অগ্নিবীণা
গ্রন্থপরিচয়[১]

অগ্নিবীণা
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিকল্পিত ও চিত্রশিল্পী বীরেশ্বর সেন অঙ্কিত ১৯২২ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত অগ্নিবীণা কাব্যের প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ।

‘অগ্নিবীণা’ বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এটি ১৯২২ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মুতাবিক ১৩২৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশক : গ্রন্থাকার, ৭ প্রতাপ চাটুজ্যে লেন, কলিকাতা; প্রকাশকরূপে অনেক ক্ষেত্রে উল্লিখিত হয়েছেন শরচ্চন্দ্র গুহ, আর্য পাবলিশিং হাউস, কলেজ স্ট্রিট মার্কেট (দোতলা), কলিকাতা। পৃ. ২ + ৬৬; মূল্য এক টাকা। গ্রন্থটি ছাপা হয় মেটকাফ প্রেস, ৭৯ নং বলরাম দে স্ট্রিট, কলিকাতা থেকে। ‘অগ্নি-বীণা’ প্রচ্ছদপটের পরিকল্পনা ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং এঁকেছিলেন তরুণ চিত্রশিল্পী বীরেশ্বর সেন। এই কাব্যে মোট বারোটি কবিতা আছে। কবিতাগুলি হচ্ছে— ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘বিদ্রোহী’, ‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা’, ‘আগমণী’, ‘ধূমকেতু’, কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার ‘রণভেরী’, ‘শাত-ইল-আরব’, খেয়াপারের তরণী’, কোরবানী’ ও মোহররম’। এছাড়া গ্রন্থটির শুরুতে বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ-কে উৎসর্গ করে লেখা একটি উৎসর্গ কবিতাও আছে।

গ্রন্থটির উৎসর্গ হচ্ছে- “বাঙলার অগ্নিযুগের আদি পুরোহিত সাগ্নিক বীর শ্রীবারীন্দ্রকুমার ঘোষ শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু”। নিচে লেখা আছে “তোমার অগ্নি-পূজারী -হে- মহিমাম্বিত শিষ্য — কাজী নজরুল ইসলাম”। অরবিন্দ ঘোষের ভ্রাতা বারীন্দ্রকুমার ঘোষ বাংলা তথা ভারতের বিপ্লববাদী আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ছিলেন। বিপ্লবে বিশ্বাসী নজরুল তাই নিজেকে বারীন্দ্রকুমারের ‘—হে-মহিমান্বিত শিষ্য’ বলে উল্লেখ করে তাকেই তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন।

অগ্নিবীণার দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৩০ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে, তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণে এবং চতুর্থ সংস্করণ ১৩৩৪(?) বঙ্গাব্দের শ্রাবণে। কবির সুস্থাবস্থায় প্রকাশিত অগ্নিবীণার যে-কটি সংস্করণ এখনও সংরক্ষিত আছে তার মধ্যে চতুর্থ সংস্করণই সর্বশেষ; অগ্নিবীণার এই সংস্করণটি সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের গ্রন্থাকারে রক্ষিত আছে। এর প্রকাশক ছিলেন ডি. এম. লাইব্রেরির পক্ষে গোপালদাস মজুমদার, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪ + ৫৮; মূল্য পাঁচ সিকা, মুদ্রণ সংখ্যা ২২০০। বাঙলা একাডেমি প্রকাশিত ‘নজরুল রচনাবলী’ জন্মশতবর্ষ সংস্করণে ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যের তৃতীয় মুদ্রণ অনুসরণ করা হয়েছে। এই সংস্করণটির প্রকাশক মঈনউদ্‌দীন হোসায়ন বি. এ., নূর লাইব্রেরি, ১০ সারেঙ্গ লেন, তালতলা, কলিকাতা; বাসন্তি প্রেস, ৭১ নং নেবুতলা লেন, কলিকা, এন মুখার্জী কর্তৃক মুদ্রিত।

‘উৎসর্গ’ গানটি ‘অগ্নি-ঋষি’ শিরোনামে ১৩২৮ বঙ্গাব্দের শ্রাবণের ‘উপাসনা’য় প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনামের নীচে লেখা ছিল : “তিলক-কামোদ-ঝাঁপতাল”। “সুরের ব্যথায় প্রাণ উদাসী” চরণের “প্রাণ” স্থানে ‘উপাসনা’য় ছাপা হয়েছিল “জান্”। ‘উৎসর্গ’ গানটিতে শ্রীবারীন্দ্রকুমার ঘোষের ‘দ্বীপান্তরের বাঁশী’ নামক আন্দামানে অবস্থান-কালে লেখা বইখানির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। বারীন্দ্রকুমারের ‘দ্বীপান্তরের বাঁশী’ সম্বন্ধে ১৩২৭ বঙ্গাব্দের শ্রাবণের ‘প্রবাসী’তে বলা হয়, “কৃষ্ণের বাঁশীর রূপক বেশ সুসঙ্গত হয় নাই।”

‘প্রলয়োল্লাস’, ১৩২৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠের ‘প্রবাসী’তে প্রকাশিত হয়েছিল এবং ‘প্রবাসী’ হতে ১৩২৯ বঙ্গাব্দের আষাঢ়ের ‘নারায়ণ’-এ সঙ্কলিত হয়েছিল। ‘অগ্নিবীণা’র প্রথম সংস্করণের বিভিন্ন কবিতার কয়েকটি শব্দের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় চতুর্থ সংস্করণে। ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় “এই তো রে তার আসার সময় ঐ রথ-ঘর্ঘর” চরণটির পরে একটি অতিরিক্ত চরণ পাওয়া যায় : “শোনা যায় ঐ রথ-ঘর্ঘর”।

‘নজরুল-গীতিকা’য় অন্তর্ভুক্ত এই গীতি-কবিতাটির ষষ্ঠ স্তবকের শেষাংশের পাঠ নিম্নরূপ—

এই তো রে তাঁর আসার সময় ঐ রথ-ঘর্ঘর—

শোনা যায় ঐ রথ-ঘর্ঘর!

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!

এবং সপ্তম স্তবকের পরে আছে এরূপ—

তাই সে এমন কেশে বেশে

প্রলয় ব’য়েও আসছে হেসে—

মধুর হেসে!

ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির-সুন্দর!

‘বিদ্রোহী’ ১৩২৮ বঙ্গাব্দের কার্তিকে দ্বিতীয় বর্ষের তৃতীয় সংখ্যক ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় বের হয়েছিল। ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ২২শে পৌষের সাপ্তাহিক ‘বিজলী’তে এবং ১৩২৮ বঙ্গাব্দের মাঘের ‘প্রবাসী’তে এটি সঙ্কলিত হয়েছিল। ‘মোসলেম ভারতে’ প্রকাশিত ‘বিদ্রোহী’র ৯১—৯৪ সংখ্যক চরণগুলি ছিল নিম্নরূপ—

ছুটি      ঝড়ের মতন করতালি দিয়া

     হাসি হা-হা হা-হা হি-হি হি-হি,

তাজি      বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার

হাঁকে      চিঁ-হিঁ হিঁ হিঁ চিঁ-হিঁ হিঁ-হিঁ।

‘মোসলেম ভারতে’ প্রকাশিত ‘বিদ্রোহী’তে “আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার” পঙ্‌ক্তির পূর্বে ছিল এই পাঁচটি পঙ্‌ক্তি—

আমি      উত্তাল, আমি তুঙ্গ, ভয়াল, মহাকাল,

আমি      বিবসন, আজ ধরাতল নভ ছেয়েছে আমারি জটাজাল।

আমি ধন্য! আমি ধন্য!!

আমি      মুক্ত, আমি সত্য, আমি বীর, বিদ্রোহী সৈন্য!

আমি ধন্য! আমি ধন্য!!

১৩৩০ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে কলিকাতার আর্য পাবলিশিং হাউস হতে প্রকাশিত ‘অগ্নিবীণা’র দ্বিতীয় সংস্করণেও এই পাঁচটি পঙ্‌ক্তি ছিল; কিন্তু পরবর্তীকালে এই পঙ্‌ক্তিগুলি পরিত্যক্ত হয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ পাঠে কবি গোলাম মোস্তফা ১৩২৮ বঙ্গাব্দের মাঘের ‘সওগাতে’ লেখেন ‘নিয়ন্ত্রিত’। ১৩২৯ বঙ্গাব্দের বৈশাখে ‘সাধনা’য় ‘বিদ্রোহী’ ও ‘নিয়ন্ত্রিত’ পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল।

‘অগ্নিবীণা’র চতুর্থ সংস্করণে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার পাতাগুলো ছেঁড়া থাকায় ‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থের পঞ্চম সংস্করণ (কলিকাতা, ভাদ্র ১৩৫২) সঙ্কলিত ‘বিদ্রোহী’র পাঠ অনুসৃত হয়েছে। “আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস”—এই চরণের আগে প্রথম সংস্করণে দুটি চরণ ছিল:

আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশে ম্লান গৈরিক।

এই চরণদুটি ‘সঞ্চিতা’র অন্তর্ভুক্ত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বর্জিত, ‘অগ্নি-বীণা’র দ্বাদশ সংস্করণেও (কলিকাতা, অগ্রহায়ণ ১৩৫৫) নেই।

‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ৫ই ভাদ্র তারিখে প্রথম বর্ষের চতুর্থ সংখ্যক ‘ধূমকেতু’তে প্রকাশিত হয়েছিল।

‘আগমনী’ ১৩২৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিনের ‘উপাসনা’য় প্রকাশিত হয়েছিল। এ সম্পর্কে ‘উপাসনা’ সম্পাদক শ্রীসাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন—

“নজরুলের এক বিশিষ্ট দিকের কবিতা ‘শাতিল আরব’ যখন ‘মোসলেম ভারতে’ প্রকাশ হয়, প্রায় ঠিক সেই সময়ে হিন্দুর দেব-দেবী নিয়ে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘উপাসনা’য়—

এ কি রণ-বাজা বাজে ঝনঝন।”

— কবিতা, কার্তিক-পৌষ, ১৩৫১।

‘আগমনী’ ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ৯ই আশ্বিন তারিখের ‘ধূমকেতু’তে পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল।

‘ধূমকেতু’ শীর্ষক কবিতাটি ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৬শে শ্রাবণ মুতাবিক ১৯২২ খৃষ্টাব্দের ১১ই আগষ্ট শুক্রবার প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যক অর্ধ-সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ [সারথী ও স্বত্ত্বাধিকারী : কাজী নজরুল ইসলাম] পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

‘কামাল পাশা’ ১৩২৮ বঙ্গাব্দের কার্তিকের ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় বের হয়েছিল। ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৬শে ভাদ্র তারিখের ‘ধূমকেতু’তে কবিতাটির কিয়দংশ সঙ্কলিত হয়েছিল।

‘শাত্-ইল্-আরব’ ছাপা হয়েছিল ১৩২৭ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠের ‘মোসলেম ভারতে’। সে সংখ্যার Fontispiece-রূপে শোভিত হয়েছিল ‘শাতিল-আরবে’র চিত্র; তার নীচে ক্যাপশনরূপে ছাপা হয়েছিল কবিতাটির প্রথম দুই চরণ। ‘একজন সৈনিক’ লেখেন এই ‘চিত্র পরিচয়’—

“টাইগ্রীস (দিজ্‌লা) আর ইউফ্রেটিস (ফোরাত) বসরার অদূরে একজোট হয়ে ‘সাতিল আরব’ নাম নিয়েছে। তার পর, বসরার পাশ দিয়ে বয়ে পারস্য-উপসাগরে গিয়ে পড়েছে। এর তীরে দু’ তিন মাইল করে চওড়া খর্জুর-কুঞ্জ; তাতে ছোট্ট নহর, তারই কূলে আঙুরলতার বিতান, বেদানা-নাশপাতির কেয়ারী। এখানে এলেই অনেক পুরানো স্মৃতি জেগে ওঠে আর আপনিই গাইতে ইচ্ছা করে—

সাতিল্-আবর! সাতিল্-আরব! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।

শহীদের লোহু দিলীরের খুন ঢেলেছে যেখানে আরব-বীর।”

‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশকালে এবং প্রথম সংস্করণে ‘সাত-ইল-আরব’ কবিতার শিরোনামে ও পাঠে সাত-ইল-আরব বা সাতিল আবর মুদ্রিত হয় দন্ত্য স দিয়ে। চুতুর্থ সংস্করণে সেখানে তালব্য শ ব্যবহৃত হয়েছে : শাত-ইল-আরব বা শাতিল আরব।

‘খেয়া-পারের তরণী’ ছাপা হয়েছিল ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ‘মোসলেম ভারতে’। সে সংখ্যার গোড়ায় শোভিত হয়েছির একখানি চিত্র। তার ক্যাপশনরূপে ছাপা হয়েছিল:

“বৃথা ত্রাসে প্রলয়ের সিন্ধু ও দেয়া-ভার,

ঐ হলো পুণ্যের যাত্রীরা খেয়া-পার।”

‘চিত্র-পরিচয়’ প্রদান প্রসঙ্গে বলা হয়—

“চিত্রশিল্পী নওয়াবজাদী মেহেরবানু খানম সাহেবা ঢাকার পরলোকগত স্যার নওয়াব আহ্‌সানউল্লাহ্ বাহাদুরের কন্যা এবং স্যার নওয়াব সলিমুল্লাহ বাহাদুরের ভগিনী। ইহার স্বামী খানবাহাদুর খাজা আজম সাহেবও বঙ্গে সুপরিচিত।”

‘খেয়াপারের তরণী’ প্রসঙ্গে মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ প্রদত্ত নিম্নলিখিত তথ্য উদ্ধৃতিযোগ্য:

কি কারণে জানিনা, আফ্‌জালুল হক সাহেব ঢাকা গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর “মোসলেম ভারতে” ছাপানোর উদ্দেশ্যে ঢাকার বেগম মুহম্মদ আজম সাহেবার (খান বাহাদুর মুহম্মদ আজমের স্ত্রী) আঁকা একখানা নৌকার ছবি সঙ্গে নিয়ে আসেন। পত্রিকায় ছাপানোর আগে ছবিখানার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিখিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। তার জন্যে ছবিখানা একদিন বিকালবেলা নজরুল ইসলামের নিকটে আফ্‌জালুল হক সাহেব রেখে গেলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে, নজরুল ইসলাম গদ্যে এই আধ্যাত্মিক ছবিখানার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিখে দিবে। কিন্তু নজরুল তা করল না। সে রাত্রিবেলা প্রথমে মনোযোগ সহকারে ছবিখানা অধ্যয়ন করল এবং তারপরে লিখল এই ছবির বিষয়ে তার বিখ্যাত কবিতা “খেয়াপারের তরণী”।

—কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা, দ্বিতীয় বাংলাদেশ সংস্করণ, ঢাকা ১৯৭৬, পৃষ্ঠা ৫৩-৫৪।

‘খেয়া-পারের তরণী’ সম্বন্ধে ১৩২৭ ভাদ্রের ‘মোসলেম ভারতে’ কবি মোহিতলাল মজুমদার ‘একখানি পত্রে’ লেখেন—

… “খেয়া-পারের তরণী” শীর্ষক কবিতায় ছন্দ সর্বত্র মূলত এক হইলেও মাত্রাবিন্যাস ও যতির বৈচিত্র্য প্রত্যেক শ্লোকে ভাবানুযায়ী সুর সৃষ্টি করিয়াছে; ছন্দকে রক্ষা করিয়া তাহার মধ্যে এই যে একটি অবলীলা, স্বাধীন স্ফুর্তি, অবাধ আবেগ, কবি কোথাও তাহাকে হারাইয়া বসেন নাই; ছন্দ যেন ভাবের দাসত্ব করিতেছে—কোনখানে আপন অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে নাই—এই প্রকৃত কবি-শক্তিই পাঠককে মুগ্ধ করে। কবিতাটি আবৃত্তি করিলেই বোঝা যায় যে, শব্দ ও অর্থগত ভাবের সুর কোনখানে ছন্দের বাঁধনে ব্যাহত হয় নাই। বিস্ময়, ভয়, ভক্তি, সাহস, অটল বিশ্বাস এবং সর্বোপরি প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত একটা ভীষণ-গম্ভীর অতিপ্রাকৃত কল্পনার সুর, শব্দবিন্যাস ও ছন্দঝঙ্কারে মূর্তি ধরিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। আমি কেবল একটি মাত্র শ্লোক উদ্ধৃত করিব,—

‘আবুবকর উস্‌মান উমর আলী-হাইদর

দাঁড়ী যে এই তরণীর, নাই ওরে নাই ডর!

কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা,

দাঁড়ী-মুখে সারি-গান—‘লা-শরীক আল্লাহ্!’

এই শ্লোকে মিল, ভাবানুযায়ী শব্দবিন্যাস এবং গভীর গম্ভীর ধ্বনি আকাশে ঘনায়মান মেঘপুঞ্জের প্রলয়-ডম্বরু-ধ্বনিকে পরাভূত করিয়াছে; বিশেষ ঐ শেষ ছত্রের শেষ বাক্য ‘লা-শরীক আল্লাহ্’—যেমন মিল, তেমনি আশ্চর্য প্রয়োগ। ছন্দের অধীন হইয়া এবং চমৎকার মিলের সৃষ্টি করিয়া এই আরবী বাক্য-যোজনা বাঙ্‌লা কবিতায় কি অভিনব-ধ্বনি-গাম্ভীর্য লাভ করিয়াছে।”

‘কোরবানী’ ছাপা হয়েছিল ১৩২৭ ভাদ্রের ‘মোসলেম ভারতে’। এ কবিতাটি সম্পর্কে অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খান লিখিয়াছেন:

“তরীকুল আলম ব’লে একজন ডেপুটি-ম্যাজিস্ট্রেট ‘কোরবানী’কে বর্বর-যুগের চিহ্ন ব’লে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এ প্রবন্ধ প’ড়ে নজরুল ইসলামের কলম গর্জে উঠল। নব্য তুর্কীরা তখন স্বাধীনতার জন্য অকাতরে জান কোরবান করছিল। সেই ব্যাপারের সাথে মিলিয়ে তিনি লিখলেন:

ওরে হত্যা নয়, আজ সত্যাগ্রহ, শক্তির উদ্বোধন!”

১৩২৭ শ্রাবণের ‘সবুজপত্রে’ তরিকুল আলম ‘আজ ঈদ’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন:

“… আজ এই আনন্দ-উৎসবে আনন্দের চেয়ে বিষাদের ভাগই মনের উপর চাপ দিচ্ছে বেশী ক’রে। যেদিকে তাকাচ্ছি, সেই দিকে কেবল নিষ্ঠুরতার অভিনয়। অতীত এবং বর্তমানের ইতিহাস চোখের সামনে অগণিত জীবের রক্তে ভিজে লাল হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই লাল রঙ্ আকাশে-বাতাসে চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে—যেন সমস্ত প্রকৃতি তার রক্তনেত্রের ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে পৃথিবী বিভীষিকা ক’রে তুলেছে। প্রাণ একেবারে হাঁপিয়ে উঠছে।”

‘কোরবানী’ কবিতার ছন্দ সম্পর্কে শ্রীমোহিতলাল মজুমদার লিখেছেন:

“শুধু ঘন ঘুন যুক্তাক্ষর-বিন্যাসই নয়—পর্বান্ত হসন্তবর্ণ যতদূর সম্ভব বর্জন করিতে পারিলে, স্বর-প্রসারণের কোন অবকাশ আর থাকে না বলিয়া, এই বাংলা ছন্দেও প্রবল আঘাতমূলক ছন্দস্পন্দের সৃষ্টি করা যায়, যথা—

ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন

ইহা পড়িবে এইরূপ—

ওরে র্হত্যা-র্নয়াজ ০ র্সত্যার্গ্রহ ০ শক্তি-র্রুদ্ধো ০ র্ধন

ইহার কোনখানে স্বর-প্রসারণের অবকাশ মাত্র নাই।”

— বাংলা কবিতার ছন্দ, ২৮-২৯ পৃষ্ঠা।

‘মোহর্‌রম’ ছাপা হয়েছিল ১৩২৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিনের ‘মোসলেম ভারতে’। সে সংখ্যার গোড়ায় ছিল একটি ছবি; তার উপরে লেখা ছিল ‘কারবালা-প্রান্তরে ইমাম হোসেনের সমাধি’। ছবিটির নীচে লেখা ছিল:

“মোহর্‌রম! কারবালা! কাঁদো ‘হায় হোসেনা!’

দেখো মরু-সূর্যে এ খুন যেন শোষে না!!”

‘মোসলেম ভারতে’ প্রকাশিত ‘মোহর্‌রম’ কবিতাটির শেষে ছিল এই শ্লোকটি—

দুনিয়াতে খুনিয়ারা দুর্মদ ইসলাম,

লোহু লাও, নাহি চাই নিষ্কাম বিশ্রাম।

কিন্তু গ্রন্থবদ্ধ হওয়ার সময় এই অগ্নিক্ষরা শ্লোকটি বর্জিত হয়েছিল। ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ১৬ই ভাদ্র তারিখের বিশেষ মোহর্‌রম সংখ্যা ‘ধূমকেতু’তে কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘নজরুল রচনাবলী’ জন্মশতবর্ষ সংস্করণে প্রদত্ত গ্রন্থপরিচয় ও অন্যান্য তথ্যসূত্রের আলোকে লিখিত।