কামাল পাশা

[তখন শরৎ-সন্ধ্যা। আশমানের আঙিনা তখন কারবালা ময়দানের মতো খুনখারাবির রঙে রঙিন। সেদিনকার মহা-আহবে[১] গ্রিক-সৈন্য সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হইয়া গিয়াছে। তাহাদের অধিকাংশ সৈন্যই রণস্থলে হত অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। বাকি সব প্রাণপণে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিতেছে। তুরস্কের জাতীয় সৈন্যদলের কাণ্ডারী বিশ্বত্রাস মহাবাহু কামাল পাশা মহাহর্ষে রণস্থল হইতে তাম্বুতে ফিরিতেছেন। বিজয়োন্মত্ত সৈন্যদল মহাকল্লোলে অম্বর ধরণি কাঁপাইয়া তুলিতেছে। তাহাদের প্রত্যেকের বুকে পিঠে দুইজন করিয়া নিহত সৈনিক বাঁধা। যাহারা ফিরিতেছে তাহাদেরও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গোলাগুলির আঘাতে, বেয়নেটের খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত, পোশাক-পরিচ্ছদ ছিন্নভিন্ন, পা হইতে মাথা পর্যন্ত রক্ত-রঞ্জিত। তাহাদের সেদিকে ভ্রূক্ষেপও নাই। উদ্দাম বিজয়োন্মাদনার নেশায় মৃত্যু-কাতর রণক্লান্তি ভুলিয়া গিয়া তাহারা যেন খেপিয়া উঠিয়াছে। ভাঙা সঙিনের আগায় রক্ত-ফেজ উড়াইয়া, ভাঙা খাটিয়া আদি দ্বারা নির্মিত এক অভিনব চৌদোলে কামালকে বসাইয়া বিষম হল্লা করিতে করিতে তাহারা মার্চ করিতেছে। ভূমিকম্পের সময় সাগর-কল্লোলের মতো তাহাদের বিপুল বিজয়ধ্বনি আকাশে-বাতাসে যেন কেমন একটা ভীতি-কম্পনের সৃজন করিতেছে। বহু দূর হইতে সে রণতাণ্ডব নৃত্যের ও প্রবল ভেরিতূরীর ঘন রোল শোনা যাইতেছে। অত্যধিক আনন্দে অনেকেরই ঘন ঘন রোমাঞ্চ হইতেছিল। অনেকেরই চোখ দিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়িতেছিল।]

সৈন্যবাহিনী দাঁড়াইয়া। হাবিলদার-মেজর তাহাদের মার্চ করাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল। বিজয়োন্মত্ত সৈন্যগণ গাহিতেছিল,–

ওই খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,

অসুরপুরে শোর উঠেছে জোরসে সামাল সামাল তাই,

কামাল! তু নে[২] কামাল কিয়া[৩] ভাই!

হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

[হাবিলদার-মেজর মার্চের হুকুম করিল : কুইক মার্চ!

লেফট! রাইট! লেফট!!

লেফট! রাইট! লেফট!!

সৈন্যগণ গাহিতে গাহিতে মার্চ করিতে লাগিল]

ওই খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,

অসুরপুরে শোর উঠেছে জোরসে সামাল সামাল তাই,

কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

[হাবিলদার-মেজর : লেফট! রাইট!]

সাব্বাস ভাই! সাব্বাস দিই, সাব্বাস তোর শমশেরে[৪]

পাঠিয়ে দিলি দুশমনে সব যম-ঘর একদম-সে রে!

বল দেখি ভাই, বল হাঁ রে,

দুনিয়ায় কে ডর্ করে না তুর্কির তেজ তলোয়ারে?

[লেফট! রাইট! লেফট!]

খুব কিয়া ভাই খুব কিয়া!

বুজদিল[৫] ঐ দুশমন সব বিলকুল সাফ হো গিয়া[৬]!

খুব কিয়া[৭] ভাই খুব কিয়া!

হুররো হো!

হুররো হো!

দস্যুগুলোয় সামলাতে যে এম্‌নি দামাল কামাল চাই!

কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

[হাবিলদার-মেজর : সাবাস সিপাই! লেফট! রাইট! লেফট!]

শির হতে এই পাঁও-তক্[৮] ভাই লাল-লালে-লাল খুন মেখে

রণ-ভীতুদের শান্তি-বাণী শুনবে কে?

পিণ্ডারিদের খুন-রঙিন

নখ-ভাঙা এই নীল সঙিন

তৈয়ার হ্যায় হর্দম ভাই ফাড়তে জিগর[৯] শত্রুদের।

হিংসুক-দল! জোর তুলেছি শোধ তোদের!

সাবাস জোয়ান! সাবাস!

ক্ষীণজীবী ওই জীবগুলোকে পায়ের তলেই দাবাস্ –

এম্‌নি করে রে–

এম্‌নি জোরে রে–

ক্ষীণজীবী ওই জীবগুলোকে পায়ের তলেই দাবাস্!

সাবাস জোয়ান! সাবাস!

[লেফট! রাইট! লেফট!]

হিংসুটে ওই জীবগুলো ভাই নাম ডুবালে সৈনিকের,

তাই তারা আজ নেস্ত-নাবুদ[১০], আমরা মোটেই হই নি জের[১১]!

পরের মুলুক[১২] লুট করে খায়, ডাকাত তারা ডাকাত!

তাই তাদের তরে বরাদ্দ ভাই আঘাত শুধু আঘাত!

কি বল ভাই স্যাঙাত[১৩]?

হুররো হো!

হুররো হো!

দনুজ-দলে দলতে দাদা এমনি দামাল কামাল চাই!

কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

[হাবিলদার-মেজর : রাইট হুইল! লেফট! রাইট! লেফট!

সৈন্যগণ ডানদিকে মোড় ফিরিল!]

আজাদ[১৪] মানুষ বন্দি করে, অধীন করে স্বাধীন দেশ,

কুল মুলুকের[১৫] কুষ্ঠি করে জোর দেখালে ক-দিন বেশ,

মোদের হাতে তুর্কি নাচন নাচলে তাধিন তাধিন শেষ!

হুররো হো!

হুররো হো!

বদ-নসিবের[১৬] বরাত খারাব বরাদ্দ তাই করলে কিনা আল্লায়,

পিশাচগুলো পড়ল এসে পেল্লায় ওই পাগলাদেরই পাল্লায়!

এই পাগলাদেরই পাল্লায়

হুররো হো!

হুররো হো!

ওদের কল্লা[১৭] দেখে আল্লা ডরায়, হল্লা শুধু হল্লা,

ওদের হল্লা শুধু হল্লা,

এক মুর্গির জোর গায়ে নেই, ধরতে আসেন তুর্কি তাজি[১৮],

মর্দ গাজি মোল্লা!–

হাঃ! হাঃ হাঃ!

হেসে নাড়িই ছেঁড়ে বা!

হা হা হাঃ! হাঃ! হাঃ!

[হাবিলদার-মেজর : সাবাস সিপাই! লেফট! রাইট! লেফট!

সাবাস সিপাই। ফের বল ভাই!]

ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,

অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোরসে সামাল সামাল তাই!

কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

[হাবিলদার-মেজর : লেফট হুইল! য়্যাজ য়ু ওয়্যার! – রাইট হুইল! –

লেফট! রাইট! লেফট!

সৈন্যদের আঁখির সামনে অস্ত-রবির আশ্চর্য রঙের খেলা ভাসিয়া উঠিল।]

দেখচ কী দোস্ত অমন করে? হৌ হৌ হৌ!

সত্যি তো ভাই! সন্ধেটা আজ দেখতে যেন সৈনিকেরই বৌ!

শহীদ সেনার টুকটুকে বউ লাল-পিরাহন[১৯]-পরা,

স্বামীর খুনের ছোপ-দেওয়া, তায় ডগডগে আনকোরা! –

না না না, – কলজে যেন টুকরো-করে কাটা

হাজার তরুণ শহিদ বীরের, – শিউরে ওঠে গা-টা!

আশমানের ওই সিংদরজায় টাঙিয়েছে কোন্ কসাই

দেখতে পেলে একখুনি গ্যে এই ছোরাটা কলজেতে তার বসাই!

মুণ্ডুটা তার খসাই!

গোস্বাতে[২০] আর পাই নে ভেবে কী যে করি দশাই!

[হাবিলদার-মেজর : সাবাস সিপাই! লেফট! রাইট! লেফট!

ঢালু পার্বত্য পথ, সৈন্যগণ বুকের পিঠের নিহত সৈন্যদের ধরিয়া সন্তর্পণে নামিল।]

আহা কচি ভাইরা আমার রে!

এমন কাঁচা জানগুলো খান খান করেছে কোন সে চামার রে?

আহা কচি ভাইরা আমার রে!!

[সামনে উপত্যকা। হাবিলদার-মেজর : লেফট ফর্ম।

সৈন্যবাহিনীর মুখ হঠাৎ বামদিকে ফিরিয়া গেল! হাবিলদার-মেজর :ফরওয়ার্ড!

লেফট! রাইট! লেফট!]

আশমানের ঐ আংরাখা[২১]

খুন-খারাবির রং-মাখা,

কী খুবসুরৎ[২২] বাঃ রে বা!

জোর বাজা ভাই কাহার্‌বা!

হোক না ভাই এ কারবালা ময়দান –

আমরা যে গাই সাচ্চারই জয়গান!

হোক না এ তোর কারবালা ময়দান!!

হুররো হো

হুররো হো!!

[সামনে পার্বত্য পথ – হঠাৎ যেন পথ হারাইয়া ফেলিয়াছে। হাবিলদার-মেজর পথ খুঁজিতে লাগিল। হুকুম দিয়া গেল : ‘মার্ক টাইম!’ সৈন্যগণ এক স্থানেই দাঁড়াইয়া পা আছড়াইতে লাগিল, –

দ্রাম! দ্রাম! দ্রাম!

লেফট! রাইট! লেফট!

দ্রাম! দ্রাম! দ্রাম!]

আশমানে ঐ ভাসমান যে মস্ত দুটো রং-এর তাল,

একটা নিবিড় নীল-সিয়া[২৩] আর একটা খুবই গভীর লাল,–

বুঝলে ভাই! ঐ নীল-সিয়াটা শত্রুদের

দেখতে নারে কারুর ভালো,

তাইতে কালো রক্ত-ধারার বইছে শিরায় স্রোত ওদের!

হিংস্র ওরা হিংস্র পশুর দল!

গৃধ্নু ওরা, লুব্ধ ওদের লক্ষ অসুর বল –

হিংস্র ওরা হিংস্র পশুর দল।

জালিম[২৪] ওরা অত্যাচারী!

সার জেনেছে সত্য যাহা হত্যা তারই!

জালিম ওরা অত্যাচারী!

সৈনিকের ওই গৈরিকে ভাই –

জোর অপমান করলে ওরাই,

তাই তো ওদের মুখ কালো আজ, খুন যেন নীল-জল!–

ওরা হিংস্র পশুর দল!

ওরা হিংস্র পশুর দল!

[হাবিলদার-মেজর পথ খুঁজিয়া ফিরিয়া অর্ডার দিল : ফরওয়ার্ড! লেফট হুইল –

সৈন্যগণ আবার চলিতে লাগিল – লেফট! রাইট! লেফট!]

সাচ্চা ছিল সৈন্য যারা শহিদ হল মরে।

তোদের মতন পিঠ ফেরেনি প্রাণটা হাতে করে –

ওরা শহীদ হল মরে।

পিটনি খেয়ে পিঠ যে তোদের ঢিট হয়েছে! কেমন!

পৃষ্ঠে তোদের বর্শা বেঁধা, বীর সে তোরা এমন!

মুর্দারা সব যুদ্ধে আসিস! যা যা!

খুন দেখেছিস বীরের? হাঁ, দেখ টকটকে লাল কেমন গরম তাজা!

মুর্দারা[২৫] সব যা যা!

[বলিয়াই কটি দেশ হইতে ছোরা খুলিয়া হাতের রক্ত লইয়া দেখাইল।]

এঁরাই বলেন হবেন রাজা!

আরে যা যা! উচিত সাজা

তাই দিয়েছে শক্ত ছেলে কামাল ভাই!

[হাবিলদার-মেজর : সাবাস সিপাই!]

এই তো চাই! এই তো চাই!

থাকলে স্বাধীন সবাই আছি, নেই তো নাই, নেই তো নাই!

এই তো চাই!!

[কতকগুলি লোক অশ্রুপূর্ণ নয়নে এই দৃশ্য দেখিবার জন্য ছুটিয়া আসিতেছিল, তাহাদের

দেখিয়া সৈন্যগণ আরও উত্তেজিত হইয়া উঠিল!]

মার দিয়া ভাই মার দিয়া

দুশমন সব হার গিয়া!

কিল্লা ফতে হো গিয়া!

পরওয়া নেহি, যানে দো ভাই যো গিয়া

কিল্লা ফতে হো গিয়া!

হুররো হো!

হুররো হো!

[হাবিলদার-মেজর : সাবাস জোয়ান! লেফট! রাইট!]

জোর সে চলো পা মিলিয়ে,

গা হেলিয়ে,

এমনি করে হাত দুলিয়ে!

দাদরা তালে ‘এক দুই তিন’ পা মিলিয়ে

ঢেউ-এর মতন যাই!

আজ স্বাধীন এ দেশ! আজাদ মোরা বেহেশতও না চাই!

আর বেহেশ্‌তও না চাই!

[হাবিলদার-মেজর : সাবাস সিপাই! ফের বল ভাই!]

ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,

অসুরপুরে শোর উঠেছে জোরসে সামাল সামাল তাই!

কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

[সৈন্যদল এক নগরের পার্শ্ব দিয়া চলিতে লাগিল। নগরবাসিনীরা ঝরকা[২৬] হইতে মুখ বাড়াইয়া এই মহান দৃশ্য দেখিতেছিল; তাহাদের চোখ-মুখ আনন্দাশ্রুতে আপ্লুত। আজ বধূদের মুখের বোরখা খসিয়া পড়িয়াছে। ফুল ছড়াইয়া হাত দুলাইয়া তাহারা বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা করিতেছিল। সৈন্যগণ চিৎকার করিয়া উঠিল!]

ঐ শুনেছিস্? ঝরকাতে সব বলছে ডেকে বউ-দলে –

‘কে বীর তুমি! কে চলেছ চৌদোলে?’

চিনিস নে কি? এমন বোকা বোনগুলি সব? – কামাল এ যে কামাল!

পাগলি মায়ের দামাল ছেলে! ভাই যে তোদের!

তা না হলে কার হবে আর রৌশন[২৭] এমন জামাল[২৮]?

কামাল এ যে কামাল!

উড়িয়ে দেব পুড়িয়ে দেব ঘর-বাড়ি সব সামাল।

ঘর-বাড়ি সব সামাল!!

আজ আমাদের খুন ছুটেছে, হোশ[২৯] টুটেছে,

ডগমগিয়ে জোশ[৩০] উঠেছে!

সামনে থেকে পালাও।

শোহরত[৩১] দাও, নওরাত[৩২]ি আজ! হর ঘরে দীপ জ্বালাও!

সামনে থেকে পালাও!

যাও ঘরে দীপ জ্বালাও!!

[হাবিলদার-মেজর : লেফট ফর্ম! লেফট! রাইট! লেফট! ফরোয়ার্ড!]

[বাহিনীর মুখ হঠাৎ বামদিকে ফিরিয়া গেল। পার্শ্বেই পরিখার সারি। পরিখাভর্তি নিহত সৈন্যের দল পচিতেছে।]

ইস! দেখেছিস! ওই কারা ভাই সামলে চলেন পা,

ফসকে মরা আধ-মরাদের মাড়িয়ে ফেলেন বা!

ও তাই শিউরে ওঠে গা!

হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!

মরল যে সে মরেই গেছে!

বাঁচল যারা রইল বেঁচে

এই তো জানি সোজা হিসাব! দুঃখ কি তার? আঁ:?

মরায় দেখে ডরায় এরা! ভয় কি মরায়! বাঃ

হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!

[সম্মুখে সংকীর্ণ ভগ্ন সেতু! হাবিলদার-মেজর অর্ডার দিল : ‘ফর্ম ইনটু সিঙ্গল লাইন।’ এক একজন করিয়া বুকের পিঠের নিহত ভাইদের চাপিয়া ধরিয়া অতি সন্তর্পণে ‘স্লো মার্চ’ করিয়া পার হইতে লাগিল।]

সত্যি কিন্তু ভাই!

যখন মোদের বক্ষে বাঁধা ভাইগুলির এই মুখের পানে চাই –

কেমন সে এক ব্যথায় তখন প্রাণটা কাঁদে যে সে!

কে যেন দুই বজ্র-হাতে চেপে ধরে কলজেখানা পেষে!

নিজের হাজার ঘায়েল জখম ভুলে তখন ডুকরে কেন কেঁদেও ফেলি শেষে!

কে যেন ভাই কলজেখানা পেষে!!

ঘুমোও পিঠে, ঘুমোও বুকে, ভাইটি আমার, আহা!

বুক যে ভরে হাহাকারে যতই তোরে সাব্বাস দিই,

যতই বলি বাহা!

লক্ষ্মীমণি ভাইটি আমার, আহা!!

ঘুমোও ঘুমোও মরণ-পারের ভাইটি আমার, আহা!!

অস্ত-পারের দেশ পারায়ে বহুৎ সে দূর তোদের ঘরের রাহা,

ঘুমোও এখন ঘুমোও ঘুমোও ভাইটি ছোটো আহা!

মরণ-বধূর লাল রাঙা বর! ঘুমো!

আহা, এমন চাঁদমুখে তোর কেউ দিল না চুমো!

হতভাগা রে!

মরেও যে তুই দিয়ে গেলি বহুৎ দাগা রে

না জানি কোন্ ফুটতে-চাওয়া মানুষ-কুঁড়ির হিয়ায়!

তরুণ জীবন এমনি গেল, একটি রাতও পেলিনে রে বুকে কোনো প্রিয়ায়!

অরুণ খুনের তরুণ শহিদ! হতভাগা রে!

মরেও যে তুই দিয়ে গেলি বহুৎ দাগা রে!

তাই যত আজ লিখনেওয়ালা তোদের মরণ স্ফূর্তি-সে জোর লেখে

এক লাইনে দশ হাজারে মৃত্যু-কথা! হাসি রকম দেখে,

মরলে কুকুর ওদের, ওরা শহিদ-গাথার বই লেখে!

খবর বেরোয় দৈনিকে,

আর একটি কথায় দুঃখ জানান, ‘জোর মরেছে দশটা হাজার সৈনিকে!’

আঁখির পাতা ভিজল কিনা কোনো কালো চোখের

জানল না হায় এ জীবনে ওই সে তরুণ দশটি হাজার লোকের!

পচে মরিস পরিখাতে, মা-বোনেরাও শুনে বলে ‘বাহা’!

সৈনিকেরই সত্যিকারের ব্যথার ব্যথী কেউ কি রে নেই? আহা! –

আয় ভাই তোর বউ এল ওই সন্ধ্যা মেয়ে রক্তচেলি পরে,

আঁধার-শাড়ি পরবে এখন পশবে যে তোর গোরের[৩৩] বাসর-ঘরে! –

ভাবতে নারি, গোরের মাটি করবে মাটি এ মুখ কেমন করে –

সোনা মানিক ভাইটি আমার ওরে!

বিদায়-বেলায় আরেকটি বার দিয়ে যা ভাই চুমো!

অনাদরের ভাইটি আমার! মাটির মায়ের কোলে এবার ঘুমো!

[সেতু পার হইয়া আবার জোরে মার্চ করিতে করিতে তাহাদের রক্ত গরম হইয়া উঠিল।]

ঠিক বলেছ দোস্ত তুমি!

চোস্ত কথা! আয় দেখি তোর হস্ত চুমি!

মৃত্যু এরা জয় করেছে, কান্না কিসের?

আব্-জম্-জম্[৩৪] আনলে এরা, আপনি পিয়ে কলশি বিষের!

কে মরেছে? কান্না কিসের?

বেশ করেছে!

দেশ বাঁচাতে আপনারই জান শেষ করেছে!

বেশ করেছে!!

শহিদ ওরাই শহিদ!

বীরের মতন প্রাণ দিয়েছে, খুন ওদেরই লোহিত!

শহীদ ওরাই শহীদ!!

[এইবার তাহাদের তাম্বু দেখা গেল। মহাবীর আনোয়ার পাশা বহু সৈন্য-সামন্ত ও সৈনিকের আত্মীয়স্বজন লইয়া বিজয়ী বীরদের অভ্যর্থনা করিতে আসিতেছেন দেখিয়া সৈন্যগণ আনন্দে আত্মহারা হইয়া ডবল মার্চ করিতে লাগিল।]

হুররো হো!

হুররো হো!

ভাই-বেরাদর[৩৫] পালাও এখন দূর রহো! দূর রহো!

হুররো হো! হুররো হো!

[কামাল পাশাকে কোলে লইয়া নাচিতে লাগিল।]

হৌ হো হো! কামাল জিতা রও[৩৬]!

কামাল জিতা রও!

ও কে আসে! আনোয়ার ভাই? –

আনোয়ার ভাই! জানোয়ার সব সাফ!

জোর নাচো ভাই! হর্দম দাও লাফ

আজ জানোয়ার সব সাফ

হুররো হো! হুররো হো!!

সব-কুছ আব্[৩৭] দূর রহো! – হুররো হো!! হুররো হো!

রণ জিতে জোর মন মেতেছে! – সালাম সবায় সালাম! –

নাচনা থামা রে!

জখমি-ঘায়েল[৩৮] ভাইকে আগে আস্তে নামা রে!

নাচনা থামা রে!

কে ভাই? হাঁ, হাঁ, সালাম।

– ওই শোন শোন সিপাহ-সালার[৩৯] কামাল ভাই-এর কালাম[৪০]!

[সেনাপতির অর্ডার আসিল,

‘সাবাস! থামো! হো! হো!

সাবাস! হল্ট! এক! দো!!’]

এক নিমেষে সমস্ত কলরোল নিস্তব্ধ হইয়া গেল। তখনও কিন্তু তারায় তারায় যেন ওই বিজয়গীতির হারা-সুর বাজিয়া বাজিয়া ক্রমে ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া মিশিয়া গেল।

ওই খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,

অসুরপুরে শোর উঠেছে জোরসে সামাল সামাল তাই।

কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. মহা-আহব — মহাসমর; যুদ্ধ।
  2. তু নে — তুমি।
  3. কামাল কিয়া — অভাবনীয় কাণ্ড করলে! [কামাল মানে ‘পূর্ণ’]
  4. শমশেরে — তরবারিকে।
  5. বুজদিল — ভীরু, কাপুরুষ।
  6. বিলকুল সাফ হো গিয়া — একদম পরিষ্কার হয়ে গেছে।
  7. খুব কিয়া — আচ্ছা করেছ।
  8. পাঁও-তক্ — পা পর্যন্ত।
  9. হৃৎপিণ্ড, কলিজা।
  10. নেস্ত-নাবুদ — ধ্বংস-বিধ্বংস।
  11. জের — পরাভূত।
  12. মুলুক — রাজ্য।
  13. স্যাঙাত — বন্ধু, সহচর।
  14. আজাদ — মুক্ত; স্বাধীন।
  15. কুল মুলুক — সমস্ত দেশটা।
  16. বদ্-নসিব — দুর্ভাগ্য।
  17. কল্লা — মুণ্ড, মাথা।
  18. তাজি — যুদ্ধাশ্ব। স্বাস্থ্যবান ঘোড়া।
  19. পিরাহান — পিরান।
  20. গোস্বা — ক্রোধ।
  21. আংরাখা — ঢিলা জামা।
  22. খুবসুরৎ — সুন্দর।
  23. সিয়া — কৃষ্ণবর্ণ।
  24. জালিম — উৎপীড়ক।
  25. মুর্দা — মৃত।
  26. ঝরকা — জানালা।
  27. রৌশন — রওশন, উজ্জ্বল।
  28. জামাল — রূপ।
  29. হোশ — হুঁশ, কাণ্ডজ্ঞান।
  30. জোশ — উত্তেজনা।
  31. শোহরত — ঘোষণা।
  32. নওরাতি — উৎসব-রাত্রি।
  33. গোর — কবর, সমাধি।
  34. আব্-জম্-জম্ — মন্দাকিনী সুধা; মক্কাস্থ জম্‌জম নামক পবিত্র কূপের জল।
  35. ভাই-বেরাদর — আত্মীয়-স্বজন।
  36. জিতা রও — বেঁচে থাক।
  37. আব্ — এখন।
  38. জখমি-ঘায়েল — আহত।
  39. সিপাহ-সালার — প্রধান সেনাপতি।
  40. কালাম — হুকুম।