দু’টি আবেদন
এক[১]

ভারতের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি-আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেসই ছিল এতাবৎ একমাত্র রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ইহার শক্তি ছিল ক্ষুদ্র, উদ্যম ছিল অকিঞ্চিৎকর, পরিসর ছিল সঙ্কীর্ণ, এবং জীবন ছিল নৈরাশ্যপীড়িত, দেশের যৌবনশক্তি না যতদিন ইহাতে যোগ দিয়াছিল। ইহা যে অত্যুক্তি নয় একটু চিন্তা করিয়া দেখিলেই তাহা দেখা যাইবে।

কংগ্রেসকে শক্তিশালী করিয়াছে দেশের যৌবন, তথাপি সেই কংগ্রেসের কাটা-ছাঁটা, ধরা-বাঁধা মুষ্টিভিক্ষায় যৌবনের ক্ষুধা মিটিল না; তাই যুব-সমিতির সৃষ্টি। এই তো সেদিনের কথা,—জন্মের তারিখ গণনায় ইহার হিসাব মিলিবে না, কিন্তু যে মুহূর্তে সে নিঃসংশয়ে অনুভব করিয়াছে তাহার বাধা নাই, বিনাশ নাই, সে অপরাজেয় এবং তাহার ‘পরেই এ দুর্ভাগা দেশের সব চেয়ে বড় দাবী, সেই দিন হইতেই এই সমিতির বিস্তৃতির আর বিরাম নাই। সঙ্ঘ-শক্তির অপরিমেয় বিকাশে আজ এই প্রতিষ্ঠান অগ্নিকাণ্ডের ন্যায় ভারতের সর্বত্র ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে।

স্বদেশের মুক্তি-সংগ্রামে বাঙ্গলার স্থান যে কোথায় এ কথা নিজে বাঙ্গালী হইয়া উচ্চারণ করিলে আমার অবিনয়ের অপরাধ স্পর্শিবে। কিন্তু এই বঙ্গদেশের মাঝখানে হাওড়া জেলার নাম সসম্ভ্রমে উল্লেখ করিতে আর কোন সঙ্কোচ নাই। ইহার বিগত ইতিহাস যাঁহারা জানেন তাঁহারাই এ কথার সত্যতা বুঝিবেন।

অন্যান্য স্থানের ন্যায় হাওড়ার যুব-সমিতির সম্মিলনও আসন্নপ্রায়। ইহার অনেক কাজ রহিয়াছে। তাই সর্বসাধারণের কাছে, বিশেষ করিয়া দেশের তরুণসম্প্রদায়ের কাছে আমার একান্ত নিবেদন, তাঁহারা যেন একযোগে এই সম্মিলনীকে সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত করিতে অবহেলা না করেন। আপনাদের পক্ষ হইতে আমি বঙ্গদেশের সকল জেলার সকল কর্মীকেই আমন্ত্রণ করিব এবং নিঃসন্দেহে জানি আমার আহ্বান তাঁহারা কেহই উপেক্ষা করিতে পারিবেন না।

যৌবনে নিজের আর আমার দাবী-দাওয়া নাই, সামর্থ্যও নিঃশেষিতপ্রায়, তথাপি ইহার উদ্বোধনের ভার যুবকেরা স্নেহবশতঃ আমার হস্তেই ন্যস্ত করিয়াছেন। যথাশক্তি কর্তব্য সমাপন করিব প্রতিশ্রুত হইয়াছি।

এখানে এই ব্যাপারে আর একটা কথা সকলকে জানানোর প্রয়োজন অনুভব করিতেছি। যুব-সমিতির সম্মিলনের আয়োজনের প্রারম্ভেই জন-কয়েক বিশিষ্ট কর্মী-যুবক ব্যক্তিগত মতবিরোধের জন্য বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছেন। প্রথমে, উভয় পক্ষই আমাকে মীমাংসা করিয়া দিতে আহ্বান করিয়াছিলেন, কিন্তু এক পক্ষের আহ্বানে বোধ করি আন্তরিকতা ছিল না।

আমার প্রতি অশ্রদ্ধাবশতঃ আমার নির্ধারণ তাঁহারা গ্রহণ করিতে পারিলেন না, ‘কর্মী-সম্মিলনী’ নাম দিয়া তাঁহারা স্বতন্ত্র আয়োজনে ব্যাপৃত।

এইভাবে যুব-শক্তি খণ্ডিত বিক্ষিপ্ত হওয়া যত বড় বেদনার বস্তুই হোক, যাহা হইল না তাহা লইয়া ক্ষোভ করা নিষ্ফল। বোধ করি, ইহাই এ দেশের সনাতন-রীতি। যাই হোক, তাঁহাদের অধিকাংশই আমার সুপরিচিত, কর্মনৈপুণ্যে, নিষ্ঠায়, দেশের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও অনুরাগে তাঁহারা কাহারও অপেক্ষা ন্যূন নহেন। সেও দেশেরই কাজ, দেশের মুক্তি তাঁহাদেরও সাধনার সামগ্রী। প্রার্থনা করি, সে অনুষ্ঠানও যেন জয়যুক্ত হয়, ইতি—৪ঠা শ্রাবণ ১৩৩৬।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. বঙ্গবাণী, ২৪ জুলাই ১৯২৯।