ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ছয় মাস হইল সুরেন্দ্রনাথ চলিয়া গিয়াছে। ইহার মধ্যে মাধবী একটিবার মাত্র মনোরমাকে পত্র লিখিয়াছিল, আর লেখে নাই। পূজার সময় মনোরমা পিতৃভবনে আসিয়া মাধবীকে ধরিয়া বসিল, তোর বাঁদর দেখা।

মাধবী হাসিয়া কহিল, বাঁদর কোথায় পাব লো?

মনোরমা তাহার চিবুকে হাত দিয়া সুর করিয়া মৃদুকন্ঠে গাহিল–

আমি এলাম ছুটে দেখব বলে,

কেমন শোভে পোড়ার বাঁদর–

তোমার ঐ রাঙ্গা চরণতলে।

সেই যে পুষেছিলি?

কবে?

মনোরমা মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিল, মনে নেই! যে তোকে বৈ আর জানত না?

মাধবী কথাটা অনেকক্ষণ বুঝিয়াছিল, তাই অল্পে অল্পে মুখখানি বিবর্ণ হইতেছিল; তথাপি আত্মসংবরণ করিয়া কহিল, ও– তাঁর কথা? তিনি আপনি চলে গেছেন।

অমন রাঙ্গা পা-দুটি তার পছন্দ হল না?

মাধবী মুখ ফিরাইল–কথা কহিল না। মনোরমা হাত দিয়া আদর করিয়া তাহার মুখ ফিরাইল–কৌতুক করিতে গিয়া দেখিল, তাহার দুই চক্ষে একরাশি জল আনিয়া দিয়াছে। আশ্চর্য হইয়া কহিল, একি মাধবী!

মাধবী আর সামলাইতে পারিল না–চক্ষে অঞ্চল দিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

মনোরমা বিস্ময়ের সীমা নাই–একটা উপযুক্ত কথাও সে খুঁজিয়া পাইল না। কিছুক্ষণ কাঁদিতে দিল। তাহার পর জোর করিয়া মুখ হইতে অঞ্চল খুলিয়া লইয়া নিতান্ত দুঃখিতভাবে বলিল, একটা সামান্য কৌতুক সইতে পারলে না বোন!

মাধবী চক্ষু মুছিতে মুছিতে বলিল, আমি যে বিধবা দিদি!

তাহার পর দুইজনেই চুপ করিয়া রহিল। দুইজনেই নীরবে কাঁদিতে লাগিল।

মনোরমা কাঁদিতেছিল মাধবীর দুঃখে–সে বিধবা, তাই বলিয়া। কিন্তু মাধবীর অন্য কারণ ছিল। এখনি না জানিয়া মনোরমা যে ঠাট্টা করিয়াছে, যে তোকে বৈ আর জানত না–মাধবী তাহাই ভাবিতেছিল। এ কথা যে নিতান্ত সত্য, সে তাহা জানিত। অনেকক্ষণ পরে মনোরমা বলিল, কাজটা কিন্তু ভাল হয়নি।

কোন্‌ কাজটা?

তা কি বলে দিতে হবে বোন?–আমি সব বুঝেছি।

এই ছয় মাস ধরিয়া যে কথা মাধবী প্রাণপণে লুকাইয়া আসিতেছিল, মনোরমার কাছে আর তাহা লুকাইতে পারিল না। ধরা পড়িয়া মুখ লুকাইয়া কাঁদিতে লাগিল, বড় ছেলেমানুষের মত কাঁদিল।

শেষকালে মনোরমা বলিল, কিন্তু গেল কেন?

আমি যেতে বলেছিলাম।

বেশ করেছিলে–বুদ্ধিমতীর মত কাজ করেছিলে।

মাধবী বুঝিল, মনোরমা কিছুই বোঝে নাই–তাই একে একে সব কথা বুঝাইয়া কহিল। তাহার পর বলিল, কিন্তু তিনি যদি না বাঁচতেন, তাহলে বোধ হয় পাগল হয়ে যেতাম। মনোরমা মনে মনে কহিল, –এখনি বা তার কম কি?

সেদিন বড় দুঃখিত হইয়া সে বাড়ি চলিয়া গেল। সেই রাত্রেই কাগজ-কলম লইয়া স্বামীকে পত্র লিখিতে বসিল–

তুমি ঠিক বলিতে–স্ত্রীলোককে বিশ্বাস নাই। আমিও আজ তাহাই বলিতেছি, কেননা, মাধবী আমাকে শিখাইয়াছে। আমি তাহাকে বাল্যকাল হইতে জানি, তাই তাহাকে দোষ দিতে ইচ্ছা হয় না, সাহস হয় না; সমস্ত স্ত্রীজাতিকে দোষ দিই–বিধাতাকে দোষ দিই–তিনি কি জন্য এত কোমল, এই জলের মত তরল পদার্থ দিয়া নারীর হৃদয় গড়িয়াছিলেন? এত ভালবাসা ঢালিয়া দিয়া এ হৃদয় কে গড়িতে সাধিয়াছিল? তাঁহার চরণে প্রার্থনা, যেন এ হৃদয়গুলা একটু শক্ত করিয়া নির্মাণ করা হয়। আর তোমার চরণে প্রার্থনা, যেন ঐ পায়ে মাথা রাখিয়া ঐ মুখপানে চাহিয়া মরিতে পারি। মাধবীকে দেখিয়া বড় ভয় হয়,–সে আমার আজন্মের ধারণা ওলটপালট করিয়া দিয়াছে। আমাকেও

বেশি বিশ্বাস করিও না–শীঘ্র আসিয়া লইয়া যাইও।

তাহার স্বামী উত্তর লিখিলেন–

যাহার রূপ আছে, সে দেখাইবেই। যাহার গুণ আছে, সে প্রকাশ করিবেই। যাহার হৃদয়ে ভালবাসা আছে, যে ভালবাসিতে জানে,–সে ভালবাসিবেই। মাধবীলতা রসাল বৃক্ষ অবলম্বন করে, ইহা জগতের রীতি–তুমি আমি কি করিতে পারি? তোমাকে আমি খুব বিশ্বাস করি–সেজন্য চিন্তিত হইও না।

মনোরমা স্বামীর পত্র মাথায় রাখিয়া মনে মনে তাঁহার চরণ-উদ্দেশে প্রণাম করিয়া লিখিল–মাধবী পোড়ামুখী–বিধবাকে যাহা করিতে নাই, সে তাই করিয়াছে। মনে মনে আর-একজনকে ভালবাসিয়াছে!

পত্র পাইয়া মনোরমার স্বামী মনে মনে হাসিলেন। তাহার পর কৌতুক করিয়া লিখিলেন,–মাধবী পোড়ামুখী, তাহাতে আর সন্দেহ নাই, কেননা, বিধবা হইয়া মনে মনে আর একজনকে ভালবাসিয়াছে। তোমাদের রাগ হইবার কথা–বিধবা হইয়া কেন সে তোমাদের সধবার অধিকারে হাত দিতে গিয়াছে। আমি যতদিন বাঁচিয়া থাকিব, তোমার কোন চিন্তা নাই, এমন সুবিধা কিছুতেই ছাড়িও না। এই অবসরটুকুর মধ্যে পরম আরামে আর একজনকে মনে মনে ভালবাসিয়া লইও। কিন্তু কি জান মনোরমা, তুমি আমাকে আশ্চর্য করিতে পার নাই, আমি একবার একটা লতা দেখিয়াছিলাম, সেটা আধ-ক্রোশ ধরিয়া ভূমিতলে লতাইয়া লতাইয়া অবশেষে একটা বৃক্ষে জড়াইয়া উঠিয়াছিল। এখন তাহাতে কত পাতা, কত পুষ্পমঞ্জরী! তুমি যখন এখানে আসিবে, তখন দুইজনে সেটিকে দেখিয়া আসিব।

মনোরমা রাগ করিয়া তাহার উত্তর দিল না।

কিন্তু মাধবীর চোখের কোণে কালি পড়িয়াছে, প্রফুল্ল মুখ ঈষৎ গম্ভীর হইয়াছে। কাজকর্মে তেমন বাঁধুনি নাই—একটু ঢিলা রকমের হইয়াছে। সকলকে যত্ন-আত্মীয়তা করিবার ইচ্ছা তেমনই আছে, বরং বাড়িয়াছে–কিন্তু সব কাজগুলা আর তেমন মনে থাকে না–মাঝে মাঝে ভুল হইয়া যায়।

এখনো সবাই কহে, ‘বড়দিদি’, এখনো সবাই সেই কল্পতরুটির পানে চাহিয়া থাকে, হাত পাতে, অভীষ্ট ফল পায়; কিন্তু গাছ আর তেমন সরস সতেজ নাই। পুরাতন লোকগুলির মাঝে মাঝে আশঙ্কা হয়—পাছে শুকাইয়া যায়।

মনোরমা নিত্য আসে, অন্যান্য কথা হয়—শুধু একথা আর হয় না। মাধবী দুঃখিত হয়, মনোরমা তাহা বুঝিতে পারে। আর এ-সকল কথার আলোচনা যত না হয়, ততই ভাল। হতভাগী যদি ভুলিতে পারে, মনোরমা একথাও ভাবে।

সুরেন্দ্রনাথ আরাম হইয়া পিতার সহিত বাটী চলিয়া গিয়াছে। বিমাতা তাঁহার যত্নটা একটু কম করিতে আরম্ভ করিলেন, তাই সুরেন্দ্র শরীরে একটু আরাম পাইয়াছে, কিন্তু শরীর বেশ সারিতে পারে নাই–অন্তরে একটু ব্যথা আছে। রূপ-যৌবনের আকাঙ্ক্ষা-পিপাসা এখনো তাহার মনে উদয় হয় নাই,–এসব সে জানিত না। পূর্বের মত এখনো সে অন্যমনস্ক, আত্মনির্ভরশূন্য। কিন্তু কাহার উপর নির্ভর করিতে হইবে, এইটাই সে খুঁজিয়া পায় না। খুঁজিয়া পায় না বলিয়াই সেই যে নিজের কাজ নিজে দেখিতে পারে, তাহাও নহে, আজও পরের পানে চাহিয়া থাকে, কিন্তু পূর্বের মত তেমন আর মনে ধরে না, সব কাজেই যেন একটু ত্রুটি দেখিতে পায়, একটু খুঁতখুঁত করে। তাহার বিমাতা দেখিয়া শুনিয়া কহেন, সুরো আজকাল বদলে গেছে।

মধ্যে একদিন তাহার জ্বর হইয়াছিল। বড় কষ্ট হইয়াছিল; চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল। বিমাতা কাছে বসিয়াছিলেন–তিনিও একটা নূতন জিনিস দেখিলেন। মুহূর্তের মধ্যে তাঁহারও চক্ষু ফাটিয়া জল বাহির হইল, আদর করিয়া তাহার চক্ষু মুছাইয়া কহিলেন, সুরো, কেন বাবা? সুরেন্দ্র চুপ করিয়া রহিল। তারপর একখানা পোস্টকার্ড চাহিয়া লইয়া আঁকাবাঁকা অক্ষরে লিখিয়া দিল–বড়দিদি, আমার জ্বর হইয়াছে, বড় কষ্ট হইতেছে।

পত্রখানা ডাকঘরে পৌঁছিল না। প্রথমে শয্যা হইতে মেঝের উপর পড়িল, তাহার পর যে ঘর ঝাঁটাইতে আসিল সে বেদানার খোসা, বিস্কুটের

টুকরা , আঙ্গুরের তুলা এবং সেই চিঠিখানি, সব একসঙ্গে ঝাঁটাইয়া বাহিরে ফেলিয়া দিল,–সুরেন্দ্রনাথের প্রাণের আকাঙ্ক্ষা ধুলা মাখিয়া, হাওয়ায় উড়িয়া , শিশিরে ভিজিয়া, রোদ খাইয়া অবশেষে একটা বাবলা গাছের তলায় পড়িয়া রহিল।

প্রথমে সে একখানি মূর্তিমতী উত্তরের আশায় চাহিয়া রহিল, তাহার পর একখানি হস্তাক্ষর–কিন্তু অনেকদিন কাটিয়া গেল, কিছুই আসিল না। ক্রমে তাহার জ্বর সারিয়া গেল –পথ্য করিয়া উঠিয়া বসিল।

তাহার পর, তাহার জীবনে এক নূতন ঘটনা ঘটিল। ঘটনা যদিও নূতন, কিন্তু নিতান্ত স্বাভাবিক। সুরেন্দ্রের পিতা রায়মহাশয় ইহা বহূদিন হইতে জানিতেন এবং আশা করিতেন। সুরেন্দ্রের মাতামহ পাবনা জেলার একজন মধ্যবিত্ত জমিদার। কুড়ি-পঁচিশখানি গ্রামে জমিদারি; বাৎসরিক আয় প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকা হইবে। একে তিনি অপুত্রক,খরচপত্র স্বভাবতঃ কম, তাহাতে তিনি একজন প্রসিদ্ধ কৃপণ ছিলেন। তাই তাঁহার সুদীর্ঘ জীবনে বহূ অর্থ সঞ্চিত করিতে পারিয়াছিলেন । তাঁহার অবর্তমানে সমস্ত বৈভব একমাত্র দৌহিত্র সুরেন্দ্রনাথ পাইবে, রায়মহাশয় ইহা স্থির জানিতেন। তাহাই হইল। রায়মহাশয় সংবাদ পাইলেন, শ্বশুরমহাশয় আসন্ন মৃত্যুশয্যায় শয়ন করিয়াছেন। তাড়াতাড়ি পুত্রকে লইয়া পাবনা যাত্রা করিলেন । কিন্তু পৌঁছাইবার পূর্বেই শ্বশুরমহাশয় পরলোকগমন করিলেন।

সমারোহ করিয়া শ্রাদ্ধ-শান্তি হইল। শৃঙ্খলিত জমিদারিতে আরো শৃঙ্খলার ঘটা পড়িয়া গেল। পরিপক্ব-বুদ্ধি প্রাচীন উকীল রায়মহাশয়ের কড়া বন্দোবস্তে,প্রজারা সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল।

এখন সুরেন্দ্রের বিবাহ হওয়া আবশ্যক। ঘটকের আনাগোনায় গ্রামময় আন্দোলন পড়িয়া গেল। পঞ্চাশ ক্রোশের মধ্যে যে বাড়িতে একটি সুন্দরী কন্যা ছিল, সেই বাড়িতেই ঘটকের দল ঘন ঘন পদধূলি দিয়া পিতামাতাকে আপ্যায়িত ও আশান্বিত করিতে লাগিল– এমনভাবে দুই মাস, ছয় মাস অতিবাহিত হইল।

অবশেষে বিমাতা আসিলেন, তাঁহার সর্ম্পকের যে কেহ ছিল, সেও আসিল–বন্ধু-বান্ধবে গৃহ পুরিয়া গেল।

তাহার পর, একদিন প্রভাতে, বাঁশি বাজাইয়া ঢাকের প্রচন্ড শব্দ করিয়া, কাঁসির খন্‌খন্‌ আওয়াজে সমস্ত গ্রাম পরিপূরিত করিয়া সুরেন্দ্রনাথ বিবাহ করিয়া আসিল।