে নবঘনে।
নবনীল নিরূপম,
অর্দ্ধ তমস্বিনী সম,
দুলিছে দামিনী ক্ষণে ক্ষণে ।।
ঘন ঘোর গরজনে,
বিদারে গগনে বনে,
তীক্ষ্ণ তীর সম বরিষয়।
বল বল প্রাণনাথ,
কেন কেন অকস্মাৎ,
গরজন বরিষণ হয় ।।
পতি
প্রাণেশ্বরি শুন শুন,
যে কারণে পুন পুন,
গরজন বরিষণ হয়।
অতিশয় দম্ভভরে,
বর্ষা আগমন করে,
সঙ্গে সব সহচর হয় ।।
ভেবেছিল যুবরাজ,
নাহি ভুবনের মাঝ,
রূপবান তাহার সমান।
সে গর্ব্ব হইল নাশ,
হারাল তোমার পাশ,
বরষার পূর্ণ, অপমান ।।
নিবিড় চাঁচর তব,
তাহে কাদম্বিনী নব,
রূপেতে কিরূপে তোমা সমা।
তব মৃদু হাসি স্থানে,
পদে পদে অপমানে,
দুখিনী দামিনী নিরুপমা ।।
মরি কি সুন্দর পশি,
মুদিতা সুন্দরাবসি,
কোমল কমল কলি জলে।
তাহে পরাজিত করে,
তোমার হৃদয়োপরে,
নব কুচ কলিকা যুগলে ।।
বর্ষার পল্লব নব,
তাহাতে অধর তব,
শতগুণে সুকোমল শোভা।
নদ নদী জলে টলে,
তাহাতে যৌবন জলে,
তব দেহ কিবা মনোলোভা ।।
আরো দেখ করিবরে,
বরষার মত্ত করে,
দ্বিগুণ উন্মত্ত তুমি কর।
হেরিয়া তোমার করে,
হেরি তব পয়োধরে
চিৎকার করিছে কুঞ্জর ।।
যে দাড়িম্ব বরষার,
সকল গর্ব্বের সার,
তব কুচে পূর্ণ মান নাশ।
মেঘে রবি ঢাকা ঢাকি,
কেশেতে সিন্দূর মাখি,
তাহা হতে লাবণ্য প্রকাশ ।।
পদে পদে এইরূপে
হারিয়া তোমার রূপে,
কত অপমান বরষার।
এত দুখ সহিবারে,
বরষা নাহিক পারে,
রোদন করিছে অনিবার ।।
সে রোদনে অনিবার,
পড়ে বৃষ্টিধার তার,
ঘননাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
তাই প্রাণ নিরন্তর,
বরষিছে জলধর,
তাই মেঘ গর্জ্জে অনিবারে ।।
কামিনী
বিঘোর নীরদোপরে,
কত হাব ভাব ভরে,
চপলা চঞ্চলা চমকায়।
কেন কেন ক্ষণপ্রভা,
ক্ষণেক প্রকাশি প্রভা,
ক্ষণ পরে বারিদে লুকায় ।।
পতি
গিরির শিখর পরে,
থাকে যত জলধরে,
দেখিল তোমার কুচগিরি।
পরিহরি সে ভূধরে,
রৈতে পয়োধর পরে,
আসিতে লাগিল ধিরি ধিরি ।।
এসে দেখে হায় হায়,
নীলবস্ত্র মেঘে তায়,
বসিয়াছে মনের পুলকে।
ক্রুদ্ধে মেঘ নাহি রক্ষে,
অগ্নিশিখে উঠে চক্ষে,
তাই সখি বিদ্যুৎ চমকে ।।
জলধর ক্রোধমনে,
আদেশিল সমীরণে,
উড়াইতে বুকের বসন।
তাই বায়ু আসে ডেকে,
যাবে বুক খুলে রেখে,
ধরিয়ে রাখিবে কতক্ষণ ।।
কামিনী
আগে ছিল সুধাকর,
বিমল কোমল কর,
নিরমল গগন মণ্ডল।
এমন কেন গো শশী,
গগন মণ্ডলে পশি,
ঢাকিয়াছে জলদ সকলে ।।
পতি
তোমার সমান হতে,
শশধর বিধিমতে,
বাঞ্ছা করে আকাশে থাকিয়া।
দেখে তুমি কর মান,
জেনে সে মানের মান,
মুখমেঘ বসনে ঢাকিয়া ।।
বৃষ্টিধারে ধীরে ধীরে,
ফেলিয়া অশ্রুর নীরে,
ম্লানমুখে করিয়াছে মান।
হলো কিনা তোমা মত,
দেখিবারে অবিরত,
ক্ষণে ক্ষণে হয় দৃশ্যমান ।।
কামিনী
খর খর ধরি রবি,
মেঘে ঢাকা দেখে ছবি,
নহে প্রকাশিত প্রভাকর।
না হেরি পতির মুখে,
নয়ন মুদিয়া দুখে,
কমলিনী কতই কাতর ।।
সাধে কি সকলে কয়,
পুরুষ পরম ময়,
কি কঠিন তাদের হৃদয়।
এই দেখ দিনকর,
কেমন নিদয়ান্তর,
রমণীরে কেমন নির্দ্দয় ।।
কমলিনী যার তরে
সতত বিলাপ করে
মৌনমুখী মুদিত নয়ন।
দয়া করি সেও তায়,
ফিরিয়া নাহিক চায়,
সদা করে প্রাণে জ্বালাতন ।।
পতি
গুণমণি দিনমণি,
কেন লো রমণি মণি,
না বুঝিয়ে দোষ দিবাকরে।
নলিনীর পেয়ে দোষ,
দিনেশ করেছে রোষ,
তার সনে দেখা নাহি করে ।।
তব মুখে কমলিনী,
কোলে ধরে বিনোদিনী,
সিন্দূরের বিন্দু প্রভাকর।
কোলে অন্য দিবাকর,
কমলিনী কলেবর,
দেখিয়ে ম্লান দিনেশ ঈশ্বর ।।
মনে জানিলেন দড়,
নলিনী অসতী বড়,
নাহি করে মুখ দরশন।
গুণমণি, দিনমণি,
কেন লো রমণি মণি,
না জানিয়া দোষ লো তপন ।।
কামিনী
এ সময় মধুকরে,
কি জ্বালায় জ্বলে মরে,
মুদিত সকল শতদল।
যদি কোন পদ্ম পায়,
অপ্রফুল্ল দেখে তায়,
মধুহীন যতন বিফল ।।
ভ্রমে ভ্রমি সে ভ্রমরে,
যদ্যপি গমন করে,
অন্য কমলিনী নিকেতন।
মৃণাল কণ্টকে লেগে,
ছিন্ন অঙ্গ হয়ে রেগে,
অন্য পদ্মে করিলো গমন ।।
অপ্রকাশ্য সেই কলি,
বাতাস লাগিল বলি,
হেলে দুলে ফেরে তাহা হতে।
নিরুপায় নিরাশায়,
শেষে মধুকর যায়,
কলিকা উপরে স্থান লতে ।।
পতি
আ মরি লো এ অধীনে,
সেই মত এক দিনে,
ঘটাইলে প্রাণের রতন।
তুমি লো কমলবন,
ছয় পদ্ম সুশোভন,
কর পদ হৃদয় বদন ।।
যবে প্রিয়ে মান করি,
মজাইলে প্রাণেশ্বরি,
লক্ষ্য করি মুখ শতদল।
গিয়ে তার মধুপানে,
তৃপ্ত করিবারে প্রাণ,
অপ্রফুল্ল দেখি সে কমল ।।
তাহাতে বঞ্চিলে ছলে,
যাই কর শতদলে,
হাতে ধরে ঘুচাইতে মান।
গহনা মৃণালে কাঁটা,
অঙ্গুলি যাইল কাটা,
পরে পাদ পদ পড়ি প্রাণ ।।
হেলে দুলে সে কমলে,
লুটাইয়া শতদলে,
ফিরাইলে প্রাণের ললনা।
শেষে যাই কলিপরে,
শোভিছে যা হৃদিপরে,
দূরে গেল মানের ছলনা ।।
কামিনী
বল বল তারাচয়
কেন কেন ম্লান হয়,
ছিল কিবা শোভাকর কর।
পতি
যামিনী কামিনী সতী,
লইয়ে যামিনী পতি,
বিলাসিছে মেঘের ভিতর ।।
পাছে বা দেখিতে পাই,
নিভাইয়ে দেছে তাই,
আকাশের দীপ তারাগণে।
তবুও তো নিরন্তর,
স্থির নহে শশধর,
উঁকি মেরে দেখে ক্ষণে ক্ষণে ।।
কামিনী
পেয়ে নীরধর নীর,
পূর্ণাকার ধরে নীর,
আহা মরি শোভা তার কত।
জলপূর্ণ সরোবর,
যদ্যপি হে মোহকর,
কমলিনী বিনে শোভা হত ।।
পতি
না লো প্রাণ মনোহর,
দেখিতেছি সরোবর,
সরোজিনী সহ শোভা পায়।
ধরণী সলিলাবৃতা,
যেন সরো সুশোভিতা,
তুমি প্রাণ কমলিনী তায় ।।
কামিনী
এর বা কারণ কিবা,
এই বরষার দিবা,
দীর্ঘ দেহ করেছে ধারণ।
কমে গেছে তমস্বিনী,
তবু তাহে বিষাদিনী,
বিরহিণী বিনোদিনী গণ ।।
পতি
সুমেরু শিখর আর,
ও কুচ ভূধরাকার,
এ তিন শিখর নিরখিয়া।
হইল তপন ব্যস্ত,
কোন্টায় যাবে অস্ত,
তাই ভাবে বিলম্ব করিয়া ।।
ঘন ঘোর ঘন অতি,
ঢেকেছে যামিনী পতি,
বিরহিনী বিষাদে রজনী।
কেঁদে কেঁদে বুক ফাটি,
দুখে দেহ করে মাটি,
যৌবনেই মরে গেল ধনী ।।
-‘সংবাদ প্রভাকর’, ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৩
কালেজীয় কবিতার মারামারি1