(তিন মিত্রের কথোপকথন)
প্রথম মিত্র
কি বিষাদে মুখখানি, হাসি-ভরা নাই।
বেণা-বনে বোসে কেন, উঠ উঠ ভাই ।।
দ্বিতীয় মিত্র
দেখিয়া দেশের গতি, কেঁদে মরি মনে।
সে দুখে বসিয়া আছি, বিরস বদনে ।।
তৃতীয় মিত্র
সখা রে বচন ধর,
মিছা দুখ পরিহর,
নিজ সুখে সুখী হও ভাই।
দ্বিতীয় মিত্র
নিজ সুখ এ সংসারে,
বন বন বল কারে,
আমি তো সে সুখ দেখি নাই ।।
তৃতীয় মিত্র
না জেনে কহিছ ভাই,
সংসারে সে সুখ নাই,
জান না তো কার কাছে পাবে।
রাখ রে মানস পুরী,
প্রমদার প্রেমে পূরি,
কত সুখে তোমারে মজাবে ।।
পদে পদে প্রেম পথে,
মজাইবে মনোরথে,
মহিলার মোহন বদনে।
মোহ মন্ত্রে রবে বাঁধা,
মানিবে না কোন বাধা,
কত সুখে রবে মনে মনে ।।
প্রথম মিত্র
এ কথাটি ভাল বটে, রটে ধরাময়।
পরম পুলকপ্রদ, প্রমদা প্রণয় ।।
বিশেষতঃ কত তাহে, ধর্ম্মের সঞ্চার।
বিবাহ বিশেষ তাই, বিধি বিধাতার ।।
নর নারী উভয়েতে, হইয়া মিলিত।
আরাধনে করিবেক, পরমেশে প্রীত ।।
দ্বিতীয় মিত্র
ছিছি ছিছি কেন ছার,
মুখাম্বুজে মহিলার,
মরিয়াছ মোহিত হইয়া।
জানি জানি কত জ্বালা,
দেয় প্রণয়িনী বালা,
হারিয়াছি বারেক ঠেকিয়া ।।
সবে তার এক দিন,
হই আমি প্রেমাধীন,
নাকে কাণে খৎ দি হে তায়।
আদরে ভাঙ্গাতে মনে,
হইয়াছি অপমান,
না ভাঙ্গিল আমার কথায় ।।
প্রথম মিত্র
সব তার সহিলাম,
কত কথা কহিলাম,
মধুর মিনতি কত করি।
রামায়ণ আদি নিয়া,
সব কথা কাটাইয়া,
তবু মানে রহিলা সুন্দরী ।।
সামান্য রতন নহে, রমণী রূপসী।
তার না ভাঙ্গিবে মান, বেণা-বনে বসি ।।
তাই বলি উঠ ভাই, পরিহরি দুখ।
বল তুমি বল কারে, পৃথিবীর সুখ ।।
দ্বিতীয় মিত্র
অনিত্য সকল সুখ নিত্য কারে বলি।
সকল সংসার সুখ, স্বপনে কেবলি ।।
পৃথিবীতে আছে সুখ, কেবলি স্বপনে।
স্বপ্ন বিনে আর সুখ, নাহি জানি মনে ।।
স্বপনে স্বকরে পাই, সংসার মণ্ডল।
স্বপনে নারীর দেখি, লপন কমল ।।
ভারত জনম ভূমি, সতীত্ব অঙ্গনা।
শশিমুখী সরস্বতী, আর কত জানা ।।
তৃতীয় মিত্র
সে সব স্বপন ভাই, শ্রবণে তোমার।
শ্রবণে প্রবেশ করে, শত সুধাধার ।।
কবি দেখ ছেলে দেখ, দেখ গিয়া মেয়ে।
স্বপনে জিনেছ ভাই, সকলের চেয়ে ।।
মধুর সরল ভাষে, মুগ্ধ কর মন।
করুণায় ভেসে যায়, নীরেতে নয়ন ।।
রসিক তুমি, জানি ইহাতেই।
স্বপ্ন দরশনে দেখ, সতীত্ব নিজেই ।।
প্রথম মিত্র
এখন হে জানিলাম, স্বপ্নে যত সুখ।
এসো মিত্র স্বপ্নে মোরা, ঘুচাইব দুখ ।।
তৃতীয় মিত্র
স্বপনে আমার ভাই, মন নাই ভজে।
আসল পাইলে বল, নকলে কে মজে ।।
বিশেষ একেতে আমি, ডরি হে কতক।
একেবারে তাড়াবো না দেশের র* ক ।।
প্রথম মিত্র
ওই দোষে চিরকাল, মরিলি রে তুই।
ভাল কথা তোর মুখে, শুনি নি কভুই ।।
তৃতীয় মিত্র
তুমিই তো ওই রসে, মজিয়াছ ভাই।
সে কথা শুনেছি ভাল, কামিনীর ঠাঁই ।।
চতুর জামাই হও, শ্বশুরের ঘরে।
ফুল খেলা কত জানো, বাগান ভিতরে ।।
কিন্তু আহা মরি মরি, কামিনীর রূপ।
কি মোহন মন্ত্র দিয়ে, বর্ণেছ স্বরূপ ।।
মধুর মোহন ভাষে, মোহিনী বর্ণন।
বুঝি হে কখনো আর, ভুলিবে না মন ।।
এই সময়ে শ্যামাচন্দ্র বিশ্বদাস ও গুপ্ত নাম কয়েক
জন পুলিস সংক্রান্ত শস্ত্রধারী আসিয়া কহিল যে,
চোর চোর ধর চোর, এই জন চোর।
পর ধন কর চুরি, এত সাধ্য তোর ।।
তৃতীয় মিত্র
বাহারে! এ যে হে বড়, বাহারে চাতুরী।
বল দেখি কার কিবা, করিয়াছ চুরি ।।
গুপ্ত
কার কি করেছো চুরি, এ তো নাহি জানি।
বিশ্বদাস
বলেছে তোমারে চোর, শুধু অনুমানি ।।
তৃতীয় মিত্র
ভাল ভাল এত বুদ্ধি, প্রশংসার বটে।
না জানিয়া চোর বলা, সুবুদ্ধিতে ঘটে ।।
শ্যামাচন্দ্র
না জানিয়া তোরে কভু, চোর বলি নাই।
তাহার কারণ তবে, শুন মোর ঠাঁই ।।
সে কালের কালী বাবু, বড় ধনবান্
পোরেছিল ছ পাড়ের, ধুতি একখান ।।
তুমিও তো ছ পাড়ের, ধুতি পরিয়াছ।
তাই বলি তার ধুতি, চুরি করিয়াছ ।।
তৃতীয় মিত্র
বটে বটে দিব্য আছে, এই পৃথিবীতে।
দু খানি ছপেড়ে ধুতি, নারিবে জন্মিতে ।।
শ্যামাচন্দ্র
চোপ্ চোপ্ চোপ্ রহ, মৎ কর সোর।
পুলিসের ম্যাজিষ্ট্রেটি, পদ আছে মোর ।।
আমি বলিতেছি তুই, চুরি কোরেছিস্।
আমার কথায় হয়, ডিক্রী বা ডিস্মিস্ ।।
তৃতীয় মিত্র
যো হুকুম খোদা-বন্দ, হইল ইয়াদ্।
বল দেখি কত দিন, খাটিব মিয়াদ ।।
গুপ্ত
মানিলাম নাহি তুমি, করিয়াছ চুরি।
তবু দোষ দেখাইতে, পারি ভূরি ভূরি ।।
প্রথম মিত্র
কেবলি দেখায়ে দোষ, কি লাভ তোমার।
গুপ্ত
দোষ দেখানো হে বাপু, ব্যবসা আমার ।।
তোমারো সহস্র দোষ, দেখাইতে পারি।
বিশ্বদাস তাহে মোর, আছে সহকারী ।।
প্রথম মিত্র
ভাল ভাল সাধু সাধু, কি নাম তোমার।
অসার সংসারে শুধু, তুমি প্রশংসার ।।
গুপ্ত
গুপ্ত রাখিলাম বাপু, নামটি আমার।
গু আছে প্রথমে তার মধ্যেতে পকার ।।
তিন জন পুলিস প্রহরী
কথার গতিক বড়, উত্তম না ঘটে ।।
স্বস্থানে প্রস্থান করা, যুক্তি মত বটে ।।
ইঁহারা প্রস্থান করুন।
তৃতীয় মিত্র
সময় হোতেছে নাশ,
যাই নিজ নিজ বাস,
কি করিব ভেবে দেখি মনে।
তুমি যাও এই বেলা,
কর গিয়া ফুল খেলা,
যামিনীতে কামিনীর সনে ।।
তুমি ত্যজিবে না বনে,
ভাবো গিয়ে নিজ মনে,
আজিকে দেখিবে কি স্বপন।
আমি বাড়ী গিয়ে ভাই,
মনসুখে নিদ্রা যাই,
স্বপন কি, না জানি কখন ।।
তবে গো বিদায় হই,
প্রণয়েতে যেন রই,
এই আশা করে মোর মন।
যদি কোন কথা মোর,
হয়ে থাকে অতি জোর,
then beg you pardon.
-‘সংবাদ প্রভাকর’, ২৭ মে, ১৮৫৩